Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্বিচারী দার্শনিক সেনেকা, স্টোয়িকবাদ ও একটি ট্র্যাজেডির গল্প

জনপ্রিয় স্টোয়িক দর্শনের অন্যতম এই পথিকৃৎ আলোচিত হন নানা কারণে। অসংখ্য ট্র্যাজেডি নাটকের এই রচয়িতার মৃত্যুও ছিলো আরেক ট্র্যাজিক আখ্যান। প্রচারিত দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক ব্যক্তিজীবনের জন্য দ্বিচারী চরিত্র। কোনো দার্শনিকের পকেট তাঁর মতো স্ফীত ছিলো বলে স্বয়ং ইতিহাসও মনে করতে পারবে না। সেই আলোচিত প্রতিভাবান রোমান দার্শনিক সেনেকা আর তার দর্শন-শিক্ষা নিয়েই আজকের লেখা।

শৈশব ও তারুণ্য

পুরো নাম লুইস অ্যানিয়াস সেনেকা। সেনেকা বলেই বিশ্বময় যার পরিচিতি, তাঁর বাবার নামও কিন্তু লুইস অ্যানিয়াস সেনেকা। এজন্য সেনেকাকে অনেকে ‘সেনেকা দ্য ইয়াঙ্গার’ও বলে থাকেন। খ্রিস্টের জন্মের ৪ বছর পর অধুনা স্পেনের কর্ডোবায় জন্মেছিলেন সেনেকা। এর পরপরই পরিবারসমেত তারা চলে আসেন রোমে। শৈশব-কৈশোরে অ্যাটালাস ও সোশনের কাছে অলঙ্কারশাস্ত্রের সাথে স্টোয়িক ও পাঠ নিয়েছিলেন সেনেকা। ছোটকাল থেকেই ক্ষীণকায় সেনেকার অসুখ-বিসুখ লেগেই লাগতো। বায়ুবদলের জন্য ২১ বছর বয়সে মিসরে গিয়েছিলেন তিনি। খালার ঐকান্তিক শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে সেনেকা ১৫ বছর পর পুনরায় ফিরে আসেন রোমে।

প্রসিদ্ধির সাথে প্রতিপক্ষ বৃদ্ধি

রোমে ফেরার বছরই প্রত্যক্ষ ভোটে সেনেকা নির্বাচিত হন ম্যাজিস্ট্রেট। বাগ্মীতা ও দার্শনিক উৎকর্ষের রোমে অল্প সময়ে বেশ ভালোই প্রভাব কামিয়েছিলেন তিনি। পরের বছর (৩৭ খ্রিস্টাব্দ) যখন ক্যালিগুলা এলেন সম্রাটের গদিতে, বেঁধে যায় দুজনের ব্যক্তিত্বের সংঘাত, যা পরে রূপ নেয় শত্রুতায়। সম্রাট কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েও ভাগ্যগুণে বেঁচে যান সেনেকা।

Source: theguardian.com

৪১ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিগুলাকে হত্যা করে ক্ষমতায় এলেন ক্লডিয়াস। কিন্তু সম্রাটের সাথে বিরোধের চিত্রটা যেন পাল্টালো না। ক্লডিয়াসের স্ত্রী মেসালিনা এবার অভিযোগ দাগলেন ম্যাজিস্ট্রেট সেনেকার প্রতি। সেনেকা নাকি ব্যাভিচারে জড়িয়েছেন ক্যালিগুলার বোন জুলিয়া লিভিয়ার সাথে! ফলাফল, কর্সিকা দ্বীপে সেনেকার নির্বাসন।

নির্বাসনকালেই তিনি মাকে চিঠি লিখতেন সান্ত্বনা জানিয়ে। এই চিঠিগুলোতে প্রতিফলিত হতো সেনেকার স্টোয়িক দর্শনের আত্মোপলব্ধি। সেনেকার ব্যক্তিজীবন নিয়ে আলোচনায় একটু বিরতি দিয়ে এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক স্টোয়িকবাদের দিকে।

স্টোয়িকবাদের গোড়ার কথা

স্টোয়িকবাদের স্রষ্টা সেনেকা নন। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩০০ বছর আগে এর জন্ম সিটিয়ামের দার্শনিক জেনোর হাত ধরে। সিটিয়ামের ‘স্টোয়া পয়কিলে’ নামক খোলা এক আর্ট গ্যালারিতে সর্বপ্রথম এই দর্শনের প্রচার শুরু করেছিলেন জেনো। ‘স্টোয়া’ থেকেই তাই এলো ‘স্টোয়িসিজম’ নামকরণ।

সেই আর্ট গ্যালারি; Source:pinterest.com

দর্শন কেবল অভিজাত-জ্ঞানীর উচ্চমার্গীয় অলঙ্কার নয়, বরং একে ধারণ করতে হবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। কেননা তা আত্মশুদ্ধির হাতিয়ার- এমনটিই মনে করেন স্টোয়িক দার্শনিকেরা। জেনোর পর এই দর্শনকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রদান করতে ভূমিকা রাখেন মূলত তিন দার্শনিক– এপিক্টেটাস, সেনেকা ও অরেলিয়াস।

স্টোয়িকবাদ মূলত ভাবনার দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করে-

  • আমাদের চারপাশ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও
  • আত্মনিয়ন্ত্রণ

Source: pinterest.com

স্টোয়িকবাদ অনুযায়ী, আমাদের জীবন আসলে কোনো বাহ্যিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয় না, বরং সে ঘটনাটিকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে আমরা কীভাবে নিচ্ছি, তার ওপরই নির্ভর করে সমস্ত কিছু। ধরা যাক, আপনার ক্লাসের নোট খাতা হারিয়ে গেছে এবং আপনি ব্যথিত, কেননা পরীক্ষা আগামীকাল। কিন্তু এখানে আপনার কষ্ট পাওয়ার কারণ কিন্তু নোটখাতা নয়, বরং পরীক্ষায় কম নম্বর পাবার শঙ্কা। এখন স্টোয়িকবাদ বলে? স্টোয়িকবাদ আপনাকে বলবে ভাবনায় ইতিবাচকতা আনতে। ব্যস, আপনি সুখী!

দ্বিতীয়ত, কোনটি আপনার নিয়ন্ত্রণে আর কোনটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তা অনুধাবন করুন। এর দ্বারা ইচ্ছাশক্তিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন আপনি, কাজেকর্মে সফলও হবেন। যেমন ধরুন, আপনি একজনকে ভালোবাসেন, সে আপনাকে প্রত্যাখ্যান করছে কেননা আপনি ধূমপান করেন। এখন আপনার তো তার মনের ওপর হাত নেই। কিন্তু নিজের সিগারেট খাবার ব্যাপারে তো নিয়ন্ত্রণ আছে। সুতরাং আপনি আপনার কাজটাই করেন দেখুন না! কাজ হলেও হতে পারে।

স্টোয়িকবাদের কয়েকটি বুনিয়াদি শিক্ষা

১। “প্রতিটি দিন এমনভাবে যাপন করো, যেন এটিই তোমার শেষ দিন” – সেনেকা

স্টোয়িক দর্শনে সময়ের মূল্য দেবার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়। অ্যাপিক্টেটাসের মতে, মৃত্যু জীবনকে অর্থহীন করে না, বরং মৃত্যুই জীবনকে বেঁচে থাকার পক্ষে করেছে মূল্যবান। প্রতিটি দিনই মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছি জেনে তাই কাজ করে যেতে হবে বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে।

২। “খাবার হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের সেরা পরীক্ষা” – জেনো

আমরা দিনশেষে যা-ই খাই, তা হজম হয়ে আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করে, দেহবৃদ্ধি ঘটায় এবং উচ্ছিষ্টাংশ মলে পরিণত হয়। এখান থেকে বোঝা যায়, জিহবা বা অন্তরে প্রশান্তির কারণ হলেও খাবার-পানীয়ের মূল কাজটা কেবলই জীবনে টিকে থাকা! সক্রেটিসও তা-ই বলেছেন, বেঁচে থাকার জন্য খাও, খাওয়ার জন্য বেঁচে থেকো না। খাবারের ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ চর্চার কথা বলে স্টোয়িকবাদ।

৩। “ব্যর্থতা হচ্ছে স্বাভাবিক, আক্ষেপ হলো নিরর্থক” – অরিয়ালেস

ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাবার কথা বলে স্টোয়িকবাদ। কেননা আক্ষেপ করাটা প্রথম বুনিয়াদি শিক্ষার সাথেই তো সাংঘর্ষিক!

৪। “মঙ্গল সাধিত হয় ছোটর সাথে ছোট জোড়া লেগেই। তাই কোনো কিছুই আদতে ‘ছোট’ নয়” – জেনো

জীবনে কোনো কিছুকে ‘ছোট’ বলে উপেক্ষা না করাও স্টোয়িকবাদের শিক্ষা। বড় বড় অর্জনের দিকে চেয়ে আক্ষেপ করবার বদলে ছোট অর্জনগুলো নিয়ে সুখী হওয়াই স্টোয়িক আদর্শ।

সেনেকা যখন সম্রাট নিরোর বেতনভোগী

পুনরায় ফিরে আসছি সেনেকার ব্যাপারে। নির্বাসন থেকে ৮ বছর বাদে সেনেকাকে নাটকীয়ভাবে ফিরিয়ে আনেন সম্রাট ক্লডিয়াসের ৪র্থ স্ত্রী অ্যাগ্রিপিনা। নিজের পূর্বপক্ষের সন্তান নিরোকে পরবর্তী সম্রাট বানাবার জন্য ক্লডিয়াসের কাছে সমস্ত তদবিরই করেছিলেন অ্যাগ্রিপিনা। সেই নিরোরই শিক্ষক নিযুক্ত করা হলো সেনেকাকে।

সম্রাট নিরো; Source: biography.com

৫৪ খ্রিস্টাব্দে নিরো যখন ১৭ বছর বয়সে সম্রাট হলেন তখন আফ্রানিয়াস বুরাস ও সেনেকা সম্রাটের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। উপদেষ্টার উপদেশ নিরো কানে নিতেন যতসামান্যই। সেনেকা, বুরাসের বাধা সত্ত্বেও মাকে হত্যা করতে তাই বাধেনি নিরোর। তবুও বুরাসের মৃত্যু অবধি তিনি নিরোর অনুগতই ছিলেন। তাঁর জীবনের মূল বিতর্ক এখানেই। মানুষকে আত্মোন্নয়নের দীক্ষা যেই দার্শনিক দিতেন, তিনি কিনা ইতিহাসের বর্বরতম একজন সম্রাটের শিক্ষক ও বেতনভোগী কর্মচারি ছিলেন! সেনেকার মতে, “অর্থের অভাব কাউকে গরিব বানায় না, বরং অর্থের লোভেই মানুষ গরিব হয়”। অথচ তার নিজের জীবনেই এই শিক্ষার বাস্তবায়ন দেখা যায় না। কেননা সম্রাট নিরোর জন্য বক্তব্য লিখেই সেনেকার আয় ছিলো ৩০০ মিলিয়ন সেসেরিত্তি (ইতালীয় মুদ্রা)। শুধু তা-ই নয়, চড়াসুদে ঋণের ব্যবসা করতেন তিনি। অনেকের কাছেই তাই তিনি প্রচণ্ডভাবে একজন কপট ও দ্বিচারী। সেনেকা যে এ ব্যাপারগুলো বুঝতেন না, তা নয়। তিনি স্মিত হেসে বলতেন তখন,

“আমি জ্ঞানী নই। কোনোদিন হতেও পারবো না”।

লেখালেখিময় শেষজীবন

৬২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটের চাকরি ছেড়ে সেনেকা পুরোদমে লেখালেখিতে সঁপে দিলেন নিজেকে। দার্শনিক গ্রন্থ ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’-তাঁর সেরা মৌলিক (আপাত) কাজ। নিজের স্টোয়িক চিন্তাচেতনা ও নিগূঢ় জীবনদর্শন উঠে এসেছে তাতে। স্টোয়িকবাদ নিয়ে তাঁর অন্য ভাবনাগুলো এসেছে মাকে লেখা ও লুসিয়াসকে লেখা ৬৯টি চিঠিতে।

সম্রাটের উপদেষ্টা থাকাকালেই সেনেকা লিখেছিলেন রাজনৈতিক প্রহসন ‘দ্য আপোকোলোসিন্টোসিস’ এবং নাটক ‘ফিড্রা’। অবসরের পর ৬২-৬৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি তিনি লিখেছেন অসংখ্য ট্র্যাজেডি নাটক ও গল্প। ‘দ্য ট্রোজান উইমেন’, ‘মেডিয়া’, ‘দ্য ফিনিশিয়ান উইমেন’, ‘দ্য ম্যাড হারকিউলিস’। তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় ‘ইডিপাস’ ও ‘আগামেমনন’ ছিলো যথাক্রমে গ্রিক উপন্যাস ‘সফোকলস’ ও ‘অ্যাসকাইলাস’ অবলম্বনে রচিত। তাঁর লেখায় ভার্জিল ও ওভিডের প্রভাব ছিলো বলার মতো। তাঁর বেশিরভাগ কাজ মৌলিক নয়, তবুও লেখক হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ হবার কারণ দু’টো।

১। তিনি গুটিকয়েক রোমান দার্শনিকের অন্যতম হয়েও গ্রিক দর্শন ও পুরাণকে সাহিত্যে প্রাণবন্ত উপজীব্য করেছেন।

২। শেক্সপিয়রের পূর্বে সফল ট্র্যাজেডি নাটক রচয়িতা হিসেবে অনেকে সেনেকাকেই স্মরণ করেন।

সেনেকার ভাস্কর্য; Source: theguardian.com

করুণ জীবনাবসান

যা-ই হোক, এত ট্র্যাজেডি যার কলম থেকে বেরিয়েছে, তাঁর জীবনটাও ঐ ট্র্যাজেডি দিয়েই শেষ হয়েছিলো। ৬৫ খ্রিস্টাব্দে গায়াস কালপার্নিয়াস পিসো আর সেনেকার ভাতিজা লুকান মিলে ষড়যন্ত্র করেছিলেন নিরোকে হত্যা করবার। ভাতিজার সূত্রে কীভাবে যেন সেনেকার নামও জড়িয়ে পড়ে সেই ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। ফলাফল, সেনেকার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন নিরো। তবে শিক্ষাগুরু হওয়ায় খানিকটা ‘দয়া’ হয় নিরোর। জল্লাদ নয়, সেনেকার দণ্ড কার্যকরের ভার দেওয়া হলো স্বয়ং সেনেকাকেই।

সহজ মরণের জন্য দু’হাতের রগ কাটলেন সেনেকা। ভীষণ ক্ষীণকায় হওয়ায় রক্তপাতও তেমন হচ্ছিলো না, কেবল কষ্টই পাচ্ছিলেন তিনি। এই দৃশ্য দেখে সেনেকার স্ত্রী পম্পিয়া পলিনাও হাত কেটে ফেলেন, তাকে অবশ্য উদ্ধার করেছিলো সম্রাটের রক্ষীরা। যা-ই হোক, রগ কেটেও না মরতে পারায় সেনেকা পান করলেন এক চুমুক হেমলক বিষ। কাকতালীয়ভাবে তাতেও মৃত্যু হচ্ছিলো না তাঁর, শুধুই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। শেষে সেনেকাই সৈন্যদের বলেন তাকে গরম পানির চৌবাচ্চায় রাখতে। আজীবন শ্বাসকষ্টে ভোগা সেনেকার শেষ নিঃশ্বাসটিও সেই চৌবাচ্চাতেই পড়েছিলো।

তিনি যা উপদেশ দিয়ে গেছেন, তা হয়তো তিনি অনেক সময় নিজে পালন করেননি। পরনারী আসক্তির রিপুও তার ছিলো। কিন্তু স্টোয়িকবাদের ইতিহাস কিংবা ট্র্যাজেডি সাহিত্য কিন্তু তাঁর কাছে ঋণী থাকবে সবসময়েই। আর তাছাড়া সেনেকা তো সবসময় বলেছেনই,

“নেতিবাচকতা পরিহার করো”

আমরাও নাহয় তাঁর জীবন বা দর্শন থেকে কেবল ইতিবাচকটাই নিলাম!

ফিচার ইমেজ:dailystoic.com

Related Articles