Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পাবলো পিকাসো: বিংশ শতাব্দীর চিত্রসম্রাট

শিল্পক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা একজন ব্যক্তিত্ব পাবলো পিকাসো। তার চিত্রকর্মের কাছে সে সময়ের অন্যান্য চিত্রকরের আঁকা চিত্রকর্ম যেন নস্যি। কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডে পিকাসোর আঁকা ছবিগুলো নিয়ে একটি একক প্রদর্শনী করা হয়। সেখানে তার আঁকা ২৬,০৭৫টি চিত্রকর্ম স্থান পায়। পিকাসো বেঁচেছিলেন একানব্বই বছর। দিনের হিসেবে ৩৩ হাজার ৪০৩ দিন। এর মানে দাঁড়ায়, তার ২৬,০৭৫ টি প্রকাশিত চিত্রকর্ম গণনা করলে, পিকাসো তার ২০ বছর বয়সের পর থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন একটি করে চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেছিলেন। অন্তত ৭১ বছর তিনি নিপুণভাবে তার কর্মযজ্ঞ চালিয়ে গেছেন। 

জন্ম

পাবলো রুইজ ই পিকাসো একটি স্পেনীয় নাম। তার প্রথম পারিবারিক নাম হল Ruiz এবং দ্বিতীয় নাম Picasso। বাবার নাম হোসে রুইজ ব্লাসকো। মায়ের নাম মারিয়া পিকাসো লোপেজ। মায়ের নামের অংশ থেকেই তার বিশ্বপরিচিত নামটি এসেছে।

১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণ স্পেনের ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বন্দর-শহর মালাগায়। বাবা ছিলেন প্রাদেশিক চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের চিত্রাঙ্কনের শিক্ষক এবং স্থানীয় জাদুঘরের কিউরেটর। বিখ্যাত আন্দালুসিয়ার মধ্যে মালাগা ছিল চারুকলার জন্য বিখ্যাত কেন্দ্র। তাই ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল পিকাসোর।

পিকাসো; Image Source: fineartsamerica.com

বাবার হাতে হাতেখড়ি

পিকাসোর বাবা নিজ হাতে ছেলেকে ছবি আঁকা শেখান। নিজের স্টুডিওতে নিয়ে কেমন করে ইজেলে ছবি টানাতে হয়, কেমন করে প্যালেটে  রঙ মেশাতে হয়, কোন রঙের সঙ্গে কোন রঙ মেশালে কোন রঙ হয় তা শেখান। কেমন করে প্যালেট থেকে অবশিষ্ট  রঙ ধুয়ে ফেলতে হয় এসব শিখতে শিখতে স্টুডিওর পরিবেশ ভালো লেগে যায় পিকাসোর। বাবাও ছেলেকে স্টুডিওতে পেয়ে আনন্দিত।

বাবা হোজে পাঁচ বছর পরেই কোরুনা থেকে বার্সেলোনার ‘লা লোঞ্জা আর্ট স্কুলে’ চারুকলার শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়ে চলে যান। এ সময়ই ঘটে পিকাসোর জীবনে প্রথম মানসিক আঘাতের ঘটনা। ছোট বোন কঞ্চিতা মাত্র সাত বছর বয়সে মারা যায়। এরপর পুরো পরিবার বার্সেলোনা চলে আসে। বার্সেলোনা অনেক বড় শহর। এ শহরে পাবলো মনের মতো করে ছবি আঁকার সুযোগ পেলেন। এখান থেকে ফ্রান্স যাওয়া সহজ। আন্তর্জাতিক শিল্প-সাহিত্যের ঢেউ এসে এখানে লাগে।

এ সময় তিনি ‘অয়েল অ্যান্ড চ্যারিটি’ নামে একটি ছবি আঁকলেন। ছবিটি দেখে বাবা নিজেই মাদ্রিদে জাতীয় প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে ছবিটি মর্যাদার আসন লাভ করে। পরে জন্মভূমি মালাগার একটি প্রদশর্নীতে ছবিটি আবার পাঠালেন বাবা। সেখানে ছবিটি স্বর্ণপদক পায়। এভাবে কিশোর পাবলো সসম্ভ্রমে প্রবেশ করেন শিল্পী জীবনে।

জীবনের মোড়

ছোটবেলায় পিকাসোর মা তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি খুব বড় হবে। তুমি যদি সেনাবাহিনীতে যোগ দাও তাহলে জেনারেল হবে। যদি সন্ন্যাসী হও তাহলে পোপের পদ পর্যন্ত অলঙ্কৃত করবে।’ মায়ের ধারণার মতোই বড় মাপের মানুষ হয়েছিলেন পাবলো। হয়েছেন বিশ্বখ্যাত পাবলো পিকাসো। তার মা জানিয়েছেন শিশুকালে পাবলোর মুখে প্রথম উচ্চারিত শব্দ ছিল ‘পিজ’ ‘পিজ’! ‘পিজ’ আসলে ‘লাপিজ’ শব্দের শিশুতোষ সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ। ‘লাপিজ’ অর্থ পেনসিল।

বাবার কর্মস্থল লা লোঞ্জা আর্ট স্কুলে পিকাসো বেশিদিন থাকলেন না। এক বছর পরেই মাদ্রিদের ‘সান ফার্নান্দো রয়্যাল একাডেমি’তে ভর্তির আবেদন করলেন। নামকরা এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর ব্যাপারে বাবার এবং চাচার বিশেষ আগ্রহ ছিল। এখানেও পিকাসো ভর্তি পরীক্ষায় চমৎকার নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। ভর্তি হওয়ার আগেই শহরের একটি চিত্র প্রদর্শনীতে তার একটি চিত্রকর্ম বিচারকদের মুখে প্রশংসিত হয়। 

ক্লাসের একঘেয়ে বিষয়ের পুনরাবৃত্তি থেকে মুক্তির জন্য তিনি ক্লাস ফাঁকি দিতে থাকেন। তবে ক্লাস ফাঁকি দিলেও কাজে ফাঁকি দেননি। প্রতিদিন পথে পথে যাকে দেখেন, ভিখারি, অন্ধ, পঙ্গু, কুলি-মজুর, বস্তিবাসী, জেলখালাস দাগী, ফেরিওলা এসব নিম্নশ্রেণির লোকদের স্কেচ করতে থাকেন।

শিল্পীদের কাছে ফরাসি শিল্পরীতি আকর্ষণীয় ছিল। তাই পিকাসো সরাসরি ফ্রান্সেই চলে যাওয়ার কথা ভাবলেন। তিনি বন্ধু কাসাজেমাসকে সঙ্গে নিয়ে প্যারিসে চলে গেলেন। সেখানে শিল্পী ইসিদ্রের লোনেলের এলাকায় থাকতে লাগলেন। এর মধ্যে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায় পাবলোর জীবনে। তার বন্ধু কাসাজেমাস গভীরভাবে এক তরুণীর প্রেমে পড়ে যায়। সেই তরুণী প্রথমে কিছুদিন তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করলেও পরে অন্য একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে। একদিন বন্ধুটি তার প্রিয় মানুষটিকে নিমন্ত্রণ জানায়। সেই তরুণী নিমন্ত্রণে আসে; তবে সঙ্গে করে তার নতুন প্রেমিককেও নিয়ে আসে। এ আঘাত সহ্য করা সম্ভব হয়নি কাসাজেমাসের পক্ষে। সে তাদের সামনেই মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে।

এ ঘটনায় পিকাসো দারুণভাবে মুষড়ে পড়েন। শৈশবে ছোট বোন কঞ্চিতার মৃত্যু দেখেছেন, কয়েক বছর পরেই আবার দেখলেন প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু। শোকার্ত শিল্পী প্রয়াত বন্ধুর ছবি আঁকলেন। বিখ্যাত শিল্পী এল গ্রেকোর ‘বেরিয়াল অব কাউন্ট অর্গাজ’-এর মতো করে শেষকৃত্য নিয়ে একটি ছবি আঁকেন। পাবলো ছবিটিতে এল গ্রেকোর ছবির মতো পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক দুই স্তরের আবহ দিয়ে ভরে তুলেন। এ সময়টিতে পিকাসো রাতে একা ঘুমাতে ভয় পেতেন।

বন্ধুকে হারানোর পরে প্রায় নিঃসঙ্গ পাবলো একজনকে বন্ধু হিসেবে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে নেন। দুজনে মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন চিত্রকলা বিষয়ক সাময়িকী ‘আর্ত হোভেন’। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯০১ সালের ৩১ মার্চ।

তার এ সময়ের আঁকা ছবিতে তুলুজ লুত্রেক এর প্রভাব ছিল স্পষ্ট। তিনি ফরাসি ইম্প্রেশনিস্টদের মতো উজ্জ্বল রঙের দ্বারা প্রভাবিত। তখন তিনি ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদদের মুক্তি ও স্বাধীনতার আদর্শের অনুসারী। এ সময়ের ছবিতে তার নিজের স্বকীয়তা স্পষ্টভাবে দেখা দেয়নি। তার সে সময়কার চিত্রকর্মে রেনেসাঁ যুগের স্পেনিশ শিল্পী এল গ্রেকোর প্রভাব দেখা যায় খুব।

নতুন অধ্যায়

১৯০১ সালের দিকে বার্সেলোনা আসার পরে তার চিত্রধারায় একটা পরিবর্তন দেখা গেল। আগে তিনি স্পষ্ট, উজ্জ্বল ও গাঢ় রঙ ব্যবহার করতেন। এ সময় তিনি সেসব রঙ পরিহার করে গ্রহণ করলেন অনুজ্জ্বল নীল রঙ। এর সঙ্গে ঘন এবং প্রায় কালো রঙ ব্যবহার শুরু করলেন। এটাই পিকাসোর জীবনে নতুন বা বিশেষ অধ্যায় বলে পরিচিত।

এ সময়ে অবশ্য শুধু রঙ-তুলি-প্যালেট আর ক্যানভাসের বিষয়ই মূখ্য ছিল না। শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ও সংযুক্ত ছিল। আগের অভিজাত শ্রেণির সুখী মানুষদের উজ্জ্বল আলোময়, কিংবা রঙিন উজ্জ্বল পোশাক পরা রোমান্টিক ধাঁচের ছবি থেকে সরে এসে পিকাসো আঁকা শুরু করলেন সমাজের দুঃখী মানুষদের বেদনা ও বিষন্নতার ছবি।

এদের ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে বাস্তববাদী রেখার ঢঙ ভেঙে তিনি নতুন রেখাভঙ্গি বেছে নিলেন। শীর্ণ দেহাবয়ব, ঋজু কিন্তু অনড় দাঁড়িয়ে থাকা, অপুষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কৌণিকভাবে বেড়ে ওঠা হাত-পা ইত্যাদি সব মিলিয়ে একেবারে অনাকর্ষণীয় ফিগারে তুলির আঁচড় কাটলেন। দর্শকের চোখে যেন দার্শনিকের মতো নতুন তত্ত্ব দিয়ে আঘাত করলেন পিকাসো। অন্ধ ভিখারি, অনাশ্রিত, ভবঘুরে নিয়তির কাছে পরাজিত মানুষদের ছবি তিনি মমতা আর সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে দেখে দেখে আঁকলেন। ফিগারগুলোর চোখের দিকে তাকালে দর্শকের মনে মায়া জাগে, করুণা জাগে, বুকের ভেতর হাহাকার ওঠে। ক্যানভাস থেকে রঙের কোমলতা দূর করে দিয়ে হৃদয়ের কোমলতাকে স্থান দিলেন।

ছবিতে অনুজ্জ্বল রঙের ব্যবহার

জীবনে রোমাঞ্চের আবির্ভাব

প্যারিসের স্থায়ী জীবন থেকে পিকাসোর ক্যানভাসে আবার একধরনের বাঁক দেখা দিল। ১৯০৫ সালে পরিচয় হয় ফার্নান্দো অলিভিয়েরের সঙ্গে। শিল্পীর জীবনে প্রেম ও আনন্দের ঢেউ জাগে। এ সময় বিশ্বখ্যাত কবি গিয়োম এপোলোনিয়ের সঙ্গেও পরিচয় হয়। শিল্পীর জীবন থেকে বিষন্নতার নীল যন্ত্রণা কেটে যেতে থাকে। এবার তার ক্যানভাসে রঙের জায়গায় সেই বেদনা নীল বিষন্নতা পাল্টে গিয়ে ধীরে ধীরে স্থান পেতে থাকল গোলাপি।

পিকাসোর এই পর্বের একটা নাম আছে—পিংক পিরিয়ড বা গোলাপি পর্ব। এ ধারায় তিনি ছবি আঁকেন ১৯০৬ সাল পর্যন্ত। গোলাপি পর্বের চিত্রগুলোতে দেখা যায় কমলা ও গোলাপি উষ্ণ রঙের  আধিক্য। এর মধ্যে আছে আনন্দ। এই ছবিগুলোতে দেখা যায় মানব জীবনে অনেক শূন্যতা আছে কিন্তু সামাজিক বা আর্থিক দৈন্যতা নেই। তিনি ফার্নান্দো অলিভিয়েরকে মডেল করে অনেক ছবি আঁকলেন।

এর মধ্যে শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয় বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশের লোকজনের সঙ্গে। সংকীর্ণ জাতীয়তার ঊর্ধ্বে নিজেকে দেখতে পেলেন। পরিচিত হলেন মার্কিন লেখক ভাই-বোন লিও স্টেইন ও গারট্রুড স্টেইনের সঙ্গে। তারা প্যারিসের গ্যালারিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। একটি গ্যালারিতে পিকাসোর একটি ছবি দেখে তাদের ভালো লেগে যায়; তা কিনে নেন তারা। কিনেছিলেন সে সময়ের আটশো ফ্রাংক দিয়ে। এর আগে এত বেশি দামে পিকাসোর কোনো চিত্রকর্ম বিক্রি হয়নি। চিত্রকর্ম বিক্রি হতে থাকলে পিকাসোর হাতে টাকা-পয়সা আসতে থাকে। অভাব-অনটন দূর হয়।

গোলাপি পর্বের ছবিগুলোতে পিকাসো কৌণিক রেখার পরিবর্তে ঢেউ খেলানো রেখা ব্যবহার করেন। এই রেখায় ও রঙে কোমলতা ফিরে আসে। এ সময় তিনি যেসব ছবি আঁকেন এর মধ্যে কয়েকটি বিখ্যাত হয়ে আছে। এসব ছবিতে দেখা যায় আনন্দের বিষয়গুলো উষ্ণ রঙে প্রকাশিত হচ্ছে। জীবনের এ পর্বে তিনি ভাস্কর্যও সৃষ্টি করেন। 

ছবিতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার শুরু

বারংবার প্রেমের হাতছানি

১৯১২ সালে তার জীবনসঙ্গিনী ফার্ন্দান্দো অলিভিয়ের চিত্রশিল্পী উবালদো ওপ্পির সঙ্গে চলে যায়। এতে পিকাসো দারুণ হতাশায় পড়ে যান। এ হতাশা কাটানোর জন্য তিনি ব্যস্ত থাকেন। তার জীবনে নতুন এক সঙ্গী জুটে। তিনি হলেন— মার্সেল হামবোর্ট ওরফে ইভা। এর কিছুদিন পর ১৯১৩ সালে পিকাসোর পিতা রুইজ ব্লাসকো মারা যান।

পিকাসো তখন পূর্ব ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য সমৃদ্ধ দেশ রাশিয়া সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এর মধ্যে শিল্পীর নতুন সঙ্গিনী ইভা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক অবস্থায় চলে গেছেন। পিকাসো তার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে পিকাসো তাকে হাসপাতাল নিয়ে ভর্তি করান। নিজে সময় দিয়ে সেবা করেন। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল হয়। ইভা মারা যায় ১৯১৫ সালে।

এই শোক ভুলে থাকার জন্য পিকাসো আবার ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ সময় পরিচয় হয় কবি, ঔপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী জাঁ ককতোর সঙ্গে। ককতো পিকাসোকে নতুন কাজে জড়িয়ে নেন। তিনি ব্যালে নৃত্যের পরিচালক ছিলেন। ককতো ব্যালের মালিক সের্গেই দিয়েগিলেভের এক নৃত্য অনুষ্ঠানের ব্যালে দৃশ্য, মঞ্চ সজ্জা, পরিচালনা, কস্টিউম ডিজাইনের কাজ দেন। পিকাসো রুশ ব্যালেরিনাদের জন্য কাজ করে দেন। তবে সেই কাজ বুর্জোয়া দর্শকদের কাছে ভালো লাগেনি। তারা আশা করেছিলেন এসব দৃশ্যে ও সাজসজ্জায় আভিজাত্য তুলে ধরা হবে। কিন্তু পিকাসো সমাজের বৈষম্য, যুদ্ধের ভয়াবহতা ইত্যাদি তুলে ধরেছিলেন।

রাশিয়ান ব্যালের সঙ্গে কাজ করা পিকাসোর জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি নৃত্য সম্পর্কেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

এই ব্যস্ততার মাঝে পিকাসোর জীবনে নতুন প্রেম আসে। রুশ ব্যালেরিনা ওলগা কখলোভার সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম গড়ে ওঠে। ওলগা রাশিয়ার জারের এক কর্নেলের মেয়ে। কয়েক বছর ধরেই পিকাসো রাশিয়া সম্পর্কে আগ্রহী। এ সময় ওলগার সঙ্গে পরিচয় হওয়াতে রুশ অভিজাততন্ত্রের কাছে চলে যান। তার মাধ্যমে রুশ সমাজ সম্পর্কে জানতে পারেন।

এর মধ্যে ১৯১৮ সালে ওলগা কখলোভাকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯২১ সালেই পিকাসোর পুত্র পাওলো (পল)-এর জন্ম হয়। সন্তানের পিতা হয়ে পিকাসো মা ও শিশুকে নিয়ে ছবি আঁকেন। সেসব ছবি বিখ্যাত হয়ে আছে। কখলোভা নানা কারণে পিকাসোর সঙ্গে দাম্পত্যজীবন চালিয়ে যেতে সুবিধা বোধ করলেন না। কারণ পিকাসো ১৭ বছর বয়সী এক তরুণীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তখন পিকাসোর বয়স ৪৫ বছর।

কিছুদিন পর তরুণীর কোল জুড়ে আসে পিকাসোর একটি কন্যা সন্তান। কিন্তু এই সম্পর্কও বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কিছুদিনের মধ্যেই পিকাসো ফ্রাঁসোয়া জিলো নামে আরেক তরুণীর প্রেমে মত্ত হন। তখন পিকাসোর বয়স ৬৩ বছর। ফ্রাঁসোয়া জিলো এবং পিকাসোর দুটি সন্তান হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পিকাসো তার থেকে ৪৩ বছরের ছোট আরেক নারীর প্রতি আকৃষ্ট হন।

প্রকৃতপক্ষে, পিকাসোর জীবনে একের পর এক নারীর আগমনই তার চিত্রকর্মকে জীবনীশক্তি দিয়েছিল। তিনি প্রায় ৫০ হাজার কাজ বিভিন্ন মাধ্যমে সারা জীবনে করে গেছেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরাই ছিল সেই কাজের কেন্দ্রে। তার ধারণা ছিল যদি কাজ না করেন তাহলে বুড়ো হয়ে যাবেন। আর যাতে দেহ বুড়ো হয়ে না যায়, সে কারণেই নারীর প্রয়োজন।

প্রেমিকার সাথে পিকাসো; Image source: Thoughtco.com

বিশেষ বৈশিষ্ট্য

পিকাসোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য- তিনি চিত্রকর্মের প্রত্যেক পর্যায়ে তার আগের পর্যায় থেকে সরে এসেছেন। এক একটা পর্যায়কে ভেঙে আর একটা পর্যায়ে গেছেন। আর এই সব কিছুর সঙ্গেই তার গভীর আত্মিক যোগ ছিল। আগাগোড়া এক শিল্পীর জীবন তিনি কাটিয়ে গেছেন। তার প্রত্যেকটা ছবির মধ্যেই আসল মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যায়। পিকাসোর সৃজনশীলতা ছিল বাঁধনহারা। সব সময়ই নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করতেন। যদিও তিনি বলতেন, “আমি কিছু খুঁজি না, আমি পেয়ে যাই।”

পিকাসো; Image Source: Pinterest.com

উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম

তার উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের মাঝে আছে- ল্যা মুল্যাঁ দা ল গালেৎ, দ্য ব্লু রুম, ওল্ড গিটারিস্ট, সালত্যাঁবাঁক, সেলফ-পোর্ট্রটে, টু নুডস, আভাগঁর রমণীরা, থ্রি মিউজিশিয়ানস, স্কাল্পটর, মডেল অ্যান্ড ফিশবৌল, থ্রি ড্যান্সার্স, গিটার, গ্লাস অব আবস্যাঁৎ, সিটেড বাথার, পালোমা ও গোয়ের্নিকা। তিনি একের পর এক ছবি এঁকেছেন, ভাস্কর্য গড়েছেন, প্রিন্ট ও খোদাইয়েরও কাজ করেছেন। যখন কাজ করতেন না তখন মেতে থাকতেন ষাঁড়ের লড়াই নিয়ে। এছাড়া তিনি ১৯৩৫-১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিন শতাধিক কবিতা লিখেছেন।

পিকাসোর চিত্রকর্ম; Image Source: Pinterest.com

গুয়ের্নিকা

গুয়ের্নিকাকে বলা হয় পৃথিবীর সর্বকালের সেরা যুদ্ধবিরোধী চিত্রকর্ম। ১৯৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময়ে গুয়ের্নিকা গ্রামে ঘটে যাওয়া বোমা হামলার বিভীষিকাকে চিত্রিত করেছেন এই ছবিতে। সাড়ে ৩ মিটার লম্বা ও প্রায় ৮ মিটার চওড়া এই ছবিটি তেল রঙে আঁকা। ছবিটির সামনে দাঁড়ালে মনে হবে আপনি নিজে যেন গুয়ের্নিকার সেই ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের সময়ে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে আছেন।

১৯৩৭ সালের ২৬শে এপ্রিল স্পেনের গুয়ের্নিকা বাস্ক শহরের উপর জার্মানরা আক্রমণ করে বসে। নির্মমভাবে বোমা ফেলে। এর জন্য দায়ী ছিল নাৎসি বাহিনী। ১৯৪০ সালে জার্মানরা প্যারিস দখল করে নিলে একজন নাৎসি অফিসার পিকাসোর স্টুডিও দেখতে আসে। সে গুয়ের্নিকা পেইন্টিংটির সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে পিকাসোকে জিগ্যেস করে, এটা কি আপনার কাজ? পিকাসো বলে, “না, এটা আপনাদের কাজ।”

গুয়ের্নিকা নিয়ে যত বই লেখা হয়েছে আধুনিক যুগের আর কোনো চিত্রকর্ম নিয়ে এত বই প্রকাশিত হয়নি। নিঃশন্দেহে গুয়ের্নিকা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম। এতে লুকায়িত সব রহস্য এখনো সম্পূর্ণরূপে উন্মোচিত হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ পিকাসো নিজে থেকে কোনো কিছুই ব্যাখ্যা করে যাননি।

গুয়ের্নিকা

চিত্রকর্মের আর্থিক মূল্য

পিকাসোর অসংখ্য চিত্রকর্ম বিক্রি হয়েছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মূল্যে- যা তার সময়ে যেকোনো চিত্রশিল্পীর তুলনায় অনেক বেশি। ২০০৪ সালে তার ‘গ্যারসন আ ল্যা পাইপ’ বিক্রি হয়েছিল ১০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০১০ সালে পিকাসোর ‘ন্যুড, গ্রীন লিভস এন্ড বাস্ট’ নামক অপর একটি শিল্পকর্ম ১০৬. ৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। পিকাসোর চিত্রকর্মগুলো যেন সবসময় সব যুগের মানুষের কাছে গ্রহণীয় এবং আকর্ষণীয়।

বিদায়বেলা

১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ফ্রান্সের মৌগিন্সে ৯১ বছর বয়সে মারা যান পাবলো পিকাসো। মৃত্যুর আগে তিনি ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন। শেষের দিকে ফুসফুসে পানি জমে গিয়েছিল। মৃত্যুর ধ্বংসাত্মক থাবা থেকে বাঁচতে হলে অমরত্ব লাভের উপযোগী করে কাজ করতে হবে—এ ধরনের ভাবনা তাকে সর্বদাই সজাগ রেখেছে। একমাত্র শ্রমই মানুষকে অমর করে রাখতে পারে এই চিন্তা থেকেই তিনি চিত্রকর্মকে বেছে নেন তার পেশা হিসেবে। কিংবদন্তি এই চিত্রশিল্পী মৃত্যুর পরেও বেঁচে আছেন তার সৃষ্ট শিল্পের কল্যাণে।

পরিশেষে পাবলো পিকাসোর একটি সেরা উক্তি দিয়ে লেখা শেষ করছি,

আমরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব পরিকল্পনা নামের একটি গাড়িতে চড়ে, যে গাড়ির প্রতি আমাদের থাকতে হবে অগাধ বিশ্বাস এবং যার উপর ভিত্তি করে আমাদের নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে। এর বাইরে সাফল্যের আর কোনো পথ নেই।

Featured image: Bettmann/gettyimages

Related Articles