Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি: সুফিবাদ এবং হৃদয়ের ভাষার এক মহাগুরু

আমি জেনেছি প্রত্যেক নশ্বর সৃষ্টিই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে, তবে এ-ও জেনেছি যে, কেবল গুটিকয়েকই জীবনের আস্বাদ গ্রহণ করবে।

সুফিবাদ বা তাসাউফের গভীরতা ব্যাপক, আর এসব গভীরতার এক বিশ্বস্ত নাম মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি, যিনি রুমি নামেই সারাবিশ্বে পরিচিত। ইসলামের শুরুর দিকেই সুফিবাদের জন্ম হয়, তবে আধুনিক সুফিবাদের সাথে মূল সুফিবাদের দ্বন্দ্বও স্পষ্ট! মূল সুফিবাদের জন্ম হয় সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের নতুন ধারা হিসেবে, যে ধারা ইসলামের সকল ফরয আইন মেনে তার সাথে নিজেদের ধ্যান ধারণা নিয়ে এগিয়ে যায়। সুফিবাদ আসলে সরাসরি মানুষের পরিশুদ্ধার সাথে  জড়িত,আত্ম-সম্পর্কীয় আলোচনা যার মুখ্য বিষয়। খুব সহজভাবে বলতে গেলে সুফিবাদের মূল কাজ হচ্ছেআপন নফসের সঙ্গে, নিজ প্রাণের সাথে, নিজের জীবাত্মার সাথে, শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে এ জড়জগত থেকে মুক্তি পাওয়া।

সুফিবাদের আলোচনায় যে নামটি অবশ্যই উচ্চারিত হবে সেটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির, যিনি ইংরেজি ভাষাভাষীদের কাছে রুমি নামেই বেশি পরিচিত। কারো কাছে আবার তিনি মাওলানা রুমি, তবে সর্বোপরি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি হিসেবেই সুপরিচিত।

তার জন্মস্থান বালখ, যা বর্তমানে আফগানিস্তান। শৈশব থেকেই তার সুযোগ হয়েছিল জ্ঞান আর জ্ঞানীদের সাথে মিলেমিশে বড় হওয়ার, যার স্পষ্ট ছাপ পাওয়া তার প্রতিটি কথায়। মাওলানা রুমির জ্ঞানসাধনা আর তার জীবন বুঝতে গেলে আসলে তার পরিবার নিয়ে আলাপ-আলোচনা জরুরি হয়ে পড়ে। এতে করে তার শিকড়ের খোঁজটাও পাওয়া যাবে।

Image Source: thequint.com

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির পারিবারিক জীবনী

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি জন্মগ্রহণ করেন ১২০৭ সালে বালখে। তার বাবা বাহা উদ্দিন একজন সুপরিচিত আলেম। সেই সাথে তিনি বালখের একজন ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনজ্ঞও ছিলেন। রুমির অনুসারীদের কাছে তিনি ‘সুলতান আল-উলামা’ নামেই পরিচিত।

বাবার হাত ধরেই শৈশবে ধর্মীয় জ্ঞানের পথে পা বাড়ান মাওলানা রুমি। তার চিন্তা-চেতনার মূল স্রোতের শুরু আসলে সেখান থেকেই। পরিচিত আলেম সমাজের সাথে চলাফেরা, পড়াশোনার পাশাপাশি বহু মানুষের সাথে আলাপ-আলোচনাও তার চিন্তার গভীরতার জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।

অপরদিকে মাওলানা রুমির মা মুইমিনা খাতুনের পরিবার ছিল সেসময়ে বেশ সম্মানিত। তার পরিবার বহু যুগ ধরেই ইসলামের হানাফি মাযহাবের প্রচারকের ভূমিকায় কাজ করে যাচ্ছিল, যা পরে মাওলানা রুমিও জারি রাখেন।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির জীবনে চিন্তা ভাবনার গভীরতার প্রবেশ

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির শৈশবের ঘটনা খুব একটা জানা যায় না, তবে বেশ কিছু ঘটনায় এটা স্পষ্ট হয় যে তিনি শৈশব থেকেই আলাদা। তার যে উক্তি ও কবিতাগুলো আমাদের হৃদয় নাড়িয়ে দেয়, তা তো আসলে কয়েকদিনে হুট করে সৃষ্টি হওয়ার কথা না। এমন গভীরতার জন্য চাই বহু দিন-রাত্রির সাধনা! শৈশবেই তিনি ছিলেন নিজের আলোয় আলোকিত আর বিকশিত, কারণ হিসেবে কয়েকটি ঘটনার কথা বলা যাক।

মাওলানা রুমির বয়স যখন মাত্র ১১ বছর, সে সময় মঙ্গোলরা মধ্য এশিয়ায় আক্রমণ করে। ফলে মাওলানা রুমির বাবা তার কিছু অনুসারীসহ তাদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র রওয়ানা হন। সেসময় রুমি চলার পথে অনেকের সান্নিধ্যে আসেন, যা তার জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে রুমি মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেসময় তার সাথে দেখা হয় পারস্যের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক কবি আত্তারের। পারস্যের এই কবির একটি বিখ্যাত বই আছে ‘আসারনামা’ নামে, বইটি  ইহজগতের গভীরতা নিয়ে লেখা। পরবর্তীতে এই বই মাওলানা রুমীর চিন্তা-চেতনাকে স্পর্শ করে। আত্তার রুমিকে বইটি উপহার দেন, কারণ তিনি তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন এই বইয়ের মর্ম রুমি বুঝবেন।

রুমি যখন পুরো দলের সাথে হেঁটে যাচ্ছিলেন, সেই দলের অগ্রভাগে ছিলেন তার বাবা। তা দেখে কবি মন্তব্য করেছিলেন,

একটি হৃদের পেছনে একটি সমুদ্র যাচ্ছে

১২২৮ সালের দিকে আনাতোলিয়ার শাসক আলাউদ্দিন কায়কোবাদ মাওলানা রুমির বাবা বাহাউদ্দিন এবং তার পরিবারকে আনাতোলিয়ার কোনিয়ায় নিমন্ত্রণ করে আনেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুরোধ করেন, যার ফলশ্রুতিতে রুমির পুরো পরিবার সেখানে থেকে যায়। তার বাবা বাহাউদ্দিন সেখানের একটি মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পর তিনি মারা গেলে মাত্র ২৫ বছর বয়সে রুমি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে সবার কাছে মাওলানা ও মৌলভী হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা ছিল বলেই তিনি সেসময় নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন।

মাওলানা রুমির ভেতর গভীর চিন্তা-চেতনার জন্ম আসলে এমনি এমনি হয়নি। প্রচুর পড়াশোনা আর জগত জানার চেষ্টাই তাকে নিয়ে গেছে জ্ঞানের গভীরতম শাখায়। তার বাবার এক ছাত্রের কাছে তিনি টানা নয় বছর পড়াশোনা করেন ইসলামী শরিয়া আর সুফীবাদ নিয়ে। তার লেখায় জীবন নিয়ে যেসব গভীর ভাবনা আমাদের হৃদয় নাড়িয়ে দেয়, সে অবস্থায় যেতে আসলে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে জ্ঞানের এক বিশাল পথ। সেই সাথে নিজের ভেতর আলো জ্বালিয়ে রাখতে করতে হয়েছে নানা রকম জ্ঞানগত পরিশ্রম, কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজই হলো আলো বিলানো। তাই হয়তো মাওলানা রুমি বলতেন,

মোমবাতি হওয়া সহজ কাজ নয়, আলো দেয়ার জন্য প্রথমে নিজেকে পুড়তে হয়

Image Courtesy: steemit.com

 শামস তাবরিজি এবং মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি

শেখার জন্য তুমি পড়াশোনা করো, কিন্তু বুঝতে হলে তোমার প্রয়োজন ভালবাসা
– শামস তাবরিজি

মাওলানা রুমির জন্ম অত্যন্ত সচ্ছল পরিবারে। মায়ের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, বাবাও বেশ সম্মানিত কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। অপরদিকে শামস তাবরিজি ছিলেন সমাজ থেকে একটু আলাদা, যিনি নিজেকে সম্পদ থেকে সবসময় দূরে রেখেছেন। আধ্যাত্মিকতা আর সম্পদের মোহ থেকে মুক্ত থাকার দরুণ তিনি সবসময় কিছু মানুষের কাছে অন্যরকম মর্যাদা পেতেন। মানুষ তাকে ‘পাখি’ বলে ডাকত, কারণ তিনি এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না, দ্রুত জায়গা পরিবর্তন করতেন। লোক মুখে প্রচলিত ছিল, তিনি একজন শিষ্য খুঁজতেন যে কি না তার পরে আধ্যাত্মিকতার কাজটি এগিয়ে নেবে।

শামস তাবরিজি; Image source: feelingbuddhaful.com

শামস তাবরিজির সাথে যখন রুমির প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখন রুমির বয়স মাত্র ২১ বছর। সেই সময় মাওলানা রুমিকে শিষ্য হিসেবে পছন্দ করেন তাবরিজি, কারণ বয়স কম হলেও তিনি রুমির ভেতর জ্ঞানের বিশালতা আর গভীরতা খুঁজে পান, তবে আরও একটু পরিপক্ব বয়সের আশায় তাবরিজি তখনও রুমিকে কোনোপ্রকার শিষ্যত্বের ইঙ্গিত দেননি!

অনেক বছর পর যখন মাওলানা রুমির বয়স ৪০ বছর হয়, তখন শামস তাবরিজি আবার রুমিকে খুঁজে নেন। কারণ তিনি মনে করতেন এটাই সেই বয়স যখন রুমি নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন আকাশের বিশালতায়! তার সাথে আলাপ-আলোচনায় রুমি যেন অন্য এক জগতের সন্ধান পান, যেখানে দুনিয়ার অনেক বড় বিষয়গুলো ক্ষুদ্র মনে হতে থাকে। নিজেদের আলাপে ভর করে জ্ঞানের নতুন আলোর আরও গভীরে যেতে রুমি তাবরিজিকে বাসায় নিয়ে আসেন, আলাপ-আলোচনায় জ্ঞান গ্রহণের ভেতর দিয়ে সময় কাটাতে থাকেন।

রুমির সাথে তাবরিজির জ্ঞানের সম্পর্ক মানুষ মেনে নিতে চায়নি! একে তো তাবরিজি সমাজ থেকে পুরোপুরি আলাদা, সমাজের অধিকাংশ নিয়ম-কানুনকে তিনি সবসময়ই একরকম  প্রত্যাখ্যানই করেন। তার উপর রুমির পরিবার সমাজে সুপরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত। যদিও তাবরিজি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত এক বাদশা, তবে অধিকাংশ মানুষ সেই হিসেবে কোনোদিন তাকে বিচার করতে যায়নি। তাদের কাছে তাবরিজি এক নিঃস্ব মানুষ ব্যতীত আর কিছুই ছিল না!

সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই এগিয়ে যান রুমি। যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, ঠিক তখন রুমি করে বসলেন এক অদ্ভুত কাজ! তিনি তার সৎ মেয়ে কিমিয়ার সাথে তাবরিজির বিয়ে দিয়ে দেন। এতে করে সেই সমাজে তাবরিজির একটা শিকড় জন্মে, যা প্রত্যাখ্যান করে কেউ আর তাকে ছুঁড়ে ফেলার সাহস করবে না।

তবে তাবরিজির সাথে রুমির এই জ্ঞানসাধনা বেশি দিন টেকেনি। তার সাথে কিমিয়ার বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই কিমিয়া মারা যায়। ফলে তার শিকড় আবারও আলগা হয়ে যায়। কথিত আছে, তাবরিজিকে হত্যা করা হয়। সে যা-ই হোক, তাবরিজি যেন হয়ে ওঠেন বনের সেই পাখিটি, যে কি না আবার হারিয়ে যায়, যা মাওলানা রুমিকে প্রচন্ড ব্যথিত করে।

তাবরিজির হারিয়ে যাওয়া অথবা মৃত্যুর অনেক দিন পর অবধি মাওলানা রুমি তাকে ফিরে পাওয়ার আশায় বিভোর ছিলেন। তারপর যখন বুঝতে পারলেন জ্ঞানের সাগরের সাথে তার আর দেখা হচ্ছে না, তখন তিনি তাবরিজির মৃত্যুর ঘোষণা দিলেন। তাকে হারিয়ে ফেলার শোকে রুমি লিখলেন ‘দেওয়ান-এ শামস-এ তাবরিজি’। এখান থেকেই যেন এক অন্যরকম রুমির আবির্ভাব ঘটে। নতুন রুমি সবার কাছে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। হৃদয়ের আলো-অন্ধকারের কথা, সুফিবাদের কথা এমনভাবে বলতে থাকেন যে দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বিষয় তখন কেউ দেখেনি। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, মানুষের হারিয়ে যাওয়া, সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের সম্পর্কের ভাবনা নিয়ে হাজির হন এক অন্য রুমি।

জীবনের ভাবনাগুলো তখন শুধু জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেগুলো হয়ে উঠেছিল নীরব আর গভীর। যেমন শামস তাবরিজিকে খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার বিপরীত দিকে গিয়ে তিনি লেখেন,

আমি কেন তাকে খুঁজব?
সে আর আমি তো একই
তার অস্তিত্ব আমার মাঝে বিরাজ করে
আমি নিজেকেই খুঁজছি।

শামস তাবরিজিকে নিজের আলোয় অমর করতে তার গ্রন্থ ‘দেওয়ান–এ শামস-এ তাবরিজি’তে একে একে যোগ করতে থাকেন গজল, কবিতা, যা আধ্যাত্মিকতার এক নতুন পাঠ হিসেবে সবার কাছে প্রকাশিত হয়।লোকমুখে তখন প্রচলিত হয় যে, তাবরিজির মৃত্যুর পর মাওলানা রুমিই তাবরিজি হয়ে ওঠেন! কারণ ততদিনে মাওলানা রুমির লেখা একেকটি লাইন মানুষের ভেতর নাড়িয়ে দিতে থাকে, ক্ষমতাশীল পৃথিবীকে তুচ্ছ করে দেয়ার মতো সব লেখা লিখতে থাকেন তিনি।

‘দেওয়ান-এ শামস-এ তাবরিজি’র ১৫০৩ সালের পৃষ্ঠার অনুকরণ; Image Source: enacademic.com

জীবনে এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে যাওয়া, দুনিয়ায় টিকে থাকার যুদ্ধ- এসব বিষয়কে রুমি যেন নতুন করে পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসেন। রুমি মানুষের নিজস্বতার উপর জোর দিলেন, মানুষের ভেতরকার আলোর সন্ধান দিলেন, যে আলো পৃথিবীর থেকেও শক্তিশালী বলে তিনি জানান,

তুমি কি এখনও এ ব্যাপারে অবগত নও? এ তো তোমারই আলো, যা দিয়ে সমগ্র জগত প্রজ্বলিত হয়!

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি দিন দিন যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করলেন। সুফিবাদ আর মানুষের নিজের আলো জ্বালাতে যেন আরও দুর্বার, দুরন্ত হয়ে উঠলেন। তার জীবনে আসতে থাকলো নতুন নতুন ভাবনা আর কাজ, যা দিয়েই তিনি মৃত্যুর এত বছর পরও আলোচনা-ধ্যান-জ্ঞানে বেঁচে আছেন।

লেখালেখির আগে-পরে ধ্যানের সাথে এমন মগ্নভাবে তিনি ঘুরতে থাকতেন, যেন এই জগত ছেড়ে তিনি অন্য জগতে চলে গিয়েছেন! দেখতে নাচের মতো হলেও নাচের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। এটা ছিল পৃথিবীর মতো ঘুরতে ঘুরতে স্রষ্টার প্রেমে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার মুহুর্ত, যেন স্রষ্টার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার প্রবল ইচ্ছায় ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরতে থাকার মুহুর্ত, যেমন করে মাওলানা রুমি বলতেন,  

সম্মুখে উপস্থিত ছাড়া কোনো প্রার্থনাই পরিপূর্ণ নয়।

রুমির দেখানো এই মগ্ন হওয়ার ধারা আজও বিদ্যমান সুফি নৃত্য নামে। সুফিবাদের ইতিহাসে এটি অবশ্যই এক নতুন আলো, যে আলো দিয়ে সুফিবাদের তত্ত্ব আরও আলোকিত হয়েছে। কারণ সুফিবাদের ইতিহাসে কখনও কেউ নিজেকে ধরে রাখতে চায়নি, বরং চেয়েছে স্রষ্টার কাছে সপে দিতে।

সুফি নৃত্য; Image Source: washingtonpost.com 

রুমি এই মগ্ন থাকার ধারাকে নিজের জন্য ফরয ভাবতেন। এভাবেই প্রতিদিন নিজেকে সঁপে দিতেন স্রষ্টার কাছে। এ ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন,

আমরা শূন্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসেছি
যেমনটা তারারা আকাশে ছড়িয়ে থাকে
তারারা মিলে একটি বৃত্তের সৃষ্টি করে
এবং তার মাঝে আমরা নাচতে থাকি।

এভাবেই রুমি তাবরিজিকে হারিয়ে এক অন্য রুমি হয়ে ওঠেন। জীবনের গভীর ভাবনা ভাবতে ভাবতে তার দিন কাটতে থাকে, জীবনে আর গুরুত্বপূর্ন কেউ না আসলেও বন্ধু আসে আবারও, যার নাম ছিল সালাউদ্দিন জাকুব। পেশায় তিনি একজন স্বর্ণকার ছিলেন। রুমি অবশ্য এই বন্ধুকেও হারান। যদিও ততদিনে তিনি সম্পর্কের বন্ধন থেকে নিজেকে অনেক উপরে নিয়ে গিয়েছিলেন। পাওয়া-না পাওয়া, প্রেম-বিরহ সবকিছু আরও মেলে ধরে তিনি লিখতে বসেন আরেক বিস্ময়কর গ্রন্থ ‘মাসনবী শরিফ’। এই গ্রন্থের প্রথমেই তিনি লেখেন,

বাঁশের বাশি যখন বাজে, তখন তোমরা মন দিয়ে শোন সে কী বলে
সে তাহার বিরহ বেদনায় অনুতপ্ত হইয়া ক্রন্দন করিতেছে

এই ‘মাসনবী শরীফ’-এই পাওয়া যায় সে সময়ের সুফিবাদের নানা দর্শন, সেই সাথে ফুটে ওঠে তিনি জীবনে যাদের খুব ভালবেসেছিলেন তাদের প্রতি ভালবাসার কথাও। আর এখানেই তিনি যেন দিয়েছিলেন তার মৃত্যুর ইঙ্গিত,

কীভাবে জানবো কোন ধরনের রাজা আমার মধ্যে আছে আমার সহচর হিসেবে,
আমার উজ্জ্বল মুখে দৃষ্টি দিও না, আমার বদ্ধ পাগুলোর জন্য!

মাওলানা রুমি আসলে এমনই ছিলেন। জমিনে ছিল তার পা, অথচ ছিলেন আকাশের মতো বিশাল। মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালাতে যা লিখে গেছেন, তার সবই অমরত্ব পেয়েছে। আধুনিক বিশ্বেও তাই রুমির বলা প্রতিটি কথা তুমুল আলোচিত। সুফিবাদেও যিনি যোগ করেছেন এক নতুন আলো, যা মানুষের হৃদয়ের অন্ধকার দূর করতে সক্ষম।

রুমির মৃত্যুর পর জর্জিয়ার রানী তার সমাধিস্থল নির্মাণ করতে তহবিল প্রদান করেন, যার ফলে কোনিয়ায় তার সমাধিস্থল নির্মাণ করা হয়। তার বড় ছেলে সুলতান ওয়ালাদ বাবার অনুসারীদের নিয়ে মৌলভী সম্প্রদায় গড়ে তোলেন, যারা বর্তমান তুরস্কে ঘূর্ণায়মান দরবেশ নামে পরিচিত। এখনও পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে যায় রুমির সমাধিস্থলে, যেখানে তার দেখানো পথে মানুষ ঘুরছে নিজেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সঁপে দিতে!

মাওলানা রুমির সমাধিস্থল; Image Source: bazaarturkey.com 

শেষের কথা

মানুষ তার জীবনে খুব বেশি কিছু হলে একটি ইতিহাস হয়, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি হয়েছেন এক জীবনব্যবস্থা, ভাবনার পরিপূর্ণতা! তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন বার বার, তবে পা দুটো তার মাটিতেই ছিল। তিনি নিজের ভেতর জন্ম নেয়া আলোকে চিনতে পেরেছেন, সেই আলোয় আলোকিত করতে চেয়েছেন সারা পৃথিবীকে। শক্তিশালী সব চিন্তা-চেতনা দিয়ে হৃদয় আলোকিত করতেই যেন জন্মেছিলেন মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। এক আধ্যাত্মিক জীবনের খোঁজে তার কাছে তো যাওয়াই যায়।

তোমার ক্ষুদ্র জগত থেকে বের হয়ে আসো এবং স্রষ্টার অসীম জগতে প্রবেশ করো

Related Articles