Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্লেটো: যোগ্য গুরুর যোগ্য শিষ্য

সুন্দর পৃথিবীতে এসেছি আমি“- এই বাক্যটি ছোটবেলায় শিক্ষকরা শিখিয়েছিলেন ইতিহাসের চারজন অতি পরিচিত মহামানবের নাম সহজে মনে রাখবার জন্য। গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের এই ধারা শুরু হয় সক্রেটিস থেকে যার শিষ্য প্লেটো। পরে প্লেটোর শিষ্য হন অ্যারিস্টটল আর তার শিষ্য হন আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট। আজকের আলোচনা সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটোকে নিয়ে

গ্রীক দার্শনিক প্লেটো, আরেক বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের শিষ্য এবং অ্যারিস্টটলের গুরু, প্রাচীন গ্রীসের তো বটেই, সমগ্র বিশ্বেরই একজন অতি পরিচিত, সম্মানিত ও আলোচিত ব্যক্তি। তার চিন্তাধারা ও দর্শন কালের মহাস্রোতে হারিয়ে যায়নি। বরং কালক্রমে অধিক শক্তিশালীরূপে মানুষের মনে বসতি গড়েছে। যুগে যুগে মানুষ তার দর্শন নিয়ে ভেবেছে, অনুপ্রাণিত হয়েছে। বিশেষভাবে পশ্চিমাদের দর্শন ব্যাপকভাবে প্লেটোর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত।

প্লেটো (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৮-৩৪৮); image source: intellectualtakeout.org

সক্রেটিসের দ্বারা ভীষণ মাত্রায় প্রভাবিত প্লেটোর অধিকাংশ লেখারই কেন্দ্রীয় চরিত্র সক্রেটিস। সক্রেটিসকে ঘিরে লেখা তার ‘লোগোই সক্রেটিকো’গুলো নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও অন্তত প্রাচীন গ্রীসের সমাজ ও দর্শন জানার জন্য প্লেটোর লেখাগুলোকেই সবচেয়ে প্রামাণিক বলে ধরে নেয়া হয়। ‘দ্য একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা (অনেকের মতে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ‘রিপাবলিক’ লেখার জন্যই তিনি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেন। আর তার ‘ফিলোসোফার কিং’ বিষয়ক দর্শন তো যেকোনো যুগের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের আদর্শ হবার দাবিদার।

জন্ম ও শৈশব

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, প্লেটোর সম্পর্কে যে তথ্যগুলো আপনাদের জানাবো, সেগুলোর অধিকাংশই বিতর্কিত। তবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য তথ্যগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

খ্রিস্টপূর্ব ৪২৮ অব্দে (সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, মতান্তরে ৪২৭-৩১) প্লেটো প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ব্যক্তিজীবন এবং পরিবার সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা যায়। তার বাবা অ্যারিস্টন এবং মা পেরিকটিওন উভয়েই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য ছিলেন। প্লেটোর আরো দুই ভাই গ্লকন ও অ্যাডেইমেন্টাস উভয়ে বয়সে তার চেয়ে ছোট ছিল। শৈশবেই তার বাবা অ্যারিস্টোন মারা যান। মা পেরিকটিওন নিজের দূর সম্পর্কের চাচা পাইরিল্যাম্পসকে বিয়ে করেন। সৎ বাবার ঘরে প্লেটোর আরো এক ভাই অ্যান্টিফোনের জন্ম হয়।

একটি বিষয়, যা অনেকেই জানেন না, তা হলো প্লেটোর আসল নাম। প্লেটোর দাদার নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখা হয়েছিল অ্যারিস্টোক্লেস। আমরা সবাই জানি শারীরিকভাবে প্লেটো ছিলেন অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারী। তার প্রশস্ত দৈহিক গঠনের জন্য তার কুস্তি শিক্ষক তার নাম দেন ‘প্লেটো’ যার অর্থ প্রশস্ত। তবে অনেকে বলেন তার কপাল বেশ বড় থাকায় তার নাম প্লেটো দেয়া হয়। তবে কারণ যা-ই হোক, প্লেটো তার ডাকনাম এতে সন্দেহ নেই।

রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিবার

প্লেটো ছিলেন সমসাময়িক গ্রীসের রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাধর পরিবারের সদস্য। সক্রেটিসের জীবনীতে পড়া ‘টাইরেন্ট থার্টি’র কথা মনে আছে তো? সক্রেটিসের এক চাচা চার্মিডেস ছিলেন সেই টাইরেন্ট থার্টির একজন ক্ষমতাধর সদস্য। শুধু চাচাই নয়, টাইরেন্ট থার্টির প্রধান ক্রিটিয়াস ছিলেন সম্পর্কে প্লেটোর দাদা! তবে এ দু’জনের বাইরে প্লেটোর আত্মীয়দের মধ্যে আর তেমন কেউ রাজনীতির সাথে ততটা জড়িত ছিল না। তার সৎ বাবা পাইরিল্যাম্পস কিছুটা রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তিনি ডেমোক্রেটিক গ্রীসের প্রধান সেনাপতি পেরিক্লেসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

ভ্রমণ এবং একাডেমি প্রতিষ্ঠা

প্লেটোর একাডেমির ধ্বংসাবশেষ; image source: panoramio.com

সক্রেটিসের মৃত্যুর পর প্লেটো ভ্রমণে বের হন। তিনি সাইরেন, ইতালি, সিসিলি, মিশরে ভ্রমণ করেন। মিশরে তার ভ্রমণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ একমত নন। তিনি প্রায় ১২ বছর দেশে দেশে ভ্রমণ করে বেড়ান। এ সময় তিনি সিরাকিউজ গমন করেন এবং বিখ্যাত গণিতবিদ পিথাগোরাসের অনেক শিষ্যের সাথে পরিচিত হন। সিরাকিউজের শাসকগোষ্ঠীর সাথেও তার খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়।

৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো নিজ শহর এথেন্সে ফিরে আসেন। এর দু’বছর পর আনুমানিক ৩৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি গ্রীক বীর ‘আকাডেমাস’ এর উদ্যানে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং নাম দেন ‘দ্য একাডেমি’। প্লেটো আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন। তার মৃত্যুর পরও দীর্ঘকাল একাডেমির শিক্ষা কার্যক্রম চলেছিল (৫২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত)। গণিত, জোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, দর্শন এবং রাজনীতি ছিল প্লেটোর একাডেমির শিক্ষাক্রমের প্রধান বিষয়। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের জন্য কোনোরকম অর্থ গ্রহণ করতেন না তিনি। তবে ভর্তি হবার জন্য কঠিন ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন ঠিকই!

৩৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো সিরাকিউজে যান তার এক শিষ্যের বন্ধু ডায়নের আমন্ত্রণে। ডায়নের আমন্ত্রণটি ছিল তার বন্ধু তথা সিরাকিউজের শাসক দ্বিতীয় ডায়োনাইসিয়াসের গৃহশিক্ষক হবার। প্লেটো ভাবলেন ডায়োনাইসিয়াসকে শিক্ষা দিয়ে ‘ফিলোসফার কিং’ বানাতে পারলে মন্দ হয় না। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে ডায়োনাইসিয়াসকে নিয়ে প্লেটোর স্বপ্নভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। ডায়োনাইসিয়াস প্লেটোর দর্শন বুঝতে না পেরে ভাবলেন তার বন্ধু ডায়ন এবং প্লেটো মিলে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই ধারণা থেকে তিনি ডায়নকে নির্বাসনে পাঠান এবং প্লেটোকে গৃহবন্দী করেন। তবে সৌভাগ্যক্রমে প্লেটো সিরাকিউজ থেকে পালিয়ে নিজ শহরে ফিরে আসতে সক্ষম হন।

অ্যারিস্টটলের সাথে প্লেটো; image source: extinguishedscholar.com

মৃত্যু

শেষজীবনটা প্লেটো কাটিয়ে দেন তার স্কুল একাডেমিতে শিক্ষাদান করে এবং লেখালেখি করেই। আনুমানিক ৩৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো এথেন্সে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স ছিল আশির কাছাকাছি বা সামান্য বেশি।

প্লেটোর দর্শন ও কাজ যাদের দ্বারা প্রভাবিত

দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও ডায়োজেন এর মতে প্লেটো প্রাথমিক জীবনে হেরাক্লিটাসের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তবে হেরাক্লিটাসের প্রভাব নিয়ে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও, প্লেটোর দর্শন ও কাজ যে পার্মেনিডেস ও জেনোর দ্বারা ভালোরকম প্রভাবিত তা নিয়ে কারো সংশয় নেই। অন্যদিকে সিরাকিউজে ভ্রমণকালীন প্লেটো পিথাগোরাসের গাণিতিক দর্শন দ্বারাও প্রভাবিত হন। তবে প্লেটো সবচেয়ে বেশি যার দ্বারা প্রভাবিত তিনি হলেন তার গুরু সক্রেটিস। এ প্রসঙ্গে প্লেটোর একটি উক্তি উল্লেখ না করলেই নয়। সক্রেটিসের মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে প্লেটো বলেছিলেন, “সক্রেটিস হচ্ছেন পৃথিবীর মহত্তম ব্যক্তি।

এথেন্সে স্থাপিত প্লেটোর একটি ভাস্কর্য; Photographer: Eric Gerlach

প্লেটোর ডায়লগ

শৈশব থেকেই প্লেটোর মধ্যে শৈল্পিক ও সৃজনশীল গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। তিনি কিশোর বয়সেই লেখালেখিতে অভ্যস্ত হন। তার জীবনে অধিকাংশ লেখাই সক্রেটিসকে কেন্দ্র করে লেখা। কথোপকথন বা ডায়লগের মাধ্যমে সক্রেটিসের দর্শন তুলে ধরেছেন তিনি এসব লেখায়। জেনোফোন আর অ্যারিস্টোফোনদের মতো প্লেটোর লেখায়ও সক্রেটিসকে প্রধান চরিত্রে কথক হিসেবে রেখে লেখা এগিয়ে গিয়েছে। তবে পণ্ডিতগণ প্লেটোর অনেক ডায়লগের ব্যাপারে সন্দিহান। বিশেষ করে প্লেটোর শেষ দিককার ডায়লগগুলো অতিমাত্রায় বিতর্কিত এবং অধিকাংশের মতে সেগুলোতে সক্রেটিসের চরিত্রে আদতে প্লেটো নিজের দর্শনই প্রতিফলিত করেছেন। তবে সক্রেটিসের প্রকৃত দর্শন কোনগুলো আর কোনগুলোতে প্লেটো নিজের দর্শন লিখেছেন তা নিয়ে বিতর্ক এড়াতে পণ্ডিতগণ তার লেখাগুলো সময়ের ক্রমানুসারে সাজিয়েছেন। এক্ষেত্রে কোনো লেখাতে নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না থাকায় পণ্ডিতগণ ‘স্টাইলোমেট্রি’ নামক বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন পদ্ধতিতে কন্টেন্ট অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে তার সবচেয়ে নিরপেক্ষ লেখাগুলোকে প্রথম দিকে রেখে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তিনটি ভাগ সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।

আর্লি ডায়লগ বা প্রাথমিক ডায়লগ

দ্য অ্যাপোলজি অফ সক্রেটিস; image source: genius.com

আর্লি বা গোড়ার দিকে ডায়লগগুলোর মধ্যে প্লেটোর অ্যাপোলজিই (দ্য অ্যাপোলজি অব সক্রেটিস) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে ধরা হয়। আধুনিককালের দর্শনশাস্ত্রের পণ্ডিতগণ যদিও কখনোই প্লেটোর লেখাগুলোকে সম্পূর্ণ প্রামাণিক বলে মনে করেন না, তথাপি এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে অ্যাপোলজিতে যা কিছু আছে সবই প্রকৃত অর্থে সক্রেটিসের বাণী। প্রথম দিককার আরো কিছু ডায়লগ হচ্ছে চার্মিডেস, ক্রিটো, হিপিয়াস মেজর, হিপিয়াস মাইনর, লাইসিস, মেনক্সানাস এবং রিপাবলিক বুক-১। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে বলে রাখা ভালো, এই ডায়লগুলোর নামকরণ করা হয়েছে যেসব ব্যক্তির নামে, তারা এর মূল চরিত্র নয়। প্রতিটিতেই মূল চরিত্র সক্রেটিস, যার সাথে এই ব্যক্তিরা কথোপকথন করেছেন।

প্লেটোর প্রথম পর্যায়ের এই ডায়লগগুলো পণ্ডিতগণ চারটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকেন।

  • ইউনিটারিয়ান ভিউঃ প্লেটোর ডায়লগে যে সকল দর্শন পাওয়া যায় সবই প্লেটোর নিজের দর্শন। সক্রেটিসের এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।
  • লিটারারি ভিউঃ অনেকে মনে করেন প্লেটোর ডায়লগগুলো নেহায়েতই সাহিত্যিক মনোভাব থেকে লেখা। সক্রেটিসের দর্শন তুলে ধরা প্লেটোর উদ্দেশ্য ছিল না।
  • ডেভলপমেন্টালিস্ট ভিউঃ এই দৃষ্টিকোণ থেকে যারা ব্যাখ্যা করেন তাদের দাবি প্লেটোর প্রথম দিকের ডায়লগগুলোর সাথে পরবর্তী ডায়লগগুলোর পরিবর্তনই প্রমাণ করে সেখানে প্লেটোর দর্শন রয়েছে।
  • হিস্টোরিকাল ভিউঃ এই দৃষ্টিকোণ থেকেই অধিকাংশ পণ্ডিতগণ দেখে থাকেন এবং আমরাও দেখেছি এই লেখায়। হিস্টোরিকাল ভিউ অনুযায়ী সক্রেটিস বেঁচে থাকতে এবং তার মৃত্যুর কিছু সময় পর পর্যন্তও প্লেটোর উপর সক্রেটিসের প্রভাব শক্তভাবে বিদ্যমান ছিল। তাই তখনকার লেখা ডায়লগগুলোতে প্লেটো নিরপেক্ষভাবে সক্রেটিসের দর্শনই তুলে ধরেছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি সক্রেটিসের প্রভাবমুক্ত হতে থাকেন এবং নিজের দর্শন তুলে ধরতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

প্লেটোর প্রথম দিকের ডায়লগগুলোতে সক্রেটিসকে যেসব বিষয়ে আলোচনা করতে দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে নৈতিকতা, ধর্ম ও মনস্তত্ত্ব। তবে ধর্মের আলোচনাই সবচেয়ে বেশি হয়। এ সময়কার দর্শনগুলোর মধ্যে কিছু বিখ্যাত দর্শনের কথা না লিখলেই নয়।

১) ঈশ্বর সম্পূর্ণ পূজা-অর্চনার প্রয়োজনের বাইরে। তিনি সর্বজ্ঞানী এবং মানুষের প্রতি সদা সদয়।
২) মৃত্যুকে ভয় পাবার কিছুই নেই। মৃত্যুর পর ভালো আত্মাগুলো পুরস্কার আর মন্দ আত্মাগুলো শাস্তি পাবে, যদি মৃত্যু পরবর্তী জীবন থেকে থাকে।
৩) মানুষ সজ্ঞানে নিজের আত্মাকে কলুষিত করে না। অর্থাৎ কোনো খারাপ কাজ জেনে-বুঝে করে না। যা নিজের কাছে ভালো মনে হয় (অন্যের কাছে যেটা খারাপও হতে পারে) তাই সে করে।
৪) প্রতিশোধ শান্তি আনতে পারে না।
৫) সকল পূণ্যের মাঝে একপ্রকার সংযোগ আছে। গভীরভাবে চিন্তা করলে সকল পূণ্য একই।

মিডল ডায়লগ বা মধ্যবর্তী সময়ের ডায়লগ

মধ্যবর্তী সময়ের ডায়লগ; Image source: blog.oup.com

এই ডায়লগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রিপাবলিক বুক-২ থেকে বুক-১০ পর্যন্ত। আরো আছে ফায়েডো এবং সিম্পোসিয়াম। এই লেখাগুলোর ধরন এবং পদ্ধতিগতভাবে দর্শনের বিশ্লেষণ আর্লি ডায়লগগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা।

এই পর্যায়ের লেখাগুলোতে সক্রেটিসকে মানুষের আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে কথা বলতে শোনা যায়। সক্রেটিসের মতে মানুষের আত্মার কোনো মৃত্যু নেই। মানুষের জন্মের পূর্বেও আত্মাগুলো জীবিত ছিল এবং মৃত্যুর পরও অন্যরূপে অন্যদেহে পুনর্জন্ম লাভ করবে। এখানে প্লেটোর ডায়লগে সক্রেটিস আরো বলেন মানুষের আত্মার তিনটি অংশ রয়েছে।

  • রেশনাল অংশঃ যুক্তি ও সত্যের খোঁজ করে এই অংশ।
  • স্পিরিটেড অংশঃ এই অংশ জয়, পরাজয়, সম্মান এসব বিষয়ে ভাবে।
  • অ্যাপিটাইট অংশঃ এই অংশ যাবতীয় ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লোভ-লালসার জন্ম দেয়।

মধ্যবর্তী সময়ের ডায়লগের সবচেয়ে প্রধান অংশ হচ্ছে ভালোবাসার সংজ্ঞায়ন। প্লেটো তার ডায়লগ সিম্পোসিয়ামে ‘থিওরি অব এরোস’ বা ভালোবাসা নিয়ে আলোচনা করেন। (গ্রীক শব্দ এরোস অর্থ ভালোবাসা) পণ্ডিতগণ এই অংশের নাম দিয়েছেন ‘প্লেটোনিক লাভ’ এবং এখানে সক্রেটিসের দর্শন নয় বরং প্লেটোর নিজের দর্শন সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পেয়েছে বলে দাবি করেন। যা-ই হোক, এখানে ভালোবাসাকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের কাছে ব্যাপকমাত্রায় জনপ্রিয় হয়। ভালোবাসা বিষয়ক কিছু দর্শন তুলে ধরা হলো।

  • দুজন মানুষ যাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে তারা একে অপরের অর্ধাঙ্গ/ অর্ধাঙ্গীনী।
  • একজন প্রেমিকের ভালোবাসা যদি সত্য হয় তাহলে সে ‘ল্যাডার অব লাভ’ বা ভালবাসার সিঁড়ি (প্রতীকি) খুঁজে পায় যার দ্বারা সে প্রকৃত সৌন্দর্যের কাছে আরোহণ করতে পারে।
  • ভালোবাসা হচ্ছে ‘স্বর্গীয় উন্মাদনা’ যার সাহায্যে মানুষ শ্রেষ্ঠতম অর্জনে সমর্থ হয়।
  • প্রকৃত প্রেমে যৌনতার কোনো স্থান নেই। কারণ ভালোবাসা হচ্ছে সুন্দর আর যৌনতা হচ্ছে বিকৃত।

image source: Quote Pixel

লেট ডায়লগ বা শেষ সময়ের ডায়লগ

পারমেনিডেস, সোফিস, ক্রিটিয়াস, স্টেটসম্যান, ল, ফিলেবাস ইত্যাদি হচ্ছে এই পর্যায়ের ডায়লগ। এই ডায়লগগুলোতে প্লেটো পুরো ফিলোসফিকাল মেথডকেই বদলে দেন। আগের ব্যাখ্যা করা ডায়ালেকটিক বা প্রশ্ন করার পদ্ধতি বদলে তিনি অন্য একটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেন যা তার মতে ‘সঠিক’ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কোনো সমস্যার ব্যাপারে আগে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। এরপর সে তথ্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ততক্ষণ ভাগ করতে হবে যতক্ষণ না সেগুলো এমন অবস্থায় উপনীত হয় যে আর বিশ্লেষণ করা যায় না (অনেকটা ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস এর মতো)। আর এভাবে সমস্যার প্রকৃত সমাধান বের হয়ে আসে। শেষ দিকের ডায়লগগুলোতে এই নতুন পদ্ধতির অবতারণা এবং এর ভাসা ভাসা ব্যাখ্যায় দর্শনশাস্ত্রের পণ্ডিতগণ নিশ্চিত হন যে সেগুলো প্লেটোর সম্পূর্ণ নিজেরই দর্শন। এই ডায়লগগুলোর আরো একটি দিক হচ্ছে সক্রেটিসের প্রধান চরিত্র থেকে সরে আসা। এখানে দেখা যায় সক্রেটিস অধিকাংশ সময়ই নীরব শ্রোতা। অন্যদিকে ক্রিটিয়াসের মধ্যে তিনি তার বিখ্যাত কল্পিত নগরী ‘আটলান্টিস’ এর কথা উল্লেখ করেন।

সক্রেটিসের চরিত্রায়নে ভিন্নতা

প্রথমদিকের ডায়লগগুলোতে প্লেটো সক্রেটিসকে যেভাবে তুলে ধরেছেন তার মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃত সক্রেটিসকে দেখতে পাই। এখানে সক্রেটিসকে প্রচণ্ড রকমের জিজ্ঞাসুরূপে উপস্থাপন করা হয় যিনি প্রশ্নে প্রশ্নে প্রশ্নকারীর মধ্য থেকেই উত্তর বের করে আনতেন। এবং সবশেষ প্রশ্নোক্ত বিষয়টি সম্পর্কে নিজের অজ্ঞতার কথা প্রকাশ করতেন। এই পদ্ধতিকে বলা হতো ‘সক্রেটিক মেথড অব টিচিং’ এবং সক্রেটিসকে বলা হতো ‘এলেনকাস’। গ্রীক শব্দ ‘এলেনকাস’ অর্থ খণ্ডনকারী। কিন্তু মিডল ডায়লগগুলোতে দেখা যায় সক্রেটিস প্রশ্ন করার বদলে কিছুটা দক্ষ শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন যিনি সমস্যা সমাধানে নিজের তত্ত্বগুলো প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালিয়েছেন। আর শেষ ডায়লগে তো দর্শন পদ্ধতিই বদলে গেলো।

ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত প্লেটোর রিপাবলিকের একটি স্ক্রল; image source: battleofearth.wordpress.com

আরো কিছু কাজ

থার্টিন লেটারস, এইটিন ইপিগ্রামসহ আরো কিছু কাজ প্লেটোর বলে ধরা হয় যেগুলো নিয়ে পণ্ডিতদের মাঝে বিতর্ক রয়েছে। এগুলোর অন্যতম হচ্ছে স্পুরিয়া। দার্শনিক ডায়োজেনস প্রায় দশটি স্পুরিয়ার কথা উল্লেখ করে গেছেন। অন্যদিকে এপিগ্রাম বা (শোক) কবিতা আঠারোটি নাকি সতেরোটি তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এগুলো মূলত লেখা হয়েছিল কোনো শোকানুষ্ঠান বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। আর সর্বশেষ রয়েছে ডুবিয়াস। উপরোক্ত এই কাজগুলো আদতে প্লেটোর কিনা তা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও সার্বিকভাবে সেগুলোর জন্য প্লেটোর কথাই স্মরণ করা হয়।

দর্শন ও মানুষের প্রকৃতির উপর প্লেটোর চিন্তা ভাবনা নিজের দেশ গ্রীস ও নিজের কাল ছাড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। তার সমতা ভিত্তিক সমাজ গড়ার দর্শন থেকেই আজকের পৃথিবীর আধুনিক গণতন্ত্রের উদ্ভব। একজন প্লেটোকে কোনো নির্দিষ্ট কালের সীমায় বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। তিনি এসেছিলেন একজন মহান গুরুর শিষ্য হয়ে। শেষতক নিজেকে গুরুর যোগ্য শিষ্যই প্রমাণ করে গেছেন।

ফিচার ইমেজ- shutterstock.com

Related Articles