দ্বিতীয় পর্ব: নেপোলিয়ন: দ্য কর্সিকান বয় (পর্ব-২)
কর্সিকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলেও ফ্রান্সকে তখনো নেপোলিয়ন আপন করে নেননি। ফ্রান্সের বিপ্লবী সরকারের রাজনীতি মারাত্মক বিপদজনক এবং কী হতে পারে তা কোনোভাবেই আন্দাজ করা সম্ভব নয়। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে তাদের মতো এমন এক পরিবার, যারা ফরাসি অভিজাতদের দলে নাম লিখিয়েছে। তাছাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভালো ক্যারিয়ারের জন্য ইউরোপীয় সৈন্যদের নিজ দেশত্যাগ অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। ভালো বেতন ও জীবনের বিনিময়ে একমাত্র নিজেদের দেশে আক্রমণ ব্যাতীত যেকোনো কাজেই তারা ছিল এক পায়ে খাড়া। ব্যতিক্রম ছিলেন না নেপোলিয়নও, ১৭৯৫ সালে তিনি অটোমান সুলতানের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তুরস্কের সেনাদলে ভেড়ার জন্য। যদি তা-ই ঘটতো, তবে ইউরোপের ইতিহাস লেখা হতো সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে।
১৭৯৩-এর বসন্তে তুলোঁ শহর বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলো, সাথে ব্রিটিশদেরও আমন্ত্রণ জানালো এই শহরকে ব্রিটেনের নৌবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের জন্য। বন্দরনগরীকে অবরোধ করার জন্য যে ফরাসি সেনাদলকে পাঠানো হলো, তাতে ছিলেন নেপোলিয়নও।
কিছুটা ভাগ্য আর আর নিজের একাগ্রতার সাহায্যে এই প্রথমবার নিজের দক্ষতার ঝলক দেখানোর প্রথম সুযোগ পেলেন তিনি। গোলন্দাজ বাহিনীর কমান্ডার আহত হলে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে কমিটির কাছে নেপোলিয়নের নাম সুপারিশ করেন কর্সিকা থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ ক্রিস্টফ সালিসেত্তি। নেপোলিয়নও এ সুযোগ কাজে লাগালেন, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতো, নিজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তোয়াক্কা না করেই একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাথে আলোচনা করে শহর আক্রমণের নীলনকশা তৈরি করলেন।
তুলোঁর রক্ষ্মণব্যবস্থার ত্রুটি খুঁজে বের করে দল নিয়ে নিজেই আক্রমণ করে বসলেন তিনি, প্রতিপক্ষের গুলিতে নিজের ঘোড়া মারা পড়লো, উরুতে বেয়নেটের খোঁচা খেয়েও চালিয়ে গেলেন আক্রমণ। নেপোলিয়নের কৌশলে তুলোঁর বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করলো, নেপোলিয়নের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়লো সবার মুখেমুখে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে তাকে পদোন্নতি দিয়ে ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল’ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলো।
এরপর ফরাসি রাজনীতির টালামাটাল অবস্থার মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন নেপোলিয়ন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার সময় নেপোলিয়নের নাম যিনি সুপারিশ করেছিলেন, তিনি হলেন অগাস্টিন রবসপিয়েঁ, ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম মাথা ম্যাক্সিমিলিয়ান রবসপিয়েঁর ভাই। শীঘ্রই তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন উগ্র রবসপিয়েঁ সমর্থকদের মধ্যে, যারা ফ্রান্সের Reign of Terror-এর স্থপতি। নেপোলিয়ন মনে মনে রবস্পিয়েঁকে শ্রদ্ধাই করতেন, কারণ ফ্রান্সের সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ১৭৯৪-এর জুনে রবসপিয়েঁদের পতন ঘটলো, অগাস্টিন আত্মহত্যা করলেন, পরদিন ম্যাক্সিমিলিয়ানের গলা কাটা পড়লো গিলোটিনে। নেপোলিয়নসহ রবসপিয়েঁদের প্রিয় অফিসারদেরকে গ্রেফতার করে ২ সপ্তাহ আটকিয়ে রাখা হলো। নতুন কর্তৃপক্ষ নেপোলিয়নকে মৃত্যুদণ্ড না দিলেও, তাকে স্টাফ হিসেবে বসিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। অন্যান্য সেনাধ্যক্ষরা যখন যুদ্ধের প্রান্তরে নিজেদের পোশাকে নতুন নতুন ব্যাজ যুক্ত করছে, নেপোলিয়ন তখন টেবিলের ওপর নিজের আঙুল কামড়াচ্ছেন। এ সময়ই বিরক্ত হয়ে তিনি তুরস্কের সেনাবাহিনীতে কাজ করতে যাওয়ার আবেদন করেন, যদিও ফ্রান্স সরকার তার আবেদন নাকচ করে দেয়।
নেপোলিয়নের এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে এবার তুলোঁতে দেখানো দক্ষতা, সাহস, একাগ্রতা এবং ভাগ্য এগিয়ে এল। ১৭৯৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নতুন সংবিধান (ফরাসি বিপ্লবের পর তৃতীয় সংবিধান) কার্যকর করা হলো, যেখানে এর আগের সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যই নির্বাচিত হবে। রাজতন্ত্র ফিরে আসবে এই আশায় বুক বাধা রক্ষণশীল সমর্থকরা এর প্রতিবাদ করতে প্যারিসের রাস্তায় নেমে এল, হাতে তুলে নিল অস্ত্র। তাদেরকে দমন করার দায়িত্ব দেওয়া হলো পল বারাস নামক এক অভিজাতের কাছে, যিনি রবসপিয়েঁদেরকে টেনে নামিয়েছিলেন। তুলোঁর বিদ্রোহীদের দমানোর দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন এই বারাস, তা-ই এবার যখন রাজতন্ত্রপন্থীরা দমানোর প্রয়োজন হলো, তিনি তার সেই ফরাসি সেনাবাহিনীর অফিসারদের ডাক দিলেন।
কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে, প্যারিসের সরু রাস্তার মধ্যেই নেপোলিয়ন তার গোলন্দাজ বাহিনীকে আদেশ দিয়েছিলেন এই বিদ্রোহীদেরকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য। গালগল্প যা-ই হোক, শহরের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে সেনাবাহিনী পরিচালনা করা, প্যারিসের সরু রাস্তায় খুব দ্রুত সেনাবাহিনী ও গোলন্দাজ বাহিনীকে কাজে লাগানোর কৃতিত্বের জন্য বারাসের চোখে নেপোলিয়ন এক অসাধারণ সমরবিদ হয়ে ওঠেন। রাজতন্ত্রপন্থীদের দমনের পর কিছুদিনের মধ্যেই নেপোলিয়নকে তা-ই দেওয়া দেওয়া অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রধানের দায়িত্ব, সাথে বিশাল বেতন এবং একইসাথে তার দুই ভাই জোসেফ এবং লুসিয়েনের জন্য আকর্ষণীয় চাকরি।
বারাসের হাত ধরে নেপোলিয়নের জীবনে আরও একটি বড় পরিবর্তন আসলো। বারাস নেপোলিয়নের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন নিজের সাবেক এক রক্ষিতাকে, নাম রোজ দ্য বিউহার্নেঁ। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ফরাসি উপনিবেশ মার্টিনিকের অভিজাত পরিবার থেকে উঠে আসা এই বিধবা নিজের স্বামীকে হারিয়েছেন রেইন অফ টেররের সময়, নিজের প্রাণও বাঁচিয়েছেন কোনোভাবে পালিয়ে। বারাসের কাছে এই ত্রিশোর্ধ্ব মহিলা কেবলই একজন ব্যবহৃত সম্পত্তি, কিন্তু নেপোলিয়নের কাছে রোজ ছিলেন একেবারে সাক্ষাৎ স্বর্গ থেকে নেমে আসা অপ্সরী।
নেপোলিয়ন যে এর আগে কখনো প্রেমে পড়েননি তা নয়। দক্ষিণ ফ্রান্সে থাকার সময়েই এক সিল্ক ব্যবসায়ীর মেয়ে ডেজিরি ক্লেয়ারি (Désirée Clary)-র সাথে দীর্ঘদিন প্রেম করেছিলেন, যদিও শেষমেশ সেই মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে যায় তারই এক সহযোদ্ধা জাঁ-বাপ্তিস্তে বার্নাদোতের সাথে (এবং একপর্যায়ে ক্লেয়ারি এবং বার্নাদোতে সুইডেনের রাজা-রানী হয়ে যান, যাদের উত্তরপুরুষ এখনো সুইডেনের সিংহাসনে রয়েছেন!)।
তবে রোজের প্রতি নেপোলিয়নের প্রেম ছিল অন্য মাত্রায়, যে কারণে দুই সন্তানের জননী এই রোজকে বিয়ে করতেও পিছপা হননি তিনি। পরিবারের বারণ সত্ত্বেও ছ'মাসের মাথায় বিয়ে করে বসেন রোজকে, যাকে তিনিই জোসেফিন নাম দেন। তবে জোসেফিনের কামনার সাথে নেপোলিয়ন কামনার মিল ছিল না, যে কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া নেপোলিয়নের অনুপস্থিতির সুযোগে জোসেফিনও ইচ্ছামতো প্রেমিকদের সাথে মিলিত হতেন। কষ্ট পেলেও নেপোলিয়ন জোসেফিনকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন, যে কারণে এসব নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতেন না, আর এই কষ্ট সুদে-আসলে উসুল করতেন যুদ্ধক্ষেত্রে, শত্রুদের হারিয়ে।
জোসেফিনের সাথে বিয়ের দু'দিন পরেই যুদ্ধক্ষেত্রে ডাক পড়ে নেপোলিয়নের, আর নিজের অবস্থান আরও শক্ত করতেই বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই ছুটে যান নেপোলিয়ন। ফরাসি বিপ্লবের আগ থেকেই ফ্রান্সের সাথে গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রিয়ার হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য, স্পেন-পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, প্রুশিয়া, হলি রোমান সাম্রাজ্য এবং ইতালির রাজ্যগুলোর (সার্ডিনিয়া, নেপলস, পিয়েডমন্ট) সাথে ফ্রান্স একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কার্ল ভন ক্লসভিটজ লিখেছেন, ‘১৭৯৩ সালে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হলো যা সব কল্পনাকে ছাপিয়ে যায়। হঠাৎ করেই যুদ্ধ হয়ে উঠল মানুষের ব্যবসা, ৩ কোটি ফরাসি জনগণ উন্মত্ত হয়ে উঠলো যুদ্ধের তাড়নায়, যা ছিল ফ্রান্সের প্রতিপক্ষের জন্য অশনি সঙ্কেত।’
১৭৯৫ সালে ফ্রান্স নেদারল্যান্ডস দখল করে নেওয়ার পর ফ্রান্সের চাপে প্রুশিয়া ও স্পেন এই ঐক্যজোট থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। স্পেন সরে গেলে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণের কোনো আশঙ্কা না থাকায় ফ্রান্স এবার নজর ফেরায় পূর্বে। তখন ফ্রান্সের সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য, তাদেরকে দমাতে তিনদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। এক বাহিনী যাবে উত্তর-পূর্বদিক থেকে জার্মানির রাইনল্যান্ডে, অন্যটি ঢুকবে দক্ষিণ জার্মানিতে, এবং সবচেয়ে ছোট যে বাহিনী, সেটি মূলত অস্ট্রিয়ার মিত্র উত্তর ইতালিতে আক্রমণ করবে অস্ট্রিয়ার নজর যেন বিক্ষিপ্ত থাকে সেজন্য। এবং এই শেষ বাহিনীরই সেনাপতি হলেন নাপোলেওঁ বোনাপার্তে, কর্সিকা জয়ের স্বপ্ন এখন তার কাছে আরও ক্ষুদ্র।
This article is in the Bengali language. It is about Napoleon Bonaparte, the Emperor of France.
References:
1. Napoleon: A Biography - Frank McLynn - Arcade Publishing (2003)
2. Napoleon: A Concise Biography - David A. Bell - Oxford University Press (2015)