Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শত্রুর সন্ধানে: মোল্লা ওমরের শেষ দিনগুলো

৯/১১ এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তান দখল করে, তখন তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল মোল্লা ওমরকে গ্রেপ্তার করা। মোল্লা ওমরকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আমেরিকা সে সময় ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, যা ছিল বিন লাদেনের পর সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

দীর্ঘদিন আফগানিস্তানে কাজ করা প্রখ্যাত ডাচ সাংবাদিক বেটে ড্যাম  (Bette Dam) সম্প্রতি তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের উপর একটি বই প্রকাশ করেছেন। Looking for An Enemy নামের এই বইয়ে উঠে এসেছে আফগানিস্তানের ইসলামিক ইমারাতের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান এবং তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের শেষ দিনগুলোর পলাতক জীবনের কথা, তার মৃত্যুর কথা এবং তাকে ধরতে মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থতার কথা। 

তার বইয়ের সারমর্ম অবলম্বনে মোল্লা ওমরের জীবনের শেষ দিনগুলো নিয়ে আমাদের তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব। সবগুলো পর্ব পড়ুন এখান থেকে: প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব এবং তৃতীয় পর্ব

আফগানিস্তানে সাংবাদিক বেটে ড্যাম; Image Source: Joel Van Houdt

কান্দাহার ছাড়ার পর দীর্ঘ দেড় বছর পর্যন্ত মোল্লা ওমর তালেবানের সাথে কোনো যোগাযোগ করেননি। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো তিনি তার স্ত্রীর আত্মীয়, মোল্লা আজিজুল্লাহর মাধ্যমে একটি অডিও বার্তা পাঠান মোল্লা ওবায়দুল্লাহ এবং তার ডেপুটি, পাকিস্তানের কোয়েটায় অবস্থিত তালেবান নেতা মোল্লা বেরাদারের কাছে। সেখানে তিনি তার ক্ষমতা হস্তান্তরের চিঠিটির কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি জানান, মোল্লা ওবায়দুল্লাহই হচ্ছেন তালেবানের নতুন প্রধান। তিনি একইসাথে মোল্লা ওবায়দুল্লাহর অধীনস্থ তালেবান কাউন্সিলের সদস্যদের নামও ঘোষণা করেন।

সংগঠন পরিচালনা করা তো দূরের কথা, মোল্লা ওমর নিজে থেকে কখনোই তালেবান নেতাদের সাথে যোগাযোগ করতেন না। তালেবান নেতারা যখন গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্তে একমত হতে পারতেন না, তখন তারাই মোল্লা আজিজুল্লাহকে পাঠাতেন মোল্লা ওমরের পরামর্শ নেওয়ার জন্য। এ সময় মোটামুটি তিন থেকে সাত মাস অন্তর মোল্লা আজিজুল্লাহর সাথে মোল্লা ওমরের সাক্ষাৎ হতো।

উদাহরণস্বরূপ, তালেবান নেতারা যখন কাতারের রাজধানী দোহায় অফিস খোলার প্রস্তাবে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, তখন তারা মোল্লা আজিজুল্লাহকে পাঠিয়েছিলেন মোল্লা ওমরের মতামত নেওয়ার জন্য। মোল্লা ওমর অফিস খোলার পক্ষেই মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। আব্দুল জব্বার ওমারির মতে, মোল্লা ওমর তালেবানের অপারেশনাল প্রধান ছিলেন না, তিনি ছিলেন সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতার মতো অনেকটা।

নব্বইয়ের দশকে মোল্লা ওমর; Image Source: AP

তালেবানের পদ ছাড়ার পর থেকে মোল্লা ওমর যাবতীয় জাগতিক বিষয়ের উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি তার ছোট খুপরি ঘরটি থেকে খুব একটা বেরুতেন না। শুধুমাত্র শীতকালে মাঝে মাঝে রোদ পোহানোর জন্য কিছুটা সময় বাইরে কাটাতেন। খুব একটা কথা বলতেন না, কোনো বিষয়ে আগ্রহও প্রকাশ করতেন না। তার চাওয়া-পাওয়ারও তেমন কিছু ছিল না। শুধু মাঝে মাঝে স্থানীয় তামাক জাতীয় পদার্থ নাসওয়ার এবং দাড়িতে লাগানোর জন্য মেহদির সন্ধান করতেন।

মোল্লা ওমর প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় নিয়ম করে বিবিসি পাশতুর সংবাদ শুনতেন, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক বা জাগতিক বিষয় নিয়ে তিনি আব্দুল জব্বার বা অন্য কারো সাথে আলোচনা করতেন না। ২০১১ সালে যখন আরব বসন্ত ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন কেবল একদিন তিনি মন্তব্য করেছিলেন, এটা আরব বিশ্বের জন্য সর্বনাশ বয়ে আনবে। কিন্তু কয়েকমাস পরেই যখন ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল, তিনি কোনো মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে সংবাদটি শুনে গিয়েছিলেন।

মোল্লা ওমরের অধিকাংশ সময় কাটত কুরআন শরিফ তিলাওয়াত করে। কুরআন এবং হাদিস ছাড়া তিনি অন্য কোনো বই পড়তেন না। প্রায় সময়ই তিনি আব্দুল জব্বারকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন, আব্দুল জব্বারও মুগ্ধ হয়ে তার নেতার তিলাওয়াত শুনতেন। দিনের বাকি সময় মোল্লা ওমর ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ বন্ধ করে নীরবে একস্থানে বসে থাকতেন। দেখে মনে হতো, তিনি গভীর ধ্যানে মগ্ন।

মোল্লা ওমরের বাসস্থান সম্পর্কে তালেবানের দাবি; Image Source: Twitter

মোল্লা ওমরের কাছে একটি নকিয়া মোবাইল ফোন ছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি কোনো সিম কার্ড ব্যবহার করতেন না, কাউকে কলও করতেন না। মোবাইল ফোনটা তিনি ব্যবহার করতেন শুধু নিজের কুরআন তিলাওয়াত রেকর্ড করার জন্য। প্রায় সময় তিনি নিজেই বসে বসে নিজের তিলাওয়াত শুনতেন। সারা দিন কুরআন এবং হাদিস নিয়ে পড়ে থাকার কারণে এ সময় তার মধ্যে শুদ্ধ আরবিতে কথা বলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যেত, যদিও অতীতে তিনি সব সময় পশতু ভাষাতেই কথা বলতেন।

আব্দুল জব্বারের ধারণা, মোল্লা ওমর এ সময় ধ্যান করতে করতে ওলির পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন। তার ধারণা মোল্লা ওমর এ সময় গায়েবী জ্ঞান লাভ করেছিলেন, যা তিনি সাংকেতিক ভাষায় তার ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলেন। মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর পাওয়া ডায়েরিতে দুর্বোধ্য অদ্ভুত কিছু লেখা দেখেই তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।

তবে সাংবাদিক বেটে ড্যাম ঘটনাটির একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, মোল্লা ওমর পড়তে পারলেও ভালো লিখতে পারতেন না। ৯/১১ এর আগেও তিনি প্রধানত অন্যের লিখে দেওয়া চিঠির নিচেই স্বাক্ষর করতেন। বেটে ড্যামের ধারণা, অবসর সময় কাটানোর জন্য মোল্লা ওমর তার ডায়েরিতে আঁকিবুকি করতেন, সেটাকেই আব্দুল জব্বার রহস্যময় ভাষা হিসেবে অভিহিত করেছেন।

তালেবান কর্তৃক প্রকাশিত মোল্লা ওমরের শেষ সাত বছরের বাসস্থান; Image Source: Twitter

২০১৩ সালের শুরুর দিকে মোল্লা ওমর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি আব্দুল জব্বারকে বলেন, এই অসুস্থতা থেকে তিনি আর ফিরে আসতে পারবেন না। আব্দুল জব্বার তাকে তার প্রিয় শুরোয়া স্যুপ রান্না করে দিতেন, কিন্তু মোল্লা ওমর সেটাও খেতে পারতেন না। আব্দুল জব্বার তার জন্য ডাক্তার নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, আব্দুস সামাদ উস্তাদ চেয়েছিলেন তাকে পাকিস্তানে নিয়ে শেষ চিকিৎসা করাতে। কিন্তু মোল্লা ওমর কোনোটাতেই রাজি হননি।

২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল মোল্লা ওমর মৃত্যুবরণ করেন। আব্দুল জব্বারের বর্ণনা অনুযায়ী, সেদিন শুষ্ক মরুময় আফগানিস্তানে যে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি হয়েছিল, সেরকম ঝড় তিনি তার জীবনে দেখেননি। সাংবাদিক বেটে ড্যাম প্রথমে আব্দুল জব্বারের কথা বিশ্বাস করেননি। কিন্তু পরবর্তীতে রেকর্ড ঘেঁটে তিনি আবিষ্কার করেন, সত্যিই সেদিন প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টিতে কান্দাহারে মার্কিন টাস্ক ফোর্সের ৮০টি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল।

সেদিন রাতের অন্ধকারে আব্দুল জব্বার এবং তার দুই সহকারী মোল্লা ওমরকে দাফন করেন। কফিন ছাড়া, অচিহ্নিত একটি সাদামাটা কবরে স্থান হয় মোল্লা ওমরের। পরদিন আব্দুল জব্বার পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পাকিস্তানের কোয়েটায় গিয়ে তিনি মোল্লা ওমরের সৎ ভাই আব্দুল মান্নান এবং পুত্র ইয়াকুবকে খুঁজে বের করেন এবং তাদেরকে মোল্লা ওমরের মৃত্যু সংবাদ দেন।

তালেবান কর্তৃক প্রকাশিত মোল্লা ওমরের শেষ সাত বছরের ঘরের ভেতরের দৃশ্য; Image Source: Twitter

আব্দুল জব্বার মোল্লা ওমরকে দাফন করার একটি দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে রেখেছিলেন। কিন্তু তারপরেও নিজের চোখে প্রমাণ দেখার জন্য আব্দুল মান্নান এবং ইয়াকুব তার সাথে জাবুলে ফেরত আসেন। ইয়াকুবের জোরাজুরিতে ১৭ দিন পর কবর খনন করা হয় এবং একটি কাঠের বাক্সে ভরে পুনরায় দাফন করা হয়। এরপর তারা পুনরায় পাকিস্তানে ফেরত যান তালেবান নেতাদেরকে সংবাদটি জানানোর জন্য।

তালেবানের অপারেশনাল লিডার মোল্লা আখতার মানসুর যখন মোল্লা ওমরের মৃত্যু সংবাদ পান, তিনি তালেবানের শীর্ষ ১০ জন নেতার একটি অধিবেশন ডাকেন। ১২ বছর ধরে মোল্লা ওমরকে আগলে রাখা আব্দুল জব্বারের কাছ থেকে তারা বারবার জানতে চান, মৃত্যুর আগে মোল্লা ওমর কি কোনো চিঠি রেখে গিয়েছিলেন? অথবা সংগঠনের ভবিষ্যত সম্পর্কে কোনো দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন?

তাদেরকে হতাশ করেন আব্দুল জব্বার। না, যে সংগঠনটিকে মোল্লা ওমর নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন, বিতর্কিতভাবে হলেও যে সংগঠনের হয়ে তিনি আফগানিস্তান শাসন করেছিলেন, যে সংগঠনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিল, তার ভবিষ্যত সম্পর্কে তিনি কিছুই বলে যাননি। এমনকি সংগঠনটির হাল কে ধরবে, সে ব্যাপারেও তিনি কোনো ইঙ্গিত দিয়ে যাননি।

তালেবানের আশঙ্কা ছিল, মোল্লা ওমরের অবর্তমানে সংগঠনটির মধ্যে ফাটল ধরতে পারে। তাছাড়া সে সময় ওবামার সৈন্য হ্রাসের ঘোষণায় তারা আশা করছিল, শীঘ্রই তারা আমেরিকাকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে। এবং পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পরেই কেবল মোল্লা ওমরের মৃত্যুসংবাদ প্রচার করবে। কিন্তু দুই বছর পর আফগান গোয়েন্দা সংস্থা যখন তালেবান নেতাদের উপর নজরদারি করতে গিয়ে মোল্লা ওমরের মৃত্যুসংবাদ জেনে ফেলে, তখন তারা তা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়।

মোল্লা ওমর; Image Source: The National

২০০১ সালে কান্দাহারের পতনের পর মোল্লা ওমর সত্যি সত্যিই তালেবান থেকে সম্পূর্ণ অবসরে চলে গিয়েছিলেন। তালেবানের পরবর্তী উত্থান, মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম, কোনোটির সাথেই তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে তালেবান, দুই বিপরীত পক্ষই তাকে তালেবানদের সক্রিয়া নেতা হিসেবে প্রচার চালিয়ে গেছে নিজ নিজ স্বার্থে।

আমেরিকা মোল্লা ওমরকে সক্রিয় হিসেবে প্রচার করেছে এবং বিন লাদেনের সাথে একত্রে মিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনার মিথ্যা তথ্য দাবি করেছে মূলত আফগানিস্তানে তাদের দখলদারিত্বের বৈধতা বজায় রাখার জন্য। আর বিপরীত দিকে তালেবান প্রকৃত সত্য জেনেও সেটা গোপন করে গেছে মোল্লা ওমরের ইমেজ ব্যবহার করে সদস্যদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার জন্য। কিছু না করেও তাই মোল্লা ওমর এক যুগ ধরে আফগান যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে গেছেন।

সবগুলো পর্ব পড়ুন এখান থেকে: প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব এবং তৃতীয় পর্ব

This article is in Bangla language. It's about the last days of the late Taliban leader Mullah Omar, based on the book "Looking for an enemy' by Dutch journalist Bette Dam.

All the references are hyperlinked inside.

Featured Image: The National

Related Articles