Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিখাইল তাল: দ্য ম্যাজিশিয়ান ফ্রম রিগা || শেষ পর্ব

[১ম পর্ব পড়ুন]

খেলাধুলার মধ্যে দাবা যেমন বেশ বুদ্ধিবৃত্তিক, সাথে আনপ্রেডিক্টেবল; তেমনই দাবাড়ুদের জীবনও বেশ বৈচিত্র্যময়। বিশ্বখ্যাত যেসব দাবাড়ু স্বীয় প্রতিভা আর সৃজনশীলতা দিয়ে দাবার বোর্ডে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গিয়েছেন, মিখাইল নেখমেভিচ তাল তাদের মধ্যে অন্যতম। তালের ৮৫তম জন্মদিনে আমরা তাকে স্মরণ করছি তার জীবনী আলোচনার মাধ্যমে। প্রথম পর্বে তার খেলোয়াড়ি জীবনের সূচনা থেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া পর্যন্ত দেখেছি। এ পর্বে মুকুট হাতছাড়া হওয়া, ক্যারিয়ারের অস্তবেলা এবং স্মরণিকা আলোচনা করা হবে। 

মুকুট হারানো 

গত বছর তালের কাছে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ হারানো বতভিনিক ১৯৬১ সালে সরাসরি রি-ম্যাচ পান তৎকালীন নিয়ম অনুসারে। এই ম্যাচে ড্র হয় মাত্র ছয় গেম। তাল অষ্টম গেম ড্র করে পয়েন্ট কাছাকাছি আনেন ৪.৫-৩.৫ করেন। কিন্তু পরবর্তী তিন গেম টানা জিতে বতভিনিক এক বড়সড় লিড নেন। এরপরের নয় গেমে দুই পক্ষই তিনটি করে জয় পায়। এরপর শেষ গেমে জিতে পুরো চ্যাম্পিয়নশিপের সু-সমাপ্তি করেন বতভিনিক। ১৩-৮ পয়েন্টে তার হারানো মুকুট পুনরুদ্ধার করেন এই গ্র্যান্ডমাস্টার।

ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে বতভিনিক তালের প্রশংসা করার পাশাপাশি প্রস্তুতির অভাবকে পরাজয়ের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করেন। বতভিনিক বলেন, 

যখন বোর্ডে ঘুঁটির আধিক্য থাকে, অনেক ভ্যারিয়েশন সম্ভব হয় সেরকম পজিশনে তালের সমকক্ষ কেউ নেই। তালের ক্যালকুলেশন স্কিলও দারুণ! তবে তার প্রস্তুতিতে ঘাটতি স্পষ্টভাবে লক্ষ্যনীয়। পর্যাপ্ত প্রিপারেশন নিয়ে আসলে এখনকার থেকে অনেকগুন বেশি বিপজ্জনক হিসেবে আবির্ভূত হতেন তিনি। 

ফিরতি ম্যাচে মিখাইল তাল এবং বতভিনিক; Image Courtesy: Unknown, Source via Twitter/Douglas Griffin

বয়সে বতভিনিকের অর্ধেক হলেও তাল এই সামান্য বয়সেই জটিল এক ব্যাধিতে ভুগতে শুরু করেছিলেন। কিডনির সমস্যা তাকে যথেষ্ট ভোগাচ্ছিল, যদিও তাল কোনো অজুহাত দেননি। মিখাইল তাল আসলেই মহানুভব একজন ব্যক্তি ছিলেন, ম্যাচ জয়ের পূর্ণ কৃতিত্ব বতভিনিককে দিয়ে তিনি বলেন, 

I think that I lost to him because he beat me! He was very well-prepared for the second match. Botvinnik knew my play better than I knew his. 

বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ-পরবর্তী ক্যারিয়ার 

তাল পরবর্তীতে আর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচের জন্য কোয়ালিফাই করতে পারেননি। অসুস্থতার জন্য ১৯৬২ সালের ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। যদিও ষাটের দশক জুড়েই বেশ শক্ত খেলোয়াড় হিসেবে খেলে গিয়েছেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ইন্টারজোনাল টুর্নামেন্ট জিতে তা আবার প্রমাণ করেন। ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন আবার, যার বিজয়ী চ্যাম্পিয়নকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফাইনালে বরিস স্পাস্কির কাছে +১ -৪ =৬ পয়েন্টে (একটি জয়, চারটি পরাজয়, ছয় ড্র) হেরে সেই আশার গুড়ে বালি। ১৯৬৭ সালে তাল তার তৃতীয় সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেন লেভ পোলগেভস্কির সাথে যৌথভাবে। ১৯৬৯ সালের ক্যান্ডিডেটস-এর সেমিফাইনালে ভিক্টর কোর্চনোইয়ের কাছে হেরে যান তাল। এভাবে আর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা হয়ে ওঠেনি তালের।  

অসুস্থতা এবং একটি মজার ঘটনা

পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই অসুস্থতা অনেক ভুগিয়েছে তালকে। অনেকবার টুর্নামেন্টের মাঝখানে সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। তাল তার আত্মজীবনীতে ১৯৬৯ সালের একটি ঘটনা লিখেছেন। সেবার তিবিলিসি গিয়ে তার একটি কিডনি অপসারণ করেন তিনি। চিকিৎসকদের মতে যা আরও ২-৩ বছর আগেই অপসারণ করা দরকার হয়ে পড়েছিল। অপারেশন সফলভাবেই সম্পন্ন হয়, পাঁচদিন পরেই তাল পরবর্তী টুর্নামেন্ট খেলার জন্য তৈরি হওয়া শুরু করেন। 

কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, অপারেশন থিয়েটারেই তাল মারা গেছেন। যুগোস্লাভিয়ার পত্রপত্রিকায় সেই খবর ছাপা হলে তার সেখানকার বন্ধু-বান্ধবগণ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। তাল তখন সশরীরে তাদের আশ্বাস দিতে যান সেই ক্লাসিক কৌতুক বলে, The rumors about my death are greatly exaggerated! সেখানে তার কাঙ্ক্ষিত টুর্নামেন্টটিও খেলেন তাল, সুয়েটিনের বিপক্ষে এক ম্যাচে কুইন স্যাক্রিফাইস করলে ধারাভাষ্যকার হাস্যরস করে বলেন, not bad for a dead man, don’t you think!  

তালের যে বছর একটি কিডনি অপসারণ করা হয়, সেবছরের ছবি, ১৯৬৯ সাল; Image Courtesy: Wikimedia Commons

ক্যারিয়ারের পড়ন্তবেলায়

রোগের সাথে যুঝে হলেও খেলা চালিয়ে গিয়েছিলেন তাল। শুধু ষাটের দশকই নয়, সত্তর এমনকি আশির দশকেও দারুণ প্রতাপের সাথে খেলতে থাকেন তাল। তার পরের তিনটি সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপ যথাক্রমে ১৯৭২, ১৯৭৪ এবং ১৯৭৮ এ নিজের করে নেন তিনি। এর মধ্যে ১৯৭২-৭৪ এই সময়ে দুটি আনবিটেন স্ট্রিক গড়েন ৮৬ এবং ৯৫ ম্যাচের যা কিনা ২০১৮ পর্যন্ত টিকে ছিল! র‍্যাঙ্কিংয়ে সর্বদাই শীর্ষ দশের মধ্যে থাকতেন তিনি, এমনকি বিভিন্ন সময় ২-৩ এও উঠে এসেছিলেন! 

কিংবদন্তি ববি ফিশার কিন্তু তালকে খেলতে মোটেই স্বাচ্ছন্দ্য পেতেন না। তিনি ফিশারের জন্য বলা যায় অভিশাপের মতো ছিলেন। কারণ, তাল প্রায় সর্বদাই তাকে শোচনীয়ভাবে হারাতেন। ফিশার ১৯৬১ সালে ব্লেড টুর্নামেন্টে তালের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো জিততে সক্ষম হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাল সবসময় ফিশারের জন্য ঝামেলা হয়ে ছিলেন, বিশেষ করে তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে।

এরপর একসময় তাল কারপভের সাথে কাজ করেছেন, খুব গুরুত্বের সাথে কাজ করেছেন। যদিও তাদের খেলার ধরন ভিন্ন ছিল। ধারণা করা হয়, ফিশারের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে এটা শুরু করেন তারা। কারপভ যখন কোর্চনোইয়ের সাথে খেলেন তখন তাল তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু তাদের এই আন্তঃসম্পর্কের সর্বোচ্চটা ছিল ১৯৭৮ সালে। এ সময় তালের উত্থানকেও নির্দেশ করে, কারণ এই ধরনের সহযোগিতা উভয় পক্ষকেই সাহায্য করে। তালের সাহায্য কারপভের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু তালও দাবার নতুন ধাঁচ সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছিলেন। তালের ১৯৭৮-৭৯ সালে তার উত্থানও এই কাজের ফল।

জীবনের শেষ বড় কোনো অর্জন হিসেবে তাল ১৯৮৮ সালে দ্রুতগতির ব্লিটজ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন! ৩২ জনের নক-আউট টুর্নামেন্ট ছিল এটি। কারপভ প্লে-অফেই ছিটকে যান, ক্যাসপারভ কোয়ার্টার-ফাইনালে। 

রিগায় এই বাড়িতে থাকতেন মিখাইল তাল; Image Courtesy: Wikimedia Commons 

মৃত্যু

দাবা অন্তঃপ্রাণ এই মানুষটি মৃত্যুর একমাস আগেও ব্লিটজ টুর্নামেন্ট খেলেছেন। খেলাকে আসলেই মন থেকে ভালবাসতেন তিনি। কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়াকে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়। স্বাস্থ্যের দিকে বলতে গেলে নজরই ছিল না তার। পার্টিপ্রিয় তাল একদিকে যেমন ছিলেন তুখোড় ধূমপায়ী, সাথে মদ্যপানও করতেন বলে জানা যায়। এগুলো এই মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়েই দিয়েছে শুধু। আরেক বর্ণনানুযায়ী, অন্ননালীতে রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। মস্কোর এক হাসপাতালে ২৭ অথবা ২৮ জুন মৃত্যুবরণ করেন এই জাদুকর। গ্যারি ক্যাসপারভ তার বইয়ে ২৮ জুন বলেছেন, যদিও তালের সমাধিফলকে উৎকীর্ণ আছে ২৭ তারিখ।

অসাধারণ খেলার ধরনের কারণে মিখাইল নেখমেভিচ দ্য এইটথ, তাল বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। যার মধ্যে দ্য ম্যাজিশিয়ান ফ্রম রিগা, দ্য পাইরেট অফ লাতভিয়া, দ্য এলিয়েন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বন্ধুরা ডাকত মিশা বলে। তাল আসলে দাবার এক বিপ্লবের নাম, প্রথাগত শিকল ভেঙে নিয়ম-কানুনের ঊর্ধ্বে ওঠার নাম। 

তিনি ছিলেন এক জ্বলজ্বলে দ্যুতি, যার দ্রুতই উদয় ঘটেছে এবং দ্রুতই পতনও ঘটেছে। উপমা দিয়ে বলতে গেলে, তারাটি এত উজ্জল হয়ে জ্বলেছিল যে, সেটি দীর্ঘসময় নিজেকে জ্বালিয়ে রাখতে পারেনি, একবারে পুড়ে গেছে।

– তালের ব্যাপারে ক্রামনিক

তালের সমাধি; Image Courtesy: Wikimedia Commons

লেখক তাল

চৌষট্টি খোপে যেমন অপ্রতিরোধ্য ছিলেন তাল, তেমনই কলম হাতেও ছিলেন সামনের সারিতে! অনেক কালোত্তীর্ণ বই যেমন লিখেছেন, তেমনই পুরো এক দশক (১৯৬০-৭০) ছিলেন রিগা শাহ’স ম্যাগাজিনের সম্পাদক (শাহ’স শব্দের অর্থ দাবা)। বতভিনিকের বিরুদ্ধে ১৯৬০ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের উপর লেখা তাল-বতভিনিক ১৯৬০-কে বলা হয়, যেকোনো ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে লেখা সেরা বই। 

তার আত্মজীবনী দ্য লাইফ অ্যান্ড গেমস অফ মিখাইল তাল তো দাবা বিষয়ক শ্রেষ্ঠ বই বলে বিবেচ্য। এই বইয়ের বিশেষত্ব হলো তার সাথে একজন সাংবাদিকের কাল্পনিক কথোপকথনের ধাঁচে এটি লিখিত। এক্ষেত্রে তার সহলেখক ইয়াকভ দামস্কির মুন্সিয়ানাও আছে বলতেই হবে। এই দুই মাস্টারপিস ছাড়াও ১৯৬৬ সালের পেত্রসিয়ান-স্পাস্কি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে তাল লিখেছেন World Championship: Petrosian vs. Spassky 1966। চেস ডাইজেস্ট প্রকাশ করেছে এটি। আর আত্মজীবনীর প্রকাশক Everyman Chess থেকে তার অ্যাটাকিং দাবা নিয়ে বের হয়েছে অ্যাটাক উইথ মিখাইল তাল। এগুলো ছাড়াও সর্বমোট তার দশের অধিক বই আছে।

ব্যক্তিজীবন

শৈশব থেকেই তালের স্বাস্থ্য ছিল বেশ ভঙ্গুর, এবং সেই সাথে তার জীবনযাত্রারও নেতিবাচক প্রভাব ছিল। আকর্ষণীয়, হাস্যরসিক, উচ্চশিক্ষিত এবং পার্টিপ্রিয় তাল তার জীবনের শেষ বছরগুলোতে খুব অসুস্থ ছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান মাত্র ৫৬ বছর বয়সে। তার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কম জানা যায়, কিন্তু যদ্দুর জানা যায়- তিনি নিপাট ভালমানুষ ছিলেন। তার জীবনে কোনো উচ্চাশা ছিল না। 

এ সম্পর্কে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির ক্রামনিক বলেন, 

তাল একজন তারকা ছিলেন, ছিলেন এক প্রকৃত দাবা-প্রতিভা। যতদূর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তার জীবনে কোনো উচ্চাশা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি খেলাটা শুধুই উপভোগ করে গেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি অপেশাদার ঠেকতে পারে, কিন্তু তার ট্যালেন্ট এতটাই মায়ার ইন্দ্রজাল সৃষ্টিকারী ছিল যে, তার অ্যামেচার অ্যাপ্রোচেই তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে যান।

তালের জীবনযাপন এবং খেলার ধরন সম্পর্কে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হবার অন্যতম দাবিদার গ্যারি ক্যাসপারভ বলেন, 

তালের লাইফস্টাইল ছিল সাধারণের থেকে অনেক আলাদা এবং অনুরূপ জীবনযাপন করা যে কারো জন্যই কঠিন, বেশ কঠিন। কিন্তু খেলার ধাঁচের কথা বললে, তালের ধাঁচে খেলতে পারা, সেটা তো একেবারেই অসম্ভব! 

স্মরণিকা 

মিখাইল নেখমেভিচ দ্য এইটথ, তথা তালের লেগ্যাসি নিয়ে লিখতে বসলে লিখে শেষ করা যাবে না। তবুও কিছু কথা না বললেই নয়। শ্রেষ্ঠ দাবাড়ুদের সেরা খেলাগুলো নিয়ে ২০০৪ সালে সংকলিত The Mammoth Book of the World’s Greatest Chess Games বইয়ে অন্য যেকোনো দাবাড়ুর থেকে তালের বেশি গেম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 

তালের মৃত্যুর পর মার্কিন গ্র্যান্ডমাস্টার রবার্ট ব্রাইন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, 

এটা শুনতে খুব সাধারণ শোনাতে পারে, কিন্তু খুব কম খেলোয়াড়ই তার মতো দাবাকে ভালবাসত। অনেকের কাছেই খেলাটা একটা পরিশ্রমের মতো, যেখানে তাল আসলে সেটা উপভোগ করতেন।

পঞ্চম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাক্স উ বলেন, 

তাল তার পূর্ববর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের থেকে বেশ কিছু গুণ পেয়েছিলেন। পল চার্লস মরফি থেকে চেস ব্রিলিয়ান্সি, স্টেইনিজ থেকে কিছুটা ম্যাজিক, ইম্যানুয়েল ল্যাস্কারের থেকে সাইকোলজিক্যাল অ্যাপ্রোচ, অ্যালেক্সান্ডার অ্যালেখাইন থেকে আক্রমণ আর মিখাইল বতভিনিক থেকে এনার্জি; এসব মিলেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাল! 

ষষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মিখাইল বতভিনিক তালের ব্যাপারে বলেন, 

মানুষ তাকে ভালবাসত, এটাই কি সুখী হবার জন্য যথেষ্ট নয়? দাবা বোর্ডে তাল বড় দুর্ধর্ষ ছিলেন, পক্ষান্তরে বাস্তব জীবনে তিনি ততটাই অহিংস লোক। এর সাথে যুক্ত ছিল তার বুদ্ধিমত্তা আর রসিকতা। তিনি কম্বিনেশনের ঝড় তুলতে ভালবাসতেন, দাবার বোর্ডে সব প্যারাডক্সিক্যাল সমাধানে বুঁদ থাকতে ভাল লাগতো তার।  

তালের এক্সিলেন্সির কথা সপ্তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভাসিলি স্মিস্লভের মুখে শুনুন, 

বৃহদার্থে চিন্তা করলে তালের আবির্ভাব ছিল এক বিস্ফোরণের মতো। কম্বিনেটিভ ব্রিলিয়ান্সির অসাধারণত্ব ধরা দিয়েছিল তার মাধ্যমে। দাবার ঘুঁটিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠত তার গেমে। 

অষ্টম চ্যাম্পিয়ন তালের ব্যাপারে নবম চ্যাম্পিয়ন তিগ্রান পেত্রসিয়ান বলেন, 

হাতে গোনা মাত্র ক’জনকে আমি জিনিয়াস মানি, যারা কিনা ছিলেন তাদের সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে, তাদের এই প্রভাবটা আমরা ধরতে পারি বেশ পরে। এমন জিনিয়াস আমার কাছে মনে হয়, পল চার্লস মরফি, অ্যালেক্সান্ডার অ্যালেখাইন আর তাল। সমসাময়িক বোদ্ধারা যেটা পারেননি, রিগার এই গ্র্যান্ডমাস্টার সেটিই করে দিয়েছেন। দুঃখের বিষয় হলো- এত তাড়াতাড়ি তার স্মৃতিচারণে বসতে হচ্ছে আমাদের! [তাল মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মারা যান, সেদিকে ইঙ্গিত করে] 

দশম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বরিস স্পাস্কি তালের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলেন,

আমার সাথে তার সম্পর্ক ছিল খুবই দারুণ, একবারের জন্যও আমরা কোনো সমস্যায় জড়াইনি। খেলার মাঠে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও বাস্তব জীবনে আমাদের চমৎকার বোঝাপড়া ছিল বরাবরই। গ্রেট খেলোয়াড়দের মধ্যে মিশাই মনে হয় একমাত্র যার ভেতর অহংকারের ছিটেফোঁটাও ছিল না। 

তালের ব্যাপারে দ্বাদশ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আনাতোলি কারপভ উপমা দেন “এলেন, দেখলেন, জয় করলেন”, 

সেরা সময়ের তালকে নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, “তিনি এলেন-দেখলেন-জয় করলেন”। তার কম্বিনেটিভ ট্যালেন্টে পরাস্ত হয়েছিল সবাই। ব্যতিক্রমী প্রজ্ঞা, মন-স্মৃতিশক্তির সুতীক্ষ্ণ ব্যবহার- এগুলোই তাকে অপ্রতিরোধ্য বানিয়ে দিয়েছিল। 

এই তিন বিশ্বচ্যাম্পিয়নই তালের স্মরণিকায় তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। বাঁ থেকে কারপভ, উ (নিচে), স্মিস্লভ; Image Courtesy: Wikimedia Commons

তালের আত্মজীবনীর মুখবন্ধে সম্পাদক জন নান বলেন, 

মিশার ব্যক্তিত্ব ছিল বেশ উষ্ণ এবং আন্তরিক, যেখানে কদর্যতার লেশমাত্র ছিল না। দাবার প্রতি ছিল তার অসীম আবেগ। জীবনের শেষদিনগুলোতে অসুস্থতা তাকে অনেক ভুগিয়েছে কিন্তু তিনি কখনই কোনো অজুহাতের আশ্রয় নেননি। [খেলাটাকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন।] ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হলেও তিনি ম্যাচ পেছাতেন না কখনও, গেম স্থগিত করাকে মন থেকে ঘৃণা করতেন তাল।

ভ্লাদিমির ক্রামনিকের এই মূল্যায়ন ছাড়া স্মরণিকা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে, 

তালের ব্যাপারে কিছু বলা কঠিন, কারণ তিনি ছিলেন খুবই প্রতিভাবান, তাকে শুধুই ন্যাচারাল ফেনমেনন বলাই মানায়। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, যদি তিনি দাবায় না আসতেন তবে অন্য যেদিকে ফোকাস করতেন, সেখানেই সেরা হতেন। যদি তিনি বিজ্ঞানী হতেন, তবে সম্ভবত নোবেল পুরস্কার পেতেন। তার বৈশিষ্ট্য ছিল জাগতিক গুণাবলীর বাইরে। যারা তাকে ব্যক্তিগতভাব চিনতেন, তাদের অনেকেই বলেছেন, তার মধ্যে হোমো-স্যাপিয়েন্সের কোনো বৈশিষ্ট্যই ছিল না। তিনি ছিলেন এলিয়েন। তার দাবা নিয়ে আলোচনা করা হলো ঈশ্বর কেমন দেখতে, সেটা নিয়ে আলোচনা করার মতো! 

যন্ত্রের দাপটের এই যুগে সবাই যেভাবে সুপার কম্পিউটারসুলভ মেশিনের মতো খেলছে, সেখানে তালের অ্যান্টি-পজিশনাল খেলার ধরন কতটা কাজে আসবে, এই চিন্তা করেন অনেক বোদ্ধাই। তবে বর্তমান প্রজন্মও বসে নেই। হালের দানিয়েল দুবভকে অনেকে ভালবেসে এই জমানার তাল বলে ডাকেন। তার খেলার ধরনও যে তালের মতোই! 

বর্তমানের দানিয়েল দুবভের মাঝে অনেকেই তালের ছায়া দেখতে পান; Image Courtesy: Nikki Riga/Twitter

মিশা আজ নেই, কিন্তু তার গেমগুলো আছে। তার স্যাক্রিফাইসিং-রোমান্টিক-অ্যাটাকিং স্টাইলে আজ দাবাপাড়া বুঁদ। শুধু একটি-দুটি নয়, গোটা কয়েক প্রজন্মের দাবার পাঠ তিনি দিয়েছেন সামনে থেকে। তার লালিত স্বপ্ন আজ বাস্তবতার মুখ দেখছে। কুইন স্যাক্রিফাইস হরহামেশাই হচ্ছে, এমনকি ১২ তম মুভেও! স্যাক্রিফাইসিং-রোমান্টিক-অ্যাটাকিং দাবা বেঁচে থাকুক আজীবন! বেঁচে থাকুন তাল, তার অনন্য সব ম্যাচের মাঝে, চোখধাঁধানো কুইন স্যাক্রিফাইসের মাঝে!

This article (2nd part) is about the legend himself, Mikhail Nekhmevic Tal, the 8th World Chess Champion! Here we discuss his playing style alongside his life too. Necessary references are given below.

Feature Image: Chess Or History

References:

  1. Mikhail Tal. Iakov Damsky. The Life and  Games of Mikhail Tal. Cadogan Chess Series. 1998. ISBN: 1 85744 202 4.
  2. Garry Kasparov. My Great Predecessors II. Everyman Chess Series. 2003. ISBN: 1 85744 342 X.
  3. Mikhail Tal. Tal-Botvinnik 1960. Revised & Expanded Fifth Edition. 2000. ISBN: 1-888690-08-9.
  4. Player Profile. Mikhail Tal. Chess.com. 
  5. Kasparov on Tal,  Echo Moskvy.
  6. Kramnik on Tal, Russian ChessMag e3e5.

Related Articles