Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রেনে দেকার্ত: স্বপ্নাদেশ পালন করে যিনি দার্শনিক হয়েছেন!

১৬১৯ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ। জার্মানির নিউবার্গ শহরে তখন কনকনে শীত। শীতে কাঁপতে কাঁপতে এসে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলেন ২৩ বছরের যুবক রেনে দেকার্ত। সারাদিনের পরিশ্রম দেহে ক্লান্তি ধরিয়ে দিয়েছে। তবু বসে থাকলে চলবে না। বসে গেলেন অংক করতে। কিন্তু স্টোভের আগুনে ঘরের ভেতরে আরামদায়ক উষ্ণতা বিরাজমান। সে উষ্ণতায় ঝিমুতে ঝিমুতে টেবিলে মাথা রেখে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন দেকার্ত। আর তাতেই বদলে গেল বিজ্ঞানের ইতিহাস, বিজ্ঞানীদের কাজ করার ধরন! শুধু কি তা-ই? এই ঘুমই তৈরি করে দিল পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক! গাঁজাখুরি গল্প? মোটেও না। ঘুমের মধ্যে যে দেকার্ত সেদিন দেখা করেছিলেন স্বয়ং দেবতার সাথে!

source: harshmode.com

হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠলেন দেকার্ত। তখন মধ্যরাত। প্রথমে কিছুক্ষণ বিশ্বাস হচ্ছিলো না ব্যাপারটা। এক ঘুমেই দেখেছেন তিনটি স্বপ্ন, দেখেছেন দেবতা এসে তাকে তিনটি বিষয় বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তবে ঘোর ভাঙতেই দ্রুত কাজে লেগে গেলেন। লিখতে শুরু করলেন দেবতার বাতলে দেয়া উপায় সমূহ। তিনটি বিষয়ের উপর কাজ করবার উপায় বলেছেন দেবতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি আর দর্শন। সে রাতের প্রায় ১৮ বছর পর ১৬৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘ডিসকোর্স ডি লা মেথড’ (ডিসকাশন অব দ্য মেথড) এবং ‘লা জিওম্যাত্রি’ (জিওমেট্রি)। এই দুটি বই তাকে ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন দিয়েছে। দুটি বইয়ের মাঝেই তিনি উল্লেখ করেছেন ১০ নভেম্বরের সেই শীতের রাতের কথা

ডিসকাশন অব দ্য মেথড; source: Wikimedia Commons

‘ডিসকাশন অব দ্য মেথড’ রেনে দেকার্তের অমর কীর্তি, যার জন্য বিজ্ঞান চিরকাল ঋণী থাকবে তার কাছে। এই বইয়ে তিনি বিজ্ঞানকে পদ্ধতিগত করেছেন প্রথম ব্যক্তি হিসেবে। তার সবচেয়ে বৈপ্লবিক চিন্তা হচ্ছে ‘স্কেপ্টিসিজম’ বা সংশয়বাদ। এই তত্ত্বের মূল কথাই হচ্ছে সব কিছু নিয়েই সংশয় থাকতে হবে এবং কোনোকিছু নিয়ে ততক্ষণ নিশ্চিত হওয়া যাবে না, যতক্ষণ না তা প্রমাণ করা যাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি চারটি মূল ধারণা দিয়েছেন।

  • কোনোকিছু ততক্ষণ বিশ্বাস না করা, যতক্ষণ একে সন্দেহ করার মতো সকল বিষয় মিথ্যা প্রমাণ না হবে।
  • একটি যথার্থ সমাধানে পৌঁছুতে একটি সমস্যাকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সংখ্যক ভাগে ভাগ করা।
  • চিন্তাগুলোকে ক্রমানুসারে এগিয়ে নেয়া। প্রথমে সবচেয়ে সহজ ভাবনা, তারপর ধীরে ধীরে আরো গভীর এবং জটিল ভাবনার দিকে যাওয়া।
  • পরিগণনা ও পুনঃসমীক্ষা সর্বদা পরিপূর্ণ হতে হবে, যেন কোনোকিছুই বাদ না যায়।

দেকার্তের এই অসাধারণ ধারণাগুলো প্রকাশ পাবার পর তার এক বন্ধু মজা করে তাকে বলেছিলেন,

“তোমার নীতি বলছে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কোনোকিছু বিশ্বাস না করতে। আমিও কিন্তু বিশ্বাস করছি না তুমি এসব ধারণা আঠারো বছর আগে সেদিন স্বপ্নে পেয়েছিলে!”

স্কেপ্টিসিজম বা সংশয়বাদের মূলকথা; source: youtube.com

গণিত পড়েছে কিন্তু কার্তেসীয় গুণজের কথা শোনেনি, এমন মানুষ পাওয়া ভার। এই ‘কার্তেসীয়’ শব্দটি দেকার্তের সম্মানেই রাখা হয়। দেকার্ত এর ল্যাটিন প্রতিশব্দ ‘কার্তেসিয়াস’ থেকে কার্তেসীয় হয়েছে। জ্যামিতির ক্ষেত্রে দেকার্ত একরকম বিপ্লব সাধন করেন। তিনি জ্যামিতিক সমস্যাবলীকে বীজগণিতে রূপান্তর করে সেগুলো সমাধানের উপায় আবিষ্কার করেন। তার এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘অ্যানালিটিক্যাল জিওমেট্রি’। লা জিওম্যাত্রিতে দেকার্ত দেখান, বক্র রেখাকেও দ্বিমাত্রিক সমতলে X ও Y অক্ষরেখায় প্রকাশ করা সম্ভব যা থেকে বীজগণিতে রূপান্তর সহজ হয়ে যায়। তবে জেনে রাখা ভালো, দেকার্ত নিজে তার কাজে কখনো এই দুই অক্ষ আঁকেননি। এই দুই অক্ষ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেন লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রানজ ভ্যান শুট্যান ও তার সহযোগী গণিতবিদরা। তারা ‘লা জিওম্যাত্রি’-কে ফ্রেঞ্চ থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে এই কাজ করেন।

দেকার্তের একটি বড় সাফল্য এই যে, তিনি সূচক লেখার আধুনিক পদ্ধতি তৈরি করেন। যেমন- ক.ক.ক এর পরিবর্তে দেকার্ত লেখেন ক৩। অন্যদিকে জ্যামিতিক সমস্যাকে বীজগাণিতিক উপায়ে সমাধান করার পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ায় প্রাচীন গ্রীসের গণিতবিদদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যান তিনি। অনেক অভেদ্য সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়। তবে ঠিক দেকার্তের সময়েই ফ্রান্সের আরেকজন গুণী বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ পিয়েরে ডি ফারম্যাট বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। এখানে বিতর্ক রয়ে গেছে যে কে আসলে বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি প্রথম শুরু করেছিলেন। তবে এই বিষয়টির উপর লক্ষ্য রেখে যে, দেকার্ত দেখিয়েছিলেন কীভাবে জ্যামিতিকে বীজগণিতে রূপ দেয়া যায় আর ফারম্যাট দেখিয়েছিলেন কীভাবে বীজগণিতকে জ্যামিতিতে রূপ দেয়া যায়, ইতিহাসবিদরা উভয়কেই অ্যানালিটিক্যাল জিওমেট্রি আবিষ্কারের সম্মান দেন।

দেকার্তের অ্যানালিটিক্যাল জিওমেট্রির একটি ল্যাটিন সংস্করণ; source: maa.org

যদি বলা হয় আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান গণিতের কোন অংশটি ছাড়া অচল, তাহলে উত্তর আসবে- ‘ক্যালকুলাস’। গণিত এবং বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটানো এই ক্যালকুলাস ১৬৬০ এর দশকে নিউটন এবং লিবনিজ উভয়ে পৃথকভাবে আবিষ্কার করেন। তবে তারা যে দেকার্তের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন তা কি জানা আছে? দেকার্তের একটি মূল দর্শন, “সমস্যাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা” যা অবশ্যই ক্যালকুলাসের পথপ্রদর্শক। অন্যদিকে দেকার্ত বক্ররেখার ট্যানজেন্ট নির্ণয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। সমসাময়িক সময়ে ফারম্যাটও এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন ভিন্ন উপায়ে। উভয়ের পদ্ধতিই পরবর্তীকালে নিউটন এবং লেবিনিজের জন্য সহায়ক হয়। কেননা এই পদ্ধতি ডিফারেনসিয়াল ক্যালকুলাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর পরপরই দেকার্ত তার ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৬৩৩ সালে কাজ শেষ করেও গ্যালিলিওর সাজার কথা মাথায় রেখে চার্চের ভয়ে তিনি এটি প্রকাশ করেননি। চার বছর পর আইন শিথিল হলে তিনি ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ প্রকাশ করেন।

দেকার্তকে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক বিবেচনা করা হয়। তার মতে দর্শন হচ্ছে একটি সামগ্রিক ভাবনাপদ্ধতি যা জ্ঞানকে মূর্ত করে। তার ভাষায়-

দর্শন হচ্ছে একটি বৃক্ষের মতো যার মূল হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা, কাণ্ড পদার্থবিজ্ঞান। বিজ্ঞানের অন্য শাখাগুলো এই কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা হিসেবে বের হয়। তাদেরকে আবার মূল তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা- চিকিৎসাশাস্ত্র, বলবিজ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্র।”

দেকার্ত মানুষের চিন্তা ও ধারণাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: ১) সৃষ্ট ধারণা যা মানুষ ভেবে-চিন্তে তৈরি করে, ২) অস্থানিক ধারণা, যা ভাববার প্রয়োজন হয় না; যেমন, গরম পানি হাতে পড়লে তৎক্ষণাৎ গরম লাগার কথা চিন্তা করবে মানুষ এবং  ৩)সহজাত চিন্তা যা মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এগুলো চাইলেও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, মানুষ চাইলেই একটি ত্রিকোণ বস্তুকে চতুষ্কোণ বলে ভাবতে পারে না। অন্যদিকে দেকার্তের দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ‘ডুয়েলিজম’ বা দ্বৈতবাদ। এই তত্ত্বের প্রধান কথা হচ্ছে, আমাদের দেহ এবং মন সম্পূর্ণ পৃথক দুটি সত্ত্বা। মন আমাদের মস্তিস্কপ্রসূত নয় এবং মস্তিস্ক দ্বারা চালিতও নয়। বরং মন সম্পূর্ণ বিমূর্ত, অপার্থিব এবং আধ্যাত্মিক একটি ব্যাপার। দেকার্তের এই ধারণা একইসাথে ধর্ম এবং বিজ্ঞান দ্বারা চালিত।

দেকার্ত এবং ফারম্যাটের বক্ররেখার ট্যানজেন্ট নির্ণয়ের পদ্ধতি; source: maa.org

১৫৯৬ সালের ৩১ মার্চ, ফ্রান্সের তোরাইন গ্রামে এক ধনাঢ্য পরিবারে রেনে দেকার্ত জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বর্তমান নাম তার সম্মানে ‘দেকার্ত’ রাখা হয়েছে। কখনোই অর্থাভাবের সম্মুখীন না হওয়া দেকার্ত একটি জিনিসের অভাব আমৃত্যু অনুভব করেছেন। তা হচ্ছে বাবা-মায়ের ভালোবাসা। জন্মের এক বছরের মাথায় মা মারা যাবার পর কিছুদিনের মধ্যে তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং অন্যত্র গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। যদিও বাবার সাথে দেকার্তের সম্পর্ক সর্বদাই ভালো ছিল, তথাপি পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হবার একটা ক্ষোভও ছিল তার মাঝে। তাকে লালন পালন করেন তার দাদী এবং চাচা। দশ বছর বয়সে তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন যা খুব একটা দীর্ঘমেয়াদি হয়নি। তিনি স্কুলজীবনে পদার্থ, গণিত, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, গ্রীক, ল্যাটিন সবকিছুই অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শেষ করার পূর্বেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা ছেড়ে দেন এবং স্বশিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়েন।

দেকার্ত ছিলেন জ্ঞানপিপাসু শৌখিন মানুষ। এক্ষেত্রে অনেকে তাকে ভাগ্যবানও বলতে পারেন। কারণ জীবিকার্জন কী, তা দেকার্তের জানার প্রয়োজন হয়নি। তিনি সর্বদা নিজের জ্ঞান আহরণ আর দার্শনিক ভাবনা নিয়েই থাকতেন। চলার মতো প্রয়োজনীয় সম্পদ তিনি বাবার কাছেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। চব্বিশ বছর বয়সে সেগুলো একেবারে বিক্রি করে বিশাল অঙ্কের অর্থের মালিক বনে যান, যা দিয়ে বাকি জীবনটা আরামেই কাটিয়েছেন! শুধু কি কাটিয়েছেন? জীবনের প্রায় ২০ বছর তিনি কাটিয়েছেন ভ্রমণ করেই! দেকার্তে কখনো বিয়ে করেননি। তবে হল্যান্ডে ভ্রমণকালীন এক সুন্দরী আয়ার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে এক সন্তানের পিতা হন। মেয়েটির নাম রাখেন ফ্রান্সিন। মা-মেয়েকে ফ্রান্সে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসলেও আসল ঘটনা চেপে গিয়ে মেয়েকে ভ্রাতুষ্পুত্রী বলে পরিচয় দেন। কিন্তু স্কারলেট জ্বরে ভুগে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ফ্রান্সিন মৃত্যুবরণ করলে মর্মপীড়ায় ভোগেন দেকার্ত। আরো দুঃখের ব্যাপার হলো, ফ্রান্সিনের মৃত্যুর পর ফ্রান্সিনের মা দেকার্তকে ছেড়ে অন্য এক লোকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ); source: thefamouspeople.com

১৬৫০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি স্টকহোমে মৃত্যুবরণ করেন রেনে দেকার্ত। তাকে স্টকহোমের অ্যাডলফ ফ্রেডরিক চার্চে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি ভ্রাম্যমাণ ছিলেন, মৃত্যুর পরেও তা-ই ছিলেন! তার মৃত্যুর ১৬ বছর পরে তার দেহাবশেষ স্টকহোম থেকে সরিয়ে প্যারিসের ‘সেন্ট আঁতেইন দ্যু মন্ত’এ এনে সমাহিত করা হয়। ১৮১৯ সালে পুনর্বার তার দেহাবশেষ সেখান থেকে সরিয়ে প্যারিসের ‘সেন্ট জার্মে দেস প্রাস’ চার্চে আনা হয়। তবে এখানেই তার স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে, অন্তত এখনো পর্যন্ত এখানেই আছেন। তবে তার দর্শন আর বিজ্ঞান? সেগুলো কিন্তু আজও চলছে, তার মতোই ভ্রাম্যমাণ!

ফিচার ছবি: Wallup.net

Related Articles