Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মুনিবা মাজারী: ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানো এক লৌহমানবীর গল্প

“প্রতিটা অনুপ্রেরণামূলক ছবির পেছনেই রয়েছে এক অবিরাম বয়ে চলা কষ্ট, অধ্যবসায়, প্রচেষ্টা এবং স্থির সংকল্পের গল্প। আমাদের আশেপাশে অনেক মানুষ রয়েছে যারা প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা নিজেদের সাথে অনবরত যুদ্ধ করে চলেছে। কিন্তু  তাদের মুখে লেগে থাকা সার্বক্ষণিক হাসির কারণে আমরা তা কখনোই বুঝতে পারি না। তারা কখনো কাঁদে না, তারা কখনো অভিযোগ করে না এবং তারা কখনো থেমে যায় না। আমি এই ধরনের মানুষগুলোকে যোদ্ধা বলি, যারা সত্যিকার অর্থেই বেঁচে থাকার অর্থ জানে এবং সঠিকভাবে বাঁচতে জানে।”

এই কথাগুলো বলেই মুনিবা মাজারী ২০১৫ সালে টেডেক্স ইসলামাবাদের মঞ্চে তার জীবনের গল্প বলা শুরু করেন। পাকিস্তানের লৌহমানবী নামে খ্যাত মুনিবা মাজারী বর্তমানে একজন চিত্রশিল্পী, সমাজকর্মী, উপস্থাপিকা, মডেল, গায়িকা এবং একজন অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা। এইযে এত ঈর্ষণীয় সফল একজন মানুষ, তার এই সফলতার পেছনের গল্পটা কিন্তু মোটেও ঈর্ষণীয় নয়, বরঞ্চ গল্পটি অবিশ্রান্ত কষ্টের এবং যুদ্ধের।

জীবন মুনিবা মাজারীর সামনে এনে দিয়েছিল পাহাড় সমান বাধা এবং অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ও কষ্ট কিন্তু তিনি সেই যন্ত্রণা ও কষ্টগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন পেছনের থেকেও দ্বিগুণ গতিতে, তৈরি করেছেন নিজের পরিচয়, লালন করেছেন নিজের স্বপ্নকে এবং অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন জীবনে চলার পথে হোঁচট খাওয়া প্রতিটি মানুষের জন্য। চলুন জেনে আসা যাক, এই লৌহমানবীর জীবনের গল্প

মুনিবা মাজারী পাকিস্তানের রহিম ইয়ার খানে ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন শিল্পী এবং মা গৃহিণী। এক বোন দুই ভাইয়ের মাঝে তিনিই সবচেয়ে বড়। তিনি আর্মি পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং রহিম ইয়ার খানের একটি কলেজ থেকে ফাইন আর্টসে ব্যাচেলর করেন, স্বপ্ন ছিল তার চিত্রশিল্পী হবার। কিন্তু মাত্র আঠার বছর বয়সেই পাকিস্তানি পাইলট খুররাম শাহাজাদের সঙ্গে বাবা মায়ের ইচ্ছায় তার বিয়ে হয়ে যায়।

যেই গাড়িটিতে বসে দুর্ঘটনার শিকার হন মুনিবা মাজারী; Source: bunkstories.com

বিয়ের দু’ বছর পর ২০০৭ সালের কথা, মুনিবা মাজারী তার স্বামী খুররাম শাহজাদের সাথে বালুচিস্তান থেকে রহিম ইয়ার খানে তার বাবার বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে খুররাম শাহজাদ গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়েন এবং গাড়িটি একটি খাদে পড়ে যায়। সৌভাগ্যবশত খুররাম শাহজাদ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে বের হতে সক্ষম হলেও মাজারীর সে সৌভাগ্য হয়নি। তিনি গাড়িতে আটকা পড়েন এবং মারাত্মকভাবে আহত হন।

তার ডানহাতের রেডিয়াস আলনা, কাঁধের হাড়, কলার বোন, পাঁজরের সবগুলো হাড় ভেঙে যায়। মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় সম্পূর্ণ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। দুর্ঘটনার পর পর কোনো এ্যাম্বুলেন্স খুঁজে না পাওয়ায় দু ঘণ্টা পর একটি জিপগাড়ির পেছনে করে তাকে নিকটস্থ একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় এবং তার ভয়াবহ অবস্থা দেখে চিকিৎসকেরা তাকে সেখান থেকে বের করে দেন।

এরপর দ্বিতীয় একটি হাসপাতালও তাকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। অতঃপর তাকে করাচি নিয়ে গিয়ে সেখানের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাকে নিয়ে এই টানা হেঁচড়ার সময় তার শরীরের নিচের অংশ থেকে তার স্পাইনাল কর্ডের সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় মুনিবা মাজারী; Source: lifedaily.com

করাচির হাসপাতালে মুনিবা মাজারীকে আড়াইমাস কাটাতে হয়। হাসপাতালের সেই আড়াইমাস ছিল তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ ও দুঃস্বপ্নের আড়াইটি মাস। চিকিৎসা চলার সময় একদিন ডাক্তার এসে তাকে খবর দেন,

“আমি শুনেছি আপনি একজন চিত্রশিল্পী হতে চাইতেন, কিন্তু আপনার জন্য একটি খারাপ খবর রয়েছে, আপনার হাত মারাত্মকভাবে জখম হওয়ায় আপনি আর কোনোদিন কলম ধরতে পারবেন না। অর্থাৎ, আপনি আর কোনোদিন ছবি আঁকতে পারবেন না।”

একথা শুনে মুনিবা মাজারী চুপ করে থাকেন। পরদিন ডাক্তার তাকে বলেন, তার মেরুদণ্ডের আঘাতটি এতটাই প্রকট যে তিনি আর কোনদিন হাঁটতে পারবেন না। কিন্তু তৃতীয় দিন ডাক্তার তাকে যে কথাটি শোনান তার জন্য মাজারী একদমই প্রস্তুত ছিলেন না। ডাক্তার তাকে বলেন তার মেরুদণ্ড এবং পেছনের হাড়গুলো ভেঙে যাওয়ায় তিনি আর কোনোদিন সন্তান জন্ম দিতে পারবেন না। একথা শুনে তিনি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন, যতটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল সব যেন নিঃশেষ হয়ে যায়। তিনি তার মাকে বলেন, “আমিই কেন? আমার সাথেই কেন?” তিনি ভাবতে থাকেন, “বাচ্চা ছাড়া তো একটা মেয়ের জীবন পুরোটাই অসম্পূর্ণ।” সেই মুহূর্তে মুনিবা মাজারীর মা তার সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে দাঁড়ান। তিনি তাকে বলেন,“এই খারাপ সময়টা কেটে যাবে। স্রষ্টার অবশ্যই তোমার জন্য বড় কোনো পরিকল্পনা রয়েছে। আমি জানিনা সেটা কী, কিন্তু অবশ্যই রয়েছে।” মায়ের এই কথাগুলো যেন মুনিবা মাজারীর জন্য জাদুর মতো কাজ করে। তিনি ধৈর্য ধরে সামনে তাকানোর সিদ্ধান্ত নেন।

মুনিবার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তার মা; Source: twitter.com/muniba_mazari/status

মুনিবা মাজারীর মতে, তার জীবনে নেওয়া সবথেকে সঠিক সিদ্ধান্তটি ছিল তার হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছবি আঁকতে শুরু করার সিদ্ধান্ত। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে চারদিকে সাদা দেয়াল আর পর্দা দেখতে দেখতে তিনি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন তিনি একদিন তার ছোট ভাইকে ডেকে কিছু ছোট ক্যানভাস, রঙ আর তুলি এনে দিতে বলেন। তিনি তার ভাঙা হাত দিয়েই ছবি আঁকার চেষ্টা করতে শুরু করেন এবং চেষ্টা করতে করতে সত্যিই তিনি কিছু ছবি এঁকে ফেলেন।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আঁকা ছবিগুলো মুনিবা মাজারীর কাছে শুধু ছবিই ছিল না। সেগুলো ছিল তার কষ্টগুলোকে ভেতর থেকে বের করে দেওয়ার মাধ্যম। তার নিজের গল্প বলার আর নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম। হাসপাতালের বাকি সময়টুকু তিনি এভাবেই কাটান, কোনো অভিযোগ না করে শুধুমাত্র আড়ালে চোখের পানি ফেলে এবং ছবি এঁকে

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় আসার পর মুনিবা মাজারী বুঝতে পারেন, তার পিঠে এবং পেছনে শয্যাক্ষত হয়ে গিয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন সংক্রমণ আর অ্যালার্জি। আর এ কারণে ডাক্তার তাকে সম্পূর্ণ দু বছরের জন্য বেডরেস্ট দিয়ে দেন। দু’টি বছর মুনিবা মাজারী নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কাটিয়ে দেন। তিনি উপলব্ধি করেন, মানুষ আসলে কতটা সৌভাগ্যবান কিন্তু তারা স্বীকার করতে চায় না, তিনি বুঝতে পারেন শুধুমাত্র সুস্থ থাকাই যে সৃষ্টিকর্তার কত বড় উপহার।

মুনিবা মাজারীর আঁকা ছবি; Source: maloomaat.com

দু বছর পর তিনি যখন প্রথম বিছানা ছেড়ে হুইলচেয়ারে উঠে বসেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ। দিনটিকে তিনি নিজের পুনর্জন্মদিন হিসেবে পালন করেন। হুইলচেয়ারে বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে সেদিন তিনি নিজেকে বলেছিলেন,

“এখন কোনো অলৌকিকতা এসে আমাকে আগের মতো সুস্থ করে দিতে পারবে না। আমি এখন যেমন আছি, যত তাড়াতাড়ি নিজেকে এভাবে মেনে নেব- সেটাই আমার জন্য মঙ্গল।”

মুনিবা মাজারী সিদ্ধান্ত নেন, নিজের ভয়গুলোর সাথে যুদ্ধ করার। নিজেকে বলেন, আর যা-ই হোক, ভয় নিয়ে বাঁচা যাবে না। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল বিবাহবিচ্ছেদ। তাই বারবার জোর করে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে চাইতেন যে, মানুষটা তাকে ঠিক আর আগের মতো চাইছে না তার সাথে। কিন্তু একটা সময় তিনি ঠিকই বুঝতে পারেন, যে মানুষটা তার সাথে থাকতে চাইছে না, তাকে বোঝা মনে করছে, তার সাথে জোর করে থাকাটা আরো বেশি অপমানের এবং যন্ত্রণার। তাই তিনি নিজেই একটা সময় খুররাম শাহজাদকে বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠিয়ে দেন। তাকে মুক্ত করার মাধ্যমে তিনি নিজেকে নিজের ভয় থেকে মুক্ত করেন।

মুনিবা মাজারী তার ছেলে নেইলের সঙ্গে; Source: hipinpakistan.com

মুনিবা মাজারীর জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ ছিল তার মা হতে না পারার কষ্ট। তার এই আক্ষেপ দূর করে তার দত্তক নেওয়া ছেলে নেইল। নিজের মাতৃত্বের অভাব ঘোচাতে বিভিন্ন এতিমখানার দ্বারে একটি বাচ্চার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন তিনি। তখন একটি এতিমখানা থেকে ইন্টারভিউয়ের ডাক পড়ে তার। ভয়ে ছিলেন, তার এই হুইলচেয়ারে বেষ্টিত অবস্থা দেখে হয়ত প্রথম দর্শনেই বাদ পড়ে যাবেন তিনি, তাকে হয়তো বলা হবে তিনি বাচ্চার সঠিক যত্ন নিতে পারবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে প্রিন্সিপ্যাল তাকে বলেন,

“আমি জানি আপনিই এই বাচ্চাটির সবচেয়ে ভালো মা হতে পারবেন। তার যেমন আপনাকে দরকার, আপনারও তাকে দরকার।”

এই বলে দু’দিন বয়সী বাচ্চাটিকে তার কোলে তুলে দেন তিনি। মুনিবা মাজারী যেন সত্যিকারের গর্ভযন্ত্রণা অনুভব করেন সে সময়। একজন নারী হিসেবে যেই যন্ত্রণার আক্ষেপ তার সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর কথা ছিল।

দীর্ঘ দু’ বছর শয্যাশায়ী থাকার পর মুনিবা মাজারী পরনির্ভরশীল হয়ে বাঁচার যন্ত্রণাটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। শারীরিকভাবে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা চলে আসলেও এখনও তার অনেক কিছু করার ক্ষমতা রয়েছে এটা তিনি নিজের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। আর তার এই বিশ্বাসকে প্রমাণ করার জন্যই তিনি অল্প অল্প করে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি নিজের আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনী করা শুরু করেন এবং একটি অনলাইন পোর্টালে কন্টেন্ট লেখক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। এভাবে তিনি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে থাকেন।

শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মুনিবা মাজারী তার ভাইদের সহযোগিতায় চালিয়ে যাচ্ছেন সামাজিক সেবামূলক কর্মকাণ্ড; Source: maloomaat.com

কিন্তু তিনি নিজের সাথে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। তিনি আরো বড় কিছু করতে চাইছিলেন। সমাজের জন্য তার দেশের জন্য কিছু করতে চাইছিলেন। আর তখনই একটি পোলিও ক্যাম্পেইনের বিজ্ঞাপনে তার চোখ আটকে যায়। সেখানে আট-দশ বছরের পোলিওতে আক্রান্ত একটি শিশুকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ছেলেটির বাবা তার পাশে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছিলেন এবং অন্যদের সতর্ক করে বলছিলেন,

“আপনার সন্তানদেরকে পোলিও টিকা দিন না হলে আপনাদের বাচ্চাদেরও আমার বাচ্চার মতো অবস্থা হবে।”

বিজ্ঞাপনটিতে পঙ্গু মানুষদের প্রতি এই নেতিবাচক বার্তাটি ভীষণভাবে নাড়া দেয় মুনিবা মাজারীকে। একটি বিকলাঙ্গ শিশু বা মানুষকে কখনোই এভাবে সমাজের জন্য বোঝা মনে করা উচিত নয়। তাদেরও অনেক কিছু করার সামর্থ্য রয়েছে, যা তিনি নিজেকে দিয়েই জানেন। আর সেদিনই তিনি ঠিক করে ফেলেন, সমাজে বিকলাঙ্গ মানুষদের নিয়ে যে ধারণা রয়েছে, তা বদলাতে হবে।

তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বেশি বেশি মানুষের সামনে আসার। তিনি মডেলিং করা শুরু করেন। ‘পন্ডস’, ‘টনি অ্যান্ড গাই’সহ বিভিন্ন কোম্পানির ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে তিনি যোগ দেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রথম হুইল চেয়ারে বসা চিত্রশিল্পী হিসেবে তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। তিনি পাকিস্তানের ন্যাশনাল টিভিতে প্রথম হুইল চেয়ারে বসা উপস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন।

মুনিবা মাজারী এবং তার গানের দল; Source: twitter.com/muniba_mazari/status

এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়া শুরু করেন। তিনি এবং তার দুই ভাই বিভিন্ন পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে সেখানের রোগীদের সাহস যোগাতে শুরু করেন যে তাদের জীবন শেষ হয়ে যায়নি, এখনো চাইলে অনেক কিছু করা সম্ভব। এছাড়াও তিনি জেন্ডার সমতাসহ নারীদের ও বাচ্চাদের অধিকার নিয়ে বেশ কিছু কাজ করা শুরু করেন।

তার এই সাহসিকতা এবং দুর্দমনীয় মনোভাব দেখে ‘ইউএন উইমেন পাকিস্তান’ তাকে তাদের ‘ন্যাশনাল গুডউইল অ্যাম্বাসেডর’ হিসেবে নিয়োগ দেন। এখানে তিনি নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন। ২০১৫ সালে তিনি নির্বাচিত হন ‘বিবিসি ইন্সপিরেশনাল উইমেন’দের একজন হিসেবে। ২০১৬ সালে তিনি জায়গা করে নেন ‘ফোর্বস থার্টি আন্ডার থার্টিতে’। ‘পন্ডস মিরাকেল উইমেন’ও তাকে তালিকাভুক্ত করেছেন একজন ‘মিরাকেল উইমেন’ হিসেবে।  

আবার কোনদিন হাঁটতে পারবেন এমনটা অনেকটা স্বপ্নের মতোই ছিল মুনিবা মাজারীর কাছে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন সত্যি হয় ২০১৮ সালের ১৯ মে, ‘রি ওয়াক রোবটিক্স’ নামে একটি সংগঠনের সহযোগিতায়। রি ওয়াক রোবটিক্স, যাদের শরীরের নিচের অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত, রোবটিক্সের মাধ্যমে তাদের জীবনযাপনের মান উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। ২০১৮ সালের ১৯ মে, রোবটিক্স সাপোর্ট সিস্টেমের মাধ্যমে দীর্ঘ এক দশক পর আবার নিজের দু’পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান তিনি। নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই ভাইয়ের সাথে দাঁড়ানো একটি ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন দেন, “বিগ ডে ফর আস সিব্লিংস!”  

প্রায় দশ বছর পর নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান মুনিবা মাজারী; Source: pakistantoday.com.pk

বর্তমানে নিজের ছেলে ও পরিবারের সাথে বেশ ভালোই আছেন মুনিবা মাজারী। পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের ছবি আঁকা, সামাজিক সেবামূলক কর্মকাণ্ড, মডেলিং ও উপস্থাপনা। নতুন করে শুরু করেছেন গান গাওয়া। তৈরি করেছেন ‘মুনিবাস ক্যানভাস’ নামে নিজের ব্রান্ড, যার শ্লোগান, “Let Your Walls Wear Colors.” বা “নিজের দেয়ালকে রাঙিয়ে দাও।” মুনিবার আঁকা বেশিরভাগ ছবির বিষয়ই নারী। যা বলে নারীদের শক্তির গল্প, আর ফুটিয়ে তোলে তার শিল্পীর বিশ্বাস ও পরিচয়কে।

মুনিবা মাজারী নিজেকে চিনতে শিখেছিলেন, নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখেছিলেন। তাইতো আজ পুরো বিশ্ব তাকে চিনেছে। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, কীভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবার পরও আবার ফিনিক্স পাখির মতো আগের থেকে শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসা যায়। তিনি যেন সত্যিকার অর্থেরই বাস্তবের এক ফিনিক্স পাখি। তাইতো তার কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। মুনিবা মাজারীর গল্পটি শেষ করছি তারই একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে,

“আমি জানি না কীভাবে আমার গল্পটি শেষ হবে, কিন্তু আমার গল্পের কোথাও লেখা থাকবে না- আমি হার মেনেছিলাম!”

বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

Related Articles