Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রিতা ফারিয়া: উপমহাদেশের প্রথম মিস ওয়ার্ল্ডজয়ী

সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সমস্ত নারীদের সুন্দর হতে হয়। এই সুন্দর কেবল শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও।  সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নারীরা মেধা, মনন এবং বাহ্যিক সৌন্দর্য- সমস্তটা মিলেই নিজেদের প্রমাণ করেন। এই প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন সময়ে এসেছেন বিভিন্ন নারী, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে। আমাদের এই উপমহাদেশ, এশিয়া থেকে নির্বাচিত হয়েছেন অনেকে, জিতেছেন শ্রেষ্ঠ হওয়ার মুকুট। তবে আজ তাদের সবাইকে নিয়ে নয়, বরং বলবো রিতা ফারিয়াকে নিয়ে। এই উপমহাদেশের প্রথম মিস ওয়ার্ল্ডের মুকুট জিতেছিলেন তিনি। কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং নিজের অভ্যন্তরীণ, মানসিক সৌন্দর্য দিয়ে।

রিতা ফারিয়া; Source: The Indian Express

১৯৬৬ সালের ১৭ই নভেম্বর। রিতা ফারিয়া বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার মঞ্চে তখন দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছেন। চেহারায় অবশ্য সেটা প্রকাশ পাচ্ছে না। সেই বছর মিস ওয়ার্ল্ডের মঞ্চে অংশ নিয়েছিলেন আরো ৬৬ জন প্রতিযোগী। তাদের সবাইকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে এসেছিলেন রিতা। ওয়েলিংটন স্ট্রিটের লাইসিয়াম বলরুমে মঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিযোগীদের নিয়ে চলছিল নানারকম চিন্তা-ভাবনা। কে হবেন মিস ওয়ার্ল্ড?

রিতার চাইতে সবার চিন্তায় এগিয়ে ছিলেন ২০ বছর বয়সী ব্রিটেনের জেনিফার লো। ৭৪ বছর বয়সী রিতার চোখে আজও সেই সন্ধ্যাটি জ্বলজ্বল করে ওঠে। সেদিনের সবকিছু যেন নিজের মনে বাকিটা জীবনের জন্য গেঁথে রেখেছেন তিনি। “আমার উপরে একজন ভারতীয় নাগরিক শুধু দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বাজি ধরেছিল, হয়তো আমার ভাগ্যের পেছনে তারও হাত আছে“, মনে করেন রিতা। হাসেন। সত্যিই, এশিয়ার মধ্যে থেকে কেউ পশ্চিমা বিশ্বকে হারিয়ে দিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার মুকুট নিয়ে যাবে এমনটা তখন বিশ্বাস করাটা শক্ত ছিল। আর এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটিকেই বাস্তব করে তুলেছিলেন রিতা।

মুকুট জেতার পর আফ্রিকায় রিতা ফারিয়া; Source: Flickr

অবশ্য ভাবনার চাইতেও অনেক বেশি কঠিন ছিল রিতার সময়গুলো। লন্ডনে আসার সময় তেমন কিছুই ছিল না রিতার কাছে। একটি ধার করে আনা শাড়ি আর বাথিং স্যুট। তবে সেই পোশাকটিও ছিল অনেক কম মানানসই। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপকেরা প্রথমেই না করে দেন পোশাকটিকে। রিতার কাছে বাকি ছিল কেবল ৩ পাউন্ড আর একটি ছোট্ট মেক-আপের বাক্সভর্তি কিছু প্রসাধনী। প্রসাধনীর মধ্যে অবশ্য বেশি ছিল লিপস্টিক। আর তেমন কিছু ছিল না তখন ঠিক করে নিজেকে সাজানোর জন্য। ব্যবস্থাপকদেরকথা শুনে রিতা নিজের তিন পাউন্ড খরচ করে পোশাক আর জুতো কেনেন। সেই জুতো আর পরা হয়নি কখনো। তবে সেটা যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছেন রিতা। কেন? কারণ, এই সবকিছুই তাকে মনে করিয়ে দেয় নিজের সংগ্রামের কথা, ভালোলাগার সেই দিনটির কথা।

ফারিয়ার জন্ম হয় মাতুঙ্গায়। সেখানে মধ্যম আয়ের এক পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। ফারিয়ার বাবা ছিলেন মিনারেল ওয়াটার কোম্পানির এক সামান্য কর্মচারী। অন্যদিকে মা ছিলেন মেরিন লাইনে একটি স্যালুনের মালিক। রিতা ফারিয়ার জীবনটাও হয়তো এমন কিছু হয়েই থেকে যেত, থমকে যেত মা-বাবার সাথে খুব সাধারণ কোনো কাজ করার মাধ্যমে। কিন্তু তা হয়নি। নিজের ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার কারণে সবার নজরে পড়ে যান রিতা। সেখানেই সবাই তাকে মডেলিং করার কথা বলেন। রিতার বান্ধবী ৭৪ বছর বয়সী সিসিলিয়া মেনেনেজ রিতার কথা বলতে গিয়ে হাসেন। বেশ ছিমছাম আর গোছালো ছিল রিতা. জানান তিনি। যেকোনো সময় নিজেকে গোছাতে অনেক বেশি সময় নিতেন রিতা। তবে নিজেকে কীভাবে সুন্দর এবং সাবলীল লাগবে সেটা ঠিক বুঝতে পারতেন। তবে মডেলিং নয়, বরং একজন চিকিৎসক হতে চাইতেন রিতা, জানান সিসিলিয়া।

বর্তমানে রিতা ফারিয়া; Source: Target Goa

প্রশ্ন হল, যদি চিকিৎসক হওয়ার এত বেশি ইচ্ছা থাকে তাহলে কেন সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো? পুরোটাই কেবল অভিজ্ঞতার জন্য আর নতুন কিছু চেষ্টা করার জন্যেই করা হয়েছিল বলে জানান রিতা ফারিয়া। না, তার মোটেও গুরুত্ব দিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তবে মজার কিছু মনে হয়েছিল তার পুরো ব্যাপারটিকে। আর তাই বোন ফিলোমেনার তোলা নিজের কিছু ছবি তিনি জমা দেন প্রতিযোগিতায়।

রিতার বয়স তখন ২৩ বছর। মুম্বাইয়ের গ্র্যান্ট মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী যে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে সেটা ভাবাটা হাস্যকর ছিল সবার কাছে। অনেক বেশি অপ্রত্যাশিতও বলা চলে ব্যাপারটিকে। তবে অনেকটা খেলার মতো ভেবেই মিস বোম্বে প্রতিযোগিতায় নিজের ছবি জমা দেন রিতা ফারিয়া।

নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গিয়ে একটু ভাবেন রিতা ফারিয়া। সেই সময় বেশ সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে মিস বোম্বেতে। আয়োজকেরা ঠিকভাবে জানতেন না যে কীভাবে সুন্দরী প্রতিযোগিতা করতে হয়। চারপাশে ছড়িয়ে ছিল অব্যবস্থাপনা। আয়োজকেরা একটা সময় জানতে পারেন যে, এই প্রতিযোগিতায় সাঁতারের পোশাক পরতে হয় মেয়েদের। তাদের কাছে সাঁতারের পোশাক পরা মানে ছিল বিচারকদেরকে মেয়েদের পা ঠিক আছে কিনা সেটা দেখার সুযোগ করে দেওয়া। তাই মিস বোম্বে প্রতিযোগিতায় শাড়ি খানিকটা উপরে তুলে মেয়েদের পা ঠিক আছে কিনা প্রতিযোগিতার জন্য সেটা বিচার করতে শুরু করেন।

চিকিৎসকের বেশে রিতা ফারিয়া; Source: eenaduindia.com

তবে এই প্রতিযোগিতায় রিতা ফারিয়া নিজের দেশ থেকে প্রথম কেউ ছিলেন না। এর আগে ভারত থেকে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া হয় ১৯৫৯ সালে। আয়োজকেরা এত বেশি আনাড়ি ছিলেন যে, রিতার কাছে খুব বেশি পোশাকও ছিল না বাইরে গিয়ে দেশকে উপস্থাপন করার জন্য। অবশ্য, মায়ের সাহায্যে বেশ কিছু পোশাক নিজের সাথে নেন রিতা। তবে মিস ইন্ডিয়া জিতে যাওয়ার পর আয়োজকেরা বুঝতে পারেন যে, রিতার কাছে পাসপোর্ট নেই।

খুব দ্রুত অনেক ঝামেলার মাধ্যমে ব্যবস্থা করা হয় ভিসা আর পাসপোর্টের। একটি কাঠের রেপ্লিকা, আর কিছু অর্থ পান রিতা ফারিয়া মিস ইন্ডিয়া জেতার পর। মোট ১৫ হাজার রুপি। সেইসময় সংখ্যাটি খুব একটা কম কিছু ছিল না। নিজের সবটুকু টাকা মায়ের হাতে দিয়ে দেন রিতা। রিতার মা কিছু এতিম শিশুদের জন্য কাজ করতেন। তাদের জন্য খরচ হয় টাকাগুলো। কারো মাথায় তখন খেলা করেনি যে রিতা বাইরে যাবে এবার আর সেখানে তার টাকার দরকার পড়বে।

নিজেকে লন্ডনে পুরপুরি বেমানান বলে মনে হয় রিতার। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত সেই দেশের প্রতিযোগীকে ডেকে নিয়ে যায় দূতাবাসে। কিন্তু রিতার বেলায় তেমন কিছুই হয়নি। লন্ডন অবশ্য এর মধ্যে যতটা সম্ভব দেখার চেষ্টা করেন রিতা। নিজের মেধাই তাকে সেরা ২৫ এ নিয়ে গিয়েছিল বলে মনে করেন রিতা। সেইসাথে উঁচু হওয়ার সুবিধা তো ছিলোই, বলেন তিনি। অন্যদের যখন বিশ্ব সুন্দরী হওয়ার কারণ এবং পরবর্তী লক্ষ্য ছিল সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা কিংবা ভালো গৃহিণী হওয়া, রিতা তখন বিচারকদের জানান যে, কেন তিনি চিকিৎসক হতে চান। শিশুদের এবং শিশুর মায়েদের ভালোর জন্য গাইনি চিকিৎসক দরকার বলে মত প্রকাশ করেন তিনি। বিচারকেরা মুকুটের জন্য বেছে নেন রিতাকেই।

স্বামী-সন্তানের সাথে রিতা ফারিয়া; Source: The Quint

এরপর? এরপর কী করেছিলেন রিতা ফারিয়া? বেছে নিয়েছিলেন চলচ্চিত্র দুনিয়া আর মডেলিংকে, নাকি ফিরে গিয়েছিলেন চিকিৎসক হওয়ার পথে? রিতা ফারিয়া জানতেন যে অভিনয়কে বেছে নিলে তার চিকিৎসা সংক্রান্ত পড়াশোনা আর হবে না। তাই পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। তারপর এপিডেমোলোজিস্ট হিসেবে কাজ করেন বোস্টনে। পরবর্তোতে আয়ারল্যান্ডে জুনিয়র হসপিটাল ডক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এর মধ্যে তার দেখা হয় ডেভিড পাওয়েলের সাথে। বিয়ে করেন তারা। সংসার আর চিকিৎসা সেবা- উপমহাদেশের প্রথম মিস ওয়ার্ল্ড বিজয়ী রিতা ফারিয়া বাকিটা জীবন কাটিয়েছেন এভাবেই। তবে হ্যাঁ, নিজের সিদ্ধান্তে খুশি ছিলেন তিনি আর এখনো আছেন। আজ বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষ্যে উপমহাদেশের প্রথম মিস ওয়ার্ল্ডের মুকুট জিতে নেওয়া নারী রিতা ফারিয়ার জন্য শুভেচ্ছা!

ফিচার ইমেজ: YouTube

Related Articles