(পর্ব ১-এর পর থেকে)
৩.
শুরুটা হয় ১৯৯৮ এর গ্রীষ্মের এক ঘর্মাক্ত দিনে। স্ট্যানফোর্ডের ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারের এক শ্রেণিকক্ষে থিয়েল এক মেধাবী কোডারের সাথে আলাপ করছিলেন। ২৩ বছর বয়সী ম্যাক্স লেভচিন এসেছিলেন থিয়েলের এক লেকচারে অংশ নিতে, যেখানে তিনি এয়ার কন্ডিশনিংয়ের ওপর লেকচার দিচ্ছিলেন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। ওই আলাপে থিয়েল লেভচিনের এক স্টার্টআপের ব্যাপারে জানতে পারেন। একদিনের মাথায় থিয়েল তার বন্ধু ও পরিবারের কাছ থেকে অর্থ জোগাড় করে এটাকে হেজ ফান্ডে রূপান্তর করে লেভচিনকে বলেন তার স্টার্টআপে বিনিয়োগ করতে চান। এটা পাম পাইলটসের জন্য সফটওয়্যার তৈরি করত। ওই বছরের শেষে তারা ডিভাইসগুলোর মালিকদের কাছে একটা মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক লিখিত দলিল পাঠাতেন। তারা এটাকে বলতেন পেপাল। থিয়েল এর মাঝে অপার সম্ভাবনা দেখতে পেলেন।
আপনি যখন পেপালের মাধ্যমে অর্থ পাবেন, এটাকে কোনো ব্যাংকে স্থানান্তর করতে পারেন। অথবা আপনি পেপালের মধ্যেই ফান্ড রেখে দিয়ে অন্যদের পারিশ্রমিক দিতে পারেন। থিয়েল উপলব্ধি করেন, এটা পেপাল সেবাকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন ডিজিটাল কারেন্সিতে রূপান্তরিত করবে। তিনি মনে করতেন, এটা পকেটে থাকা সুইশ ব্যাংকের সমপর্যায়ের কিছু। থিয়েল কোম্পানিতে স্ট্যানফোর্ড রিভিউ এর সাবেক সম্পাদকদের নিয়োগ দেন। তিনি তার স্বাধীনতাবাদী আদর্শ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পর্যায়ে আরোপ করতে থাকেন। পেপাল কর্মীদের জন্য অফিসের বৈঠকে দেরি করে আসার অনুমতি ছিল, যতক্ষণ না তারা প্রতি মিনিটের জন্য এক ডলার করে জরিমানা দেন, এবং তাদেরকে অ্যাইন র্যান্ডের মতো লেখকদের বই পড়তে হতো।
কোম্পানিটি তাদের প্রথম অফিস ভাড়া করে পালো আলটোর কেন্দ্রস্থলে এক স্টেশনারি দোকান ও এক ফ্রেঞ্চ বেকারির ওপরে। ওই সময়ে ভ্যালিতে পেমেন্ট কোম্পানিগুলোর মধ্যে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল যে, পেপালের একই ফ্লোরে আরেকটি কোম্পানি ছিল এক্স ডট কম। পেপালের চেয়ে এক্স ডট কমের বিনিয়োগ আরো বেশি ছিল। তাদের ছিলেন একজন বিখ্যাত বিনিয়োগকারী সেকুইয়া ক্যাপিটালের মাইকেল মরিটজ এবং একজন ক্যারিশম্যাটিক উদ্যোক্তা, যিনি ইতোমধ্যে তার আরেকটি স্টার্টআপ ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তার নাম ছিল এলন মাস্ক।
মাস্ক জানতেন না পাশের ফ্ল্যাটের প্রকৌশলীরাও ডিজিটাল মানি ট্রান্সফার নিয়ে কাজ করছিলেন। কারণ তাদের দরজায় প্যারেন্ট কোম্পানির নাম ছিল। এক্স ও পেপাল কোম্পানি ওই ভবনের পেছনের গলিতে একই ট্র্যাশ বিনে ময়লা ফেলত। একদিন পেপালের প্রকৌশলীরা এক্সের কর্মীদের বড়াই করে বলছিলেন, তারা এক্সের পেমেন্ট পদ্ধতি সম্পর্কে ডকুমেন্ট পেয়ে গেছেন। এতে পাম পাইলটের পরিবর্তে ওয়েবসাইট ব্যবহার করা হতো এবং গ্রাহকদের ক্যাশ দেওয়ার বিনিময়ে রেফারেলে নিয়ে আসার সিস্টেমও ছিল। তারা ওই আইডিয়াটা পেপালে এনে বাস্তবায়িত করে। আমি এক্সের কয়েকজন কর্মীর সাথে কথা বলে দেখি, তারা ওই ফাঁপা বুলিকে সত্যিই ধরে নিয়েছেন। কিন্তু মাস্ক এই গল্পের সত্যতা নিয়ে সন্দিহান। তিনি আমাকে বলেন,
এটা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এটা অনেকটা, ‘তুমি চাঁদে যাওয়ার জন্য আমার আইডিয়া চুরি করেছ’ জাতীয় কিছু বলা হয়ে যায়।
এরপর অনেক লম্বা সময় পেরিয়ে টেসলা আর স্পেসএক্স নিয়ে কাজ করলেও থিয়েল সম্পর্কে মাস্কের অনুভূতি অম্ল-মধুর। এর কারণ অনেকটা ওই সময়ের পরবর্তী ঘটনাগুলোর জন্য।
পেপালের কার্যক্রম ওয়েবে নিয়ে এসে নতুন ব্যবহারকারীদের রেফারেল ফি দেওয়ার ব্যাপারটা কোম্পানির বিস্তৃতি বাড়িয়ে দেয়। থিয়েলের কয়েকজন প্রোগ্রামার একটা ছোট সফটওয়্যার অ্যাপ তৈরি করেন, যার মাধ্যমে কতজন ব্যবহারকারী নতুন একাউন্ট খুলেছেন তাদের ট্র্যাক করা যায়। এদের তালিকাগুলো থিয়েলের স্ক্রিনে একটা ছোট বক্সে চলে আসত, যার টাইটেল ছিল 'ওয়ার্ল্ড ডমিনেশন ইনডেক্স'। প্রতিবারই যখন নতুন কোনো ব্যবহারকারী একাউন্ট খুলত, অ্যাপে একটা বেল বাজত। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে পেপালের গ্রাহক ছিল কয়েক হাজার। বসন্ত আসতে আসতে ওই ইনডেক্সে প্রায় ১ মিলিয়ন ব্যবহারকারী চলে আসে। কোনো কোম্পানির এরকম হারে অগ্রগতি হওয়া প্রায় অভূতপূর্ব ব্যাপার ছিল। কিন্তু এর জন্য কোম্পানির ২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের মধ্যে রেফারেল ফি হিসাবেই ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছিল। আর্থিক ক্ষতি আর ব্যবসায় সামঞ্জস্যতা থাকায় থিয়েল ও মাস্ক তাদের কোম্পানিগুলো একত্রিত করে ফেলেন।
একত্রীকরণের কিছুদিনের মধ্যেই থিয়েল তার পদ ছেড়ে দেন। এরপর মাস্ক হয়ে যান প্রধান নির্বাহী। তিনি বলেন,
আমি বলব না আমাদের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক ছিল, তবে তার সাথে আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক বড় পার্থক্য ছিল। পিটার দাবা খেলার মতো বিনিয়োগ নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। আমার এতে সমস্যা নেই। কিন্তু আমি মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। আমি কোনো বিনিয়োগকারী না। অন্য লোকদের অর্থ ব্যবহার করা আমার কাছে স্মার্ট কিছু মনে হয় না।
তাদের দুজনের সাথেই অন্যকে নিয়ে কথা বলা একজন আরেকটু সংক্ষেপে বলেন,
মাস্ক মনে করেন পিটার একজন সোশ্যিওপ্যাথ। অন্যদিকে পিটার মনে করেন, মাস্ক একজন প্রতারক ও দাম্ভিক ব্যক্তি।
ঘটনাপ্রবাহ দেখলে মনে হয়, কোম্পানিতে ক্ষমতার লড়াইয়ে মাস্কই জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু থিয়েল সেখানে ফাঁদ রেখে গিয়েছিলেন। তার অধীনস্থ বেশিরভাগ কর্মীকে নির্বাহী পর্যায়ে রেখে গিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে লেভচিন ও রিভিউ এর লেখকরাও ছিলেন। মাস্ক বুঝতে পারেননি তার আশেপাশের কর্মীরা তার চেয়ে থিয়েলের প্রতি বেশি অনুগত। ওই বছরের পরবর্তী সময়ে মাস্ক ছুটি কাটানোর জন্য দুই সপ্তাহের ভ্রমণে যান। তিনি যখন বিমানে ছিলেন, থিয়েল সমর্থকরা কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষক মরিটজের স্যান্ড হিল রোডের অফিসে গিয়ে দাবি করেন, তাদের নেতাকে পদ ফিরিয়ে দিতে।
মরিটজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হওয়ার পর থিয়েল তার ফায়দা নিতে থাকেন। তিনি এক বোর্ড সভায় পরামর্শ দেন, পেপালের সব ক্যাশ তার এক হেজ ফান্ড থিয়েল ক্যাপিটালে স্থানান্তর করতে। এতে তিনি ডট কম বাবল বিপর্যয়-পরবর্তী উত্থানের সময়টা কাজে লাগাতে পারবেন। মরিটজ মনে করছিলেন থিয়েল মজা করছেন। কিন্তু তিনি শান্তস্বরে ব্যাখ্যা করেন, তিনি ওই সময়ের ইন্টারেস্ট রেট কমে যাওয়া নিয়ে একটা বাজি ধরার পরিকল্পনা করছেন। থিয়েলের আইডিয়া অগ্রাহ্য করা হয়। কিন্ত মরিটজ ভীত হয়ে পড়েন। একটা স্টার্টআপ কোম্পানির সীমিত আয় একটা অনুমানের ওপর বিনিয়োগ করা, তা-ও আবার যেখানে প্রধান নির্বাহীর ব্যক্তিগত লাভের ব্যাপার থাকে, সেটা কোনো পুঁজি বিনিয়োগকারী বা আত্মসম্মানবোধ থাকা উদ্যোক্তা চিন্তাও করতে পারার কথা না। প্রধান নির্বাহীর পদ জোর করে নিয়ে আবার এমন একটা প্রস্তাবনা মরিটজ ও অন্যান্য বোর্ড সদস্যদের কাছে দ্বিগুণ বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
থিয়েল আর মরিটজের দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। এর পেছনে কিছুটা ব্যক্তিগত কারণও থাকতে পারে। মরিটজ প্রকৃতপক্ষে মাস্কের কোম্পানির সাথে যুক্ত ছিলেন, থিয়েলের কোম্পানিতে নয়। কিন্তু এর পেছনে আরো একটা কারণ ছিল থিয়েলের সাথে মরিটজ, মাস্ক, ও তার পূর্বে আসা সিলিকন ভ্যালির প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সাথে তার মতপার্থক্য থাকা। মরিটজ আমাকে বলেন,
পিটার কোনো উদ্যোক্তা না। সে একজন ‘হেজফান্ড ম্যান’।
কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ে আশা করা হয়- তারা নিজেদের কোম্পানিগুলোকে যতটা সম্ভব বড় করার জন্য কাজ করবেন। সিলিকন ভ্যালির মিথোলজি বিশ্বাস করলে, তারা বিশ্বকে আরো কল্যাণকর করার জন্য কাজ করবেন। এরকম মনোভাব থাকলে থিয়েল পেপালের বৃদ্ধির জন্য দিন-রাত খাটার কথা, ইনভেস্টমেন্ট পোর্টফোলিও সমৃদ্ধ করার পেছনে থাকার কথা না। কিন্তু থিয়েল সিলিকন ভ্যালির সংস্কৃতিকে গোনায়ই ধরতেন না। তার কর্মকাণ্ড এমন একটা কৌশলের দুনিয়া খুলে দেয়, তার পূর্বসূরিরা যা চেষ্টা করার মতো নির্লজ্জ ছিলেন না।
থিয়েলের অধীনে পেপালের ব্যাংকিংয়ের নিয়ম উপেক্ষা করা একটা কৌশলগত সুবিধা এনে দেয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লেনদেন করার জন্য তাদের গ্রাহকদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া লাগত। কিন্তু পেপাল দাবি করে, তারা কোনো ব্যাংক নয়। অবৈধ কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে কেউ পেপাল একাউন্টে অর্থ রাখলেও কোম্পানিটি সেটা নিয়ে খুব কমই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। পেপালের গ্রাহকদের কাছে রিফান্ড করার প্রক্রিয়াটা ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলো নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। তারা এটা নিয়ে প্রতিবাদ করলে পেপাল কেবল ক্ষমা প্রার্থনা করে কূটনৈতিক আলোচনায় চলে আসে। বর্তমানে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য টেকসইবিহীন বা নৈতিক দিক দিয়ে সন্দেহজনক কার্যক্রমকে 'গ্রোথ হ্যাকিং' বলা হয়। এই কৌশলের কৃতিত্ব দেওয়া হয় থিয়েল ও তার নির্বাহীদের ওপর, এবং পুরো ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোক্তারা এটা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে। থিয়েল যেটা করতে পেরেছেন, তারা সেটাই করার চেষ্টা করছে। থিয়েল পেপালের সিইও হওয়ার এক বছর পর ইবে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে কোম্পানিটি কিনে নেয়।
৪.
২০ বছর পর থিয়েলবাদ সিলিকন ভ্যালির প্রতিষ্ঠিত নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর একটা কারণ হচ্ছে থিয়েল ইন্ডাস্ট্রিতে তার শিষ্যদের প্রতিষ্ঠা করতে খুবই দক্ষতার সাথে কাজ করে আসছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী নাম নিঃসন্দেহে মার্ক জাকারবার্গ। থিয়েল জাকারবার্গকে নিয়ন্ত্রণ করেন না, তবে তাদের সম্পর্কটা জটিল। ফেসবুক শেয়ারবাজারে পাবলিক কোম্পানি হিসেবে নাম লেখালে থিয়েল তার বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি করে দেন। ফেসবুকের তখন শেয়ার পড়ে যাচ্ছিল, আর মনোবলও কমে যাচ্ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জাকারবার্গ তাকে সদর দপ্তরে এক সভায় আমন্ত্রণ করেন। কিন্তু থিয়েল সেখানে গিয়ে তাদের অপমান করেন। তিনি বলেন,
আমার প্রজন্মের ওপর প্রত্যাশা ছিল আমরা চাঁদে কলোনি স্থাপন করব। এর পরিবর্তে আমরা পেয়েছি ফেসবুক।
কিন্তু তারপরও এত বছর থিয়েল জাকারবার্গের বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবেই ছিলেন। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক বিরোধী কিছু ব্যক্তিকেও সাহায্য করেছেন। এদের মাঝে আছেন ডানপন্থী উদ্যোক্তা জেমস ওকিফি, যিনি গোপন ভিডিও নির্মাণ করেছেন রক্ষণশীলদের প্রতি ফেসবুকের বিমাতাসুলভ আচরণকে উন্মুক্ত করতে। এছাড়া আছেন চার্লস জনসন, যিনি ফেস-রিকগনিশন কোম্পানি ক্লিয়ারভিউ এআই-এর কার্যক্রম শুরু করতে সাহায্য করেছিলেন।
ক্লিয়ারভিউ তাদের মুখাবয়বের বিশাল ডেটাবেজ তৈরি করেছিল ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি থেকে, যেটাকে ফেসবুক তাদের সার্ভিসের নীতিমালা ভঙ্গ হিসেবে দেখেছিল। জনসন আমাকে বলেন, তিনি যখন থিয়েলের কাছ থেকে বিনিয়োগ নিচ্ছিলেন, তিনি একইসাথে ক্লিয়ারভিউকে একটা প্রতিশ্রুতিশীল ব্যবসা ও ফেসবুকের দুর্বল প্রাইভেসি উন্মুক্ত করে একে ধ্বংস করে দেওয়ার একটা মাধ্যম হিসেবে দেখিয়েছিলেন। ফেসবুকের বোর্ড সদস্য হিসেবে থিয়েলের উচিত ছিল কোম্পানির স্বার্থ দেখা, কিন্তু তিনি ক্লিয়ারভিউতেও বিনিয়োগ করেন। পিটার থিয়েল ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্সি নির্বাচনের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সহায়তা করেন। এটা নিয়ে তার সমালোচনা করেন আরেক ফেসবুক বোর্ড সদস্য রিড হ্যাস্টিংস। জনসন বলেন, থিয়েল তাকে ব্যবহার করেছেন থিয়েল ও হ্যাস্টিংসের মাঝে চালাচালি হওয়া ইমেইল ফাঁস করে দেওয়ার জন্য।
যেকোনো স্বাভাবিক কোম্পানিতে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করলে কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়া হতো। কিন্ত থিয়েল নয়, বরং হ্যাস্টিংসই ফেসবুকের বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন। জাকারবার্গও তার শিক্ষককে কখনো শাস্তি দেননি। দুই সাবেক ফেসবুক কর্মীর মতে, এর একটা কারণ ছিল থিয়েলের অকপট পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা, এবং অন্য আরেকটা কারণ ছিল জাকারবার্গ তাকে রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে দেখতেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই জাকারবার্গ ডানপন্থী মিডিয়াগুলোতে সমালোচিত হয়ে আসছিলেন। থিয়েলের উৎসাহে তিনি সেগুলো উপেক্ষা করে যান।
২০১৯ সালে থিয়েল ওয়াশিংটনে যান কংগ্রেসের কাছে তার ডিজিটাল কারেন্সি নিয়ে জবাবদিহিতার জন্য যান। তখন হোয়াইট হাউজে সস্ত্রীক আসা জাকারবার্গ, জারেড কুশনার ও ট্রাম্পের সাথে আলোচনায় যোগ দেন। ওই আলোচনার নির্দিষ্ট বিষয়টা গোপন। তবে থিয়েল তার এক বিশ্বস্ত সহকর্মীকে পরবর্তীতে এটা নিয়ে বলেন, ওই দিনের আলোচনায় জাকারবার্গের সাথে কুশনারের একটা বোঝাপড়া হয়েছে। জাকারবার্গ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি রাজনৈতিক বক্তৃতার ফ্যাক্ট-চেকিং এড়িয়ে যাবেন। এতে করে ট্রাম্প শিবির তাদের ইচ্ছানুযায়ী যেকোনো কিছু দাবি করতে পারবেন। কোম্পানি যদি ওই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চলত, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো বড় ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করবে না।
ওই ডিনারের পর জাকারবার্গ রক্ষণশীল সাইটগুলো এড়িয়ে যেতে থাকেন। ওই বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে ফেসবুক এক নিউজ অ্যাপ চালু করে, যেখানে বলা হয় “গভীর অনুসন্ধানী ও তথ্যবহুল” সংবাদমাধ্যমের খবর দেওয়া হয়েছে। ওই তালিকার একটা ছিল স্টিভ ব্যাননের সাইট ব্রেইটবার্ট, যদিও সেটা কট্টর ডানপন্থীদের প্রচার মাধ্যম ছিল, এবং এর একটা কলাম ছিল “কৃষ্ণাঙ্গ অপরাধ” নিয়ে। ফেসবুক ডেইলি ওয়্যার নিয়েও শিথিল অবস্থান নেয়, যেটা ছিল ব্রেইটবার্টের তরুণ ও প্রগতিপন্থী সংস্করণ। ফেসবুক অনেক আগে থেকেই নিজেদের সরকারের সমপর্যায়ের মনে করত। এখন থিয়েলের মাধ্যমে সরকারের সাথে বোঝাপড়া হওয়ায় সাইটটি পরিণত হয় সরকার অনুমোদিত রক্ষণশীল স্থানে।
জাকারবার্গ ট্রাম্পের সাথে এমন কোনো চুক্তির ব্যাপারে অস্বীকার করেন। তিনি এই ধারণাকে ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু নির্বাচন পর্যন্ত ফেসবুকের কার্যক্রম বিবেচনা করলে তার অস্বীকৃতিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সময় টুইটার ট্রাম্পের একটা পোস্ট হাইড করে দেয়, যেটা মনে হয়েছিল সহিংসতাকে উসকে দেয়। ট্রাম্প লিখেছিলেন, “লুট করা শুরু হলে গোলাগুলিও শুরু হবে।” কিন্তু ফেসবুক সেই পোস্ট রেখে দেয়। ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলের সেই আক্রমণের ঘটনার আগপর্যন্ত ট্রাম্পকে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট দাবি করা “স্টপ দ্য স্টিল গ্রুপ” এর কার্যক্রম বন্ধের আবেদন আসলেও ফেসবুক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো উপেক্ষা করে।
আমেরিকান পুঁজিবাদের একসময়ের সোনার টুকরা ফেসবুক বা মেটা কীভাবে এমন শক্তিতে রূপান্তরিত হলো? এসবের উত্তর খুঁজতে গেলে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মতো কাঠামোগত দিকগুলোকে অবশ্যই দায়ী করা যায়। কিন্তু এর সাথে আদর্শগত কারণও আছে। রূপকার্থে ও আক্ষরিক অর্থে দু'ভাবেই থিয়েল তার বইয়ে একচেটিয়া পুঁজিবাদ নিয়ে লিখেছেন। তিনি তার একগাদা সমর্থক জড়ো করেছেন, যাদের মধ্যে জাকারবার্গও আছেন।
This is a Bengali article written about an influencial Silicon Valley billionaire Peter Thiel. The article is translated from an excerpt of the book "The Contrarian".
Reference:
Featured Image: DREW ANGERER/GETTY IMAGES