Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রামানুজন: গণিতের জগতে এক অনন্য প্রডিজি

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিভার অভাব নেই। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত ব্যক্তিও এই উপমহাদেশেরই একজন, শ্রীকান্ত জিকচার। বিশটি স্নাতক ডিগ্রিধারী এই ভদ্রলোকের জন্ম ১৯৫৪ সালে। আর আমাদের আজকের প্রতিবেদনের নায়ক শ্রীনিবাস আয়াঙ্গার রামানুজনের জন্ম ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর ভারতের মাদ্রাজের তাঞ্জোর জেলার ইরেভদ শহরের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। মাদ্রাজ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ছোট্ট এই গ্রামটিতে দাদীর বাড়িতেই প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই গণিতবিদ। রামানুজনের বয়স যখন মাত্র এক বছর, তখন তার মা তাকে নিয়ে কুম্বাকোনাম শহরে চলে আসেন, মাদ্রাজ থেকে এটি ১৬০ কিলোমিটার দূরবর্তী। এখানে এক কাপড় ব্যবসায়ীর দোকানে কেরানির চাকরি করতেন রামানুজানের বাবা কে শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার। মা কোমালাতাম্মাল ছিলেন গৃহিণী, মাঝে মাঝে স্থানীয় মন্দিরে গানও করতেন অবশ্য।

রামানুজনের বাড়িটি; Source: bp.blogspot.com

রামানুজনের বয়স যখন দেড় বছর, তখন তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় তার ছোট ভাই সাদাগোপান। যদিও জন্মের তিন মাসের মধ্যেই মারা যায় সে। ১৮৮৯ সালের ডিসেম্বরে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হন রামানুজন। সে বছর এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৪,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠেন রামানুজন। মা’র হাত ধরে চলে আসেন নানাবাড়ি কাঞ্চিপুরামে। ১৮৯১ এবং ১৮৯৪ সালে আরও দুটি সন্তানের জন্ম দেন তার মা, তাদের কেউই প্রথম জন্মদিন পালন করা পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে বিচরণ করতে পারেনি।

১৮৯২ সালের ১ অক্টোবর স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হন রামানুজন। কাঞ্চিপুরাম আদালত থেকে তার নানার চাকরি চলে গেলে তিনি এবং তার মা আবারও কুম্বাকোনামে ফিরে আসেন। এবার রামানুজনকে ভর্তি করা হয় কাঙ্গায়ান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দাদার মৃত্যুর পর আবারও তাকে নানা-নানীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মাদ্রাজ অবশ্য তার খুব একটা ভালো লাগতো না। অবলীলায় স্কুল পালাতে শুরু করলেন তিনি। ছেলে যেন ঠিকমতো স্কুলে যায়, তা নিশ্চিত করতে একজন কনস্টেবল নিয়োগ করলেন রামানুজনের বাবা-মা। ফলাফল, ছয় মাসের মধ্যে আবারও কুম্বাকোনামে চলে আসেন তিনি। রামানুজনের বাড়িটি এখন ‘শ্রীনিবাস রামানুজন ইন্টারন্যাশনাল মনুমেন্ট’ হিসেবে পরিচিত।

রামানুজন; Source: ytimg.com

বাবা যেহেতু সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, মায়ের তত্ত্বাবধায়নেই বেড়ে উঠতে থাকলেন রামানুজন। মায়ের সাথে তার সম্পর্কটা ছিল খুব ঘনিষ্ঠ। ধর্মীয় গান, সংস্কৃতি, পূজা-পাঠ, ব্রাক্ষ্মণদের জীবনাচরণের সবটাই তিনি শিখেছেন মায়ের কাছ থেকে। কাঙ্গায়ান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখায় বেশ ভালো ফলাফল করতে লাগলেন রামানুজন। বয়স দশ বছর হওয়ার আগেই তিনি ইংরেজি, তামিল, ভূগোল আর পাটিগণিতে পুরো জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাস করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি ভর্তি হন টাউন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, এখানেই তিনি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে গণিতের সাথে পরিচিত হন। বয়স যখন এগারো, তখনই তিনি বাড়িতে জায়গীর থাকা দুই কলেজ ছাত্রের গাণিতিক জ্ঞান বলতে গেলে গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। উচ্চতর পর্যায়ের ত্রিকোণমিতি শেখার জন্য এস. এল. লুনির একটি বই ধার নেন তিনি। তের বছর বয়সে এই বইয়ের জটিল সব সমস্যার সমাধান নিজে নিজে করতে শেখেন। বয়স চৌদ্দ হওয়ার পর স্কুল থেকে তার মেধার প্রতি সম্মান জানিয়ে সার্টিফিকেট দেয়া হয় এবং স্কুলের ১,২০০ ছাত্রের হিসাব রাখার ক্ষেত্রে ৩৫ জন শিক্ষক সমৃদ্ধ লজিস্টিক বিভাগকে পুরোদমে সাহায্য করতেন তিনি।

নির্ধারিত সময়ের আগেই গণিতের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে দিতেন রামানুজন। জ্যামিতি এবং অসীম সিরিজের অংক করে ফেলতেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ১৯০২ সালেই তাকে ঘন সমীকরণের মতো জটিল অংক করতে দেখা যায়। চতুর্ঘাত সমীকরণের সমাধান করার নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। পঞ্চঘাতের সমীকরণ বের করারও চেষ্টা করেন, তবে তিনি জানতেন না মূলক দ্বারা এই কাজ করা সম্ভব নয়। ১৯০৩ সালে ষোল বছর বয়সী রামানুজন এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে নিয়ে পড়েন জি. এস. কারের ‘এ সিনোপসিস অফ এলিমেন্টারি রেজাল্টস ইন পিউর অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড ম্যাথম্যাটিকস’ বইটি। এখানে প্রায় ৫,০০০ উপপাদ্যের সাথে পরিচয় হয় তার। এই বইটিকে রামানুজনের ‘প্রতিভা জাগানিয়া গ্রন্থ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বারংবার বইটি পড়তে থাকেন তিনি। পরের বছর তিনি একা একাই বার্নুলির সংখ্যাগুলো নিয়ে কাজ করেন এবং ইউলার-মাশকেরনির ধ্রুব সংখ্যাগুলো ১৫ ডেসিম্যাল পর্যন্ত উন্নীত করেন। তার সঙ্গীরা বলতেন “আমরা তাকে খুব কমই বুঝি” আর “তার প্রতি আমাদের আশ্চর্যজনক সম্মান রয়েছে”

১৯০৪ সালে টাউন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করার পর রামানুজনকে গণিতের জন্য কে. রাঙ্গানাথা রাও পদকে ভূষিত করা হয়। সে সময়ে তিনি গভীর গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। ∑(1/n) সিরিজটি নিয়ে তিনি রীতিমতো তদন্ত চালিয়ে যান। স্কুলে ভালো পারফর্ম্যান্সের সুবাদে সে বছরই কুম্বাকোনাম সরকারি কলেজে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান তিনি। যদিও পরের বছর সে বৃত্তি আর নবায়ন করা হয় নি, কেননা তিনি গণিত নিয়ে এতটাই মেতে ছিলেন যে অন্যান্য বিষয়কে বলতে গেলে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গেছেন। অর্থের যোগান ছাড়া বেশ ঝামেলায় পড়ে যান তিনি, এদিকে বাবা-মাকে কিছু জানাবেন, সে উপায়ও নেই। মাদ্রাজ শহর থেকে ৬৫০ কিলোমিটার উত্তরে ভিজাগাপাত্নামে পালিয়ে যান তিনি। সেখানে গিয়েও গণিতের কাজেই মন দেন রামানুজন। সে সময়ে অধিজ্যামিতিক সিরিজ নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। পাশাপাশি ইন্টিগ্রাল এবং সিরিজের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রচেষ্টাও চালাতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পারেন, তিনি আসলে উপবৃত্তাকার ফাংশন নিয়ে কাজ করছিলেন।

গণিতজ্ঞ রামানুজন; Source: ytimg.com

১৯০৬ সালে রামানুজন মাদ্রাজের পাছাইয়াপ্পার কলেজে ভর্তি হন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ফাইন আর্টস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, যাতে করে তিনি মাদ্রাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। তিন মাস কলেজে পড়ার পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিলেও তিনি পরীক্ষায় ঠিকই অংশগ্রহণ করেন। গণিতে পাস করলেও বাকি সব বিষয়ে অকৃতকার্য হন তিনি। তার মানে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ যায় তার জন্য। পরবর্তী বছরগুলোতে গণিত বিষয়ে তার নিজের ধারণাগুলো উন্নত করার চেষ্টা করেন। কারো সাহায্য ছাড়া এবং কোনো প্রকারের সমসাময়িক গবেষণা পত্রের ধারণা ব্যতীত তিনি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন, জ্ঞান বলতে তার সহায়ক ছিল শুধু কারের বইটি। তার গাণিতিক কার্যাবলী ১৯০৮ সালে উন্নীত হয় ভগ্নাংশ এবং অপসারণশীল সিরিজে। এই পর্যায়ে এসে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯০৯ সালের এপ্রিলে তাকে একটি অপারেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অপারেশনের পর সুস্থ হতে যথেষ্ট সময় লাগে তার। ১৯০৯ সালের ১৪ জুলাই তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মায়ের পছন্দে দশ বছর বয়সী এস. জানকী আম্মালকে বিয়ে করেন তিনি। জানকীর বয়স বারো বছর না হওয়া পর্যন্ত তারা একত্রে বসবাস করেননি।

রামানুজন তার গণিতের কাজগুলো চালিয়ে যেতে থাকেন। ‘জার্নাল অফ দ্য ইন্ডিয়ান ম্যাথম্যাটিক্যাল সোসাইটি’ নামক একটি পত্রিকায় তিনি বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা এবং তার সমাধান পাঠাতে থাকেন। ১৯১০ সালে এসে তিনি উপবৃত্তাকার মডুলার সমীকরণের সমাধান বের করে ফেলেন। ১৯১১ সালে উক্ত জার্নালে বার্নুলি নম্বর নিয়ে দুর্দান্ত একটি গবেষণা পত্র তাকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জ্ঞান না থাকলেও গণিত জগতের প্রডিজি হিসেবে মাদ্রাজে বেশ নাম করেন রামানুজন। ১৯১১ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ম্যাথম্যাটিকাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতার কাছে চাকরির জন্য পরামর্শ চান। এরপরেই তিনি তার জীবনের প্রথম চাকরিতে নিযুক্ত হন যা ছিল মাদ্রাজের অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের অফিসে একটি অস্থায়ী পোস্ট। বলা হয়, তখনই তিনি নিলোরের কালেক্টর রামাচন্দ্র রাওয়ের সাথে যোগাযোগ করেন। রামাচন্দ্র রাও ভারতীয় গাণিতিক সংসদের পক্ষ থেকে গণিত লাইব্রেরিটি পরিচালনা করতেন।

রামাচন্দ্র রাও রামানুজনকে মাদ্রাজ ফিরে যেতে বলেন। অন্যদিকে রামানুজনের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করতে থাকেন তিনি। কিন্তু তার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকায় বারবার অকৃতকার্য হন রামাচন্দ্র। ১৯১২ সালে রামানুজন মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে কেরানির পদে চাকরির জন্য আবেদন করেন। গাণিতিক বিষয়ে অভিজ্ঞতার জন্য মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট সব গণিতজ্ঞরা রামানুজনকে চিনতেন। কাজেই চাকরির আবেদনপত্রের সাথে ক্যামব্রিজের সেইন্ট জনস কলেজ থেকে পাস করা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ই. ডব্লিউ. মিডল্মাস্টের একটি প্রশংসাপত্র যোগ করতে বেগ পেতে হয়নি তার। এই প্রশংসাপত্রের জোরে কেরানির চাকরিটি পেয়েও যান তিনি। ১৯১২ সালের ১ মার্চ কাজে যোগ দেন রামানুজন। সৌভাগ্যবান রামানুজন তার চারপাশে গণিতে দক্ষ বেশ কিছু ব্যক্তির দেখা পেয়ে যান। মাদ্রাজ পোস্ট ট্রাস্টের প্রধান হিসাবরক্ষক এস. এন. আইয়ার ১৯১৩ সালে রামানুজনের কাজের উপর ভিত্তি করে ‘অন দ্য ডিস্ট্রিবিউশন অফ প্রাইমস’ নামে একটি লেখা প্রকাশ করেন। মাদ্রাজ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক সি. এল. টি. গ্রিফিথ রামানুজনের মেধা ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গণিতের অধ্যাপক এম. জে. এম. হিলের সাথে যোগাযোগ করেন। ১৯১২ সালের ১২ নভেম্বর রামানুজনের কাজের কিছু নমুনা, বিশেষত বার্নুলি সংখ্যা নিয়ে তার লেখাটি হিলের কাছে পাঠান।

হিল বেশ উৎসাহের সাথে চিঠির উত্তর দেন, কিন্তু রামানুজনের বিকিরণশীল সিরিজের উত্তরটা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি বলে জানান। ব্রমউইচের ‘অসীম সিরিজের তত্ত্ব’ পড়ার পরামর্শটি মনঃপুত হয় না রামানুজনের। ই. ডব্লিউ. হবসন এবং এইচ. এফ. বেকারের কাছে চিঠি লিখে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু দুজনের কেউই উত্তর দেননি সেই চিঠির। ১৯১৩ সালে রামানুজন জি. এইচ. হার্ডির ‘অর্ডারস অফ ইনফিনিটি’ বইটি দেখে তাকে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি তার কাজের কিছু নমুনাও সংযুক্ত করেন। হার্ডি, লিটলউডকে সঙ্গে নিয়ে রামানুজনের অপ্রমাণিত উপপাদ্যের বিশাল লিস্টটি চেক করতে বসেন। কিছুদিন পর রামানুজন একটি উত্তর পান যাতে অনেক কিছুর ভেতর লেখা ছিল, “এখানে বেশ কিছু নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব আছে বলে আমরা মনে করছি।

রামানুজনের মূর্তি; Source: wikimedia.org

হার্ডির উত্তরে দারুণ খুশি হয়ে ওঠেন রামানুজন। তিনি অপর একটি চিঠিতে ইংল্যান্ডে স্কলারশিপ পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সে বিষয়ে হার্ডিকে অনুরোধ করেন। ১৯১৩ সালের মে মাসে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই বছরের স্কলারশিপ পান তিনি। ১৯১৪ সালে হার্ডি রামানুজনকে নিয়ে যান ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। অসাধারণ এক পরিবেশে গণিত চর্চার এই সুযোগ করে দেয়াটা হার্ডির পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না। রামানুজন ছিলেন একজন গোঁড়া ব্রাক্ষ্মণ, তার উপর নিরামিষভোজী। শাস্ত্রমতে সাগর পাড়ি দেয়া তার একদম মানা ছিল, কিন্তু জ্ঞানের প্রতি অবাধ নেশা তাকে টেনে নিয়ে যায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে।

১৯১৪ সালের ১৪ এপ্রিল লন্ডন পৌঁছান রামানুজন। চারদিন পর ক্যামব্রিজে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। বিদেশের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই খাবার নিয়ে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হন তিনি। সর্বভূক এক জাতির সাথে নিরামিষভোজী এই মানুষ কীভাবে তাল মেলাবেন? তার সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিতেই শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সব মিলিয়ে ক্রমেই শরীর ভেঙে পড়তে থাকে রামানুজনের।

রামানুজনের আনুষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকায় তাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় হার্ডিকে। লিটলউডকে দায়িত্ব দেয়া হয় রামানুজনের গাণিতিক পদ্ধতিগুলোর দেখভালের। তবে শীঘ্রই যুদ্ধে যোগদানের ডাক পড়ে লিটলউডের। আর এরই মধ্যে এসে যায় শীত। শীতের তীব্রতায় আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন রামানুজন। ১৯১৬ সালের ১৬ মার্চ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি (১৯২০ সাল থেকে এই ডিগ্রিটি পিএইচ. ডি. নামে পরিচিতি লাভ করে)। ইংল্যান্ডে তার সাতটি পেপার প্রকাশিত হয়।

‘দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি’ ছবির পোস্টার; Source: amazon.com

১৯১৭ সালে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন রামানুজন। সে বছর তার উল্লেখযোগ্য সময় কাটে নার্সিং হোমে। ১৯১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রামানুজন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক সমিতির সদস্য পদে মনোনীত হন, তার জীবনে অর্জিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব এটি। বিশ্বের সব নামকরা সব গণিতজ্ঞরা তার নামটি সুপারিশ করেন যাদের মধ্যে ছিলেন হার্ডি, ম্যাকমাহন, গ্রেস, লার্মোর, ব্রমউইচ, হবসন, বেকার, লিটলউড প্রমুখ। ১৯১৮ সালের ২ এপ্রিল তিনি এখানে নির্বাচিত হন এবং ঐ একই বছরের ১০ অক্টোবর ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের সদস্য হিসেবে নিয়োজিত হন তিনি। ছ’বছর ধরে বজায় থাকে এই সদস্যপদ। এই সময়ে তার স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হয় এবং হার্ডির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন তিনি।

১৯১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন রামানুজন, ১৩ মার্চ বাড়ি পৌঁছান কিংবদন্তী এই গণিতজ্ঞ। এখানে এসেই প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি, পরের বছরের ডিসেম্বরের ২২ তারিখে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। ভারতে প্রতি বছর এই দিনটিতে ‘জাতীয় গণিত দিবস‘ পালন করা হয়। তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের এক যুবক রাইমেন সিরিজ, জেটা ফাংশন, মৌলিক সংখ্যার সিরিজ সহ প্রায় ৩,৯০০ সমীকরণের উপর কাজ করে গেছেন, যা ভাবতেও অবাক লাগে। তার এত কাজের মধ্যে পাইয়ের অসীম সিরিজ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া ক্ষণজন্মা এই প্রতিভাবান গণিতজ্ঞের প্রতি শুধু ভারতবর্ষ নয়, পুরো পৃথিবীই আজীবন কৃতজ্ঞতা জানাবে। রামানুজনকে নিয়ে জানতে আগ্রহীরা ‘দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি‘ সিনেমাটি দেখে নিতে পারেন।

ফিচার ইমেজঃ bbc.co.uk

Related Articles