Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একজন মোহাম্মদ আলী স্যার: সাদা মনের এক মহামানবের মহাপ্রয়াণ

তখন আমরা পড়ি বুয়েটের তড়িৎকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে। সবে প্রথম সেমিস্টারের প্রথম ক্লাস শুরু হবে, ২০১৩ সালের শেষ দিক। তবে আমাদের সেদিনের ক্লাস নিয়ে আমরা বেশ উত্তেজিত ছিলাম। এতদিন ধরে শুনে আসা কিংবদন্তী মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার আমাদের মেশিন কোর্সের ক্লাস নেবেন! তাঁর নানা গল্প, হাতেম তাঈ কিংবা হাজি মহসিনসুলভ কাহিনীগুলো বুয়েটের সর্বত্র শোনা যেত। এরকম একজন মানুষের ক্লাস পাওয়াও তো ভাগ্যের ব্যাপার।

অন্যান্য ক্লাসে সব আসন না ভরলেও এ ক্লাস শুরু হবার আগেই বসবার আর জায়গা নেই, অন্য সেকশন থেকে পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা চলে এসেছে তাঁর ক্লাস করবার জন্য। স্যারের ক্লাস পায়নি দেখে তাদের আফসোসের সীমা নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই ঢুকলেন সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পরা শুভ্র দাড়িওয়ালা মোহাম্মদ আলী স্যার। এত সাধারণ একটি মানুষ, কিন্তু সীমার মাঝেই অসাধারণ!

বুয়েট ইসিই ভবনের ১২২ নং রুম ছিল তাঁর ঠিকানা; Source: eee.buet.ac.bd

সেই অসাধারণত্বের পরিচয় পাওয়া গেল কিছুক্ষণের মাঝেই। বোর্ডে লিখতে শুরু করলেন ধীরে ধীরে, আর সময় যেন তাড়াতাড়ি বইতে শুরু করল। অসম্ভব গভীরে গিয়ে তিনি বোঝাতে শুরু করলেন একেকটি বিষয়, নিপুণ হাতে ঝটপট এঁকে ফেলছিলেন বিশাল সব ছবি। এতই ভালো বোঝাতেন তিনি যে পরীক্ষার আগে বই খুলে দেখা যেত বইয়েই তো এর চেয়ে কম লিখা! হ্যাঁ, ইনিই তো সেই মোহাম্মদ আলী, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সব যার নখদর্পণে। বিদ্যুৎ নিয়ে কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দিলেই যার কাছে বিদ্যুৎ বিভাগের বাঘা বাঘা মানুষেরা ছুটে আসতেন। অথচ, এই অসাধারণ জ্ঞানী মানুষটার মাঝে নিরহংকারের যে ছাপ দেখা যেত সেটি আজকালকার যুগে বিরল। কোনোদিন আমরা তাঁর মুখে তুই কিংবা তুমি ডাক শুনিনি, আমাদের মতো বয়সে এত ছোট ছাত্রদেরকেও ষাটোর্ধ্ব এ মানুষটি ডাকতেন ‘আপনি’ বলে।

২৯ জানুয়ারি সোমবার, ২০১৮ তারিখে অগণিত অনুরাগীকে কাঁদিয়ে অনেকদিন লড়াই করে কোলন ক্যান্সারের কাছে হার মেনে মোহাম্মদ আলী স্যার পরপারে চলে যান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। ২০০৭ সালে প্রথম তাঁর ক্যান্সার ধরা পরে।

তিনি বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি বুয়েটে শিক্ষকতা করাতেন মৃত্যু পর্যন্ত। বাংলাদেশে যে দিন (২০১৪ সালের ১ নভেম্বর শনিবার) পুরোপুরি ব্ল্যাকআউট হলো অর্থাৎ সারা দেশে বিদ্যুৎ চলে গেল, সেদিন আমরা ক্লাস করছিলাম বসে। দুপুর পর্যন্ত আমরা টেরও পাইনি যে বাইরে বিদ্যুৎ নেই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে না প্রবেশ করলে আমরা অনেকে হয়ত বুঝতেও পারতাম না যে বুয়েটের বাইরে, সারা ঢাকা শহর জুড়ে, এমনকি বাংলাদেশ জুড়ে কারেন্ট নেই। কারণ, বুয়েটে কখনো এভাবে কারেন্ট যায় না, যেহেতু বুয়েটের রয়েছে নিজস্ব পাওয়ারপ্ল্যান্ট বা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ ছোট্ট পাওয়ারপ্ল্যান্টের ব্যাপারেও যে মোহাম্মদ আলী স্যারের অবদান রয়েছে সে গল্প আমরা শুনব কিছুক্ষণ পরেই। তবে মনে আছে, সে রাত্রে অনেকেই বাসায় ফেরেনি, অনেকেই বুয়েটের হলগুলোতে চলে এসেছিল কারণ বাসায় গেলে যে বিদ্যুৎ পাবে না! আমি নিজেই ছিলাম তাদের মাঝে একজন।

ক’দিন বাদে কোনো এক ক্লাসে মোহাম্মদ আলী স্যার কথা বলতে বলতে হঠাৎ এই ব্ল্যাকআউটের প্রসঙ্গে চলে গেলেন। পত্রপত্রিকায় আমরা পড়েছিলাম বটে, কিন্তু তিনি তখন বিস্তারিতভাবে বলা শুরু করেছিলেন পুরো বিষয়টা কেন হয়েছিল। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেটা শোনা শেষ করলে তিনি বললেন, “এ জিনিস আপনাদের আর কেউ বলবে না।” আর কেউ বলেওনি।

একটা মানুষ নিয়ে এতগুলো কথা বলা হচ্ছে, অথচ তাঁর জীবনটা নিয়েই কিছু বলা হলো না। জন্ম তাঁর ১৯৫৬ সালের ২ জানুয়ারি। চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৭০ সালে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়, ঢাকা কলেজে পড়ালেখা করেন। এখান থেকেও তিনি পাশ করেন প্রথম শ্রেণীতেই, ১৯৭২-৭৩ সালে। এরপর ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হন, কিন্তু অতিরিক্ত সাধাসিধে মানুষটি স্পঞ্জের জুতো পরে ক্লাসে যেতেন। সেটি দেখে সেখানের শিক্ষিকা জানিয়ে দেন, স্পঞ্জ পরে আসা যাবে না ক্লাসে। সাধাসিধে জীবন বাদ দেবেন না বিধায় তিনি মেডিক্যালই ছেড়ে দেন। ভর্তি হন বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগে, এখানে তো আর তাঁকে কেউ স্পঞ্জ পরতে বাধা দিবে না। ১৯৭৮ সালে তিনি বুয়েট থেকে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করে যান। মাস্টার্সটাও এখান থেকে সেরে ফেলেন পরের বছর। ১৯৮০ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন বুয়েটে। দু’বছর প্রভাষক থাকবার পর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হয়ে যান। মাঝে চলে যান উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডাতে, ভর্তি হন Memorial University of Newfoundland-এ। সেখানে আবার মাস্টার্স করেন, এবার Power Electronics and Electrical Machines এর উপর, শেষ হয় ১৯৮৪-৮৫ সালে। একই বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ১৯৮৮-৮৯ সালে। বুয়েটে ফিরে এসে আবার শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৯৬ সালে প্রফেসর হবার পর বুয়েটে এ পদেই তিনি ছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। অবশ্য মাঝে ১৯৯৮ এর মার্চ থেকে ১৯৯৯ এর মার্চ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার মেলাকার মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি ছিলেন। ম্যাক নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মোহাম্মদ আলী চৌধুরী’ (MAC) নামের তুলনায়।

স্যার কানাডার যে ইউনিভার্সিটিতে পড়েছিলেন; Source: Bagsjar.com

তাঁর একাডেমিক সাফল্যের গাথা শুরু করলে আর শেষ হবে না। তবে সংক্ষেপে বললে, তাঁর নিজের জার্নাল ও অন্যান্য পাবলিকেশন ১০৪টি! ৬টি পিএইচডি থিসিস তিনি সুপারভাইজ করেন, আর মাস্টার্সের থিসিস ৫৩টি। পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্সে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। এগুলোর বিস্তারিততে না যাই বরং, আগ্রহীরা এখানে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন।

এই যে কয়েক পাতার কাগজ-কলমের জীবনীতে কি একটা মানুষকে জানা হয়ে গেল? একদমই না। তাঁর মেধা কত সেটা জানা গেল বটে, কিন্তু ভেতরের যে মানুষটি, তাঁকে জানতে হলে তাঁকে নিয়ে নানা মানুষের নানা ঘটনা না জানলে হবে না। দু’পাতার সিভি পড়ে কেউ জানতে পারবে না, বুয়েটের গাছগুলোর পাতায় পাতায় যে তাঁর কথা লেখা, জানবে না নামাজের ওয়াক্তে বুয়েটের বিল্ডিং থেকে তাঁর কণ্ঠে ভেসে আসা আজানের ধ্বনির কথা, লেখা নেই কত সহস্র মানুষের জীবন তিনি পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন!

সাদা মনের মানুষ মোহাম্মদ আলী স্যার আসলে কেমন ছিলেন সেটা জানবার জন্য আমরা বুয়েটের নানা বয়সের নানা অনুরাগীর কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো একত্র করেছি, যেন এতটুকু হলেও পাঠক বুঝতে পারেন এই মহামানবকে। যারা বুয়েটের নন, তাদের সুবিধার্থে অভিজ্ঞতার বেশ কিছু শব্দ সহজতর বিকল্প কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা হবে। ঘটনাগুলো শোনা যাক বরং তবে এখন।

নিশাত সুলতানা (EEE ’97)/ ৩১ জানুয়ারি, ২০১৮

একজন ভালো মানুষ শিক্ষক

২০০৪ সালের প্রথম দিকে যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা প্রায় শেষের পথে ,শুধু ফাইনালের রেজাল্ট বের হওয়া বাকি, তখন বাংলাদেশে একটা চাকরি খুঁজছি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও “প্রকৌশল” বা “ইঞ্জিনিয়ারিং” এ পড়াশোনা করা মেয়েদের সংখ্যা খুব কম। চাকরির বাজারও খুব ভালো না। অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ড জবে মেয়েদের ইন্টার্ভিউয়ে নেয়া হয় না এমন শুনছিলাম। কারণ ফ্যাক্টরিগুলো শহর থেকে দূরে যেখানে এখনো মেয়েদের থাকার মতো ভাল পরিবেশ নেই। টেলিকমের বুম তখনও হয়নি। তাই বিভিন্ন জায়গায় চাকরি খুঁজতে গিয়ে খুব তিক্ত অভিজ্ঞতা হচ্ছিলো। ইন্টারভিউতে মহিলা ক্যান্ডিডেট বলে কত যে অদ্ভুত প্রশ্ন। বেশিরভাগই ব্যক্তিগত- বিয়ে হয়েছে কিনা , ছেলে বন্ধু আছে কিনা , রাতে কাজ করতে আসতে পারবো কিনা ইত্যাদি। যেসব প্রশ্নের সাথে “ইঞ্জিনিয়ারিং” বিদ্যার কোনো যোগ নেই। তাই বেশ মনক্ষুন্ন ছিলাম।

এই ভগ্ন মনোরথে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম কিছু রেকমেন্ডেশন লেটার জোগাড় করতে। প্রতিটা চাকরিতেই শিক্ষকদের রেকোমেন্ডেশন লেটার লাগে। তাছাড়া TOEFL পড়ছিলাম বিদেশে মাস্টার্স-এ ভর্তি হওয়ার জন্য। সেখানেও ব্যাচেলার্স লেভেলের রেকোমেন্ডেশন লেটার দরকার। নিজের ডিপার্টমেন্টে গিয়েও মনটা খারাপ হলো। সিনিয়র শিক্ষকদের অনেকেই সময় দিলেন না। অনেকে “মেয়ে” হিসেবে বিয়ে করাটা চাকরির চেয়ে বেশি গরুত্বপূর্ণ এরকম উপদেশ দিলেন। খুব কষ্ট পেলাম। তখন শেষ ভরসা আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর তৎকালীন হেড স্যার মোহাম্মদ আলী স্যারের কাছে গেলাম। উনি আমার থিসিস শিক্ষক। থিসিস চলাকালীনই দেখেছি উনার রুম সবার জন্য অবারিত দ্বার। স্যার এর রুমে গিয়ে রেকমেন্ডেশন লেটার চাইলাম একাধিক, যেন একাধিক চাকরিতে জমা দিতে পারি। স্যার সাথে সাথে কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট আউট বের করে দিলেন।

এতক্ষণে মনে একটু জোর পেয়ে কাচুমাচু হয়ে স্যারকে বললাম, “স্যার আমি টোফেল পরীক্ষা দিবো সামনে। মাস্টার্স-এ এপ্লাই করতে কয়েকটা রেকমেন্ডেশন লেটার নিতে আসবো আরেকদিন।” স্যার বললেন, “নিয়ে যাবেন মনে করে যতটা লাগে। ভালো করে পরীক্ষা দেন।” বুক থেকে একটা পাষাণ নেমে গেলো আমার। স্যার সবাইকে আপনি করে বলতেন। ছাত্র-শিক্ষক, বড়-ছোট সবাইকে।

আমাদের সেই প্রিয় স্যার চলে গেলেন অন্য ভুবনের পথে। সকালে উঠে খবর শুনে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যদিও স্যার বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ, কিন্তু তবুও কেমন আশা করতাম হয়তো ভালো হয়ে যাবেন। এমন ভালো মানুষ আর কয়জন হয়? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িৎ কৌশল ডিপার্টমেন্টে এত জনপ্রিয় শিক্ষক খুব কম আছেন। নিজের ডিপার্টমেন্ট ছাড়াও সারা বিশ্ববিদ্যালয়েও উনার জনপ্রিয়তা কম না। ভালো রেজাল্ট করা তালিকায় থাকা শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর অনেকেই শিক্ষক হন। যাদের ভিতর হাতে গোনা কিছু শিক্ষক ক্লাসে ভালো পড়াতে পারেন। আর তার চেয়েও আরো কম কিছু শিক্ষক পারেন শিক্ষার্থীদের ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা দিতে অথবা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে নিজের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে সহযোগিতা করতে। আমাদের শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ আলী স্যার পেরেছিলেন এই তালিকার সবগুলোই। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ডিপার্টমেন্ট এ বিভিন্ন প্রজেক্টে খরচ করতেন। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রিন্টারসহ অন্যান্য অনেক সরঞ্জাম কিনতেন। আমরা যারা ওনার ক্লাস পেয়েছি তারা আসলেই অনেক ভাগ্যবান/ভাগ্যবতী। ক্লাস এবং ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের সাথে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতার সম্পর্ক রাখতেন, যা আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুব বিরল। কিন্তু আমাদের এই স্যার সেটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেসব শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় এগিয়ে থাকে তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকরাই কম বেশি এগিয়ে আসেন। কিন্তু পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের খোঁজ করা বা তাদের সাহায্য করা অথবা ভালো কিছু করার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়া খুব কম শিক্ষকই করেন। সেই কমের তালিকায় আমাদের মোহাম্মদ আলী স্যারকে খুঁজে পাওয়া যাবে। একজন ‘মহিলা ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে যে অনেক কিছু করার আছে এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ আছে সেই অনুপ্রেরণা তো স্যার এর দেয়া।

কয়েক বছর পরে আম্মার অসুস্থতার খবর শুনে দৌড়ে গেলাম বাংলাদেশে। তখন মাস্টার্স প্রায় শেষের পথে, একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরির অফারও পেয়েছি। এক ফাঁকে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে স্যার এর সাথে দেখা করলাম। স্যারকে বললাম আমার চাকরির খবর আর বললাম, “স্যার আপনার রেকমেন্ডেশন লেটার না পেলে আজকে হয়তো কিছু হতো না।” স্যার হাসছিলেন। বললেন, “আপনারা বিদেশে গিয়ে লেখা পড়া করবেন, চাকরি করবেন, তাতে তো আমাদেরই গর্ব, এতে রেকমেন্ডেশন বাধা হবে কেন?”

আমি জানি, যত সহজে স্যার একথা বললেন, অনেক শিক্ষক এটা চিন্তাও করতে পারবেন না। আরো জানি, আমার মতো আরো অনেক শিক্ষার্থীই তার কাছ থেকে নিঃসঙ্কোচে লেটার পেয়েছে। আর এখানেই সবচেয়ে বড় পার্থক্য। মনে আছে, আমরা যখন শেষ বর্ষে তখন স্যার আমাদের ব্যাচ এর জন্য বুয়েট মাঠে একটি বারবিকিউ বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যতটুকু জানি, এরকম অনুষ্ঠান আমাদের ডিপার্টমেন্টে আমাদের সময়ই প্রথম। স্যার নিজেই বার্বিকিউ তদারকি করেন। ওই বিদায় অনুষ্ঠানটি চিরদিন আমাদের শ্রেষ্ঠ স্মৃতির অংশ হয়ে থাকবে। একজন শিক্ষক হিসেবে শুধু না, মানুষ হিসেবেও খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। ক্যাম্পাস এ স্পঞ্জ পরে হেঁটে বেড়াতেন। শুনেছি, বিভিন্ন সময় অনেক ছাত্র/কর্মচারীদের আর্থিকভাবেও সাহায্য করতেন। আজকে প্রকৌশলী হিসেবে যে জায়গায় আছি তার জন্য আমার এই শিক্ষাগুরুর ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না। একজন শিক্ষক কেমন হওয়া প্রয়োজন এবং আমাদের দেশের সীমিত সম্পদের মাঝেও কীভাবে সব ধরনের শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা সম্ভব সেটা মোহাম্মদ আলী স্যার আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। ক্লাসে অনেকেই পড়ান, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের কাছে কতজন যেতে পারেন? আর তার চেয়েও বড় ব্যাপার, সব ধরনের ছাত্র-ছাত্রী, যেমন টিচার ফাইটার থেকে শুরু করে ব্যাকবেঞ্চার, সবার কথা শোনার মানসিকতা কয়জনের থাকে?

স্যার, আমি জানি, আপনি অন্য জগতে অনেক ভালো থাকবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা আপনার সব ছাত্রছাত্রীদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা আপনার জন্য সবসময় ছিল, থাকবে। পরম করুণাময়ের কাছে আপনার জন্য ‘রেকমেন্ডেশন লেটার’ এর কোনো অভাব হবে না।

আজকে অনেক ঘাটাঘাটি করে খুঁজে পেলাম আমাদের থিসিস পেপার। একজন ভালো মানুষের একটি স্বাক্ষর আছে আমার কাছে সেটাই বা কম কিসের?

Courtesy: Nishat Sultana

স্যারের সিগনেচার; Courtesy: Nishat Sultana

সাব্বির আহমেদ ইমন / ১৬ই জানুয়ারী, ২০১৫

একজন আলোকিত শিক্ষকের গল্প

২০০৭ এর ঘটনা। বুয়েট পাওয়ার প্ল্যান্ট ২ মেগাওয়াট থেকে ৪ মেগাওয়াটে এক্সটেনশন করা হবে। কয়েক দফা মিটিং এর পর সিদ্ধান্ত হলো, এবার বড় সাইজের ক্যাটারপিলার জেনারেটর কেনা হবে। আগের দুটো ১ মেগাওয়াট করে (G3516), এখন কেনা হবে ২ মেগাওয়াটের (G3520C) একটি। যথারীতি জেনারেটর সাইটে আসার পর স্টার্ট আপ পর্যন্ত প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম আমি। তখন পাওয়ার প্ল্যান্টের পরিচালক ছিলেন যিনি, তার সাথে প্রায়ই আমার বসা লাগতো।

ক্যাটারপিলার জেনারেটর; Source: CAT

প্রথম দিনের ঘটনা, আমাকে উনি সময় দিলেন ৯টায় যাবার জন্য। সময় মতোই গিয়েছিলাম বুয়েটে, কিন্তু উনার রুম যে ইএমই (EME) বিল্ডিং ছাড়া ওএবি’র (OAB) গ্রাউন্ড ফ্লোরেও আছে, জানতাম না। (EME Building হলো বর্তমান বুয়েট মূল ক্যাম্পাসের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ভবন আর OAB বা Old Academic Building মূল ক্যাম্পাসের আরেকটি ভবন।) আর এর চেয়ে বড়ো কথা, আমি ওই ডিপার্টমেন্টের ছাত্রও ছিলাম না। উনার সঠিক লোকেশন খুজে পেতে ৯টা ২০ বেজে গেলো। উনি তখন রুমের বাইরে তালা মেরে চলে যাচ্ছেন। উনার পরনে খুব সাধারণ একটা ইন করা ছাড়া হাফ শার্ট আর প্যান্ট। আর মজার ব্যাপার, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। আমি উনাকে বললাম, “স্যার, স্যরি, রুম খুঁজতে দেরী হয়ে গেলো। আপনার সাথে আমার মিটিং ছিলো।”

উনি আমার দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “মিটিং কয়টায় ছিলো? ৩০ মিনিটের টাইম আপনার কাছে ইম্পর্টেন্ট না হইতে পারে, আমার কাছে খুব ইম্পর্টেন্ট, তবুও আমি আপনার জন্য ৩০ মিনিট বসে ছিলাম। যেহেতু আপনি প্রথম আসলেন। এখন আমি আমার রুমে তালা দিয়ে দিসি, আপনি চলে যান।”

আমি একটু তেলতেলেভাবে বলতে গেলাম, “স্যার আর কখনো দেরী করবো না, আজ ক্ষমা করে দেন, খুব ক্রুশিয়াল ইস্যু ছিলো।”

উনি খুব ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “গেট আউট!”

আমি তখন ইয়াং, মন খুব নরম ছিলো, স্যারের ঝাড়িতে চোখ প্রায় ভিজে গেলো। মাথা নিচু করে বললাম, “স্যার, ঠিক আছে, কিন্তু পরে কখন আসবো? টাইম বলে দেন, আমি সময়ের আগে চলে আসবো।”

“যান, যান, পরে জানাবো।”

আমি চলে যাচ্ছি। উনি ডাক দিলেন। উনি আবার দরজা খুললেন, ভেতরে বসলাম। মনে হলো কোনো গবেষণাগারে প্রবেশ করলাম! খুব সাদামাটা একটা রুম। অনেক অনেক যন্ত্রপাতি, ড্রইং, আর আছে হাজারখানেক বই। উনি গম্ভীরভাবে বসলেন। আমাকে বললেন, “ঠান্ডা কিছু খাবেন?”

আমি খুশির ঠেলায় বলে ফেললাম, “জ্বী স্যার, খাবো।”

উনার রুমে নীল একটা ছোট ফ্রীজও ছিল। নিজেই উঠে আমার জন্য ক্যান কোক বের করে আনলেন।মনে মনে ভাবছিলাম, বুয়েটের স্যারের সাথে কোক খাচ্ছি, এই ব্যাপারটা কোনোভাবে সবাইকে জানাতে পারলে দারুণ হতো (তখন ফেসবুক জনপ্রিয় কিছুই ছিলো না)! স্যার গম্ভীর হয়েই বললেন, “কখনো কাউকে টাইম কমিট করে দেরীতে যাবেন না, এটা একধরনের প্রতারণা। কারন আপনি তার সময়টুকু থেকে তাকে বঞ্চিত করলেন। আমি ৮টা ৪৫ থেকেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার পিয়নকে ইলেক্ট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টে পাঠাইসিলাম, মনে হইসিলো আপনি ঐখানেই গেসেন, পান নাই।”

আমি স্তব্ধভাবে কোক খাচ্ছি। বুয়েটে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত পড়েও এই রকম মানসিকতার কোনো স্যারকে তো পাই নাই! উনি শুরু করলেন। প্রথমেই উনার কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে বললাম যে, আমি মেকানিক্যালের। ইলেক্ট্রিক্যালের অনেক কিছু আমি হয়তো ঠিক মতো বোঝাতে পারবো না।

স্যার আমাকে বললেন, “আমরা মেকানিক্যাল বা ইলেক্ট্রিক্যাল কিছু নিয়ে আলোচনা করবো না, আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে আলোচনা করবো। আপনি যেমন অনেক কিছু জানেন না, আপনিই বা কী মনে করেন? আমি ইলেক্ট্রিক্যাল এর জাহাজ! আমিও অনেক কিছু জানি না। আমরা নলেজ শেয়ার করবো, ইঞ্জিনিয়াররা এটাই করে!”

কথাগুলো উনি অসম্ভব কোমল গলায় বললেন। জানি না কেন যেন এই অসাধারণ ব্যবহার আশা করি নি। আমার সত্যিই বুকটা ফুলে গেলো স্যারের জন্য। ওই থেকে আমার শুরু। এরপর পাওয়ার প্ল্যান্ট কমিশনিং এর আগ পর্যন্ত ৮/১০ বার স্যারের সাথে মিটিং করেছি। একদিন প্ল্যান্টে আমার ডিজাইন করা সাইলেন্সারের সাউন্ড অ্যাটিনিউয়েশন সিস্টেম দেখে উনি বললেন, “দিস ইজ ইঞ্জিনিয়ারিং”– আমার মনে হয় আমার চার বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং সার্টিফিকেট ছিলো স্যারের এই কমেন্টটা, কাগজের সার্টিফিকেটের কী-ই বা মূল্য!

বুয়েটে একটা কাজের জন্য শত জায়গায় দৌড়ানো লাগে। স্টুডেন্ট অবস্থায়ও এত জায়গা চিনতাম না। আর্কিটেক্ট অফিস, সিভিল অফিস, এনভায়রনমেন্ট অফিস- সব। নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো, প্রচণ্ড কষ্ট হতো, একেক জায়গায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো। একদিন স্যার কে বললাম, স্যার জবাব দিলেন না। কী আর করার, এভাবেই চলতে হবে। পরের দিন সিভিল অফিসে গিয়ে দেখি অবস্থা অন্যরকম! কী এক কাজে সিভিল আর স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার এর সই লাগবে। সিভিল ইনচার্জের সাইন দুই মিনিটে হয়ে গেলো, উনি নিজেই এরপর দৌড়ে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের সই আনতে গেলেন। আমাকে পিয়ন চা দিয়ে গেলো। আমি জিজ্ঞেস করি, ঘটনা কী? পিয়ন মামা বলেন, “কাল বিকালে প্ল্যান্টের ডাইরেক্টর স্যার আইসিলো। কইয়া গেসে, আপনের কাজগুলা যেন ঠিকমতো দেখা হয়।” আমি খুশিতে গদগদ। আমি বলি, “স্যার খুব ঝাড়ি মারসে, না?” পিয়ন মামা খুব অবাক হয়ে বললেন, “ঝাড়ি! স্যার তো ঝাড়ি মারেন না, উনি কিছু বললে এমনিই সব হইয়া যায়।”

স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম আমি দেখেছি। ক্লাস নেয়ার পাশাপাশি পড়াশোনা, পাওয়ারপ্ল্যান্ট, ছাত্রদের খোঁজখবর- সব কিছু উনি একসাথে করতেন। অনেক পরিশ্রমের পরও উনি মাঝে মাঝে ক্লান্ত গলায় বলতেন, “কিছুই তো হচ্ছে না এখনো, আমার কথা দেয়া টাইমে প্ল্যান্ট সিনক্রোনাইজ করে চালু করতে চাই, পারবো না?” আমি প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকাতাম। উনি আমাকে বকা দিতেন, “মাথা ঝাঁকাবেন না, মুখে বলেন।”

একদিন স্যার বুয়েটের নতুন ইলেকট্রিক্যাল বিল্ডিং করার সময় আমার সামনে দাঁড়িয়ে বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলছিলেন, “বিল্ডিংটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে।” মুখে ছিলো তৃপ্তি। আমার মনে হচ্ছিলো, বিল্ডিংটা স্যারের নিজের সন্তান। সত্যিই তাই, বুয়েটের প্রতিটা অংশ, প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রী তার সন্তান, তার ভালোবাসা।

উনার পরিশ্রম বৃথা যায়নি। স্যার টেকনিক্যাল বোর্ডে জেনারেটর কেনার আগে বলেছিলেন, ৬০ দিনে ৪ মেগাওয়াট পাওয়ার টেষ্ট করা হবে। আমরা ৫৬ দিনে পাওয়ার সাপ্লাই করেছিলাম। স্যার ছাড়া আমার মতো লিলিপুট প্রকৌশলীর পক্ষে সম্ভব ছিলো না এই কর্মযজ্ঞ সময় মতো শেষ করা। এই কাজপাগল অসম্ভব ভালো মানুষটা আমার দেখা একজন শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী।

একদিন উনি আমাকে বলেছিলেন, “আপনি কি মনে করেন আপনি শুধু বুয়েট থেকে পাশ করেছেন আর আপনার ভুল মাফ আর প্রজেক্টে ভালো কিছু হলে আপনাকে বাহাবা দিবো! না। বুয়েট বলতে কিছু নাই, আপনাকে ভালো ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। বুয়েট তো আর ইঞ্জিনিয়ার না, আপনারা ইঞ্জিনিয়ার। মানুষ বুয়েটকে চিনে না, চিনে বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারদের। ভালো থাকবেন।”

উনার সাথে এরপর পিডিবির এক মিটিংয়ে দেখা হয়েছিলো। শ্মশ্রুমন্ডিত নিপাট ভালো মানুষটাকে দেখে সবার সামনে পা ছুঁয়ে সালাম করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। আমি সামনে গিয়ে পরিচয় দিলাম। চিনতে পারলেন না ভালোমতো। আমার কষ্ট লাগলো না। উনি হাজার হাজার কাজে ব্যাস্ত, পাঁচ/ছয় বছর পর আমাকে কিভাবে মনে রাখবে!

উনি আবার ডাক দিলেন। আমাকে বললেন, “শোনেন, ভালো ইঞ্জিনিয়ার হবেন। ভালো থাকবেন।”

স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সততা, ভালোবাসা, নিষ্ঠা। আমার ডিপার্টমেন্টের স্যার উনি নন, এরপরও বুকে হাত রেখে আমি বলবো, আমার দেখা বুয়েটের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক তড়িৎ কৌশলের প্রফেসর ড. মোহাম্মাদ আলী চৌধুরী।

উনি অনেক ভালো থাকুন, সুস্থ শরীরে থাকুন। আলোকিত মানুষ অন্যকে আলোকিত করে। উনি প্রমাণ করে গেছেন বহুবার।

ইসিই বিল্ডিংটা যেন স্যারের নিজের সন্তান; Source: Fiveprime

আমিন শিমুল/ ৩১ জানুয়ারি, ২০১৮

আমি (কানাডার) মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। দেশের লোক এর নাম না চিনলে প্রতিবারই বলে এসেছি, মোহাম্মদ আলী স্যার যে ভার্সিটিতে ছিলেন আমি সেখানে পড়ি। এটা বলবার সময় আমার মাঝে এক ধরনের গর্ব কাজ করত।

এখানে আসার পরে আমার এক বন্ধু একদিন জিজ্ঞেস করতেসিলো, “তোমাদের ডিপার্টমেন্টের আলি সাধুরি কে?”

চট করে আমি বুঝতে পারি না। আমি জানতে চাইলাম, “কেন?”

সে জানাল, তাকে ইলেক্ট্রিক্যাল ল্যাবের টেকনিশিয়ান বাংলাদেশি শুনেই আলি সাধুরিকে চিনে কিনা জিজ্ঞেস করেছে। কারণ তার কাছে বাংলাদেশির পরিচয় আলি সাধুরির সূত্রে এবং তার সিমপ্লিসিটি দেখে সে মুগ্ধ। আমি তখনই বুঝে যাই, এই আলী সাধুরি আসলে আমাদের মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার।

বুয়েটে থাকাকালীন স্যারের সাথে আলাদাভাবে কথা বলবার সুযোগ হয় নি। তবে বুয়েটের প্রথম ক্লাসেই তার টিচিংয়ের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা বুয়েটিয়ানরা যেখানে সুযোগ পেলেই কে কার চেয়ে কত বড় ওস্তাদ তা প্রমাণে ব্যস্ত থাকি তার বিপরীতে স্যারের প্রথম ক্লাসের কথা খুব মনে পড়ে। হুবহু মনে করতে পারছি না, তবে যতদূর মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, “আপনারা উচ্চমাধ্যমিকে অনেক ভালো ফলাফল করে এখানে এসেছেন। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং কিন্তু আসলে ভালো স্টুডেন্টদের জন্য না। এটা মিডিওকারদের জায়গা।”

কথাটা কতটুকু সত্যি সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু প্রথম ক্লাশে একজন প্রফেসর যখন এই কথা বলে তা ছাত্রদের অনেক বেশি কনফিডেন্ট করে তোলে।

স্যারের কাছে রেকমেন্ডেশনের জন্য যাই ২০০৯ এ। মেমোরিয়ালে এপ্লাই করি শুনে জানতে চাইলেন, কার কাছে যাই। আমি উত্তর দেয়ার পরে বললেন, “যান আর যাবার আগে শীতের প্রস্তুতি নিয়ে যাইয়েন।” তখনই আসলে জানতে পারি যে আমি তাঁর ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি।

মাস্টার্স শেষে যখন দেশে আসি, দেখা করতে যাই স্যারের সাথে। তখনও স্যার যথেষ্ট অসুস্থ। এর মধ্যেই আমাকে রুমে নিয়ে বসতে দিলেন। মেমোরিয়াল থেকে আসছি শুনে মেমোরিয়ালের তাঁর সময়ের বিভিন্ন জনের খোঁজ নিলেন। বলাই বাহুল্য, তার সময়ের অনেকেই এখন নেই। তারপরেও খুটিনাটি অনেকের খবরই বললাম।

শুরুতে বলা সেই ল্যাব টেকনিশিয়ানের কথাও তিনি জানতে চেয়েছিলেন। ত্রিশ বছর আগের পরিচিত ল্যাব টেকনিশিয়ানের প্রতি তার যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, সেটাই আসলে বলে দেয় মানুষ হিসেবে তিনি কতটা বড় মাপের। আজকের যুগে যেখানে আমরা ‘যদি’, ‘তবে’, ‘কিন্তু’ ছাড়া আরেকজনের ভালো বলবার আগে সংকোচ বোধ করি, এই যুগের সাথে স্যার ছিলেন বেমানান।

মোহাম্মদ আলী স্যার নেই। কিন্তু তার লাইফস্টাইল থেকে শেখবার অনেক কিছুই আছে। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা আমি চেষ্টা করি সেটা হলো মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। এই জিনিসটির বড়ই অভাব আজকের যুগে, বিশেষত যদি মানুষটি বয়সে ছোট বা পদে অধস্তন হয়। যেখানেই থাকুন, তাঁর মতো অসাধারণ মানুষ অবশ্যই ভালো থাকবেন।

স্যারের কানাডার ইউনিভার্সিটি, Memorial University of Newfoundland এর Core Science Facility; Source: Entuitive

শিহাব উল্লাহ /৩১ জানুয়ারি, ২০১৮

মোহাম্মদ আলী স্যারের ওপর অনেক অভিমান জমে ছিলো। শেষবার যখন দেশে গিয়েছিলাম, কিছুতেই তখন দেখা করতে চাইলেন না। ফোনে বলেছিলেন, ভীষণ ক্লান্ত লাগে সবসময়, কথা বলতে ইচ্ছে হয় না (তার কিছুদিন পরই স্যারের ক্যান্সার ধরা পড়ে)। সেই শেষ কথা বলা স্যারের সাথে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন!

স্যারকে প্রথম দেখি চট্টগ্রামে ওনাদের পৈত্রিক বাড়িতে। তখনও বুয়েটে ভর্তি হইনি- সবে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছি। স্যারের বাবা কর বিভাগে আমার বাবার অনেক সিনিয়র সহকর্মী। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, বড় অমায়িক ভদ্রলোক। ওনাকে দেখতেই বাবার সাথে ওনাদের বাড়িতে যাওয়া।

তখন ঈদের ছুটি চলছে। স্যারের ভাই-বোনেরা মিলে বাড়িতে গমগম অবস্থা। বাড়ির সব সন্তান নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতি- এক ভাই ডাক্তার, একজন কূটনীতিবীদ (অন্যদের কথা পরিষ্কার মনে নেই)। স্যারের বাবা জনে জনে ডেকে বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম দেখায় স্যারকে দেখে একটু সংকোচ বোধ করছিলাম- মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে স্থির দৃষ্টির গম্ভীর ধরনের মানুষ এবং খুব আলাপী নন। সেদিন স্যারের সাথে খুব অল্পই কথা হয়েছিলো। উনি খুব অল্প কথায় কেন তড়িৎ কৌশল পড়া উচিত সেটা বুঝিয়ে বলেছিলেন (বাবা অনুরোধ করেছিলেন বিষয় নির্বাচন নিয়ে আমাকে খানিকটা পরামর্শ দিতে)।

সাদাসিধে পোশাকের সেই মানুষটার কথা বেশ মনে ধরেছিলো সেদিন। বাড়ি ফেরবার পথে পণ করেছিলাম, বুয়েটে পড়লে তড়িৎ কৌশলেই পড়তে হবে। সময় গড়ায়, কিছু মাস পরে বুয়েটে পড়ার সুযোগ মেলে অবশেষে, ভাগ্যক্রমে সেই তড়িৎ কৌশলেই। আরো সৌভাগ্য, প্রকৌশল বিষয়ে হাতেখড়ি হবে মোহাম্মদ আলী স্যারের হাতেই (স্যার সে বছর ডিসি সার্কিট এনালাইসিস কোর্স নিয়েছিলেন)। স্যারের ক্লাস নেয়ার ধরণ বড্ড সাদামাটা। ক্লাসে এসে রোল কল করতেন না (মাসে বা সেমিস্টারে একবারই একটা কাগজে সিগ্নেচার দিতে হতো)। এসেই ব্ল্যাক বোর্ডে প্রথমে খস খস করে লিখে ফেলতেন অনেক কিছু। এরপর বোঝাতেন সব আস্তে আস্তে করে। কিছুদিন পর (ততদিনে অন্যদের ক্লাস করে কিছুটা পোক্ত হয়েছি) একটু একটু করে বুঝতে শিখি স্যারের সাদামাটা পড়ানোটাই কতটা অসাধারণ! আমার ধারণা, আমাদের ব্যাচের সবার ডিসি সার্কিট এনালাইসিসে ভিত ভীষণ শক্ত শুধুমাত্র মোহাম্মদ আলী স্যারের পড়ানোর কারণে। কোনো বিষয়ে খুব ভালো দখল না থাকলে অমন সহজ করে পড়ানো সম্ভব না। এটা সবাই বুঝতো বলেই ক্লাসে উপস্থিতির হার সবসময় শতভাগ (আমি মোহাম্মদ আলী স্যারের কোর্স ছাড়া বুয়েটের কোনো কোর্সেই উপস্থিতির জন্য ৩০% নম্বর পাইনি, ক্লাস করতে ভালো লাগতো না বলে।)।

স্যারের একটা কথা আমাদের মধ্যে প্রবাদ পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো, “বেশি গবেষণা করবেন না, বেশি গবেষণা করলে আমার মতন স্যান্ডেল পরে চলাফেরা করতে হবে।” স্যার সবসময় বেসিক শক্ত করার জন্য জোর দিতেন। সত্যিকারের রিসার্চ করবার জন্য ওনার কাছে স্নাতক পর্যায় আরো উপযোগী মনে হতো বলেই হয়তো। আমরা ১-২ শেষ করার পর একটা পত্রিকা বের করেছিলাম ‘শুন্য দুই’ নামে। গল্প-কবিতার পাশাপাশি ব্যাচের প্রত্যেকের জন্য একটা প্রোফাইল বরাদ্দ ছিলো (কী ভালো লাগে, অবসরে কী করি ইত্যাদি)। প্রিয় ব্যক্তিত্বের ঘরে সবচাইতে বেশি মানুষ লিখেছিলো মোহাম্মদ আলী স্যারের নাম। আমাদের মনের মধ্যে পাকাপাকি দাগ কাটতে স্যারের কেবল একটা টার্ম লেগেছিলো!

বছর চারেকের বুয়েট জীবনে প্রয়োজন/অপ্রয়োজনে স্যারের অফিস/বাড়িতে হানা দিয়েছি। স্যার থাকতেন টিচার্স কোয়ার্টারের লাল বাড়িগুলোর একটাতে- ছোটখাট এপার্টমেন্ট, ‘না হলেই নয়’ ধরনের আসবাব। স্যার চিরকুমার, এক ভাগনে পড়াশোনার জন্য থাকতেন ওনার সাথে, আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যখনই যেতাম, স্যার না খাইয়ে ফেরাতেন না। অনেক সময় হলের বন্ধুদের জন্যও খাবার দাবার বেধে দিয়েছেন।

উপদেশ দিতেন পড়াশোনায় মন দিতে, বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে (আমি তখন পড়াশোনা ছাড়া আর সব কিছুই করে বেড়াচ্ছি কিনা!)। স্যারের আপত্য স্নেহ আমার মতন অনেককেই এভাবে পথ দেখিয়েছে।

আমরা যারা ইলেকট্রিক্যাল ডে/ফেস্টের সাথে বিভিন্ন সময় জড়িত ছিলাম, তাদের কাছে স্যার সব সময়ই একটা বড় আশ্রয় ছিলেন। বাজেটের সমস্যা? স্যারের কাছে ছুটে গেলেই একটা উপায় হতই। প্রশাসনিক জটিলতা? স্যার সহায়! এমন কত কত ক্ষেত্রে স্যার যে ত্রাণকর্তা হিসেবে আমাদের উদ্ধার করেছেন, তা গুণে শেষ করা যাবে না। রাত্তির জেগে বন্ধু পারি, ফাহিম, এমিল, বনি, রনিরা মঞ্চ তৈরীর কাজ করতো ডে’র জন্য। স্যার খুব নিয়ম করে প্রত্যেকবার ওদের খবর নিতে সশরীরে যেতেন, খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা করতেন।

স্যার অকৃতদার হলেও ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে নিজের সন্তানের মতন দেখতেন, ভালো-মন্দের খোঁজ নিতেন, যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। ইলেক্ট্রিক্যালের ছাত্রছাত্রী মাত্রেই জানে রেকমেন্ডশনের মধ্যে জোগাড় করা লাগবে আসলে ১টা- মোহাম্মদ আলী স্যার আর মতিন স্যারেরটা নিশ্চিত ধরে। এমন ভরসার যায়গা ক’জন হতে পারে এ যুগে?

মোহাম্মদ আলী স্যারের সাথে দেখা না হলে কখনও বোঝা হত না ‘সন্ত’ (Saint) ধরনের মানুষ বাস্তবে থাকতে পারে। সত্যিকারের আলোকিত মানুষ, খাঁটি মানুষ। অভিমানের কথা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। সবার ওপর অভিমান করা যায় না। অভিমান করতে মানুষটার ওপর অধিকার লাগে। ‘আমার স্যার’ এতটাই বড় মানুষ ছিলেন যে সেই অধিকারটা আমরা সবাই নি:সংকোচে নিয়ে নিয়েছিলাম! ভালো থাকবেন, স্যার – একটা গর্ব আমার সবসময় থাকবে যে আমি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর ছাত্র।

মাসুদ করিম খান (CSE)/ ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

মোহাম্মদ আলী স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, আবার ছিলেনও। ভিন্ন ডিপার্টমেন্ট হওয়ার কারণে আন্ডারগ্র্যাডে আমরা ওনার কোনো ক্লাস পাইনি। বুয়েটে লেকচারারশিপের সুবাদে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল, ওষুধ গেলার মতো ক্লাসে যেতাম। মাস্টার্সে দুটো ক্লাস আগ্রহ নিয়ে করেছি, একটা পড়াতেন কায়কোবাদ স্যার, আরেকটা মোহাম্মদ আলী স্যার। সেই সুবাদে উনি আমার শিক্ষক।

মাস্টার্স করতে যখন দেশের বাইরে যাবো, নিজ ডিপার্টমেন্টের স্যারদের পাশাপাশি মোহাম্মদ আলী স্যারের কাছেও গেলাম রেকমেন্ডেশন লেটারের জন্য। যেখানে বেশিরভাগ স্যারই বললেন, “নিজে কিছু একটা লিখে নিয়ে আসো, আমি এডিট করে সাইন করে দিবো”, মোহাম্মদ আলী স্যার বললেন, “নাম আর ব্যাচ লিখে দিয়ে যান, পরশুদিন এসে লেটার নিয়ে যাবেন।” ওনাকে বললাম, “স্যার, আমি সিএসই ডিপার্টমেন্টের, ইলেকট্রিক্যালের না। আপনি হয়তো আমার সম্বন্ধে জানেন না। আমি লিখে আনি, আপনি চেক করে দেন?” স্যার বললেন, “আপনার সম্বন্ধে না জানলে খোঁজ করে জেনে নিবো, আপনি চিন্তা করবেন না।” এই হচ্ছেন মোহাম্মদ আলী স্যার, সবার থেকে ব্যতিক্রম। সবচেয়ে ভালো রেকমেন্ডেশন দিয়েছিলেন উনিই, পুরো লেখাটাতে পারসোনাল টাচ ছিলো।

যেহেতু দেশে গেলে বুয়েটে সবসময়ই যাই, কয়েকজনের সাথে দেখা না করলে বুয়েট সফর অসম্পূর্ণ থাকে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদ আলী স্যার। আগেই বলেছি, উনি আমার আন্ডারগ্র্যাডের শিক্ষক না, অসম্পূর্ণ মাস্টার্সের শিক্ষক। তারপরেও স্যারের সাথে একটা হৃদ্যতা অনুভব করতাম, হয়তো সেই রেকমেন্ডেশন লেটারের জন্যই। স্যারের সাথে কয়েকটি অতি সাধারণ স্মৃতি শেয়ার করলাম এখানে।

২০০১ সাল সম্ভবত। এক মাসের জন্য দেশে গিয়েছি। প্রায় দিনই বুয়েটে যাই। আজ এর রুমে, কাল ওর রুমে আড্ডা দেই, আমার অনেক বন্ধু এবং জুনিয়র তখন বুয়েটের শিক্ষক। সিনিয়র স্যারদের নজরে পড়লে সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাই। একদিন মোহাম্মদ আলী স্যার আমাকে দেখে রুমে ডাকলেন। “কী ব্যাপার, আপনি না আমেরিকাতে চলে গিয়েছিলেন? এখানে কী করেন?” স্যারের স্মৃতিশক্তি দেখে চমৎকৃত হলাম। বললাম, “স্যার, এখন চাকরি করি। ছুটিতে দেশে এসেছি।” স্যার বললেন, “বিয়ে করবেন? হাতে ভালো পাত্রী আছে।” আমি সবিনয়ে বললাম, “স্যার, আমেরিকা যাওয়ার আগেই এই কাজ সেরে ফেলেছি।” স্যার হেসে বললেন, “তাহলে আর বুয়েটে আসেন কেন? সবাই তো বাইরে থেকে বুয়েটে আসে পাত্রী খুঁজতে।”

২০১৪ সাল। সিএসই এবং ইইই এখন ইসিই ভবনে। কায়কোবাদ স্যার আর মোহাম্মদ আলী স্যারের রুম পাশাপাশি। ভালোই হলো, এক ঢিলে দুই পাখি, অর্থাৎ দুই প্রিয় ব্যক্তিত্বের সাথে দেখা হয়ে যায়। কায়কোবাদ স্যারের সাথে গল্প করে গেলাম মোহাম্মদ আলী স্যারের রুমে। অসম্ভব স্মৃতি শক্তি স্যারের। মাঝে কয়েক বছর দেখা হয় নাই, ঠিকই চিনে নিলেন। অনেক কথার মাঝে মজা করে বললেন, “বুঝেছেন খান সাহেব, এই যে দেয়ালটা দেখছেন এটা হচ্ছে সিএসই আর ইইই ডিপার্টমেন্টের নো ম্যান্স ল্যান্ড। কায়কোবাদ সাহেব আর আমি সারাদিন দুইদিকের বর্ডার পাহারা দেই। বুয়েটে এসে আর কাউকে না পেলেও আমাদের দুইজনকে পাবেন।”

২০১৬ সাল। স্যারের সাথে শেষ দেখা। স্যারকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। উনি যে এমন দুরারোগ্য ব্যাধি বহন করে চলছেন জানতাম না। এতো কথা বলতেন, কিন্তু কোনদিন অসুখের কথা বলেন নাই। কুশল বিনিময়ের পর অন্য এক স্যারের কথা জিজ্ঞেস করতে বললেন, “উনি তো রিটায়ারমেন্টে চলে গেছেন।” স্বগতোক্তি করলেন, “সবাই চলে যাচ্ছে।” আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আবার কবে আসবেন?” আমি বললাম, “স্যার আগামী বছর আসার ইচ্ছা আছে।” স্যার বললেন, “আচ্ছা যান তাহলে। আমাকে এখানেই পাবেন, যদি বেঁচে থাকি!”

২০১৭ তে দেশে গিয়ে আর স্যারের সাথে দেখা হয়নি। স্যার তখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অনুজপ্রতিম মিনহাজের (Minhaz Khan) লেখা থেকে স্যারের আপডেট পেতাম। ওর সাথে যখন দেখা হলো, প্রায় কেঁদেই ফেললো, স্যারের অবস্থা প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে।

এইরকম মাটির মানুষ আগামী ১০০ বছরে বুয়েট আবার পাবে কিনা সন্দেহ। আল্লাহ পাক স্যারকে বেহেস্ত নসিব করুন।

কাজী নাজমুল হাসান (EEE ’00) / ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

স্যার ফার্স্ট সেমিস্টারে আমাদের ল্যাব নিয়েছিলেন। এরপর থেকে দেখা হলে স্যার খোঁজ-খবর নিতেন।

ইলেকট্রিকাল ডে এর প্রোগ্রাম ছিল ২০০২ সালে। মোহাম্মদ আলী স্যার তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, “জীবন কী জিনিস বুঝতে হলে বিদেশে যেতে হবে। এখন তো বাবা-মা সব করে দেয়। আরামে আছেন। বিদেশ যান। একা থাকবেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই চিন্তা করবেন যে ‘খাবো কী?’ তখন বুঝবেন জীবন কী!” স্যার এর এই কথাগুলো নিয়ে আমি অনেক ভাবতাম!

স্যার থার্ড ইয়ার এ আমাদেরকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রনিক্স পড়ালেন। কঠিন সার্কিটগুলো স্যার সহজেই আঁকতেন। লেকচার সহজেই বোঝা যেত। পড়াগুলো মনে গেঁথে থাকতো। স্যার এর পড়াগুলো ভোলার নয়।

ফোর্থ ইয়ারে একদিন স্যার এর কাছে গেলাম। বললাম, “স্যার বাইরে স্কলারশিপ নিয়ে যেতে চাই।”

স্যার বললেন, “কাসেম এর কাছে এপ্লাই করেন| নোটিশ বোর্ড এ গিয়ে এড দেখেন।”

আমি ড. কাসেম স্যার এর কাছে এপ্লাই করলাম ইউনিভার্সিটি অফ তাসমানিয়াতে। কাসেম স্যার স্কলারশিপ এর প্রমিস করলেন। সব ডকুমেন্টস পাঠাতে বললেন। আবার মোহাম্মদ আলী স্যারের কাছে গেলাম, “স্যার, রেফারেন্স লেটার লাগবে।”

স্যার বললেন, “কালকে এসে নিয়ে যাবেন।” পরের দিন গিয়ে দেখলাম স্যার আমার জন্য রেফারেন্স লেটার লিখে খামে করে অফিস সহকারীর কাছে রেখে দিয়েছেন| মাস্টার্স এর স্কলারশিপ নিয়ে ২০০৭ এ তাসমানিয়া চলে গেলাম।

দেশে গেলেই স্যার এর কাছে যেতাম। স্যারের কথা শুনতাম। ভালো লাগতো। ২০০৭ এ দেশ ছাড়ার পর ১১ বছরে ১১ বার দেশে গিয়েছি। প্রায় প্রতিবার স্যারের কাছে গিয়েছি। স্যারের সাথে শেষ দেখা ২০১৫ এর জুলাইতে। ২০১৬-তে দেশে গিয়ে (বেবি হস্পিটালাইজড থাকায়) সময় করে বুয়েট এ যেতে পারিনি।

২০১২-তে গেলাম। পিএইচডি শেষের দিকে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ে করছেন?” মাথা নাড়লাম, না। স্যার মোবাইল ফোনে কথা বললেন। একটা পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ছাত্র-শিক্ষকের পরিচয় ছাপিয়ে স্যার ব্যক্তিগত বিষয়েও পরামর্শ দিতেন। খুব বেশি আন্তরিকতা না থাকলে এটা করা যায় না।

২০১৩-তে স্যারের কাছে গেলাম। পিএইচডি শেষ। কী করবো? স্যার বললেন, “অস্ট্রেলিয়াতে এখন জব নাই। অন্য কোথাও ট্রাই করেন।” সময়টা আসলেই ভালো ছিল না। তিন মাস জব ছাড়া থাকলাম। তারপর ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টারে জব নিয়ে ইউকে-তে মুভ করলাম। OAB building এর আধো আলো-ছায়ার রুমে বসে স্যার জানতেন দুনিয়ার কোথায় জব আছে, কোথায় যেতে হবে।

২০১৫ এর জুলাইয়ে স্যার এর সাথে শেষ দেখা। স্যার বিসকুট আর কোক খেতে দিলেন। বললাম স্যার দেশে ব্যাক করতে চাই। স্যার মোবাইল বের করে দুটো নাম্বার দিলেন। MIST অথবা IUT তে যেতে বললেন। তারপর জানতে চাইলেন কেন দেশে ফিরতে চাই। বললাম বাবা মা’র দেখা-শোনা করার কথা। স্যার বললেন, “কাছে থেকে কী করবেন? টাকা দিবেন, চিকিৎসা হবে। টাকা না থাকলে, হাসপাতালে বইসা কাইন্দা লাভ হবে?” এত সহজ করে এতো কঠিন কথা বলা যায়! আমি অনেক ভাবলাম স্যারের কথাগুলো। মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েনের এর চেয়ে সহজ সমাধান হয়তো আর নেই!

স্যার আরো বললেন, “আগে ছাত্রদেরকে দেশে ফিরার কথা বলতাম। এখন আর বলি না। বাইরেই থাকেন। দেশের অবস্থা ভালো না।” ২৬ বছর আগে সব সুযোগ, সম্ভাবনা, সঞ্চয় আর স্বপ্ন নিয়ে কানাডা ছেড়ে বুয়েটে ফিরে এসে মোহাম্মদ আলী স্যার ২০১৫ সালে আমাকে বললেন, “বাইরেই থাকেন। দেশের অবস্থা ভালো না।”

বইয়ের পাতায় যে বাতিঘরের কথা পড়তাম, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার ছিলেন আমাদের বাতিঘর। পথ চলতে চলতে পথ হারালে স্যার এর কাছে যেতাম। স্যার পথের দিশা দিতেন। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্যার এর পরামর্শ আর সহযোগিতা পেয়েছি। স্যারের স্নেহ, মমতা, সহযোগিতা আর পাবো না এটা ভাবতে পারি না।

আমি ভাবি, আবার যখন দেশে যাবো, বুয়েটে যাবো। স্যার এর রুম এর খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিবো। স্যার বলবেন, “আসেন, ভেতরে আসেন। কবে আসছেন?”

আমাদের বাতিঘর, আমাদের আলো, আমাদের মোহাম্মদ আলী স্যার আমাদের মাঝে থাকবেন সব সময়। আমাদের প্রার্থনা স্যারকে ঘিরে থাকবে সবসময়। স্যারের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। পরম করুণাময় স্যারকে মর্যাদাপূর্ণ আসনে রাখুন!

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব/ ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার উচ্চমানের বিকাশ ও জনপ্রিয়করণে রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষাবিদ শিক্ষা ও ব্যক্তিত্বের আলো ছাড়িয়ে শিক্ষার্থী মননে দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছেন কিনা, তা বিতর্ক সাপেক্ষ। তবে একজন ছিলেন যিনি সুবিধাবাদী, অলস, অসৎ ও লোভীদের সমাজে স্রোতের বিপরীতে চলে মহৎ প্রাণের জানান দিয়ে গেছে জীবনব্যাপী, মেধা ও মননে, উচ্চমান কর্ম ও কর্ম গভীরতায়। তাঁর প্রতিটি চিন্তা ছিল প্রয়োগমুখী, প্রতিটি চর্চা ছিল মহৎ ও নিবেদিত। ‘মানুষ’ এর অভাব থাকা ‘ব্যক্তিত্ব’হীন সমাজে ব্যতিক্রমধর্মী এই শিক্ষাবিদ “মানুষ” ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। স্রোতের বিপরীতে চলা শক্তিশালী মনোবলের একজন নিবেদিতপ্রাণ, প্রচারবিমুখ ও সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত শিক্ষাবিদ ছিলেন তিনি। প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ২৯ জানুয়ারি। জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ, কীর্তিমান, মহানুভব, সহজ, সরল সর্ব শ্রদ্ধেয় এই মাটির মানুষটিকে সমাজ কতটা মনে রাখবে এবং কীভাবে মনে রাখবে সেই আলোচনা টানা জরুরি।

কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ ট্রেন্ডের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কোর্স কারিকুলাম ডাইনামিক করা ও সেভাবে বিভাগ ও সাবজেক্ট বিন্যস্ত করা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাকে ইন্ডাস্ট্রির সংযোগ দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় থিসিসের পরিসর বাড়ানো, রিসার্চ বেইজ উচ্চমান করা, শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালুর মত বহু কাজের চিন্তা ও চর্চা করেছেন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। শিক্ষকদের কমফোর্ট জোন থেকে বের করে এনে নিবেদিত করার প্রচেষ্টা যেখানে দেশের আমলাতান্ত্রিক শিক্ষা প্রশাসন, অলস ও ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের দ্বারাই ব্যহত হয়েছে সেখানে একজন শিক্ষক হয়েও প্রফেসর চৌধুরী আক্ষরিক অর্থেই বছরের পর বছর ফজর থেকে এশা পর্যন্ত সময় দিয়ে গেছেন শিক্ষার্থীদের, লেকচার প্রিপারেশনে, ওয়ান টু ওয়ান টপিক এক্সপ্লানেশনে, থিসিস নির্ধারণ ও গবেষণা সহায়তায়, ছাত্র ছাত্রীদের পোষ্ট গ্র্যাড শিক্ষার পেপার ওয়ার্ক তৈরি ও স্কলারশিপ প্রাপ্তিতে, ক্যারিয়ার মেন্টরিং এবং ইইই’র বিভাগীয় উৎকর্ষ আনয়নের নিরন্তর চেষ্টায়। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যা সমাধানের অপেক্ষায় নিজ অফিসে পড়ে থেকেছেন গভীর রাত অবধি, আপ্যায়নের ব্যবস্থাসহ। গতানুগতিক এবং মুখস্ত লেকচার নেয়ার বিপরীতে স্বীকৃত মেধা (সিকি শতাব্দী আগে শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্রের জন্য IEEE-র পুরস্কার পেয়েছিলেন) ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার জ্ঞানভাণ্ডার থাকার পরেও এই শিক্ষাবিদ প্রিপারেশনবিহীন ক্লাসে নিয়েছেন বলে জানা যায়নি। ফলে তড়িৎ ও কম্পিউটার কৌশলের বিভাগের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ ছাত্রটিও স্যারের ক্লাস মিসের চিন্তা করেনি, বরং একই ক্লাস অন্য সেকশনের সাথে উপর্যুপরি করেছে, ফলে স্যারকে কখনও রোল কল করতে হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে পেশাজীবী হয়ে পড়া সাবেক ছাত্রদেরও কারিগরি জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছেন অফলাইনে ও অনলাইনে।

ক্যান্সার আক্রান্ত এই ব্যক্তিত্ব নিয়ে মে’১৬ তে এক লিখনীতে ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ লিখেছিলেন, “তাঁর রোজনামচা অসাধারণ। ফজরের নামাজ পড়েই অফিসে চলে আসেন। দেশি কিংবা অতিথি পাখির খাবারের ব্যবস্থা করা, চারা গাছে পানি দেওয়া, লেখালেখি, কম্পিউটারে কাজ, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নানা বই ডাউনলোড করে লাইব্রেরিতে দেওয়া, ক্লাসে যাওয়ার আগে পুরো বক্তৃতা স্বহস্তে লেখা, সমস্যা সমাধান করা। এর মাঝে বাজার, ভ্রমণ করা এবং দিন শেষে রাত নয়-দশটার দিকে বাসায় ফেরা। সারা দিন, সপ্তাহে সাত দিন, বছরে ৫২ সপ্তাহ। প্রতি ধর্মীয় উৎসবে সুবিধাবঞ্চিত দারিদ্র্যপীড়িত লোকদের রিকশা কিনে দিতেন, যাতে তাঁরা স্বাবলম্বী হয়। অনেকেই এই সুযোগের অপব্যবহার করেছে। তাই এখন অর্ধশতক রিকশাওয়ালাকে ধর্মীয় উৎসবে এককালীন অর্থ প্রদান করেন। আতিথেয়তা, বিনয় তাঁর চরিত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা তাঁকে কখনো চিন্তাভাবনা করে করতে হয় না। নানা স্বাস্থ্য-সমস্যায় ভুগেছেন, অনেক ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষী থাকা সত্ত্বেও কারও মুখাপেক্ষী কখনো হননি আজীবন অকৃতদার এই মানুষটি। কোনো বিষয়েই তেমন কোনো অভিযোগ নেই কারও প্রতি।” মোট কথা, মেধা ও মননে শিক্ষার তরে একজন মাত্র ব্যক্তির এতটা সময় ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। স্যার একটি পূর্ণ জীবন আবর্তিত করেছেন শিক্ষা দানে! নিবেদনের এই মডেল অভূতপূর্ব!

আজ অবধি বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোনো স্তরের শ্রেণী শিক্ষাকেই আনন্দঘন করে ছাত্র ছাত্রীর কাছে উপস্থাপন করা যায়নি, সেখানে এই প্রফেসরের পদাঙ্ক কীভাবে শিক্ষালয়ে অনুসরণ করা হবে তা নিয়ে ভাবা দরকার। অনন্ত প্রেরণার এই উৎসকে আমরা একটি ভবন কিংবা একটি ল্যাব কিংবা একটি সড়কের নামকরণের মধ্য দিয়ে স্মরণ করতে পারি তবে তা হবে নিতান্তই লোক দেখানো। আমাদের দরকার ছিল স্যার এর উচ্চমানের জ্ঞানভাণ্ডারকে “রিপ্রডিউস” করে রাখা। অর্থাৎ আমাদের ছাত্রদের বোঝার ক্যাপাবিলিটি ও কমন গ্যাপগুলোকে সামনে রেখে আমাদের মেধা ব্যবস্থাপনাকে উচ্চ মান করতে স্যারকে দিয়ে মাতৃভাষা বাংলা ও কর্মসংস্থানের ভাষা ইংরেজিতে ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডোমেইনে প্রচুর টেক্সট বই লিখিয়ে নেয়া, পারিশ্রমিকসহ। ক্লাসগুলোর অডিও ভিজুয়াল রেকর্ড রাখার প্রয়োজন ছিল। যদি কারো কাছে তা থেকে থাকে তাহলে সেগুলো ডকুমেন্টেড ও আর্কাইভ করে রাখা দরকার। এখনও বিভিন্ন ডোমেইনে এই রকম যারা বেঁচে আছেন তাঁদের উৎসাহ দেয়া ও রিপ্রডিউস করে জ্ঞান ধরে রাখার একটা চেষ্টা হওয়া চাই। চাই ক্লাস লেকচার ও বিষয় ভিত্তিক এক্সপার্ট প্রেজেন্টেশনগুলোর আর্কাইভ ও রিমেইক করার ও বই ছাপানোর জন্য ফান্ড তৈরির ব্যবস্থা করা। এই কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি কিংবা ব্যানবেইস কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করার কথা। দুর্ভাগ্য যে, আমরা কোনো দূরদর্শী রাষ্ট্রীয় ইন্সটিটিউশন পাইনি।

দুর্বিত্তায়িত মেধাহীন শিক্ষক নিয়োগ, দুর্বিনীত অপ রাজনৈতিক প্রভাব, দখল সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নির্ভর মারমুখী ছাত্র রাজনীতি, দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক রাজনীতি, গবেষণাহীন, ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্টতাহীন শিক্ষা মডেল, শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ, বেপারোয়া প্রশ্নফাঁস ও উত্তরপত্র যাচাইয়ের সহনীয় পাশমুখী মডেলের শিক্ষাব্যবস্থা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর মতো উচ্চমানের শিক্ষক প্রডিউস করার ক্যাপাবিলিটি রাখে না। শিক্ষায় মেধা, মান ও মনন বলতে যা কিছু রয়েছে সেসবের সৃষ্টিতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিদারুণভাবে অযোগ্য ও ব্যর্থ। তাই যে যে ডোমেইনে এখনও ভালোরা জীবিত আছেন তাঁদের জ্ঞান রিপ্রডিউস করে রাখা কর্তব্য।

শিক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে প্রফেসর মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর মত মান ও মননের নিবেদিত শিক্ষক তৈরি করতে পারবে, সেইরকম একটি মেধা ব্যবস্থাপনার একটা শুভ চিন্তার সূচনা দরকার নেতৃত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে এবং শিক্ষা প্রশাসনে স্তরে স্তরে। তবেই স্যারের মহৎ প্রাণের নিবেদন সর্বজনের তরে অর্থবহ করে তোলা যাবে।

পরম দয়ালু আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁকে সর্বোচ্চ প্রতিদান দিন- এই দোয়া করি।

মাশরুরা শারমিন ওয়ারেসী/ ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার শুরু হলো। ২০১৩ এর শেষ দিক। রুমমেট একই সাথে আমার ক্লাসমেটও। তার মারফত খবর পেলাম বিখ্যাত ম্যাক স্যার অন্য সেকশনে AC সার্কিট পড়াবেন। সম্ভব হলে ও গিয়ে ক্লাস করে আসবে। ম্যাক স্যার কে এবং কেন বিখ্যাত সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা আমারও খুব শখ হলো গিয়ে দেখে আসার। বন্ধু Sums Uz Zaman-কে বলতে সে-ও মহা উৎসাহে রাজি। দুশ্চিন্তা একটাই- স্যার ধরতে পারলে!

না, স্যার কিছু বলেন নি। এমনকি উনার ক্লাস টেস্ট (সিটি) দিয়েছি রোল নাম্বার লিখে। স্যার নম্বর শিটে আমাদের নম্বরও দিয়েছেন। আমার মতো মহা অলস মানুষও সবটুকু যত্ন ঢেলে তাঁর লেকচার তুলতো। পুরো টার্মে একদিন ক্লাস করতে পারিনি শুধু (যে ক্লাস আমার করারই কথা না অবশ্য), পরদিন ক্লাসে abc আর acb sequence বুঝিনি তাই। স্যারকে বলতেই বললেন- “গতকাল তো ক্লাসে আসেননি। বুঝবেন কী করে?” স্যার খেয়াল করেছেন! মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার মনে রেখেছেন, আমি, তাঁর উড়ে এসে জুড়ে বসা ছাত্রী ক্লাসে আসিনি! পুরো জীবনে নিজেকে এত স্পেশাল আমার কখনো লাগেনি।

সেই একই টার্মে আমার নিজ সেকশনের AC সিটি একটু পরেই। একটা জিনিস কিছুতেই পারি না। এক ছুটে স্যারের রুমে। “স্যার, বুঝি না।” সেদিনও তিনি খালি হাতে ফেরাননি।

আরো অনেক অনেক দেনা এই মানুষটার কাছে। অন্য টিচারদের নামের আগে ডক্টর উল্লেখ করতে কখনো না ভোলা স্যার নিজের বেলায় কখনো করেননি। অনেককেই তাই দেখেছি উনার পিএচডি আছে কিনা নিয়ে সন্দিহান। আমার জীবনের একাধিক দুর্বিষহ যন্ত্রণার মুহূর্তে মমতা নিয়ে পাশে ছিলেন তিনি।

অসম্ভব ধর্মভীরু, নীতিবান, সৎ, সদাচারী, অপরিমেয় জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ, শেখানোয় অতুলনীয় দক্ষ, দারুণ রসবোধসম্পন্ন, মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, সাদাসিধে জীবনযাপনকারী, দানশীল অথচ অন্যের দানের গ্রহণে চরম বিমুখ, আত্মসম্মানবোধ আর অভূতপূর্ব ব্যক্তিত্বে মহীয়ান প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যারকে সকল ক্ষমতা এবং গুণের অধিকারী করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালা বিনা হিসেবে জান্নাতুল ফেরদৌসে সবচেয়ে বিশেষ মানুষদের সাথে স্থান দিন।

এস এম সোহেলুজ্জামান (EEE ’92)/ ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

আমাদের সবার প্রিয় মোহাম্মদ আলী স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তাই অন্য ডিপার্টমেন্ট এর অনেকেই যারা স্যারের ক্লাস কখনো করেননি বা স্যার কে কাছে থেকে দেখেননি তাদের জন্য আমার কিছু স্মৃতি শেয়ার করছি।

স্মৃতি এক

EEE-র প্রথম ক্লাস। মোহাম্মদ আলী স্যার প্রবেশ করলেন। নিঃসন্দেহে আমরা ভ্যাবাচেকা খেলাম যতটা না স্যার এর পোশাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি আমাদের সবাইকে ‘আপনি’ করে সম্বোধন করাতে! স্যার এর প্রথম ক্লাস করার পরেই আমি বুঝে গেলাম যে সঠিক জায়গায় ভর্তি হয়েছি। এরপর স্যার আমাদের আরো বেশ কিছু ক্লাস নিয়েছেন। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয় এতো ভালো একজন মানুষকে এতো সামনে থেকে দেখতে পেরেছি এবং তার কথা শুনতে পেরেছি বলে। ক্লাস টেস্ট থেকে আরম্ভ করে ফাইনাল পর্যন্ত স্বপ্নের মতো কেটে গিয়েছিলো আমাদের ক্লাসগুলো। আমাদের ব্যাচের ছেলে মেয়েরা সব চেয়ে বেশি এ+ পেয়েছিলো স্যার এর কোর্সেই।

স্মৃতি দুই

ছাত্রদের উৎসাহ দেয়াতে স্যার এর তুলনা বুয়েট এ আর কেউ নেই, সেটা আন্ডারগ্র্যাড এর ছাত্র হোক অথবা পিএইচডি করতে যাওয়া বুয়েটের কোনো লেকচারার হোক। আমার মনে হয় না আমাদের ব্যাচের কেউ স্যারের রুম এর চানাচুর অথবা কোক না খেয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে! যেকোনো সমস্যা নিয়ে স্যার এর সাথে কথা বলা যেত। উনার রুমের দরজা আমরা কখনো বন্ধ দেখিনি।

স্মৃতি তিন

আমরা (EEE ’92, সেকশন- এ) খুব ভাগ্যবান ছিলাম যে লেভেল-১ টার্ম-১ এর EEE-101 সহ আরো কয়েকটি কোর্স, যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রনিক্স (খুব সম্ভবত লেভেল-৩ টার্ম-১) স্যার নিয়েছিলেন। আমাদের সেকশন- বি তখন স্যারের ক্লাস পাওয়ার জন্য রীতিমতো আন্দোলন করে ডিন স্যার এর সাথে দেখা করেছিল! আর কোনো স্যারের জন্য আমি যতদিন বুয়েট এ ছিলাম এটা হতে দেখিনি!

স্মৃতি চার

আমরা যখন লেভেল-১ এ মাত্র ল্যাব শুরু করলাম আমাদের এক বন্ধু অসিলোস্কোপ নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া করছিলো। স্যার তখন কাছে এসে বললেন, “আপনারা এখন বড় হয়েছেন, সবকিছু কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শিখতে হবে।” এবং স্যার নিজ হাতে আমাদের অসিলোস্কোপ ব্যবহার শিখিয়ে দেন। পাওয়ার ইলেকট্রনিক্সের এক ল্যাবে আমরা কয়েকজন মিলে মাল্টিপ্লেক্সিং করে অসিলোস্কোপে কয়েকটা সিগন্যাল একসাথে দেখানোর চেষ্টা করছিলাম। স্যার বললেন, “যে যন্ত্রের যে কাজ নয় আপনারা তা-ই চেষ্টা করছেন, তা-ও দেখেন চেষ্টা করে কিছু করতে পারেন কিনা!”

স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এই ধরনের অসংখ্য স্মৃতি উনি আমাদের বুকে এঁকে দিয়ে গিয়েছেন| এবং এভাবেই উনি বেঁচে থাকবেন বুয়েট আর তাঁর অতি প্রিয় ছাত্রদের মাঝে|

অসিলোস্কোপ; Source: Amazon

১০

মাহফুজ আলী শুভ্র/ ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার মারা গেছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবরটা পেলাম। অনেক স্মৃতি স্যারের সাথে। কিছু কথা শেয়ার করাটা কর্তব্য।

১) স্যারের সাথে প্রথম দেখা ২০০৬ সালে, ওএবি ভবনে। উনাকে দেখে কে বোঝে উনি ডিপার্টমেন্ট হেড তখন? স্যারকে কোনদিন জুতা পায়ে দেখি নাই, সবসময় স্যান্ডেল। সবাইকে আপনি করে ডাকেন। পাঞ্জাবির হাতা গুটানো সবসময়। পিছনে হাত দুটো থাকে হাঁটার সময়। মহাপুরুষ কেমন হয় সামনাসামনি দেখলাম।

২) প্রথম সেমিস্টারে ডিসি সার্কিট কোর্সে ৭ জন ফেল। অবস্থা ভয়াবহ। পরের সেমিস্টারে স্যার আসলেন এসি সার্কিটের কোর্স নিতে। B সেকশনে ছিলাম বলে স্যার এর ক্লাস পেলাম না। পরে টার্ম ফাইনালে A সেকশনের লেকচার পড়ে বুঝলাম- বিরাট মিস। অসাধারণ ক্লাস লেকচার আর কন্টেন্ট।

৩) 3-2 (তৃতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টার) এর পাওয়ার ইলেক্ট্রনিকস কোর্স। স্যার পড়াচ্ছেন, পিনপতন নীরবতা। থ্রি ফেইজ পাওয়ার এর হ-য-ব-র-ল গ্রাফ আঁকছেন অদ্ভুত দক্ষতায়। জটিল সব সমীকরণ অনায়াসে লিখে ফেলছেন না দেখেই। ল্যাবেও স্যার। এত ভালো পারতেন মনে হত লেগো নিয়ে খেলছেন। জুনিয়র টিচার বসেই থাকতেন, স্যারই ল্যাব করাতেন- বুয়েটে যেটা ভাবাই যায় না।

৪) ইমদাদ সিতারা ফাউন্ডেশন এর সদস্য ছিলেন স্যার। বুয়েটে বৃত্তি দেয় এই ফাউন্ডেশন। ঘটনাক্রমে আমার শ্বশুরও এর সদস্য। স্যার সবসময় বৃত্তির টাকা বাড়াতে চাইতেন। মিটিং শেষ করে সম্মানি ভাতাটাও নিতে চাইতেন না। স্যার যখন মৃত্যুশয্যায় তখন এই ফাউন্ডেশন টাকা দিয়ে স্যারের উন্নত চিকিৎসা করাতে চেয়েছিল। স্যার নেননি। কঠোরভাবে না করে দিয়েছিলেন।

৪) স্যার আমার মাস্টার্স এর থিসিস সুপার ভাইজার ছিলেন। বই, পেপার, সফটওয়্যার সব কিছু ডাউনলোড করে আমাকে দিয়ে বললেন, কাজ করেন। বুঝলাম স্যার নিজেই ৫০% কাজ করেই দিয়েছেন। পরে ডিফেন্সের দিন দেরি করে গিয়েছি রাস্তায় জ্যামের কারণে। স্যার খুব রাগ করলেন। ডিফেন্স শেষে মাফ চাইলাম স্যার এর কাছে। স্যার মাফ করে দিয়েছিলেন। সব কমিটি মেম্বারদেরকে উনি নিজের টাকায় আপ্যায়ন করলেন, আমাকে কিছুই করতে দিলেন না। আমি বুয়েটের মাস্টার্স শেষ করলাম স্যারের কল্যাণে।

৫) পলাশী বাজারে বান্ধবীকে নিয়ে ঘুরি। স্যার দেখলেন একদিন। তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলতে বললেন। বিয়েতে দাওয়াত দিলাম, স্যার শুধু বললেন দোয়া করি। স্যার বিয়েতে যেতেন না।

৬) পিজিসিবিতে চাকরি পেলাম ২০১২ সালে। সবাই খুশি, স্যার ছাড়া। বললেন কিছুই শিখবেন না, বাইরে যান। পরে স্যারের কথাটার আসল মর্মাথটা বুঝলাম।

৭) ২০১৪ সাল, ইউএসএ তে ফান্ডিং পেয়ে গেছি। স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। প্রফেসর বাঙালী শুনে স্যার বললেন, বিদেশে গিয়ে বাঙালী প্রফেসরের কাছে পিএইচডি না করাই ভালো। অবাক হয়ে গেলাম। তবে এখন বুঝি স্যার কেন এসব কথা বলেছিলেন।

৮) স্যার প্রচণ্ড প্রচারবিমুখ ছিলেন। ফেসবুকে বেশি সময় দিতে নিষেধ করতেন। বলতেন, আল্লাহ, আল্লাহ করেন এইগুলা না করে। আমি নিজেই বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি, আপনি এই ভুল করিয়েন না, বুঝছেন?

৯) স্যারের কাছে বিদায় নিচ্ছি। স্যার বললেন, ফি আমানিল্লাহ। বিদেশে যান, ভালো থাকেন। আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে মরলে এখান থেকে (স্যার পলাশী ক্যাম্পাসে বসেন তখন) সোজা আজিমপুর কবরস্থানে যেতে পারি। কত কঠিন কথা, কত সহজে বলে ফেললেন! [আজ স্যার আজিমপুর কবরস্থানেই, সোজা বুয়েট ক্যাম্পাস থেকেই]

আজকে স্যার নেই। আল্লাহ স্যারকে বেহেস্ত নসিব করুন। সবাই স্যারের জন্য দোয়া করবেন।

বুয়েটের ওএবি ভবন; Source: BUET

১১

বাপ্পী খায়ের/ ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

এক মহামানবের মহাপ্রয়াণ

আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠেই খবরটি পেলাম। অবচেতন মনে হলেও কিছুদিন ধরে কেন যেন খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল খবরটি এই বুঝি আসলো! সেটা সত্যিই হয়ে গেল। আমাদের সবার প্রিয় মোহাম্মদ আলী স্যার আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। স্যার শুধু আমাদের এই পৃথিবীটাই ছেড়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী এবং শুভানুধ্যায়ীর মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন আজন্মকাল। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, স্যার এই পৃথিবী ছেড়ে জান্নাতুল ফেরদৌসে প্রবেশ করেছেন হেসে হেসে, পৃথিবীতে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে।

আমরা যখন বুয়েটে ক্লাস শুরু করি, তখন থেকেই স্যারের কথা লোকমুখে শুনে আসছি। তখনও আমাকে চিনতেন না। তবু ক্লাসের ফাঁকে কোথাও দেখা হলেই সালাম করে কথা বলতেন। তখনকার ইএমই ভবনের নীচতলায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেক্ট্রনিক্স ল্যাবে স্যারের সাথে দেখা করতে যেতাম। ছাত্রজীবনের সকল কাঠিন্যতার মধ্যে স্যারের সাথে দেখা হলে কথা বলে সব কষ্ট যেন দূর হয়ে যেত।

লেভেল-৩, টার্ম-২ তে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেক্ট্রনিক্স এর ক্লাস নিয়েছিলেন। প্রথমদিন যখন ক্লাসে আসলেন আমরা খেয়ালই করিনি। ক্লাসে হট্টগোল, হৈচৈ। এর মধ্যেই ক্লাস নেয়া শুরু করলেন। হাতে কোন নোট বা চোথা কিছুই নেই। অথচ ইলেক্ট্রনিক্সের যতসব সার্কিট, ইকুয়েশন লিখে যেতে থাকলেন বোর্ড ভর্তি করে। মনে হচ্ছিল যেন সব স্যারের মুখস্ত। এত সহজ এবং সাবলীলভাবে সব বোঝালেন যে ক্লাসের সবাই হঠাৎ করে স্যারের দিকে তাকিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে লেকচার নোট নিতে শুরু করে দিল। আমি আমার ছাত্রজীবনে এর আগে অথবা এর পরে আর কোনো প্রফেসরকে কোনো রকম নোট অথবা চোথা ছাড়া ক্লাস নিতে দেখিনি।

ছাত্র হিসাবে প্রায় বছর চারেক এবং পরবর্তীতে সহকর্মী হিসেবে বছর তিনেক স্যারের সান্নিধ্যে আসবার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। ডিপার্টমেন্টে জয়েন করার পর স্যারের সান্নিধ্যে আসবার সুযোগ হয়েছিল সবচেয়ে বেশী। ছোট বড় সবাইকে আপনি করে সম্বোধন করতেন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সাংসারিক যেকোনো বিষয়ই স্যারের সাথে অনায়াসেই শেয়ার করতাম। এত মধুর করে কথা বলতেন, কথা বলার পর সবকিছু খুব সহজ মনে হত।

পলাশী এলাকায় এমন কোন রিক্সাওয়ালা ছিল না যে স্যারকে চিনতো না। পরিবার নিয়ে আমি তখন বুয়েটের লাল কোয়ার্টারে থাকতাম। পলাশী বাজার থেকে একদিন স্যারের সাথে রিক্সায় উঠলাম। বুয়েট লাল কোয়ার্টারে গিয়ে চোখ বন্ধ করে পকেটে যত টাকার নোট আছে সেটাই দিয়ে দিলেন। এভাবে পকেটে যত আছে দান করে দিতেন। কত টাকা সেটা দেখতেন না। পলাশীর বাজারে স্যারকে দেখলে তাই রিকশাওয়ালাদের মধ্যে শুরু হয়ে যেত তাড়াহুড়ো! স্যারের নিঃস্বার্থ এবং দান খয়রাতের এমন নমুনা বলে শেষ করা যাবে না।

স্যারের সাথে আমার অনেক স্মৃতি। স্মৃতিগুলো একেবারেই একান্ত। সেই আন্ডারগ্র্যাড থেকেই ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তীতে শিক্ষক ও কলিগ হিসেবে স্যারের সাথে বিস্তর ওঠা-বসা। স্যারের সাথে আমার সম্পর্কটা এমনি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল যে আমাদের আলাপ-আলোচনা ডিপার্টমেন্টের কাজকর্ম, দায়দায়িত্ব, পড়াশোনা, ইত্যাদিকে অনায়াসেই ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত গণ্ডির সীমানা মাড়িয়ে শেষ হত এমন এক বিন্দুতে যেন মনে হত আড্ডাটা কিন্তু আজও শেষ হলো না।

মন ভালো নেই, অফিসে বসে একঘেয়ে লাগছে, কাজ করতে ভালো লাগছে না, ব্যাস স্যারের খোঁজে চলে আসতাম ইএমই বিল্ডিঙের দোতলায়। তবে স্যার অফিসে নেই এবং উনি ডিপার্টমেন্টের অফিসে খুব একটা বসেনও না, দেখা পেতে হলে যেতে হবে ওএবি বিল্ডিঙে ওনার সেই রুমে। ওটাই ওনার আস্তানা, অনেক সময় ডিপার্টমেন্টের অফিস সহকারীরা ও কাগজপত্রে সই নিতে সেখানেই যেত। অফিসে না পেলে তাই সেখানেই ছুটে যেতাম।

বুয়েটের ইএমই ভবন; Source: Panoramio

টিচার্স ক্লাব থেকে আনমনা হয়ে ক্যাফের সামনে দিয়ে হেঁটে হলের দিকে যাচ্ছি, হঠাতই মনে হলো স্যারের সাথে দেখা করে যাই। চলে গেলাম স্যারের রুমে। বুয়েট বন্ধ, উত্তপ্ত কোনো এক গরমের দিনে হলের রুমে বসে কাজকর্ম করতে করতে দমবন্ধ লাগছে, চলে গেলাম স্যারের কাছে। দরজা খোলাই থাকত সবসময়। কোনো শব্দ না করেই ঢুকে পড়লাম রুমের ভেতর, সালাম দেয়ার আগেই কীভাবে যেন বুঝে যেতেন, বলতেন, “খায়ের সাহেব নাকি?”

“জ্বি স্যার,” সালাম দিয়ে বসে পড়ি পাশের চেয়ারে। স্যারের তখনো দু’চোখ বন্ধ, বেশীরভাগ সময় দু’চোখ বন্ধ করেই চেয়ারের মধ্যে বসে থাকতেন পা দুটো টেবিলের উপর দিয়ে, যেন কোনো এক ধ্যানের মধ্যে আছেন। একটু তাকালেন কিনা, মৃদুস্বরে বললেন, “ওই যে টেবিলের উপর শিঙ্গাড়া আছে, খেয়ে নেন।” ওনার দুপুরের খাবার বলতে ওই এক শিঙ্গাড়াই ছিল, সকালবেলা পলাশী থেকে নিয়ে আসতেন। আমি ওটা খেয়ে নিলে স্যার হয়তো দুপুরে না খেয়েই কাটাবেন, অথবা পলাশী থেকে আবার গিয়ে খাবার কিনে নিয়ে আসবেন। আমি কোনোদিন খাবার কিনে নিয়ে যেতে প্রস্তাব করলে বিস্তর আপত্তি করতেন, বলতেন, “কখনো আমার জন্য কিছু কিনে আনবেন না, আপনি টাকা পাবেন কোথায়!” আসলে টাকার ব্যাপার নয়, কারো কাছ থেকে কিছু নেবেন না, সেটাই কথা।

আমি চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বলি, “না স্যার, এখন খাবো না।”

“তাহলে ওই যে ফ্রিজ খুলে দেখেন প্রাণের জুস আছে, খেয়ে নেন,” স্যারের তড়িৎ জবাব। মোদ্দা কথা হচ্ছে, স্যারের রুমে গেলে কিছু একটা খেতেই হবে। নিয়মিত খেতাম, তবে ওইদিন বললাম, “না স্যার, জুস খেতে ভালো লাগবে না এখন।” স্যার এবার চোখ খুললেন, একটু যেন মন খারাপ করলেন, বললেন, “কিছুই খাবেন না, তবে কেন এসেছেন?” এভাবেই শুরু হতো আমাদের নিত্যদিনের কথাবার্তা, তারপর গড়িয়ে যেত বুয়েট ছাড়িয়ে, ব্যক্তি থেকে সমাজ, বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ, দেশ হয়ে বিদেশ, প্রান্তর থেকে প্রান্তরে।

২০০৬ সাল। স্যার তখন ইইই ডিপার্টমেন্টের প্রধান। আমি তখন আমেরিকা যাবার জন্য তল্পিতল্পা গুছাচ্ছি। ডিপার্টমেন্ট থেকে ছুটি নেয়া, দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া, ইত্যাদি বিভিন্নরকম অফিশিয়াল কাগজপত্র স্যারের অফিস হয়েই যায়। একদিন স্যারের সাথে দেখা করতে ওএবি বিল্ডিঙে ওনার সেই রুমে গেলে আচমকাই স্যার একটি কথা বলে বসলেন যা আমি ওই সময়টাতে আশা করিনি। বললেন, “খায়ের সাহেব, ইউএসএ-তে যাবেন যান, তবে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে যান।”

আমি চোখেমুখে আশ্চর্যভাব নিয়েই বললাম, “কেন স্যার, চাকরি ছেড়ে দেব কেন?” অনেকক্ষণ আর কোনো প্রতিউত্তর নেই। উত্তর না পেয়ে আমিই তখন বললাম, “একটা ভিন্নদেশে যাচ্ছি, নতুন জায়গা, নতুন সংস্কৃতি, কেমন লাগবে কিছুই জানি না। পড়াশোনা কেমন হবে, ঠিকঠাক শেষ হবে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নাই; এমনও তো হতে পারে ভালো লাগলনা, চলে আসতে পারি দেশে ফিরে, তখন?”

স্যার এবারও নিরুত্তর। আর কথা না বাড়িয়ে উঠে আসব, তখন আবার মৃদু স্বরে চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, “ওখানে গেলে কেউ ফিরে আসতে চায় না, ফিরে আসে না, আপনিও আসবেন না।” মনটা খারাপ হলেও আমি কিছু বুঝতে না দিয়ে নিঃশব্দে সেদিন স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে চলে আসলাম। বিদায়ের সেই বেলায় স্যারের সাথে ওটাই ছিল আমার শেষ আলাপ।

ওটাই ছিল স্যারের সাথে আমার শেষ কথা, শেষ দেখা। গত বারো বছর সরাসরি স্যারের সাথে আর দেখা হয়নি বটে; তবে আমি জানি প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা ক্ষণ কেমন এক অদৃশ্য, অজানা টান স্যারের স্মৃতি মনের গহীনে নাড়া দিয়ে দিয়ে যায়। সেইসব স্মৃতিগুলো রয়ে যাবে নীরবে অনন্তকাল।

জানি, আমার এই স্মৃতিচারণ স্যারকে নিয়ে লেখা ফেসবুকের অনেক অনেক পোস্টের মধ্যে আরেকটা ফেসবুক পোষ্ট হিসেবেই হারিয়ে যাবে সময়ের গহ্বরে। জানি, এই পোস্ট স্যার কোনদিনই দেখবেন না, অথবা স্যারের কোনো উপকারেই আসবেনা। তাই যে কাজটি করলে একটুখানি হলেও ঐ ওপারে স্যারের কাজে লেগে যেতে পারে, সেই কাজটিই আজ ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে করেছি। স্যারের জন্য দোয়া করেছি, যেটা সবসময়ই করি। ইহ ও পরকালের যিনি বিধাতা, তিনি যেন স্যারের আত্মার মাগফেরাত করেন। আমীন।

–বাপ্পী

পোর্টল্যান্ড, ওরেগন, ইউএসএ

জানুয়ারী ২৯, ২০১৮

১২

হাসান শাহরিয়ার (EEE ’96)/ ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

আমার ম্যাক স্যার

২০০৩ সাল, একটা ঔষধ কোম্পানিতে কাজ করি। কাজ মানে টেকনেশিয়ানদের রোস্টার করা। লাঞ্চে ম্যানেজারকে বলে-কয়ে বুয়েটে আসি রেকমেন্ডেশনের খোঁজে! লো সিজিপিএ, কেউ পাত্তা দেয় না, তা-ও মাছির মতো ভন ভন করি স্যারদের আশেপাশে। থিসিস সুপারভাইজার একদিন বিরক্ত হয়ে বলে দিলেন যে, উনি রেকমেন্ডেশন দেন না! আরেকদিন ব্যর্থ মনোরথে ওএবি থেকে বের হচ্ছি, দেখি মোহাম্মদ আলী স্যার রুমের তালা খুলছেন। স্যারকে দেখে সালাম দিয়ে ইতস্তত করতেছি রেকমেন্ডেশনের কথা তুলব কিনা; এডভাইজার স্যার দেন নেই, সুপারভাইজার স্যার দেন নেই, এই স্যারের তো মাত্র একটা ক্লাস করছি, স্যার কি দিবেন! আমি কিছু বলার আগের স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “কী, রেকমেন্ডেশন লাগবে?”

“জী স্যার।”

“আপনার বিস্তারিত রেখে যান, কালকে নিয়ে যায়েন।”

“জী স্যার।”

স্যারের সেই রেকমেন্ডেশনের একটা কপি বহুদিন আমার সাথে ছিল, মাঝে মাঝে খুলে পড়তাম।

শান্তিতে ঘুমান স্যার।

– সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

১৩

আনিসুল হক/ ২৯ জানুয়ারি , ২০১৮

আমার শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী আজ পরলোকগত হয়েছেন। তিনি আমার কোনো ক্লাস নেন নি। বুয়েটে আমরা যখন শুরু করি তিনি বিদেশে ছিলেন, ফিরতে ফিরতে আমরা পাশ করে ফেলেছি। আঠার বছর সহকর্মী হিসেবে একসাথে কাজ করেছি। তাঁর কাছ থেকে যা শেখা, তখনই। তাঁর কাজকর্ম খেয়াল করে, একসাথে কাজ করে আর আড্ডা দিয়ে।

সন্ন্যাসীর আধুনিক সংজ্ঞা তাঁকে দেখে লেখা যায়। টাকা পয়সার প্রতি কোন আগ্রহ ছিলো না, কখনো পয়সার বিনিময়ে কনসাল্টিং করেন নি। তবে অনেক সময়েই বিনে পয়সায় কারিগরী পরামর্শ বিলিয়েছেন। নির্লোভ ছিলেন না অবশ্য, কোক খেতে খুব পছন্দ করতেন। ছুটি নিয়ে আমি যখন দুই বছরের জন্য বাইরে যাই, টিভি, ফ্রিজ সব বিক্রি করে যাচ্ছিলাম। স্যার বললেন তিনি অফিসের জন্য এই ফ্রিজ নেবেন। আমি জানতে চাইলাম যে অফিসে প্রমাণ সাইজের ফ্রিজ দিয়ে তিনি কী করবেন। উত্তরে জানালেন, ঠান্ডা কোক রাখবেন। সবাই তাঁর কাছে আসে, তাই বড় ফ্রিজ দরকার।

ছাত্ররা তাঁকে অসম্ভব পছন্দ করতো। আমার মনে আছে ‘৯৯ এর দিকে এক ব্যাচ EEE-তে প্রথম বছর শেষ করে দ্বিতীয় বছর শুরু করে স্মরণিকা বের করেছিল। স্যার তাদেরকে প্রথম বছরে পড়িয়েছিলেন। স্মরণিকায় প্রত্যেককে লিখতে হয়েছিল প্রিয় ব্যক্তিত্বের নাম। সেখানে সবচেয়ে বেশী ছেলেমেয়ে স্যারের নাম লিখেছিল।

কয়েক বছর আগে যখন তাঁর অসুস্থতা ধরা পড়লো, দেশ-বিদেশে স্যারের সব ছাত্রছাত্রীরা অস্থির হয়ে গেল, তাঁর চিকিৎসায় সাহায্য করবে। তিনি সাফ বলে দিলেন, অন্যের টাকায় তিনি চিকিৎসা করাবেন না। কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন, সেই ক্ষেত্রে তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকেই অগ্রিম নিয়ে তিনি যেন বিদেশে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে আসেন। তাতেও রাজী হলেন না। বললেন, প্রভিডেন্ট ফান্ড অবসরের পরের সময়ের জন্য। বিদেশে যাওয়ার জন্য এখনই সেই টাকা খরচ করে ফেললে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে অবসর নিয়ে তিনি খাবেন কী! এমন তো না যে তাঁর অসুস্থতার চিকিৎসা দেশে নেই। বুয়েটের ক্যাম্পাস থেকে গুলশানে হাসপাতালে রেডিয়েশন নিতে যেতেন সিএনজি করে। অথচ বুয়েটের অ্যাম্বুলেন্স আছে, তাতে স্যারের এনটাইটেলমেন্টও আছে। তিনি বলতেন, এতক্ষণ অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখা ঠিক না। যদি কারো জরুরি দরকার হয়? আর সিএনজিতে তিনি যেতে তো পারছেন।

আমাকে স্নেহ করতেন তিনি। যখন বুয়েট ছেড়ে দেই, দুঃখ পেয়েছিলেন, অনেকবার সেই কথা বলেছিলেন, কিন্তু না যাবার কথা বলেননি। অন্যের মতামতকে সম্মান করতেন।

স্যারের প্রতি আমার শ্রদ্ধা। তাঁর দৃঢ়তা, সিম্পলিসিটি আর অন্যের প্রতি ভালোবাসার কিয়দংশও কেউ পেলে সে ধন্য হয়ে যাবে। উঁচুদরের মানুষ হয়ে উঠবে।

১৪

সন্দীপন স্যানাল/ ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৮

মোহাম্মদ আলী স্যার, কায়কোবাদ স্যার ও জনৈক আমি

আমি সেই হতভাগা বুয়েটিয়ানদের একজন যারা বুয়েটে কোনোদিন মোহাম্মদ আলী স্যারের ক্লাস বা ল্যাব করেনি। তারপরেও নানা কারণে টুকরো টুকরো সান্নিধ্য পেয়েছি। কায়কোবাদ স্যারের কাছে গিয়েছিলাম রেকমেন্ডেশন লেটার নিতে। স্যার খুব চমৎকার একটা লেটার দিলেন। তারপর বললেন, “আপনার কি এই স্কুলে আরেকটা দরকার?” আমি মাথা ঝাঁকালাম। উনি বললেন, “চলেন। মোহাম্মদ আলী স্যারের ওখানে যাই।”

আমি অবাক। উনি তো আমাকে চেনেনই না। আমি তো উনার ডিপার্টমেন্টের না। কায়কোবাদ স্যার হাসলেন। “উনার রুমে আমাদের ছাত্রদের নিয়ে অনেক গল্প হয়। কে কেমন করছে? কার কেমন সম্ভাবনা? আপনার গল্পও করেছি। তাতে আপনাকে উনি চেনেন।”

স্যার আমাকে উনার রুমে নিয়ে গেলেন আর বললেন রেকমেন্ডেশন লেটারের কথা। উনি কোনো কথা না বলে সাথে সাথে লিখে দিলেন। বুয়েটে এমন উদাহরণ কয়টি যে একজন শিক্ষক আরেকজন শিক্ষকের কাছে নিয়ে যান রেকমেন্ডেশন লেটার সংগ্রহ করতে? একজন শিক্ষক অন্য বিভাগের ছেলেকে কোনো কথা না বলে রেকমেন্ডেশন লেটার লিখে দেন? সেই থেকে স্যারের সাথে আমার পরিচয়। এর পরে উনার রুমে অনেক আড্ডাতেই থেকেছি। নানা বিষয় থেকে শুরু করে নানা ঘটকালির গল্প হয়েছে।

বুয়েট জীবনে দুজন শিক্ষকের কাছ থেকে আপনি সম্বোধন পেয়েছি। মোহাম্মদ আলী স্যার ও কায়কোবাদ স্যার। কায়কোবাদ স্যার ৮৬-৮৭ ব্যাচের সবাইকে আপনি বলেন। এর পরের ব্যাচ থেকে তুমি।

২০১৫ গরমে শেষ ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। বুয়েট বন্ধ। পোলাপান গ্যাঞ্জাম করায় হল ভ্যাকেন্ট। ডিপার্টমেন্টও ফাঁকা। কায়কোবাদ স্যার বন্ধ ডিপার্টমেন্টে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরে স্যার বললেন, চলেন, আপনাকে এই বিল্ডিং এর দাঁড়োয়ানের সাথে দেখা করিয়ে আনি। নিয়ে গেলেন পাশের রুমে। দাঁড়োয়ান মোহাম্মদ আলী স্যার রুমেই শুয়ে ছিলেন। আমাদের দেখে উঠে বসলেন। সেই শেষ দেখা। আমাদের পরম সৌভাগ্য বুয়েট এমন ‘অতন্দ্র প্রহরী’ পেয়েছিল।

অসম্ভব সুন্দর পড়ানো, বিষয়ের গভীরতায় যাওয়া, ছাত্রদের সাথে সহজে মিশে যাওয়া, সারা জীবন আদর্শকে ধরে রাখা , শিক্ষায় নিজেকে ত্যাগ করে দেয়া এতগুলো গুণ একজন মানুষের মধ্যে পাওয়া একজন শিক্ষক খুব বেশী পাওয়া যাবে না আজকের দশকে। শুধু স্বপ্নেই এমন শিক্ষকের কথা ভাবা যায় যদি না উনাকে দেখতাম। চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। দেশে-বিদেশে নানা ভক্তের মাঝে স্যার থাকবেন চিরকাল।

১৫

খালিদ ইমতিয়াজ সাদ / ২৯ জানুয়ারি , ২০১৮

গত ৬ বছরের বিদেশ জীবনে যতবার দেশে গিয়েছি, প্রতিবার মোহাম্মদ আলী স্যারের সাথে দেখা করেছি। পিএইচডির মাঝে কিছু ঝামেলা হয়েছিলো, সুপারভাইজার পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলাম। নতুন সুপারভাইজারের অধীনে কিছু বিষয় দ্রুত পড়ে নেয়া দরকার ছিলো। তখন স্যারকে ইমেইল করেছিলাম কিছু বইয়ের নাম চেয়ে। স্যার উত্তর দিয়েছিলেন।

গত বছর দেশে গিয়েও স্যারের সাথে দেখা করেছি। স্যার আলাদা করে পরিবারের প্রত্যেকের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। সামনের মার্চে আবার দেশে যাবো ইনশাল্লাহ। স্যারের সাথে আর দেখা হবে না।

আল্লাহ স্যারকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। আমিন।

১৬

কামরুল হাসান (EEE ’92)/ ২৯ জানুয়ারি , ২০১৮

বিদ্যাসাগর তার বিদ্যার জন্য উপাধি পেলেও তিনি সর্বপ্রথম ও একমাত্র “বিদ্যাসাগর” ছিলেন না। কিন্তু আজ বিদ্যাসাগর বলতে আমরা একজনকেই বুঝি এবং বাংলার মানুষ তাকে স্মরণে তাঁর বিদ্যাকে ছাড়িয়ে সর্বপ্রথম তার অতি অসাধারণ চরিত্রবল, জীবনাচরণ ও দুঃখী-দরিদ্র-বেদনার্তের জন্য অপরিসীম করুণার জন্যই তাকে মনে করে ও বিস্ময়ে অবিভূত হয়।

অনেকটা একইভাবে ম্যাক স্যারের ক্ষেত্রেও আমরা যারা তার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি তাদের অনেকেরই সমানুভূতি হবে বলে ধারণা করি। হয়ত বিদ্যা-শিক্ষাদানে ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার অসাধারণ ছিলেন কিন্তু খুঁজলে তার জুড়ি পাওয়া হয়ত অসম্ভব হবে না। তবে এর সাথে তার বিনম্র আচার-আচরণ, সৎ ও সহজ-সরল আড়ম্বরবিহীন-ভড়ংহীন জীবনাচরণ, শিক্ষায় ও ছাত্রকল্যাণে আত্ননিবেদন, বিপর্যয়ে পতিত ছাত্রছাত্রীর জন্য অপরিসীম মায়া ও তার উত্তরণে সাহায্য করার উদগ্র ইচ্ছা এসব যুক্ত হয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্যসাধারণ।

তার জীবন থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে। অনেকে অনেক কিছু বলবেন। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার যে জিনিসটি মনে পড়ছে সেটা হচ্ছে তার জীবনমুখিতা ও কর্মমুখর জীবন। যারা স্যারকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা বলতে পারবেন তার জীবন দুঃখ-কষ্ট-বেদনাহীন ছিল না, কিন্তু তাই বলে কখনো তিনি জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন নি। অর্থহীন হতাশায় সময় নষ্ট করেননি। বরং প্রতিটি মুহুর্তে যখন যেখানে ছিলেন মানুষের কাজে লাগতে চেয়েছিলেন। তড়িৎ কৌশলে এবং সম্ভবত অন্যান্য বিভাগেও প্রতিটি ব্যাচে অন্তত দুই-চারজন পাওয়া যাবে যাদের জীবনে তার সহানুভুতিশীল স্পর্শ তাদের হতাশ জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে। স্যারের জীবনের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের উপযুক্ত ব্যক্তি আমি নই। শুধু তাঁর স্মৃতি যেন মুছে না যায় এবং তার যাপিত জীবন যাতে অনেকের জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে সেই কামনা করছি।

১৭

আহমেদ ইখতিয়ার আলম পাভেল/ ২৯ জানুয়ারি , ২০১৮

মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল বছর খানেক আগে থেকেই, স্যারের অসুস্থতার খবর পেয়ে। পিতৃসম স্নেহ পেয়েছিলাম স্যারের কাছ থেকে। কতদিন স্যার এর ওএবি বিল্ডিং এর রুম এ গিয়ে উনার ফ্রিজ থেকে খাবার নিয়ে খেয়েছি। আমার বিয়ের আগে স্যার ডেকে পাঠিয়েছিলেন হবু স্ত্রীসহ দেখা করতে। তিনি তখন ডীন। হাজার কাজের ভীড়ে আমাদের বসিয়ে ৩০ মিনিটে জীবনের শ্রেষ্ঠ উপদেশগুলো দিয়েছিলেন। মাত্র ৩ বছরের মাথায় এনার্জিপ্যাক থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম দেখে প্রচন্ড রাগ করেছিলেন। উনার যুক্তির কাছে পরাজিত ছিলাম, কিন্ত নিজের যুক্তি উপস্থাপন করে তর্ক করার দুঃসাহস হয় নাই। সেই অভিমানী দূরত্ব আর ঘুচেনি, কিন্ত আশীর্বাদ টের পেয়েছি। হাজার মাইলের দূরত্বে থেকেও।

প্রিয় বড় ভাই মিনহাজ ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়মিত খবর পেতাম। মিনহাজ ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। অনেক ঘটনায় চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের জীবনের সার্থকতা যে আমরা উনার ক্লাস পেয়েছি, উনার সান্নিধ্য পেয়েছি। আজকের সংবাদের পর থেকে খুব একা লাগছে। একে একে মাথার উপরের ছাতাগুলো সরে যাচ্ছে।

একজন কিংবদন্তীর মহাপ্রয়াণ; বাংলাদেশের ৯৯ ভাগ মানুষ জানলোও না দেশের এক সূর্যসন্তান আজ আমাদের ছেড়ে গেলেন। একজন খাটি মানুষ, একজন কিংবদন্তীসম প্রফেসর। পাওয়ার ইলেকেট্রনিক্স এ জগতের বাঘা বাঘা প্রফেসররা স্যারের সাথে যোগাযোগ করত সমস্যায় পড়লে।

ওই পাড়ে ভাল থাকুন স্যার। আজ থেকে আরো একা হয়ে গেলাম।

১৮

জাফ্রি আল কাদ্রি/ ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

আমরা যারা পাওয়ার ইলেকট্রনিক্স আমাদের জীবিকার জন্য দৈনন্দিন ব্যবহার করি, তারা মোহাম্মদ আলী স্যারের কাছে সরাসরি ঋণী। উনার কারণেই বুয়েট এর পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্স আর মেশিন ল্যাব এতটা সমৃদ্ধ ছিল। কাজের ক্ষেত্রে দেখেছি, অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়ে সিমুলেশন করার আগে বুঝতে পারে না কোনো কিছুর ডিজাইন পরিবর্তন করলে কী হতে পারে। কিন্তু আমাদের বুয়েটের ছাত্ররা সেদিক দিয়ে এগিয়ে থাকে। আমাদের ইন্ট্যুশন অনেক ক্ষেত্রেই খুব ভাল। আমি স্যারের কাছে ৩টি কোর্স পেয়েছি। আমার এমএসসির ডিফেন্স বোর্ডে ছিলেন। আমার রেকমেন্ডেশন লেটার লিখে দিয়েছেন (আমাদের বিভাগের বেশির ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রে এটা সত্য)। কারণে-অকারণে স্যারের রুমে যাওয়া হত, গতবার দেশে গিয়েও দেখা করেছি। গম্ভীর কন্ঠে বলেছিলেন, “আপনি কি এখনও ঢোল বাজান?” আমি বললাম, “ঢোল না স্যার, আমি তবলা শিখেছি, জ্বি বাজাই” । স্যার বললেন, “ঐ হল, আপনি তো পাওয়ার এ পড়াশোনা (PhD) করেন নাই, তাই বলে কি চাকুরি করছেন না?”

স্যারের রুমে গেলে আপেলের জুস খেতে দিতেন, সেটা খেয়ে শেষ করে বললাম, “স্যার খুব মিস করি দেশ, ফিরে আসতে মনে চায়।” স্যার বললেন, “আসার দরকার নাই, ওখানে থেকেই দেখেন কিছু করতে পারেন কিনা, অনেকেই করতেছে কিন্তু। ইন্ডিয়ানরা দেখেন না কীভাবে করে?” আমি আমার জীবনের অল্প কিছু অর্জনের কথা বললাম স্যারকে। উনি একটা দারুণ উপদেশ দিয়েছিলেন, “মাথায় যখন যা আসে, করে ফেলবেন, দেরী করবেন না। যতটা মনে হয়, জীবনটা আসলে তার চেয়ে ছোট।” কে জানে স্যার হয়ত জানতেন আর দেখা হবে না উনার সাথে। ভাল থাকবেন স্যার, খুব অল্প সময়ের এই জীবনে কীভাবে হাজার হাজার মানুষের উপকার করতে হয় সেটা আপনি ভাল করেই দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের।

১৯

মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম/ ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

১৯৯৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর। আমাদের ‘৯৫ ব্যাচের বুৃয়েটে ক্লাস শুরুর দিন। ইইই বি সেকশনে প্রথম ক্লাসের অপেক্ষায় আমরা সবাই। কোনো স্যার তখনও ক্লাসে আসেন নাই। এই ফাঁকে একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছি, যেহেতু অনেকের সাথেই প্রথম দেখা। স্বাভাবিকভাবেই গোলমাল একটু বেশি হচ্ছিল। এর মধ্যেই হঠাৎ দেখি সামনের দরজা দিয়ে গায়ে ইস্ত্রীবিহীন সাদা হাফহাতা সহ একটা অতি সাধারণ শার্ট, একই মানের সাধারণ প্যান্ট আর চপ্পল পায়ে হাতে একটা শিট নিয়ে ক্লাসে একজন লোক ঢুকে পড়েছেন। কারো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই মনে করেছে, কোনো সহকারী হবে হয়ত। ক্লাস নেবার স্যার এখনও আসেন নি। উনি শিটটা সামনের বেঞ্চে একজনের হাতে দিয়ে “এখানে আপনারা সবাই পূর্ণ নাম এবং রোল নম্বর লিখে সাইন করেন” বলেই বোর্ডে লেখা শুরু করেছেন। গোলমাল তখনও চলছিল। লেখা শেষ হতেই আমাদের অবাক হবার পালা। উনি আমাদেরকে বললেন, আপনারা সামনে তাকান। আমি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, আপনাদের এই কোর্সটি নিব। সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। ভাবটা এমন- বলে কি! উনি বুয়েটের টিচার! তারপর উনি যখন পড়ানো শুরু করলেন সবাই নির্বাক! হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই স্যারের ক্লাসে আমরা সবাই নির্বাক হয়ে শুনতাম চমৎকার সব লেকচার। এত চমৎকারভাবে স্যার পড়াতেন যে অন্য কোনো স্যারের ক্লাসে টুকটাক শব্দ হলেও মোহাম্মদ আলী স্যারের ক্লাসে তা ছিল কল্পনার বাইরের বিষয়।

লিভিং লিজেন্ড এই স্যার সব ছাত্র-ছাত্রীদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি যে প্রায় মহামানব পর্যায়ের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এ কথা সবারই জানা। এই অসাধারণ মানুষটি কত সাধারণভাবে জীবনধারণ করছেন তা উপরের ঘটনা পড়লে আর প্রায় দুই বছর আগে স্যারের অনুমতি নিয়ে আমার তোলা সংযুক্ত ছবিটি খুটিয়ে দেখলে সহজেই অনুমেয়। আজ মাটির মানুষ ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার এই অস্থায়ী ঠিকানা ছেড়ে চিরস্থায়ী ঠিকানায় পাড়ি জমিয়েছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। সবার অত্যন্ত প্রিয় এই স্যারকে আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন এই কামনা করছি।

Courtesy: মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম

২০

Mohammad Muntasir Hasan / ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

বুয়েটে এসে প্রথম যে টিচারের সাথে ইন্টারেকশন হয়েছিল উনি ছিলেন মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার।

সেদিন ছিল বুয়েটের প্রথম ক্লাস। আমরা কয়েকজন এডভাইজারের সাথে দেখা করতে উনার রুম খুঁজছিলাম। এডভাইজারের রুমের সামনে এসে দেখি রুম তালা দেয়া। সেই রুমের বিপরীতে আরেকটি রুমে দেখলাম একজন মানুষ কম্পিউটারের সামনে বসে কী যেন করছেন। পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, কালো প্যান্ট আর চপ্পল। আমরা ভেবেছিলাম বুয়েটেরই কোনো ‘পিয়ন’ হবে হয়তো। উনাকেই ডেকে জিজ্ঞেস করলাম- “আমাদের এডভাইজারকে কোথায় পাবো জানেন?” উনার উত্তরটা ছিল চমকে দেয়ার মতো- “উনাকে তো এখন পাবেন না। উনি বাইরে গেছেন প্রাইভেট ভার্সিটিতে ক্লাস নেয়ার জন্য।”

আবার একই সাথে উনার কণ্ঠটাও ছিল অদ্ভুত। একটু ভারি কিন্তু একটা কী যেন ছিল।

যা-ই হোক, উনার উত্তর শুনে আমরা আর উনাকে কিছু বলিনি। একটু ভয়ও পেয়েছিলাম আসলে।

তবে আসল কাহিনী ঘটেছিল তার পরদিন।

আমরা পরদিন Electrical Circuit I ক্লাসটা করার জন্য ক্লাসে বসে আছি। সেদিনই ওই বিষয়ের প্রথম ক্লাস। এমন সময় হাতে একটা শিট নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন গতদিন দেখা হওয়া সেই মানুষটা। পরনে একই রকম সাদা পাঞ্জাবি আর চপ্পল। আমরা তখনো তাকে পিয়নই ভেবেছি। কিন্তু তারপর উনি যখন বললেন উনি আমাদের এই কোর্সটি নিবেন তখন আসলেই যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম।আর তারপর বাকিটা তো ইতিহাস!

স্যারের কোর্সে পিএল (Preparatory Leave) এর আগে বই পড়াই লাগেনি। মেশ এনালাইসিস, নোড এনালাইসিস কীভাবে কীভাবে যেন ক্লাসেই শিখে গেলাম! স্যারের ক্লাস ছিল সকাল ৮ টায়। কিন্তু সিলেবাস শেষ হবে না দেখে স্যার ৭.৩০ থেকে ক্লাস নেয়া শুরু করতেন। এতটাই ছিল স্যারের ডেডিকেশন! স্যারের ক্লাসে চাইলেই প্রক্সি দেয়া যেত, কিন্তু তা-ও স্যারের ক্লাসে বেশিরভাগ ছেলেপেলেই উপস্থিত থাকতো।

এর পরে স্যারকে আবারও পেয়েছি সার্কিট ল্যাবে। স্যার কখনোই পড়াশোনার ব্যাপারে সেভাবে প্রেশার দেন নাই। কিন্তু তারপরও যেটা শেখা দরকার ছিল কীভাবে কীভাবে যেন শিখে গেছি। আসলে ‘যত বেশি প্রেসার পোলাপান তত বেশি শিখবে’ এটাতে স্যার বিশ্বাসী ছিলেন না। এবং স্যার কতটা সঠিক ছিলেন সেটার প্রমাণও আমরা পেয়েছি।

প্রায় এক বছর ধরে স্যার অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তারপরও মনে হতো স্যার বোধহয় সুস্থ হয়ে উঠবেন এ যাত্রায়। স্যারকে আমরা কতটা পছন্দ করতাম সেটা কখনোই স্যারকে বলতে পারিনি। ইচ্ছা ছিল স্যারের সাথে আরেকবার হলেও দেখা করার। যেটা আর কখনোই সম্ভব হবেনা। ভাবতেই কেমন যে একটা শূন্যতা বোধ হচ্ছে বোঝাতে পারবো না।

আসলে স্যারকে যতটা না ‘শিক্ষক’ হিসেবে তার চেয়ে অনেক বেশি একজন ‘মানুষ’ হিসেবে সারা জীবন মনে রাখবো। খুব সাধারণ হয়েও যে একজন মানুষ অসাধারণ হয়ে উঠতে পারেন- এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের ম্যাক স্যার।

স্যার জান্নাতবাসী হন এই দোয়া করি।

২১

ইমাদুর রহমান / ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮ (নন বুয়েটিয়ান)

ব্যাচেলর ডিগ্রির সেকেন্ড ইয়ারে তখন আমরা। হঠাৎ শুনলাম, বাংলাদেশ থেকে একজন নতুন প্রফেসর আসছেন, উনি ওই সেমিস্টারে আমাদের ইলেক্ট্রিক্যাল পাওয়ার সিস্টেমস কোর্সের ক্লাস নিবেন। নরমালি ক্যাম্পাসে নতুন আসা দেশি স্যারদের সাথে মোটামুটি উনারা আসার পরপরই আমাদের সাথে যোগাযোগ হয়ে যায়, এই স্যারের সাথে এটা হলো না, আমি একটু কষ্ট পেলাম এতে।

নতুন সেমেস্টারের ক্লাস রুটিন হাতে পেলাম, দেখলাম, ইলেক্ট্রিক্যাল পাওয়ার সিস্টেম পড়াবেন MAC; MAC মানে কী হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব পেরেশানি। স্যার আসলেন, অতি সাধারণ মানুষটি ক্লাসে এসে একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বললেন, মাই নেইম ইজ মুহাম্মদ আলী চৌধুরী। আই উইল টিচ ইউ…!

প্রথম দিনে উনার কথা ছিলো, আমার কথা ভালো করে শোনো, আমি যে রেফারেন্স ম্যাটেরিয়াল তোমাদেরকে পড়তে বলবো, তা ঠিকমতো পড়ো, তাহলেই তোমরা সবাই এই বিষয়ের পন্ডিত হয়ে যাবে। ক্লাসের সকল ছেলেমেয়ের কী খুশি, হাততালি আর টেবিল চাপড়ানোর শব্দে আমাদের কান তালা লাগার জোগাড়। অন্যান্য সব শিক্ষকদের ক্লাসে উনারা রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দিতেন, আর এই লোকটি বলে দিলেন যে, আমার ক্লাসে মনোযোগ দিও, আর কয়েকটি রেফারেন্স পড়লেই তোমরা এই সাবজেক্টের গুরু হয়ে যাবে। সেই থেকে শুরু, স্যারের ক্লাসে কাউকে কোনো দিন অনুপস্থিত থাকতে দেখিনি। উনি গল্পের মতো করে পাওয়ার সিস্টেমের কঠিন বিষয়গুলো পড়িয়ে দিতেন। প্রতি সেমেস্টারের পর স্যার সবসময় ছাত্রদের কাছ থেকে ডিপার্টমেন্টের সকল শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেটিং পেতেন। তার অফিস রুম ছিল সবার জন্য খোলা। এখনো চোখে ভাসে, স্যার একদিন আমাকে বললেন সবাইকে নিয়ে উনার অফিসে আসতে। আমরা প্রায় ১৫-২০ জন উপস্থিত, স্যার সবাইকে পেট পুরে খাওয়ালেন ঐদিন।

একদিন আমাকে ডেকে বললেন, “ইমাদ সাহেব! আমার কাছে কিছু টাকা আছে, আপনি দেশে কোনো গরিব লোকের কাছে পাঠাতে পারবেন?” ইউনিভার্সিটি উনাকে একটা হাউসিং এলাউন্স দিতো। উনি একা মানুষ, অত টাকা তো বাসা ভাড়ায় খরচ হয় না, তাই বাকিটা উনি ফেরত দিতে HR ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন। ওরা তো বুঝতেই পারেনি, উনি আসলে কী বলছেন।

একদিন উনি অনেকগুলো আম কিনে আমাকে দিয়ে বললেন, ইমাদ সাহেব, এগুলো আপনার জন্য, আপনাকে আজকে স্টুডেন্ট ইউনিয়নে বক্তৃতা দিতে দেখেছি, তাই আপনাকে এটা উপহার। স্যার সবাইকে আপনি-আপনি বলতেন, কাউকে তুমি করে বলতে পারতেন না। আর আমাকে সবসময় ডাকতেন ইমাদ সাহেব বলে। উনার দরাজ কণ্ঠের “ইমাদ সাহেব” ডাকটি এখনো কানে বাজে।

থার্ড ইয়ারে উঠলাম। ইতিমধ্যে স্যারের সাথে অনেক সখ্যতা, কোনো একটা কারণে স্যার আমাকে খুব আদর করতেন। (আমি উনার কোর্সে এ-প্লাস পেয়েছিলাম, এই জন্যে হয়তো।) আমি আমার বাসায় থাকতে পারছি না, স্যার বললেন, চলে আসেন আমার বাসায়, একটা রুম খালি আছে ওখানে। সেই থেকে স্যারের বাসায় থাকা।

খুব সকালে স্যার আমাকে ফজরের নামাজের জন্য তুলে দিতেন, অনেকদিন ক্লাস এবং খেলাধুলা/জিম শেষে বিকেল বেলা বাসায় এসে দেখতাম, স্যার রান্না করে রেখেছেন। আমি আম খেতে খুব পছন্দ করতাম বলে আমার জন্য সবসময় আম এনে রাখতেন। ইতিমধ্যে দুই বছর ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ইউনিয়নে ইলেকশন করলাম, এবার যখন তৃতীয় বারের মতো দাঁড়াতে গেলাম, স্যার একদিন ক্লাস শেষে আমাকে ডেকে নিয়ে লাঞ্চে গেলেন, একটা নাতিদীর্ঘ লেকচার দিলেন পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়ার জন্য। সাথে আরেক স্যার, উনারই বুয়েটের ছাত্র ইফতেখার স্যারও ছিলেন, উনার কথা শুনে আমি ওখানেই আমার ইলেকশনের ইতি টানি। অনেক বছর পরে বুঝেছিলাম, ওই লেকচারটা আমার জন্য খুব দরকার ছিলো। স্যার অবশ্য পরে আমাকে বলেছিলেন, “ইমাদ সাহেব, আপনাদের মতো চ্যাংড়া পোলাপানরা আমাদের কথা ইদানিং আর শোনে না, কিন্তু আপনি শুনেছেন দেখে খুব ভালো লাগছে।”

একদিন দেখলাম, স্যার একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে করে একটা শার্ট এবং টুথপেস্ট নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন। উনি তখন সিঙ্গাপুর যাচ্ছিলেন ইন্টেল-এর ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য একটা কোর্স করাতে। আমি তো এটা দেখে হেসেই খুন, স্যার উনার মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, “ইমাদ সাহেব! সবকিছু তো ওখানে, এই ব্যাগের মধ্যে কী আছে, তাতে কী আসে যায়।”

অসম্ভব ভালো মনের এই মানুষটি আজ চলে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! আমি স্যারের মধ্যে আমার বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতাম। সারা জীবন উনি মানুষের উপকার করে গিয়েছেন। শুনেছি, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে দুই বছর সাব্বাটিকাল শেষ করে উনি যে টাকাটা জমিয়েছিলেন, তা দিয়ে ঢাকায় একটা কম্পিউটার ল্যাব করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ তার সকল গুনাহ-খাতা মাফ করুন। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন।

২২

ইমরান শাইভি / ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

তখন কেবল বুয়েট এ চান্স পেয়েছি। নিজেকে ব্যাপক হাই লেভেলের ভাবা শুরু করছি। বাংলাদেশের ‘সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি’ বলে কথা! সাবজেক্ট সিলেকশনের দিন একটু দেরি হয়েছে যেতে। ওএবি ভবনের নিচ তলায় হবে। খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শিওর হবার জন্য মামা টাইপ একজনকে জিজ্ঞেস করলাম “এই যে শুনছেন? নতুন ছাত্রদের ভাইভা/সিলেকশন কোথায় হচ্ছে?”

আমাকে উনি বললেন, “আপনি ঠিক জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছেন।” বাব্বাহ ব্যাপক তো কেবল চান্স পেলাম আর এত বয়স্ক একজন আপনি বলে সম্বধন করল! গর্বে বুক আর ২ ইঞ্চি চওড়া হয়ে গেল।

যাক, অবশেষে স্বপ্নপূরণ হবে। রুমের ভিতরে ঢুকে দেখি সেই মানুষটা ছাত্রদের সাথে কথা বলছেন। ডকুমেন্টগুলো দেখছেন। শুনলাম উনি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার। আমি তো আকাশ থেকে ধপাস করে পড়লাম। আশেপাশের কেউ সেই আওয়াজ না শুনলেও আমি বুঝেছিলাম বুয়েটে চান্স পেয়ে আমি এমন কোনো হনু হয়ে যাইনি। একজন প্রফেসর যদি এমন সাদাসিধে থাকতে পারে, আমি কোথাকার কে? স্যারের সাথে পরে আর একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। কিন্তু ওই একদিনেই যে লেসন পেয়েছি সারা জীবনের পাথেয় তা।

ভাল থাকবেন স্যার।

২৩

সন্দীপন স্যানাল/ ১১ই নভেম্বর, ২০১৪

সবাই মোহাম্মদ আলী স্যারকে নিয়ে কত গল্প লিখে। আমাদের আফসোস অন্য ডিপার্টমেন্টের বলে উনাকে নিয়ে তেমন কোনো ঘটনাই নাই। সামান্য যে ঘটনা আছে তাই শেয়ার করি।

শামসুল আলম স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। কী একটা প্রশ্ন করেছেন একজন কে। ঠিক না বেঠিক বলতে হবে। ছেলেটা অদ্ভুতভাবে মাথা নাড়াতে থাকে আর স্যার অবাক হয়ে উত্তরটা ডিকোড করার চেষ্টা করছিলেন।

মোহাম্মদ আলী স্যার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উনি দেখে ফেললেন। রুমে ঢুকে শামসুল আলম স্যারকে বলেন, “এইগুলারে চিনেন না। হ্যাঁ মানে Vertically মাথা ঝাকানো, না মানে horizontally। এইগুলা Diagonally মাথা ঝাকায়। আপনে এরে বলেন হ্যাঁ কি না।”

২৪

তন্ময় তাহমিদ / ৪ঠা এপ্রিল, ২০১৪

“…আমি কিন্তু তেমন কিছু পারি না। এখন টিচার হয়ে মান-সম্মান খোয়ানোর ভয়ে সব শিখতেছি।” বুয়েটের একজন প্রফেসর হয়ে এরকম কথা বলা মনে হয় শুধুমাত্র এই মানুষটার পক্ষেই সম্ভব।

আপাত দৃষ্টিতে স্যারকে বেশ গম্ভীর-প্রকৃতির মনে হয়। কিন্তু যাদের সৌভাগ্য হয়েছে স্যারের ক্লাস পাওয়ার তারা নিশ্চয় জানেন স্যার কেমন।

এই যেমন আমাদের ক্লাসে একদিন স্যার বললেন- “আপনারা তো এমনিতে শিখবেন নাহ। একটা গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড জোগাড় করে নিন। সে জিজ্ঞেস করলে তো আর “জানি না” বলতে পারবেন না। তখন বাধ্য হয়ে শিখবেন।”

আরেকদিন- “চাকরি পাওয়ার জন্য হইলেও কষ্ট করে পাশ করেন। ফেল করে কোচিংয়ে মাস্টারি করাইলে কিন্তু মেয়ের বাপ তখন মেয়ে দিবে না।”

স্যারের মহানুভবতা সম্পর্কে যা শুনেছি আর যা দেখেছি তা থেকে শুধু একটা কথাই মনে হয়- “এই লোকটা এত বস কেন !”

২৫

তানভির রানা তমাল/১৭ই জানুয়ারী, ২০১৪

এই তো মাস ছয়েক আগের কথা। স্যারের রুমে গিয়ে দেখি চার পাঁচটা চেয়ার এক করে উনি শুয়ে আছেন কাথা মুড়িয়ে। রিকমেন্ডেশন লেটার জলদি পাওয়ার জন্যে মিথ্যে বললাম। আসলে পনেরো দিন পর আমার ফ্লাইট। স্যারকে বললাম পাঁচ দিন পর ফ্লাইট। স্যার তিন দিন পর ফোন করে যেতে বললেন। গেলাম ছয় দিন পর। গিয়ে দেখি স্যার একই অবস্থায় শুয়ে। স্যার আমাকে দেখেই বললেন, “আপনি যাননি বিদেশ এখনো!”

স্যার খুব অসুস্থ ছিলেন। আবারো মিথ্যে বললাম “স্যার টিকেট দশ দিন পিছিয়েছি।” স্যার ইশারা দিয়ে দেখালেন আমার লেটারটা। লেটারটা নিয়ে ভাবলাম স্যারের পা ছুঁয়ে দোয়া নেই। স্যার বললেন “পা ছুঁয়ে সালাম করা মুসলিম রীতিতে নেই।” তারপর এমনিতেই দোয়া চাইলাম। স্যারও বললেন, “আমার জন্যও দোয়া করবেন। “

বাসায় এসে স্যারের লেটারটা পড়লাম। এতো অসাধারণ লেখনি! আমার CGPA খারাপ। বুয়েটে চান্স পাওয়াটাই বিশাল ব্যাপার। এটাকেই স্যার ফুটিয়ে তুললেন আর আমার খারাপ CGPA-টা ভিনদেশিদের কাছে আড়াল করলেন।

স্যার, জানি আমার ক্ষমা নেই। শুধু শুধু মিথ্যে বলেছি। সময় নিয়ে লেটারটা লিখলে আপনার পেরেশানি অনেক কম হতো। অনাহুত আমি আপনাকে ধকল দিয়েছি।

স্যার, আমার দেখা আপনিই সেরাদের সেরা। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার আকুল আকুতি স্যারকে সুস্থ করে দিন আর সুযোগ করে দিন নতুন নতুন EEE স্টুডেন্টদের এই মহান ব্যাক্তির শিক্ষা ও সান্নিধ্য পেতে। (লেখাটি স্যারের মৃত্যুর আগে লিখিত)

২৬

রিসালাত বারী /১৬ই জানুয়ারী, ২০১৪

একবার সোনালী ব্যাংক বুয়েট ব্রাঞ্চে টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। পিছন থেকে এক লোক ক্যাশে বসা ভদ্রলোকের পরিচিত হবার সুবাদে লাইন ভেঙ্গে এগিয়ে গেলেন। আমার পিছন থেকে একজন মৃদু গলায় কিন্তু দৃঢ়ভাবে এর প্রতিবাদ জানালেন। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি আমার ঠিক পিছেই মোহাম্মদ আলী স্যার লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। স্যারকে দেখে সেই ব্যক্তিও বিরস বদনে পিছিয়ে এল। আমি একটু তটস্থ হয়ে স্যারকে বললাম, “স্যার আপনি আগে দেন।”

স্যার বললেন, “আপনি তো আমার আগে থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি আগে দেন, তারপর আমি দিব।”

২৭

রিসালাত বারী / ১৫ই জানুয়ারী, ২০১৪

আমাদের সর্বশ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ আলী স্যার কখনোই খুব একটা হাসেন না। প্রচন্ড হাসির কথাও তিনি গম্ভীরমুখে বলেন, প্রচন্ড ঝাড়িও মৃদু কন্ঠেই দেন। তবে রেকমেন্ডেশন চেয়ে কেউ কখনো স্যারের কাছ থেকে খালি হাতে ফেরেনি। একবার বন্ধু আমির স্যারের কাছে গেছে রেকমেন্ডেশন নিতে। তিনি আমিরকে পরদিন এসে লেটার নিয়ে যেতে বললেন। পরদিন যথা সময়ে আমির স্যারের থেকে রেকমেন্ডেশন লেটার নিয়ে হাসি মুখে ফিরে এসেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবিস্কার হল লেটারের এক যায়গায় হিজ এক্সেলেন্সিকে “হার” সম্বোধন করা হয়েছে! আমির পরদিন আবার স্যারের কাছে যেয়ে সমস্যার কথা জানাল। স্যার অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেন, “এইটুকুর জন্য বুয়েটের সম্পদ খরচ করে আরেকটা লেটার প্রিন্ট করবেন? ফ্লুইড মেরে ঠিক করে নেন।”

২৮

তাইফ হোসাইন রকি/ ৫ই জুন, ২০১৩

তড়িৎ কৌশলের প্রথম বর্ষের প্রথম দিনের একটি ক্লাস শুরুর আগ মুহূর্ত। চরম হই চই চলছে। এমন সময় একজন এসে একটি ন্যাকড়া দিয়ে আগের স্যারের লিখে যাওয়া ক্লাস লেকচার মুছলেন।

সবাই উৎসুক ও আনন্দিত, বোর্ড যখন মোছা হয়েছে, নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মাঝে স্যার আসবেন। তারপর তিনি বললেন, “আপনারা কথা শেষ করুন।” আমরা পুলকিত, আপনি করে বলল যে! “আমি আপনাদের ডিসি সার্কিট ক্লাস নিব।”

পরের বাক্যে জেনেছিলাম, তাঁর নাম “মোহাম্মদ আলী”।

২৯

শাহরিয়ার রিস্তা/ ৫ই জুন, ২০১৩

স্যারকে প্রথম দেখায় আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নাই, ডেকেছিলাম আঙ্কেল বলে।

ঐদিন অ্যাডভাইজর স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়ে তাঁর রুম বন্ধ পাই। আলী স্যার তখন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আমি না বুঝেই স্যারকে আঙ্কেল বলে সম্বোধন করে অ্যাডভাইজর স্যারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি। স্যার আমাকে অনেক পরামর্শ দিলেন, কীভাবে কোর্স রেজিস্ট্রেশন করব বুঝিয়ে দিলেন। তখন কেবল বুঝতে পারি তিনি আমাদের স্যার।

স্যার চলে যাবার পর আমার মুখটা হাঁ হয়েগেছিল, ঠিক মাননীয় স্পীকারের মতো।

স্যার এত ভাল!

৩০

মোঃ আর ইসলাম/ ১লা জুন, ২০১৩

মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার; CGPA অনুযায়ী রেকমেন্ডেশনের ফরম্যাট ছিল স্যার এর কাছে। একদিনেই রেকমেন্ডেশন দিয়ে দিতেন স্যার। শুধু তা-ই নয়, কোনো কিছু সত্যায়িত করার জন্য তার কাছে গেলেও তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। একদিনের ঘটনা, স্যার তখন ডিপার্টমেন্টের হেড। স্যারের অফিসে গিয়ে দেখি চেয়ার খালি, স্যার শুয়ে আছেন সোফাতে, পায়ের উপর পা তুলে। আমাকে দেখে বললেন, “কী? সাইন লাগবে? আসেন দিয়া দেই।” শোয়া অবস্থাতেই হাঁটুর উপর কাগজ রেখে আমাকে সাইন করে দিলেন। আমার পেছনে ছিল BIT এর এক এমএস স্টুডেন্ট। সে হতভম্ব হয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখছিল। খুব মজা পেয়েছিলাম সেদিন।

৩১

রিয়াজ আহমেদ খান/ ১২ই মে, ২০১৩

একটি খামখেয়ালির উদাহরণ এবং একজন দয়ালু মহানুভব শিক্ষক

ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার কিছুদিন পর। আমার এক বন্ধু সকাল ১১টায় (ল্যান্ড ফোনে) ফোন করে বলল আমি যেন একটু ওদের বাসায় যাই।

আমি গেলাম। সকালের নাস্তাটা শেষ করে আমাকে বলল, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আজকে আমাদের ভর্তি হবার দিন।”

আমার তো চক্ষুস্থির। বলে কী! আজ ভর্তির তারিখ থাকলে তো এতক্ষণে সব সাঙ্গ হয়ে গেছে। আর এটা মনে হবার কী আছে! ব্যাটা বুয়েটে চান্স পেয়ে গেলি আর প্রশাসনিক কাজকর্ম কবে সে বিষয়ে তোর খবর নেই! উল্লেখ্য, আমার টেনশনটা হচ্ছিল তার জন্য। কারণ সে বোঝাচ্ছিল স্থাপত্যের কথা, যেটায় ওর ভর্তি হবার কথা।

যা-ই হোক, হু-হা করে ছুটে এলাম বুয়েটে। খোঁজ-খবর নিয়ে এলাম OAB এর সামনে। সিকিউরিটি মামা সব শুনে বলল, সব শেষ। আরও জানা গেল, স্থাপত্যের ৫৫ টা সিট ভরাট করতে মেধাক্রম ৮৭ পর্যন্ত গিয়ে থেমেছে। আর আমার বন্ধুবরের মেধাক্রম ৬০।

এরপর আর কী করা! দেখা করলাম ওই বছরের ভর্তি কমিটির প্রধানের সাথে। বকা ঝকা, ঝাড়ি দেওয়া, পার্ট নেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি তো দূরে থাক, উল্টো তিনি আশ্বাস দিলেন, কেউ ভর্তি বাতিল করামাত্রই তাকে ডাকা হবে। আর মেডিকেলের পরীক্ষা যেহেতু তখনও হয়নি, ভর্তি বাতিলের সম্ভাবনাও প্রবল বলে তিনি মন্তব্য করলেন।

এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে আমার বন্ধু দেখা করত ভর্তি কমিটির প্রধানের সাথে। স্যার শুধু বলতেন, “আপনার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সব আছে। আপনার প্রতিদিন কষ্ট করে আসতে হবে না। আমিই আপনাকে জানাব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।” তবে কোনদিন এতটুকু বিরক্তি দেখিনি।

অবশেষে সত্যি স্যার ফোন দিলেন। এবং খামখেয়ালির উৎকৃষ্ট উদাহরণ স্থাপন করেও আমার বন্ধুবর কয়েকটা দিন টেনশন করা ছাড়া আর কোনো শাস্তিই পেল না। আনন্দচিত্তে ভর্তি হল স্থাপত্যে।

বি.দ্র: দয়ালু স্যারের নাম ছিল মোহাম্মদ আলী চৌধুরী।

৩২

খালিদ ইমতিয়াজ সাদ/ ১২ই মে, ২০১৩

স্যার যে আসলেই কতটা সিম্পল, তা স্যারের এক সাক্ষাৎকার থেকে বোঝা যায়। সাক্ষাৎকারটা সম্ভবত কোনো ব্যাচের বের করা ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম।

স্যারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “আপনি বুয়েটে কেন পড়লেন?”

স্যারের জবাব, “বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল দুটাতেই চান্স পেয়ে বসে আছি। আমাদের সময়ে বুয়েটে ক্লাস শুরুর আগেই DMC-তে ক্লাস শুরু হয়েছিলো। গেলাম সেখানে ক্লাস করতে। প্রথমদিনই ম্যাডাম বললেন, ক্লাসে সবদিন জুতা পরে আসতে হবে। অগত্যা বুয়েটে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না!”

৩৩

তানভির আহমেদ/ ১১ই মে, ২০১৩

১-১ এ আমাদের সার্কিট-১ এর ক্লাস নিতেন জাহাঙ্গীর আলম স্যার । উনি মাঝেমধ্যে ক্লাসে আসতে পারতেন না । তখন কোনো পিয়নকে পাঠাতেন আমাদেরকে জানানোর জন্য যে আজকে উনি ক্লাস নিবেন না ।

একদিন সার্কিট ক্লাসে সবাই স্যারের জন্য অপেক্ষা করে আছি । দেরি হচ্ছে দেখে ভাবলাম স্যার হয়ত আজকে ক্লাস নিবেন না । কিছুক্ষণ পর পুরনো, ইস্ত্রিবিহীন ও কুঁচকানো শার্ট এবং প্যান্ট পরিহিত এক প্রবীণ ভদ্রলোক ক্লাসে প্রবেশ করলেন । দেখে ভাবলাম, স্যার হয়ত উনাকে পাঠিয়েছেন আমাদের জানাতে যে আজকের ক্লাসটি হবে না । কিন্তু উনি কিছু না বলেই সোজা বোর্ডের দিকে চলে গেলেন । তখন ভাবলাম আজকে যে ক্লাস হবে না সেই নোটিশ উনি বোর্ডেই লিখে দিবেন । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি লিখলেন, “Inductor”। এরপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাদের স্যার অসুস্থতার কারণে কয়েকদিন ক্লাস নিতে পারবেন না, ততদিন আপনাদের ক্লাস আমিই নেব।” উল্লেখ্য, স্যার সবাইকে আপনি করে বলেন।

ততক্ষণে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া! বুঝতে পারলাম যে উনি আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই একজন শিক্ষক। এবং উনার প্রথম ক্লাস করেই আমি মুগ্ধ! পরে ক্লাস শেষে জানতে পারলাম যে উনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের (এবং বুয়েটেরই) অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ‘মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার’। স্যারের নাম আগেও অনেকবার শুনেছিলাম, কিন্তু চেহারায় চিনতাম না।

পরবর্তীতে আরও দুটি কোর্সে স্যারকে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়। প্রথম ক্লাসের সেই মুগ্ধতা তো কমেইনি বরং বেড়েছে বহুগুণ। স্যারের প্রশংসা করাটা নিতান্তই বাহুল্য, তাই সেটা করব না। তবে এটা সত্য যে স্যারকে দেখলে শ্রদ্ধায় আপনা-আপনি মাথা নুয়ে আসে। আমার ধারণা, এ ব্যাপারে ইইই ডিপার্টমেন্টের সবাই আমার সাথে একমত হবে ।

৩৪

রহমান মাহফুজ/১১ই মে, ২০১৩

আমি সিএসই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। ডিপার্টমেন্টের একটা প্রজেক্টের জন্য স্যারের কাছে গেছিলাম। বলাই বাহুল্য, ধরে নিয়েছিলাম স্যার ঝাড়ি মেরে বিদায় করে দিবেন। কিন্তু স্যার আমাকে সেদিন সময় দিলেন ২ ঘন্টা। একবারও বলেন নাই যে আমি অন্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্র হয়ে নন-ইইই কোর্সের ব্যাপারে তাঁর কাছে কেন গেলাম। অদ্ভুত ভাল একটা মানুষ।

৩৫

শাহরিয়ার জাহান পল্লব/১১ই মে, ২০১৩

আমাদের ক্লাসটা খুবই লাকি যে আমরা ১-১ (প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টার) এ সার্কিটের একেবারে প্রথম কোর্সেই স্যারকে পেয়েছিলাম। সার্কিটের ভিত্তি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই কোর্সের পরীক্ষা যেভাবে বুঝে দিয়েছিলাম, অন্য কোনো সার্কিট কোর্স সেরকম বুঝে দিতে পারি নি। ১-২ তে এসি সার্কিট পড়ার পরেও রেজোন্যান্স জিনিসটা আসলে কি বুঝি নি, খালি হিসাব শিখেছি। লেভেল ৩ এ উঠে পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্স কোর্সের একটা প্রবলেম বুঝতে না পেরে কোর্স টিচারকে না পেয়ে স্যারের কাছে যখন গেলাম, তখন প্রসঙ্গ আসায় স্যার রেজোন্যান্স ১০ মিনিটে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন।

৩৬

সার্থক মুনাসিব / ১১ই মে, ২০১৩

৪-১ এ উঠে স্যারের পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্স কোর্সটা করি। অনেকেই যখন আমাদের অ্যাডভান্সড বই পড়ার উপদেশ দিতেন (৪-১ এ উঠে গেছি, বড় হয়ে গেছি তো), তখন উনি বলতেন, “বিএসসিতে শুধু বেসিক ক্লিয়ার করেন। আর কিছু করতে চাইলে পরে কইরেন।”

৩৭

খালিদ ইমতিয়াজ সাদ/১০ই মে, ২০১৩

সম্ভবত ১-২ এর কথা। ওএবি বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির কোনার মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছি স্যান্ডেল বাইরে রেখে। ভাবলাম, বুয়েটের একেবারে মাঝ দিয়ে কে স্যান্ডেল নেবে? কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। নামাজ শেষে বের হয়ে দেখি নতুন কেনা স্যান্ডেলটা চুরি হয়ে গেলো! তখন হলেও সিট পাইনি। কী করবো বুঝতে না পেরে ইইই এর লিজেন্ডারি মোহাম্মদ আলী স্যারের রুমে গেলাম (তখন উনার রুম ওএবিতে ইলেক্ট্রনিক্স ল্যাবের পাশে ছিলো)।

স্যারকে বললাম, “স্যার, নামাজ পড়তে গেছিলাম। বের হয়ে দেখি স্যান্ডেল চুরি হয়ে গেছে।”

স্যার অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, “টেবিলের নিচে কিছু স্যান্ডেল আছে। এক জোড়া নিয়ে যান।”

টেবিলের নিচে বেশ কয়েক জোড়া পুরনো (সম্ভবত স্যারের ব্যবহৃত) স্যান্ডেল ছিলো। আমি সেখান থেকে একটা নিয়ে স্যারকে থ্যাংকস দিয়ে চলে গেলাম!

এখন সে কথা মনে পড়লে মনে হয়, কী ভেবে যে ঐদিন এই প্রবলেম নিয়ে স্যারের কাছে গিয়েছিলাম! অন্য কোনো স্যার হলে যে কী করতেন, আল্লাহই জানেন! অবশ্য অন্য কোনো স্যারের কাছে যেতামই না!

স্যার এখন অসুস্থ। তবুও মানসিক জোর অসাধারণ। তাঁর মতো এতো শক্ত মনের অসাধারণ মানুষ আমি জীবনে অনেক কম দেখেছি।

৩৮

স্বজন হক/ ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

উনি ছিলেন বড্ড অন্যরকম, ঝাড়ি দেওয়া, প্রেশার দেওয়া, এসব যেখানে কমন ব্যাপার, সেখানে স্যার সবসময় চাইতেন অন্যভাবে সবাইকে শেখাতে।

বুয়েটে এটেন্ডেন্সের ৩০ মার্ক এর মতো বালাই আর কিছুর নাই। কেউ যদি হাবার মতো সবগুলা ক্লাসে বসে থাকে, তা-ও সে ৩০ মার্ক পাবে, আর যদি কেউ নিজে নিজে পড়ার চেষ্টা করে ক্লাসে না গিয়ে, সে পাবে শূন্য। স্যার এজন্য পরোয়াই করতেন না এটেন্ডেন্সের। উল্লেখ্য, আমার রুমমেটের চেয়ে তার রোলের পাশে স্যারের ক্লাসে আমার সাইন ছিল বেশি। স্যার এসব কেয়ার করতেন না।

কিছু কথা দারুণ লাগত, “আইনস্টাইন হইয়েন না এখন। বেশি বুইঝেন না, মাস্টারকে ফলো করেন।” আজ ৩ বছর পরও কথাগুলা কানে বাজে, এখন যেন কথাগুলোর অর্থ আরো বেশি বাস্তবধর্মী মনে হয়।

একজন মানুষ কতটা নিরহংকারী হতে পারে, তা স্যারের লেবাস আর কাজকর্ম দেখলেই বুঝা যায়। সাদা পাঞ্জাবি, গুটানো হাতা, কালো প্যান্ট, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল । উনি IEEE থেকে সেরা রিসার্চ পেপারের জন্য পুরষ্কার পাওয়া মানুষ। কিন্তু নদী যত গভীর হয়, তার স্রোত তত কম হয়। তাই স্যার সবসময় থেকে গেছেন পর্দার আড়ালে।

ভাল থাকবেন স্যার। আল্লাহ আপনাকে জান্নাত নসীব করুন, আমিন।

৩৯

ইসলাম এজ/ ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

আমার স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। স্যারই বুয়েট জীবনে আমার প্রথম ইইই শিক্ষক এবং বুয়েটে করা প্রথম ক্লাসটাও তাঁর ছিল, ক্লাসে কী হয়েছে খুব বেশি মনে নেই। কিন্তু কিছু জিনিস মনে পড়লে আজও অবাক লাগে আর আল্লাহর কাছে ধন্যবাদ জানাই এরকম একজন মানুষের ছাত্রী হবার সৌভাগ্য দেয়ার জন্য। ক্লাসে প্রথম এসে বলেছিলেন, উনার শরীর খুব একটা ভাল থাকে না, তাই উনি ফোন নাম্বারটা দিতে চাচ্ছেন না। তখনও জানতাম না স্যার কিছুদিন আগে ক্যান্সার থেকে রিকভারি করেছেন। স্যারের প্রথম সিটিতে যারা যারা খারাপ করল, স্যারই তাদের কনসেপ্ট ঠিক করার ব্যবস্থা করে দিলেন, তাদের কাছাকাছি রোল যে ভাল করেছে তাকে ঠিক করে দিলেন বুঝাবার জন্য এবং এটাও বললেন যে উনি যদি না বুঝে পরীক্ষায় খারাপ করে তাহলে সেই দায়ভার আপনার। তখন পরীক্ষায় খারাপ করায় আসলে ভাবলেশহীন হয়েছিলাম। কিন্তু পরে খুব অবাক লাগতো ভাবতে যে কয়জন টিচার এরকম সিন্সিয়ারলি চায় যে তাঁর প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট ভাল করুক, জিনিসগুলো বুঝুক এবং সেটার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেক? তখন খারাপ করেছিলাম দেখে খুব মন খারাপ ছিল, কিন্তু আজকে সেই খাতাটা হাতে নিয়ে খুব অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল। সেদিন যদি ৩০/৩০ পেতাম, এই লেখাগুলো তো পেতাম না।

Courtesy: ইসলাম এজ

আরেকটা খুব সুন্দর ব্যাপার ছিল স্যারের। সাধারণত ক্লাসে আমাদেরকে সহজ জিনিস শিখিয়ে, যেটা কখনো দেখিওনি, সেটা এক্সামে দেয়া হয়। কিন্তু স্যার ক্লাসে মোটামুটি সবথেকে কমপ্লেক্স সার্কিটটা ধাপেধাপে সল্ভ করে বেসিকটা শিখাতেন।

১-১ এই আরেকটা ঘটনা ঘটল। স্যারের সেকন্ড সিটিটাও খারাপ হলে অনেক বেশি হতাশ লাগছিল। তখন স্যার ডেকে নিয়ে বললেন, সিটি নিয়ে ভয় না পেতে। তিনি এমন মানুষও দেখেছেন যে কিনা সিটি বেশি ভাল না করেও ২০০/২১০ পেয়েছে টার্মে। তারপর আমি স্যারকে বললাম, স্যার বেশি সমস্যা হলে কি পিএল এ এসে দেখা করতে পারি? যদিও স্যার খুবই অসুস্থ ছিলেন, তা-ও মাথা নেড়ে সায় দিলেন। যদিও আর পরে যাইনি, কিন্তু উনি যে কী পরিমাণ একজন ডেডিকেটেড শিক্ষক ছিলেন, এটা তার একটি ছোট উদাহরণ।

এরপর আমরা পরের টার্মেই স্যারকে ল্যাব টিচার হিসেবে পেয়ে গেলাম। একেকটা জিনিস মাথায় ঢোকানোর সমস্ত দায়িত্ব উনি নিতেন। এরপর আশায় ছিলাম ৪-১ এ আরেকবার এই মহামানবের ক্লাস পাব। তাই হয়ত কথিত আছে “Man proposes God disposes“।

স্যার, আমাদের “আলোকবর্তিকা” নামের একটি বুকশেলফ হবার পর পর সব থেকে আনন্দ লেগেছিল যখন শুনেছিলাম আপনি আমাদের বুকশেলফটার সামনে দাঁড়িয়ে বইগুলো দেখছিলেন। আপনার আগ্রহ আমাদের প্রথম প্রাপ্তি ছিল। আপনি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় খুব মিস করতাম বিকালের সময়টা, যখন আপনি লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে লিফটের অপেক্ষা করতেন আর আপনাকে সালাম দিলে স্মিত হাসিমাখা মুখে সালামের উত্তর দিতেন। অনেক অনেক কিছু করার কথা ভেবেছিলাম। মনে আশা ছিল, আপনাকে আবার আমাদের মাঝে ফিরে পাব, যেমনটা আপনাকে পেয়েছিলাম ১-১ এ। অল্প সময়ের জন্য হলেও আপনাকে যে আমরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি, আপনার সান্নিধ্য লাভ করেছি, আল্লাহকে তার জন্য ধন্যবাদ। আল্লাহ স্যারকে জান্নাতবাসী করুন। (আমীন)।

৪০

হায়দার জাহান পরাশ/ ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

বুয়েটে আসার আগে শুধু সাহাবাকেরামের নিরহংকারের কাহিনী কিতাবে পড়েছি। কখনও নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বুয়েটে এসে সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে স্যারকে দেখার পর। উনার সাদাসিধা লেবাস, স্পঞ্জ, সাদা পাঞ্জাবী, কাল প্যান্ট- প্রতিটা সময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে কীভাবে গরিমা করার সকল কারণ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে আড়ালে রাখা যায়। স্যারের একটা কথা এখনো মনে আছে, “ম্যাথ অলিম্পিয়াডের মানুষ আমার রুমে এসে আমাকে কায়কোবাদ স্যারের রুম কোথায় জিজ্ঞাসা করে, আমিও দেখায় দেই। মনে করে আমি পিয়ন।”

কিছু মানুষকে সালাম দিতে পারলে মনে প্রশান্তি আসে। স্যার ছিলেন তাদের মাঝে একজন। হয়ত আর কখনও ইসিই-তে আপনাকে দেখা হবে না। আর কখনও আপনাকে সালাম দেওয়া হবে না। হয়ত আর কখনও আপনার ক্লাসে বসা হবে না। ভরাট কন্ঠে “কী করছেন?” ল্যাবে গেলে আর শুনতে পারব না । তবে আপনাকে কখনও ভুলব না । ভুলব না “ইঞ্জিনিয়াররা হল গাধা ”। আশা ছিল আপনার সাথে মু’আনকা করার। তা আর হল না। ৩ বছরের ছোট বুয়েট লাইফে আপনাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ্‌ তা’য়ালার শুকরিয়া। আশা রাখি আল্লাহ্‌ তা’য়ালা আপনার আসল বাড়ির যাত্রাকে সহজ করে দিবেন এবং আপনাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করবেন।

৪১

লতিফুর রহমান তানজিল/২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যাদের জন্য এখনও স্রষ্টা করুণা করে সূর্য উঠান। অবচেতন মন এই মানুষের জায়গা দেয় হৃদয়ের গভীরতম স্থানে। এই ধরনের মানুষকে সালাম দিতে না পারলে কেন যেন নিজেকে নিজের কাছে অসহায় মনে হয়। এই রকম একজন মানুষকে আরেকবার দেখার ইচ্ছা ছিল। আরেকটাবার সালাম দেয়ার ইচ্ছা ছিল । ভাল থাকবেন ড. মোহাম্মদ আলী স্যার। যে মহাশক্তি মানুষের জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যান সেই শক্তির কাছে প্রার্থনা, মানুষটা যেন সেই অদৃশ্য জগতে ভাল থাকেন। খুব ভাল থাকেন।

৪২

মিনহাজ খান/১৩ জুলাই, ২০১৩

অনেক দিন ধরে স্যারকে নিয়ে লিখব ভাবছিলাম। কিন্তু এত বড় মানুষকে আমি কিছুতেই কোনো লেখায় প্রকাশ করতে পারব না। তাই তার কথাগুলো লিখলাম যা সবার জন্য পাথেয় হতে পারে।

২০০০ ব্যাচের বিদায় অনুষ্ঠানে স্যারের ভাষণটা এখানে দিলাম। অনেক সিনিয়র-জুনিয়রের এর সেটা শোনা হয় নাই। হয়ত আপনাদের/আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে সাহায্য করবে এটা।

মোহাম্মদ আলী স্যারের ভাষণ

সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ, উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, বিশেষ করে বিদায়ী ছাত্র ছাত্রীরা। আজকে আসলে আমরা পরপর তিন ব্যাচকে বিদায় জানানোর প্রথম ব্যাচ বিদায়ী অনুষ্ঠান করছি। আপনাদের পরে ছয় মাস পর পর আরো দুটো ব্যাচ বের হবে, সুতরাং , বেসিক্যালি আমরা কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের বিদায় জানানোর জন্য এক বছর অপেক্ষা করব না, অপেক্ষা করব আর ছয় মাস। আপনারা আপনাদের ছাত্র-ছাত্রী জীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন সেটাই স্বাভাবিক।

কেউ শিক্ষকতা করবেন, কেউ টেলিকমে ঢুকবেন, কেউ পাওয়ার কোম্পানিতে ঢুকবেন, সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু বুয়েটের Electrical and Electronic Engineering ডীপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রীদের মেইন প্রফেশন কিন্তু বিদেশে যাওয়া। দেশে টেলিকম কোম্পানি কিংবা পাওয়ার কোম্পানিতে, অথবা অন্য কোথাও চাকরি বাকরি এখন কিন্তু Electrical and Electronic Engineering এর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য মেইন অক্যুপেশন হয়নি। এবং ভবিষ্যতেও কিন্তু আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটা হবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

কারণ টেলিকম কোম্পানিগুলো এখন যেভাবে এক্সপ্যান্ড করছে, সেগুলো এক্সপ্যানশন আমার ধারণা, আগামী তিন বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। এবং সে এক্সপ্যানশন যখন বন্ধ হবে, তখন শুধুমাত্র অপারেশনটাই তাদের কাজের মধ্যে থাকবে। এবং অপারেশনের জন্য কিন্তু কোনো কলকারখানা কিংবা কোনো ইন্সটলেশনে এ কোনো ইঞ্জিনিয়ার লাগে না। সেখানে লাগে হচ্ছে পলিটেকনিকের টেকনিশিয়ানদের। সুতরাং এক সময় আসবে যখন কোনো ইঞ্জিনিয়ার যদি সেই গুরু-শিষ্যের গল্পের মতো বিদেশ ভ্রমণে বের হয়েছে। গুরু খুব পন্ডিত লোক, শিষ্য আবার একটু লোভী ধরনের।

দুজনের এই গল্প সবাই জানেন আপনারা। দুজনে মিলে এক দেশে পৌঁছেছে। এখন পৌঁছানোর পরে দেখা গেল যে ওখানে ঘি এর দাম যা, দুধের দাম তা। লবণের দাম, চিনির দাম- সব সমান। শিষ্য তো দেখে এটার মতো দেশ আর হয় না। এখানে রসগোল্লা খাব আর ঘুমাব। গুরু বলে, “কী বাবা! যে দেশে লবণ চিনির একদাম, সেখানে থাকা ঠিক না।” তখন শিষ্য বলে, “না, কোনো অবস্থাতেই আমি এ দেশ ছেড়ে যাব না।” শিষ্যকে রেখে তো গুরু চলে গেল। এদিকে বাকি গল্প আপনাদের জানার কথা। শিষ্য খায় আর ঘুমায়। কারণ, পেয়েছে তো সস্তা।

সুতরাং, টেলিকমের চাকরি পেয়ে যদি কেউ যদি ফুর্তিতে ভাবতে থাকে যে, এক লাখ টাকা বেতন হবে, তখন সেই শিষ্যের যখন শেষ পর্যন্ত দেশে চোরের শাস্তি মৃত্যুদন্ড হলো, কাউকে না পেয়ে সেই শিষ্যকে নিয়ে আসল, কারণ সবচেয়ে মোটাতাজাটাকে ধরে নিয়ে আয়! তো, সবাই খুঁজে পেল শিষ্যকে, কারণ সে তো উঠেপড়ে ওই দেশে থেকে সস্তায় পেয়েছে সস্তায় খেয়েছে, মোটা হয়েছে, সুতরাং সবচেয়ে মোটা লোক কিন্তু ওকেই পাওয়া গিয়েছে। সুতরাং ওকে নিয়ে আসা হলো শূলে চড়ানোর জন্য। এখন আমাদেরও অবস্থা হবে তাই।

যখন একটা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আপনি প্রথমে ঢুকবেন বাইশ হাজার টাকা করে, তারপর উঠতে উঠতে এক লাখ টাকায় উঠবেন, তারপর যখন কোম্পানির এক্সপ্যানশন বন্ধ হয়ে যাবে, এটা কিন্তু দিদারুল আলম সাহেব আরো ভাল বলতে পারবেন– এটা আমেরিকার সিস্টেম। যখন কোম্পানি এস্ট্যাব্লিশড হয়ে যায়, তখন সবচেয়ে উপরের জনকেই ধরা হয়।

কারণ, তার বেতন সবচেয়ে বেশী, তার চাকরিটা যদি ছাঁটাই করে দেওয়া হয়, কোনো সংগঠন এসে কিন্তু তার চাকরীর জন্য কোনো সুপারিশ করবে না, এবং তার একজনের বেতনেই কিন্তু আর দশজনকে পোষানো যাবে। কারণ সবচেয়ে উপরে আপনাদের বেতন যখন এক লাখ টাকা, নিচের বেতন কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা। আমি বিশটা লোককে রেখে দিয়ে, আপনাকে যদি ছাঁটাই করে দেই, সেটাই সবচেয়ে ভাল হবে। সুতরাং, জিনিসটা আপনাদেরকে বুঝতে হবে। আপনারা লোভে পড়ে টেলিকম সেক্টরে থাকবেন। তিন বছর পরে টেলিকম সেক্টর শেষ হয়ে যখন পাওয়ার সেক্টর উঠতে শুরু করবে, সেই সেক্টরে যখন – এখনই কিন্তু পাওয়ার সেক্টরে বেতন ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে শুরু হয়।

Rural Power Company Limited, RPCL এ কয়েকদিন আগে একজন সিমেন্স থেকে চলে গেছে, কমিউনিকেশনের, চিনবেন হয়ত আপনারা– জানে আলম খান। সে কিন্তু সিমেন্স এর টেলিকম ছেড়ে RPCL এ গিয়েছে। টেলিকম ছাড়ার পরে এটা উঠবে কিন্তু পাওয়ারে। Electrical and Electronic Engineering এ এদেশে চাকরি সবসময় থাকবে, ঠিক একইভাবে, বুয়েটের EEE এবং CSE Department এর চাকরি কিন্তু আরো অনেকদিন থাকবে। CSE এর কিন্তু এখন, বাইরের গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরি নেই।

কারন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলি থেকে এখন CSE এবং BBA এর প্রায় পাঁচ হাজার করে বছরে বের হচ্ছে। সেজন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলি অথবা RUET, KUET, CUET এর গ্র্যাজুয়েটদের কিন্তু চাকরি পেতে অসুবিধা হবে। কিন্তু বুয়েটের গ্র্যাজুয়েটদের CSE এবং Electrical কোনোটারই কিন্তু আগামী চার-পাঁচ বছরে চাকরি পেতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে, এ অসুবিধা না হওয়ার মানে কি আমি একটা পাজেরো জিপে চড়ে, পকেটের মধ্য তিনটা মোবাইল রেখে, দেশে সেই শিষ্যের মতো চাকরি করব, নাকি আমার জ্ঞানার্জন করার জন্য একটু বাইরেও ঘুরে আসব, বিদেশের কষ্টটাও বুঝে আসব।

বিদেশে কষ্ট করে আসলে কিন্তু কিছুটা দেশের মর্যাদা বোঝা যায়। দেশে আমরা কী রকম আরামে আছি সেটা কিন্তু বিদেশে না গেলে বোঝা যাবে না। বিদেশে যখন পিএইচডি করতে যাবেন, মাস্টার্স করতে যাবেন, সকালে উঠেই প্রথম চিন্তা হবে সারাদিন খাব কী? পড়াশুনা কিন্তু খুব কম হবে, যত আরামের চিন্তাই করি, ওখানে সকালে উঠেই চিন্তা হবে যে দুপুরে খাব কী? বিকেলে খাব কী? বিকেলে গিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে হবে, কাপড় ধুতে হবে। এগুলিই হচ্ছে বিদেশের আনন্দ।

কিন্তু বিদেশের আনন্দের যে জিনিসটা আপনারা হয়ত ভাবছেন সেটা না। সবাই আমরা বড়বড় কথা বলি, আমিও বলি, টাকার পেছনে দৌড়িয়ে লাভ নেই, কিন্তু আসলে বিদেশে যাই আমরা টাকার পেছনে দৌড়ানোর জন্য। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমার কিন্তু একটা থিওরি আছে। থিওরিটা হচ্ছে, যারা ভাল ছাত্র, তারা কিন্তু আসলে সুযোগ-সন্ধানী। সুযোগ-সন্ধানী এই সেন্সে যে, পড়াশোনায় ভাল করলে হালচাষ করতে হবে না, রিক্সা টানতে হবে না। আরামে থাকা যাবে। এটার চিন্তাতেই কিন্তু লোকে পড়াশোনা করে। কীভাবে অল্প শ্রমে বেশী টাকা ইনকাম করা যায়, বেশী আরামে থাকা যায়, সেই উদ্দেশ্যেই কিন্তু আমরা লেখাপড়া করি। এখানে ৯৯ পার্সেন্ট ছেলেমেয়েই, আমরা নিজেরাও, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না আমরা লেখাপড়া শিখার জন্য লেখাপড়া শিখতে এসেছি। আমরা এখানে এসেছি, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রফেশনকেই বেছে নিয়েছি কিন্তু আমরা টাকার পেছনে ছুটবার জন্য।

আমরা অনেকে কিন্তু, যারা এখানে ভাল ভাল বক্তৃতা দিচ্ছেন, তাদের অনেকের স্বপ্ন থেকে যায় সাহিত্যিক হবে। তারা বড় নাট্যকার হবে, বড় গায়ক-গায়িকা হবে। এটাই কিন্তু মানুষের ছোটবেলার স্বপ্ন। কিন্তু সেই ছোটবেলার স্বপ্ন থেকে আমরা বিচ্যুত হই যখন নবম-দশম শ্রেণীতে আসি। প্রথম চ্যুজ করি সায়েন্সটাকে। সেই সায়েন্স চ্যুজ করার পেছনেই কিন্তু আমাদের প্রথম টাকার পেছনে ছোটার দৌঁড়টা শুরু হয়। সুতরাং, বড় গলায় কিন্তু এখানে, আমিও বলতে পারবো না, কেউ বলতে পারবে না যে, আমরা টাকার পেছনে ছুটি না। কিন্তু সেই ছোটাটাকে আমরা যুক্তিযুক্তভাবে, লিমিটের মধ্যে ছোটাটাই ভাল।

এটুকু বলেই আজকে শেষ করব। আপনারা আপনাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, আপনাদের কর্মজীবন সুন্দর হোক, এবং ভবিষ্যৎ জীবনে, সেটা কর্মজীবন, সাংসারিক জীবন কিংবা যেকোনো জীবনই হোক, যেখানেই থাকুন, সুখে থাকুন সেই কামনা করে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। ধন্যবাদ।

 

৪৩

মুহিবুল হক ভূঁইয়া/ ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

স্মৃতির পাতা থেকে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার

আমি ১৯৯১ সালে নটরডেম কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হই ১৯৯২ সালে। আমাদের ক্লাশ শুরু হয় ১৯৯৩ সাল থেকে। প্রথম সেমিস্টারে আমাদের ইলেক্ট্রিক্যাল সার্কিট ল্যাবের ক্লাশ চলছে। দুইজন শিক্ষক-শিক্ষিকা আমাদের ল্যাব করাতেন। একদিন আমাদের ল্যাবে একটি গ্রুপের যন্ত্রপাতি ঠিকমত কাজ করছে না। স্যার-ম্যাডামরা অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলেন না। এরপর ডেকে আনলেন এক ব্যক্তিকে। দেখতে খুবই সিম্পল একজন মানুষ- শার্ট পরেছেন কিন্তু অনেক ভাঁজ পরা, শার্ট ইন করাও নেই; পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা ঠিক হয়ে গেল এবং আমাদের সহপাঠীরা তাদের কাজ শেষ করল। পরে জানলাম সেই সাধারণের মত দেখতে ব্যক্তিটিই বিভাগের অসাধারণ এক মানুষ আমাদের সবার প্রিয় অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যার। কিন্তু স্যারকে আমরা প্রথম বর্ষে কোন ক্লাসে পাইনি!

এরপর আমরা দ্বিতীয় বর্ষে উঠলাম। সেবারও আমরা স্যারকে থিওরি ক্লাশে পেলাম না। কিন্তু ইলেক্ট্রিক্যাল মেশিন ল্যাব ক্লাসে পেলাম। একটি এক্সপেরিমেন্টে ভ্যারিয়াক দিয়ে আস্তে আস্তে ভোল্টেজ বাড়িয়ে মোটরে সাপ্লাই দিতে হবে হবে। আমি ভোল্টমিটার ধরে ভোল্টেজ মাপছি আর স্যার ভ্যারিয়াকের নব ঘুরিয়ে ভোল্টেজ বাড়াচ্ছেন। হঠাৎ আমার হাত লেগে গেল বেয়ার ওয়্যারের কপারের গায়ে। ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে মিটারের প্রোব হাতে নিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। স্যার বললেন, “আরে ডরাইয়েন না, কিচ্ছু হবে না, আমিতো আছি!” আবার এসে আমি ভোল্টেজ মাপা শুরু করলাম। তারপর থেকে আর কোনদিন এই কাজ করতে ভয় পাইনি।

এরপর তৃতীয় বর্ষে বি-সেকশনের বন্ধুরা স্যারকে পেল পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্স ক্লাশে। আমরা এ-সেকশনে পেলাম স্যারের অধীনে এই পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্স নিয়েই পিএইচডি করা অধ্যাপক ড. কাজী মুজিবুর রহমান স্যারকে। আমার নিজের ক্লাস নোট আর বি-সেকশনের বন্ধুদের কাছ থেকে ম্যাক স্যারের ক্লাস নোট নিয়ে পড়লাম। সেই কোর্সের পরীক্ষা বেশ ভালমতই দিলাম আর এ-প্লাস পেলাম।

সেই সময়ের আর একটি গল্পও মনে পড়ে গেল। ছেলেরা সবাই কী কারণে যেন অটো নিয়েছে, মানে ক্লাশ করবে না! স্যার তখন ইএমই বিল্ডিং-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে বসেন। আমাদের ক্লাস হয় থার্ড ফ্লোরে। স্যার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন। দোতলায় অধ্যাপক ড. রিজওয়ান খান (ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন উপাচার্য এবং এখন সেখানের অধ্যাপক) স্যারের সাথে দেখা। তিনি বললেন, “স্যার কষ্ট করে উপরে উঠে কী করবেন? আজ কেউ ক্লাস করবে না।” স্যারের জবাব, আমি গিয়ে দেখতে চাই কেউ এসেছে কি-না। আমার কাজ সময়মত ক্লাস নিতে যাওয়া। স্যার কিন্তু ঠিকই উপরে চলে গেলেন।

২০০০ সালে বুয়েটে যখন মাস্টার্সে ভর্তি হলাম তখনও স্যারের কোন কোর্স পাইনি। আমি থিসিস নিলাম অধ্যাপক ড. কাজী মুজিবুর রহমান স্যারের অধীনে। থিসিসের বিষয়- পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্স ড্রাইভ। মোহাম্মদ আলী স্যার তখন বিভাগের আশে-পাশে আমাকে দেখলেই জিজ্ঞেস করতেন, “কী? থিসিসের কাজে এসেছেন?” আমি “হ্যাঁ” বললেই জিজ্ঞেস করতেন, “কাজী মুজিব আসে নাই?” আমি যদি “না” বলতাম, উনি নিজে রুমে গিয়ে স্যারকে ফোন করে বিভাগে ডেকে আনতেন। এই ব্যাপারটা অনেকবারই ঘটেছে আমার ক্ষেত্রে। অবশ্য মুজিবুর রহমান স্যার এটা নিয়ে আমাকে কোনদিন কিছু বলেন নি। অবশ্য মোহাম্মদ আলী স্যারের ভাষার ব্যবহার ওই রকম ছিল না যে কোন স্যার পরে ছাত্রের উপর রাগ ঢালবেন!

আমার থিসিস চলাকালে অনেক সময়ই স্যারের রুমে যেতাম। স্যার তখন OAB বিল্ডিং-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে বসতেন। আর আমি ইএমই বিল্ডিং-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরের সুইচ গিয়ার ল্যাবে কাজ করতাম, অফিস ছুটির পর অথবা শুক্রবার দিন গিয়ে। একদিন গিয়েছি রাত নয়টা বেজে গিয়েছে। স্যার জুস আর বিস্কিট দিলেন। আমি না করাতেই বললেন, “আরে খান, খান। এতক্ষণ ল্যাবে কাজ করেছেন, ক্ষুধা পাইছে না? জুস খেলে শক্তি পাবেন।” স্যারের রুমেই একটি ফ্রিজে জুস আর ড্রিঙ্কস থাকত আর টিনে থাকত বিস্কিট, চানাচুর এবং টেবিলে থাকত নানান ফলমূল। স্যারের রুমে গিয়েছে, আর কিছু না খেয়ে ফিরে এসেছে এইরকম ছেলে-মেয়ে খুব কমই পাওয়া যাবে। সেদিন স্যারের সাথে গল্প করতে করতে দশটা বেজে গেল। স্যার বললেন, “যান এইবার বাসায় যান। আমিও বাসায় যাই। বাসায় গিয়া ভাত রাঁধতে হইব।” এই কথাটা কেমন যেন খুব করুন শোনাল, আমার খুব মায়া লাগল! আসলে স্যারতো ব্যাচেলর ছিলেন।

একসময় আমার থিসিস শেষ হল, সেটা ২০০২ সাল। মোহাম্মদ আলী স্যার আমার বোর্ডে ইন্টার্নাল মেম্বার। তখন অধ্যাপক ড. এম এম শহীদুল হাসান স্যার বিভাগের প্রধান (তিনি এখন ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য)। ডিফেন্সের সাতদিন আগে আমি সবাইকে থিসিসের খসড়া কপি দিলাম। ডিফেন্সের দিন প্রায় ৪৫ মিনিট ভালই প্রেজেন্টেশন দিলাম। প্রশ্নোত্তরের পর্ব আসলে স্যার আমাকে কোন প্রশ্নই করলেন না। এক্সটার্নাল মেম্বার (অধ্যাপক ড. খন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)-কে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর কোন প্রশ্ন আছে কি-না? উনি বললেন যে, “আমি এসেই ছাত্রের কাছে যা প্রশ্ন করার ছিল করে নিয়েছি আর কারেকশনও দিয়ে দিয়েছি।” (আসলে ডিফেন্স শুরু হতে একটু দেরি হওয়াতে রব্বানী স্যার তাঁর যা বলার শুরুতেই বলে নিয়েছিলেন)। হেড স্যার জরুরি একডেমিক কাউন্সিল মিটিং পড়াতে কিছুক্ষণ পরে চলে গিয়েছিলেন। তাই আর কোন প্রশ্ন আমাকে কেউ না করে আমাকে একটু বাইরে যেতে বলা হলে আমি বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলাম। তখন বেশ টেনশন হচ্ছিল না জানি কী হয়! এরপর আমাকে ভেতরে ডাকা হল। মোহাম্মদ আলী স্যার উঠে দাঁড়িয়ে প্রথম অভিবাদন জানালেন আমার মাস্টার্স ডিগ্রি কমপ্লিশনের। আর সেই সাথে খসড়া থিসিস ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এখানে যা যা লিখা আছে সে অনুযায়ী কারেকশন করে থিসিস জমা দিবেন আর শেষে কিছু প্রশ্ন আছে, সেগুলোর উত্তর শিখে নিবেন। শিক্ষক হতে হলে এর উত্তরগুলো জানা জরুরি।” আমি বাসায় এসে দেখি পাতায়-পাতায় স্যারের কলমের লাল কালির কারেকশন আর শেষে মোট ২২টি প্রশ্ন! আমি ভাবলাম স্যার যদি ডিফেন্স বোর্ডে এই প্রশ্নগুলো আমাকে জিজ্ঞেস করতেন তাহলে আমি সেখানেই শেষ!

যা-হোক কারেকশন শেষ করে দশ দিন পর থিসিসের বই বাঁধাই করে জমা দিতে বুয়েটে গেলাম। স্যারের সাথে বিভাগের অফিসের সামনেই দেখা। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “কাজ শেষ করেছেন?” আমি “হ্যাঁ” বলে স্যারকে একটা কপি দিলাম।

স্যার তখন বললেন, “যাক শিক্ষক হইছেন, মাস্টার্স করাটা ফরজ কাজ ছিল। এখন আর একটা ফরজ কাজ করেন, বিয়াটা সাইরা ফেলেন।

আমি বললাম, “স্যার সেটাও সেরে ফেলছি ইতিমধ্যে।”

স্যার বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ্‌। কিন্তু আমার পাত্রর লিস্ট থেকে একটা নাম কমিয়ে দিলেন। পাত্রী কি বুয়েটিয়ান?”

আমি বললাম, “না স্যার, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে।”

স্যার বললেন, “বুয়েটিয়ান বিয়া করেন নাই, ভালই করছেন; ঝগড়া লাগলে দুই পক্ষই আমার কাছে বিচার লইয়া আসে। আমি তখন কোন দিকে যাই?”

২০০৩ সালের জুন মাসের কথা। জাপানের হিরোশিমা ইউনিভার্সিটিতে একটা রিসার্চ কাজে যোগ দিতে যাব। ওরা আমার সিভি দেখে বলল, যেহেতু তোমার সিভিতে আছে বুয়েটের টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ছিলে (মাস্টার্স করার প্রথম সেমিস্টারে পাঁচ মাসের জন্য ছিলাম, পরে এআইইউবি-তে লেকচারার হিসেবে যোগ দেয়ার পর আর রিনিউ করিনি) সেটার কোন সার্টিফিকেট দেখাতে পারলে বেতন আর একটু বাড়িয়ে দেয়া যাবে। কারণ, বুয়েটে যে কোন কাজের অভিজ্ঞতার একটি মূল্য আছে! তখন স্যার বিভাগের প্রধান। স্যারকে গিয়ে বললাম এবং একটা ড্র্যাফটও নিয়ে গেলাম। বলাই বাহুল্য, আর একজনেরটা দেখে নকল করে লিখা। স্যার পড়ে শুধু একটা শব্দ পরিবর্তন করতে বললেন, “ইংরেজির দক্ষতা দেখি এক্কেবারে এক্সিলেন্ট লিখেছেন, বুয়েটে ইংরেজীতে বি+ আর টোফেলে ৫৫০+ স্কোরধারীকে কি এক্সিলেন্ট বলা যায়? সেটা রিপ্লেস করে লিখেন ভেরি গুড।” আমি সে অনুযায়ী বিভাগের অফিস থেকে কারেকশন করে স্যারের কাছে নিয়ে গেলাম। স্যার সেটা সই করে দিলেন, তবে স্যারই বললেন দুই কপি করে নিতে। আমি এখনও কাউকে রিকমেন্ডেশন লেটার দিতে গেলে স্যারের এই মেথডটা ফলো করি, কাগজপত্রগুলো দেখে তারপর কমেন্টগুলো লিখি এবং স্যারের মতই কাউকেই ফিরিয়ে দেই না।

২০০৫ সালের কথা। তখন আমি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশল বিভাগের প্রধান। ল্যাবের ডেভেলপমেন্ট করতে হবে। কারণ তখন সেখানে বলার মত কিছুই ছিল না। স্যারের কাছে গিয়েছি মতামত নিতে। স্যার তখনো বিভাগের প্রধান। স্যরের রুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার আমাকে বললেন, “আরে দাঁড়াইয়া আছেন ক্যান? আমিও হেড, আপনিও হেড। আরে বসেন, বসেন। একটু গল্প-সল্প করি।” তারপর বললেন, “ফ্লপি থাকলে দেন।” আমি ব্যাগ থেকে ফ্লপি ডিস্ক বের করে দিলাম। স্যার সেখানে বুয়েটের ইইই বিভাগের যাবতীয় এক্সপেরিমেন্ট শীটের ডক ফাইল আমাকে কপি করে দিয়ে দিলেন। আর বললেন, “এগুলো পড়বেন আর সেই অনুযায়ী ল্যাবগুলো বানাবেন। ল্যাব ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশুনা হয় না। মালিকরা ব্যবসায়ী, তাঁরা হয়ত এত ল্যাব-ট্যাব করতে চাইবে না; কিন্তু আপনারা শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের ঠকাবেন না।”

এরপর বছর দুয়েক পর আমি ড্যাফোডিলে তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগ খোলার উদ্যোগ নিলাম। সেবার স্যারের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে আবারও আমার কাছ থেকে ফ্লপি ডিস্ক নিয়ে বুয়েটের ইইই প্রোগ্রামের সিলেবাস পুরোটা কপি করে দিয়ে দিলেন। আর বললেন, “এটা অনুযায়ী সিলেবাস বানান, তবে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো একটু ইংরেজির উপর জোর দিতে চায়, তাই দু’একটা কোর্স ইলেক্টিভ কোর্সে পাঠিয়ে দিয়ে ইংরেজির কোর্সগুলো ঢুকিয়ে দিবেন। আর কিছু করার দরকার নাই।” আমি সেভাবেই কাজ করলাম, বিভাগের প্রধান হিসেবে একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং-এ প্রস্তাব উত্থাপন করলাম। বুয়েট থেকে তখন এক্সটার্নাল মেম্বার হিসেবে এসেছিলেন আমার পিএইচডি-র সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. কাজী দীন মোহাম্মদ খসরু স্যার। স্যার প্রস্তাব দিলেন বুয়েটে সিলেবাস পাঠাতে। স্যারই সেটা নিয়ে দিলেন মোহাম্মদ আলী স্যারকে। স্যার সেখানে আবার কিছু কারেকশন দিলেন, তাতে সিলেবাস আরও উন্নত হল, কিছু ভুলও সংশোধিত হল।

২০০৪ সালের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ICECE কনফারেন্সের কথা। সেই কনফারেন্সে আমার মাস্টার্স থিসিসের কাজের উপর তৈরি করা একটি পেপার গৃহীত হয়েছে। কিন্তু তখন মুজিবুর রহমান স্যার মালয়েশিয়াতে আছেন। স্যারকে ইমেইল করাতে স্যার মোহাম্মদী আলী স্যারের সাথে কথা বলতে বললেন। স্যার কিছু দেখে দিলেন, তাই থার্ড অথর হিসেবে সেই পেপারে স্যারের নামও চলে আসল। এই একটিমাত্র পেপারেই স্যার আমার সাথে কো-অথর হিসেবে আছেন।

সেই কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন সকালে মোহাম্মদী আলী চৌধুরী স্যার জুতো পায়ে তৎকালীন শেরাটন হোটেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমি স্যারের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আসলে বুয়েটে পড়াশুনাকালীন স্যারকে কোনদিনই জুতা পায়ে দেখিনি। তাই আমি স্যারের নতুন জুতাজোড়া দেখছিলাম। হলুদ রঙের কাপড়ের একজোড়া জুতা।

স্যার আমার কাছে এসে বললেন, “কী দেখেন চাইয়া চাইয়া? জুতা পড়লাম কেমনে? আসলে আমার কোন জুতা ছিল না। কিন্তু নতুন একটা কিনলাম, কনফারেন্সের মঞ্চে উঠে ভাষণ দেয়ার জন্য। আমার কিন্তু ভাল লাগতেছে না মোটেও। অনুষ্ঠান শেষ হইলেই এইটা খুইলা ফেলুম।”

আমি হাসতেছিলাম স্যারের কথা শুনে। আসলেই জীবন-যাপনে এইরকমই অতি সাধারণ অথচ জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় আর বুয়েট ও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের সেবা প্রদানে ছিলেন অসাধারণ এক মানুষ- আমাদের সবার প্রিয় অধ্যাপক ড, মোহাম্মদ আলী স্যার যিনি সবার কাছে MAC স্যার নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

আমাদের সবার প্রিয় MAC স্যার গত ২৯ জানুয়ারী ২০১৮ তারিখে চলে গেলেন না ফেরার দেশে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে।

গত ১ ফ্রেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে সাউথইস্টের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগে বুয়েটের একই বিভাগের দুইজন অধ্যাপক এসেছেন- একজন তাঁর ক্লাস নিতে আর একজন এসেছেন আমাদের ল্যাবের কিছু যন্ত্রপাতির কেনাকাটার ব্যাপারে এক্সটার্নাল হিসেবে মতামত দিতে। আমি এখন এই বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে আছি দুই বছর যাবত। স্বাভাবিকভাবেই সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী (MAC) স্যারের কথা উঠল।

স্যারের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে একজন স্যার বললেন, স্যার (MAC) কিছুদিন আগেই সেই স্যারকে বলছিলেন, যে স্যারের (MAC) স্কুল থেকে এক বছর বয়স কমিয়ে দেয়া ছিল। তাই স্যার বুয়েটের চাকুরির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই রিটায়ারমেন্টে যাবেন। সেই স্যার আরো বলছিলেন, স্যার অনেক মিটিং থেকেই কোন টাকা-পয়সা নিতেন না।

এই রকমই এক সততার মূর্ত প্রতীক ছিলেম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী চৌধুরী (MAC) স্যার।

আমি আমার অফিসে ব্যস্ত সময় পার করছি আর কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু স্যারের স্মৃতি বারবারই আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণেই মনে পড়ছে স্যারকে।

স্যার ভাল থাকবেন ওপারে, আর আমাদের জন্য ওপারে বসেই না হয় দোয়া করবেন। আর এই জীবনে যদি কোন পূণ্য করে থাকি তাহলে হয়ত পরকালে বেহেশতে আবার আপনার দেখা পাব। আপনার নিঃস্বার্থ ভাল কাজগুলোর কারণেই আপনাকে মহান আল্লাহ্‌তা’আ’লা বেহেশত নসীব করবেন, আমিন!

 

৪৪

ইশরাত মাহেরিন জয়া/ ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মোহাম্মদ আলী স্যারের একটা মজার ক্লাস

বুয়েটে ইলেক্ট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টে পড়েছে কিন্তু মোহাম্মদ আলী স্যারকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে না এরকম একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভালো শিক্ষক ছাড়াও তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন যার কাছ থেকে অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী উপকৃত হয়েছে। অন্য ডিপার্টমেন্টের অনেকেই স্যারকে মনে রাখবে তার সাধাসিধে পোশাক আর সবাইকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধনের কারণে। আমাদের সময়ে ই এম ই ভবনের সিঁড়ির পাশে একটা রুমে স্যার বসতেন। দরজাটা খোলাই থাকতো। শুধু লেখাপড়া না যেকোনো বিষয়ে একজন অভিভাবকের মতো তিনি ছাত্রদের সাহায্য করতেন। বুয়েটে পড়ার সময় যেমন গিয়েছি স্যারের কাছে তেমনি পাশ করেও রেকমেন্ডেশন লেটার নিতে গিয়েছি।

স্যার চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মৃত্যু আমাদের কাছে গম্ভীর, শীতল আর শোকের। স্যার যে একজন দেবতুল্য মানুষ ছিলেন সেই বিষয়ে সবাই অনেক কিছু লিখেছে কিন্তু উনি মজার মানুষও ছিলেন। আমি একটা মজার ঘটনা লিখি, যেখানে স্যারের রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

আমরা ‘৯০ ব্যাচ ভাগ্যবান ব্যাচ, যতদূর মনে পড়ে স্যার তিনবার আমাদের থিওরি ক্লাস নিয়েছেন। স্যারের ক্লাস মানেই সব কিছু মনযোগ দিয়ে শুনলে ক্লাসেই শেখা হয়ে যাবে। শেষবার আসলেন semiconductor পড়াতে। প্রথম দিন স্যার ক্লাসে ঢোকামাত্র ছেলেপেলের সে কী ফূর্তি, দুই একজন মনে হয় তালিও দিল। স্যার মৃদু হাসেন। স্যার হয়তো ভেবেছিলেন, তোমরা এতো খুশি আমাকে দেখে, আচ্ছা এবার তোমাদের নিয়ে একটু মজা করব। এই সেমিস্টারে আমাদের তো ঈদ লেগে গেল। পুরো সময় কোনো কুইজ নাই। স্যার পড়ায় আমরা খাতায় টুকি। অবশেষে পিএল চলে এলো প্রায়। একদিন স্যার ঘোষণা দিলেন এবার একটা কুইজ হবে। সিলেবাস হলো পুরো বই। আমরা তো তাজ্জব, প্রথমে তো বিশ্বাস হলো না, ভাবলাম মজা করছেন। পরে দেখি না, ছেলেপিলে পিছন পিছন ঘোরে আর স্যারকে সিলেবাস কমিয়ে দিতে অনুরোধ করে কিন্তু স্যারের কথায় নড়চড় নেই। আমাদের তো মাথায় হাত। তখন একদিন ক্লাস ভর্তি ছাত্রদের সামনে স্যার যা করলেন উনার মতো মানুষের থেকে আমরা আশা করিনি। বোর্ডে লিখতে লিখতে উনার হয়তো মনে হলো পুরো ক্লাস কুইজের চিন্তায় বিষন্ন এদের কে একটু চাঙ্গা করা দরকার। উনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “এখন কুইজের জন্য পড়েন না হলে কি হবে জানেন? ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের ওয়ার্ল্ড কাপ ম্যাচে জাভেদ মিয়াঁদাদ কিভাবে বানরের মতো লাফিয়ে উইকেট কিপারকে নিয়ে মজা করেছিল দেখেছেন? দেখেন এভাবে,” বলে সত্যি তিনটা লাফ দিয়ে দেখালেন। “এখন না পড়লে পি এলে এভাবে লাফাবেন।”

পুরো ক্লাস হতবাক তারপর সবার হাসি।

অবশেষে সেই বিখ্যাত কুইজ হলো। এক ঘন্টার ওই কুইজে আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাই, উনি কিছু বলেন নাই। আমাদের এক বন্ধু পরে সে লেকচারার হয়েছিল, ওই কুইজের দিন বই খুলে স্যারকে বলল, “স্যার এই প্রশ্নের উত্তর কোথায়?” স্যার দেখিয়ে দিলেন, “এখান থেকে তুলে দেন।” নীতিবান এই মানুষ আসলে ওই কুইজটা আমাদের পড়ানোর জন্য দিয়েছিলেন। আমার ধারণা উনি ওই কুইজ কাউন্ট করেননি কিন্তু এর ফলে আমাদের সবার ফাইনাল এক্সাম ভাল হয়েছিল।

স্যারকে নিয়ে মজার ঘটনাটা লিখলাম কিন্তু সব শেষে আবারো বলব বুয়েটে অগণিত মেধাবী মানুষের ভিড় কিন্তু উনার মতো সহানুভূতিশীল আর বিনয়ী কেউ ছিল কিনা আমার মনে পড়ে না। আল্লাহ উনাকে ভালো রাখুন, শান্তিতে রাখুন, হাসিখুশি রাখুন, সর্বান্তঃকরণে এই দোয়া করি।

-০-

 

এই ছিল আমাদের কাছে থাকা স্যারের সাথে গল্পগুলো। তাঁকে নিয়ে এত এত অভিজ্ঞতা আছে, যে একটা বইতেও কুলানো সম্ভবপর নয়। আমার নিজের সৌভাগ্য যে, আমি দুটো কোর্সে (একটা থিয়োরি, একটা ল্যাব/সেশনাল) স্যারকে পেয়েছি সরাসরি, আর আরেকটি কোর্সে পেয়েছি পরোক্ষভাবে। স্যারের লেকচার হাতে পেলে বই আর পড়বার দরকারই পড়ত না!

স্যার বলতেন, “যদি কোনো টপিক নিজে ঠিকমত বুঝতে না পারেন তাহলে আপনাদের গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডকে সেটা পড়ানোর চেষ্টা করবেন। ওইসময়ে বুঝাতে না পারলে যে লজ্জায় পড়বেন সেটার কথা চিন্তা করে হলেও পড়তে পড়তে ঠিকই বুঝে যাবেন।” পাওয়ার ইলেক্ট্রনিক্স ক্লাসে তিনি বলেছিলেন, “I am not an engineer. I am person who studies a lot to make things understandable to you. You’ll be the actual engineers I hope” অর্থাৎ “আমি ইঞ্জিনিয়ার নই। আমি কেবল এমন এক লোক যে কিনা অনেক পড়েছে যেন তোমাদের ভালোমতো বোঝানো যায়। আশা রাখি তোমরা হবে আসল ইঞ্জিনিয়ার।”

এমনও হয়েছে হরতাল অবরোধের কারণে সশরীরে এসে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেনি কোনো ছাত্র, তাঁর জরিমানা হয়ে গেছে ৫০০ টাকা। স্যার নিজের পকেট থেকে সেই জরিমানা মিটিয়ে দিয়েছেন।

এ লেখাটা যখন লিখছি তখন আমার হঠাৎ মনে পড়লো যে, একদম প্রথম ক্লাসে সম্ভবত স্যার আমাদের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভকে একটি সিডি দিয়েছিলেন রাইট করে, বলেছিলেন ওখানে বইপত্র আছে। সেটা আমি কপি করে রেখে দিয়েছিলাম, গুগল ড্রাইভে আপলোড করেও রেখেছিলাম। আগের সেই হার্ডডিস্ক আজ নেই, কিন্তু গুগল ড্রাইভের সেই ফোল্ডার আজকে খুললাম। মাঝের বছরগুলো কেন খুললাম না সে আফসোস হলো। আবিষ্কার করলাম, EEE পড়বার জন্য চার বছরে যা যা বই লাগবে এবং যা লাগবে না, সবই তিনি এক সিডিতে দিয়ে দিয়েছিলেন! শুধু শুধুই বইপত্র খোঁজার চেষ্টা করতাম, অথচ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া- আমার কাছেই যে স্যারের দেয়া সব রয়ে গেছে!

বুয়েটের ECE ভবনের করিডোর দিয়ে আর কখনো হেঁটে গেলে স্যারকে দেখা হবে না। নামাজের জায়গায় সবার আগে হাজির হওয়া মানুষটাও আর স্যার হবেন না। মিনহাজ খান ভাই থেকে নিয়মিত আমরা আপডেট পেতাম স্যারের, কেমো দেবার সময় স্যার বলেছিলেন, “খুব কষ্ট হচ্ছে।”

প্রস্তাবনা এসেছে বুয়েটের নতুন ECE Building এর নামকরণ হোক MAC Building হিসেবে। তবে এতেও তাঁর প্রতি ঋণের কানাকড়িও শোধ হবে না। শত বছরেও হয়ত আরেকজন মোহাম্মদ আলী স্যারের দেখা পাবে না বাংলাদেশ। যেদিন তিনি মারা যান, সে রাতে তাঁর জানাজায় অসংখ্য মানুষ জমায়েত হয়েছিল। জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে এত লোককে যেতে দেখা যায় না লাশ দাফনের জন্য। সবাইকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, স্যারের কাছে কারো কোনো পাওনা আছে কিনা, তাহলে যেন তখনি বলে ফেলেন। কিন্তু না, পাওনা তো কারোরই ছিল না। সবারই তাঁর কাছে দেওনার খাতায় নাম লিখানো।

মহামানব বললেও বুঝি তাঁকে কম বলা হয়। একদিকে একজন মোহাম্মদ আলী স্যার, অন্যদিকে শত সহস্র মানুষ। সত্যি বুঝি, এত সহস্র জীবন ছুঁয়ে যাওয়া মানুষটির জন্য হৃদয় নিংড়ানো ‘রিকমেন্ডেশন’ এর কোনো অভাব অন্তত পরপারে হবে না!

ইসিই ভবনের গাছগুলোও তাঁর সাক্ষী; Source: BUET

ফিচার ইমেজ: Edited by Jakaria Hasan using in-post photos

Related Articles