Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রবার্ট ব্রাউনিং: আশার কবি, প্রেমের কবি

মানুষের জীবন সবচেয়ে বেশি ফুটে ওঠে কোথায়? নিঃসন্দেহে বলা যায়, সাহিত্য আর শিল্পে। সাহিত্য যেন মানুষের জীবনেরই কালি-কলমের আয়না। গল্প-উপন্যাসের পাতায় হোক আর কবিতার ছন্দে ছন্দে, সাহিত্য যেন মানুষের আশা, হতাশা, কষ্ট, ভাগ্য, অসহায়ত্বই ফুটে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে। আর কবিতা তো অল্প কিছু শব্দে বলে যায় জীবনের কঠিন সব বাস্তবতার কথা, সুখ আর স্বপ্নের কথা। হৃদয়ের লুকানো ব্যথা, মনে ছোটবড় সব সুখ আর উচ্ছ্বাসের ছন্দে ছন্দে অলংকরণ করা হয় কবিতার বইয়ের পাতায় পাতায়। কবির লেখনী যেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের কালিতে সার্থক হয়। সাধারণ সহজ সরল মানুষদের মনের আবেগ আর অনুভূতিকে ভাষা দিতে পারেন কবি। আজ আমরা ইংরেজি সাহিত্যের এমন এক কবির জীবনের গল্প শুনবো, যার কবিতাকে বলা হয় ভগ্ন হৃদয়ের সান্ত্বনা, অশান্ত মনের প্রশান্তি। অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকরা যখন জীবনের দুঃখ-কষ্ট আর না পাওয়াগুলো নিয়ে হতাশা আর অভিযোগের কথা সাজাতো, এই কবি তখন সকল ব্যর্থতার মাঝে খুঁজে ফিরতেন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা আর আশার বাণী। বিশ্বসাহিত্যের চির আশাবাদী এই কবি হলেন রবার্ট ব্রাউনিং।

ভালোবাসা ও তারুণ্যের কবি; source: famouspeople.com

ব্রাউনিং তাঁর কবিতাগুলোতে শুনিয়ে গেছেন হাজারো না পাওয়ার মধ্যেও আশা আর ভালোবাসার বাণী। প্রেমের জয়গান করেছেন তিনি সর্বত্র, হৃদয়ের উষ্ণতাকে স্থান দিয়েছেন পৃথিবীর সব রাজ্য আর সম্পদের ওপরে, আকাশসম প্রাচুর্যের চেয়ে মূল্যবান জানিয়ে গেছেন প্রিয় মানুষের জন্য প্রতীক্ষাকে, প্রিয়ার প্রত্যাখানেও পেয়েছেন হৃদয়ের সন্তুষ্টি, হয়েছেন কৃতজ্ঞ। এমনি প্রাণভরে গেয়ে গেছেন তিনি ভালোবাসার জয়গান। ব্যর্থ প্রেমেও যে চিরকালের জন্য রক্ষিত এক স্বপ্ন থাকে, এক ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা আর প্রিয়ার সামান্য স্মৃতি যে সময়কে পার করে অম্লান হয়ে যায়- তারুণ্যকে এই খবর দিয়ে যান তিনি। ব্রাউনিংয়ের সাহিত্যের আরেক ধারায় আছে বিদ্রোহ ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা, ন্যায়ের জন্য ব্যাকুলতা। এমনি বিদ্রোহ আর প্রেমে উজ্জ্বল এক কবি রবার্ট ব্রাউনিং।

স্কুলে কিন্তু পড়া হয়নি সাহিত্যের এই নক্ষত্রের। বেশ কয়েকবার কয়েকটা স্কুলে ভর্তি হবার পর তিনি বুঝেছিলেন জীবনের কাছে যা চাচ্ছেন স্কুল তা দিতে পারবে না। বাসায় শিক্ষকদের সাহায্য নিয়েছেন কখনো কখনো। কিন্তু বাবা সিনিয়র রবার্ট ব্রাউনিংয়ের লাইব্রেরিই ছিলো তাঁর জ্ঞানচর্চার প্রধান ক্ষেত্র। ১৮১২ সালের মে মাসের ৭ তারিখে লন্ডনের সুরেই নামক এক শহরতলীর ওয়ালওর্থ নামক জায়গাতে জন্মগ্রহণ করেন। বানা ছিলেন সিনিয়র রবার্ট ব্রাউনিং আর মায়ের নাম সারা অ্যানা উইডম্যান। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান হিসাবে বড় হতে থাকেন রবার্ট। ব্যাংকে ক্লার্কের চাকরি থেকে পাওয়া বছরে মাত্র দেড়শ ডলারে সংসার চালানো বেশ কঠিন ছিলো বাবার জন্য। তাই প্রায় ৬,০০০ বইয়ের একটি লাইব্রেরিও দেখাশোনা করতেন তিনি। এই লাইব্রেরির সংস্পর্শই রবার্টকে সাহিত্যে তাঁর ভবিষ্যতের পথ দেখায়।

স্ত্রীর সাথে; source: gurglewords.wordpress.com

কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার পরও জ্ঞানের জগতে তাঁর অবস্থান যে কাউকে মুগ্ধ করবে। শৈশবেই ‘বায়োগ্রাফি ইউনিভার্সাল’ এর প্রায় তেরোটি খন্ড শেষ করে ফেলেন তিনি। চৌদ্দ বছর বয়সে ফারসি, ল্যাটিন, গ্রীক, ইতালীয় ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। মাত্র বারো বছর বয়সে লিখে ফেলেন প্রথম কবিতার বই, যদিও প্রকাশ করার জন্য কাউকে না পেয়ে নিজেই অভিমানে ছিঁড়ে ফেলেন সেই বই। পরিবারে সচরাচর ধর্মবিশ্বাস থেকে আলাদা বিশ্বাসে প্রচলন থাকায় পড়ার সুযোগ পাননি অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২৮ সালে তাই যোগ দেন লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে, যদিও সেখানে পড়ার মাঝেও ছেদ পড়ে। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সঙ্গীত প্রতিভা কাজে লাগিয়ে রচনা করেন অনেকগুলো সঙ্গীত। বাবার মতো চাকরিতে মন না দিয়ে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন।

১৮৩০ সালে সাহিত্যে নিজেকে পুরো জড়িয়ে ফেলেন ব্রাউনিং। প্রথমদিকে তেমন স্বীকৃতি না পেলেও পরিবারের সমর্থন কিন্তু তাতে কিছুমাত্র কম হয়নি। এরপর ১৮৩৩ সালে তাঁর লেখা প্রথম দীর্ঘ কবিতা ‘পাওলিন: এ ফ্রাগমেন্ট অফ কনফেশন’ প্রকাশিত হয়, যা বিখ্যাত সাহিত্যবোদ্ধা দান্তে গ্যাব্রিয়েল রোসেট্টির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরের কবিতা ‘প্যারাসেলসাস’ ডিকেন্স ও ওয়ার্ডসওয়ার্থসহ আরো অনেক বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের কাছে সমাদৃত হয়। ব্রাউনিংয়ের বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে আছে ‘দ্য লাস্ট ডাচেস’, ‘দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার’, ‘ফ্রা লিপো লিপি’, ‘অ্যা গ্রামারিয়ান ফিউনারেল’ ইত্যাদি। ১৮৬৮ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে লেখা প্রায় বারোটি বইয়ের দীর্ঘ কবিতা ‘দ্য রিং অ্যান্ড দ্য বুক’ তাকে সেসময়ের শ্রেষ্ঠ কবিদের সারিতে স্থান করে দেয়।

তরুণ বয়সে কবি; source: biography.com

ব্রাউনিংয়ের প্রথম স্ত্রী এলিজাবেথ ছিলেন সমসাময়িক আরেক জনপ্রিয় কবি। বলা যায়, বিয়ের সময় এলিজাবেথ তাঁর স্বামীর চেয়ে অধিক জনপ্রিয় ছিলেন। ১৮৪৫ সাল থেকে তাঁদের পরিচয়ের শুরু। এলিজাবেথের কবিতার বই ‘পোয়েমস’ এর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত ব্রাউনিং তীব্রভাবে আকর্ষিত হন কবির প্রতিও। এলিজাবেথের পিতার চরম অমতে ১৮৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে বিয়ে করার পর ব্রাউনিং সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে দ্রুতই স্থান ত্যাগ করেন। কনের পিতা এই বিয়েতে এতোই অসন্তুষ্ট হন যে নিজের কন্যাকেই শাস্তি হিসেবে তাঁর উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। এতে এই জোড়ার সংসারে একটু টানাপোড়ন তৈরি হলেও ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না।

প্রেমময় দাম্পত্যজীবনে এই জুটি ঘুরে বেরিয়েছে বিভিন্ন দেশ। ব্রাউনিং তার বিখ্যাত কবিতার বই ‘ম্যান অ্যান্ড ওমেন’ এলিজাবেথকে উৎসর্গ করেন। এই সুখের জীবনে বিরহ এনে এলিজাবেথ ১৮৬১ সালে দেহত্যাগ করেন। তাদের এক পুত্রসন্তান পৃথিবীতে এসেছিলো।

কবিতার পাশাপাশি তিনি নাটক লেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্রাউনিং কবি হিসেবে যতটা অসাধারণ ছিলেন, নাট্যকার হিসেবে ছিলেন ততটাই মলিন। প্রথম নাটক ‘স্ট্যাফোর্ড’ মাত্র পাঁচবার মঞ্চে স্থান পায়। কিন্তু দ্বিতীয় নাটক একবারের জন্যও মঞ্চায়িত হতে পারেনি। তৃতীয় নাটকও ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হলে নাটকের মঞ্চের সাথে সম্পর্ক ছেদ করে তিনি আবার কবিতায় মন দেন।

নাটকের চেয়ে কবিতাই ভালো আসতো তার; source: fleursdumal.nl

স্কুল পরিদর্শকের চাকরি শুরু করলেও তা নিজের পুরোদস্তুর কবি হওয়ার পথে বাধা মনে করে ছেড়ে দেন। জীবনের ৫০ বছর পার হওয়ার পর স্বীকৃতি পাওয়া শুরু করলেও একসময় তিনিই হয়ে ওঠে ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিদের একজন। ‘দ্য পাইড পাইপার’ ব্রাউনিংয়ের সবচেয়ে পঠিত ও সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পের ভিত্তিতে ব্রাউনিং রচনা করেন অসাধারণ এই কবিতা। ব্রাউনিং ১৮৮৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ভেনিসে পুত্রের বাসায় মারা যান। তাঁকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সেই মহারানী ভিক্টোরিয়ার সময়ের আরেকজন স্বনামধন্য কবি লর্ড টেনিসনের কবরের পাশে শায়িত করা হয়েছে।

দেরিতে হলেও নিজের প্রতিভা আর সাধনার ফল ব্রাউনিং পেয়েছিলেন। সাহিত্য সাধনায় আমৃত্যু তিনি ইংরেজি সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন অসাধারণ কবিতার এক অনবদ্য উপহার। ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতাগুলোর অনেকগুলোই আছে তার ঝুড়িতে। সম্মান আর স্বীকৃতিও পেয়েছেন তাই অনেক। তিনি সেই ভাগ্যবান কবি, যিনি জীবিত থাকতেই ইংল্যান্ড ও আমেরিকাতে তার সাহিত্য পড়া ও গবেষণার জন্য ‘ব্রাউনিং সোসাইটি ‘ প্রতিষ্ঠা হতে দেখে যান।

ফিচার ইমেজ- twitter.com

Related Articles