রবার্ট কচ তার সদ্য আবিষ্কৃত ‘পিওর কালচার’-এ ব্যাকটেরিয়া সংরক্ষণের প্রক্রিয়াটি সেসময়কার খ্যাতনামা অণুজীববিদ লুই পাস্তুর ও জোসেফ লিস্টারকে দেখাতে লন্ডনে যান। অতিদ্রুতই নতুন ধাঁচের পদ্ধতিটি জনপ্রিয়তা পায় বিজ্ঞানীমহলে। এ পদ্ধতির সাহায্যে ফ্রেডরিখ লফলার গ্ল্যান্ডার্স ও ডিপথেরিয়া রোগের ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারে সক্ষম হন, তিনি ছিলেন রবার্ট কচেরই একজন সহকারী। এছাড়াও রবার্ট কচের একজন ছাত্র, জর্জ গ্যাফকি টাইফয়েড জ্বরের রহস্য উন্মোচন করেন এর জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারের মাধ্যমে।
অণুবীক্ষণ প্রক্রিয়া ও পিওর কালচার তৈরির যে অভূত সংস্কার সাধন করেছিলেন রবার্ট কচ, তা ব্যবহারের ফলে নানা জায়গাতেই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণার প্রসার ঘটতে থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীমহল ধাঁধায় পড়ে যায় যক্ষ্মার প্রশ্নে এসে। তৎকালীন ইউরোপে প্রতি সাতজনে একজনের মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম এই ভয়ংকর রোগটির ব্যাপারে কোনোই সুরাহা করা যাচ্ছিল না। রোগের ধরন দেখে একে ছোঁয়াচে রোগ বলে আখ্যা দেয়া হলেও, একটি ছোঁয়াচে রোগের পেছনে যে অণুজীবের উপস্থিত থাকার কথা, তাও এক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
এখন আমরা জানি, অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া প্রাণিদেহে যেমন আচরণ করে, যক্ষ্মার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার আচরণ অনেকখানি ভিন্ন। তাই অন্যান্য সাধারণ ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুবীক্ষণের চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না। স্বচ্ছ ব্যাকটেরিয়াকে অণুবীক্ষণের জন্য যে রঞ্জন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটিয়েছিলেন রবার্ট কচ, তাতে এর উপস্থিতি খুঁজে না পেয়ে, পরবর্তীকালে ভিন্নভাবে খোঁজ শুরু হয় ব্যাকটেরিয়াটির। আর এ পদ্ধতিটিও রবার্ট কচের মস্তিষ্কপ্রসূত।
আগের রঞ্জনপ্রক্রিয়া বাদ দিয়ে, অণুবীক্ষণের সময় তিনি ‘মেথিলিন ব্লু’ রঞ্জন প্রয়োগে টের পান যে, কিছু লম্বাটে গঠনের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় যক্ষ্মা আক্রান্ত টিস্যুতে। তিনি এও লক্ষ করেন, নতুন তৈরি মেথিলিন ব্লু'র চেয়ে পুরনো তুলে রাখা মেথিলিন ব্লু ব্যবহারে আরো স্পষ্টভাবে লম্বাটে গঠনগুলো বোঝা যায়। তিনি ধারণা করেন, হয়তো তুলে রাখা রঞ্জনটি বাতাস থেকে অ্যামোনিয়ার সাথে বিক্রিয়ায় ক্ষারধর্মী হয়ে ওঠে, যা একে আরো কার্যক্ষম করে তোলে। তাই মেথিলিন ব্লু-কে ক্ষারধর্ম দিতে এর সাথে পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড মিশিয়ে দেন রবার্ট। আর এতে করে অভাবনীয় এক সাফল্যের সূচনা হয়। অণুবীক্ষণযন্ত্রে কাঁচের লেন্সের নিচে অসংখ্য পরিমাণে যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তিনি বুঝতে পারেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে দীর্ঘসময় ধরে চলে আসা একটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। ব্যাকটেরিয়াগুলো সেখানে সবসময়ই উপস্থিত ছিল, উপযুক্ত রঞ্জনপ্রক্রিয়ার অভাবে মানুষ এতদিন খুঁজে পায়নি।
ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পেলেও রবার্ট কচ বুঝতে পারেন, এখানেই সাফল্য ধরা দিচ্ছে না। তাকে আরো অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে প্রমাণ করতে হবে, এই ব্যাকটেরিয়াগুলোই যক্ষ্মার জন্য দায়ী।
ব্যাকটেরিয়াগুলো নিয়ে তিনি শুরু করেন গবেষণা, তৈরি করেন পিওর কালচার। পিওর কালচারে সদ্য জন্মানো নতুন ব্যাকটেরিয়া প্রায় ২১৭টি প্রাণীর দেহে প্রবেশ করান। প্রতিটি প্রাণীর দেহে ধীরে ধীরে যক্ষ্মার লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে।
বার্লিনে চিকিৎসক সংঘ কর্তৃক আয়োজিত এক আলোচনা সভায় যক্ষ্মার উপর করা পুরো গবেষণার যাবতীয় তথ্যাদি উত্থাপন করেন রবার্ট কচ। সে আলোচনায় বক্তৃতা প্রদানের সময় তিনি যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়াসমৃদ্ধ প্রায় দুই শতাধিক অণুবীক্ষণ স্লাইড প্রদর্শনের মাধ্যমে গবেষণায় প্রাপ্ত ফল উপস্থাপন করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি একটি অন্যতম ঘটনা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন পল এর্লিক, যিনি রবার্টের রঞ্জনপদ্ধতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে প্রক্রিয়াটির সংস্কারসাধন করেন। এর্লিকের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরে হান্স ক্রিশ্চিয়ান গ্রাম, ফ্রাঞ্জ ঝিল ও ফ্রেডরিখ নিয়েলসন রঞ্জন প্রক্রিয়ার আরো সংস্কার করেন। অণুজীববিজ্ঞানের গবেষণায় বর্তমানে ‘গ্রাম স্টেইনিং’ ও ‘ঝিল-নিয়েলসন’ নামক রঞ্জন প্রক্রিয়াদ্বয় বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।
এ গবেষণা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকমহলে ভীষণ সাড়া পায়, দ্রুত বিশ্বব্যাপী গৃহীত হয় রবার্ট কচের উত্থাপিত ফলগুলো। এ গবেষণার জন্যই ১৯০৫ সালে রবার্ট কচকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এরই মাঝে রবার্ট কচ ও আরেক মূর্তিমান ফরাসি রসায়নবিদ লুই পাস্তুর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। রবার্ট কচ পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক, তিনি চাইতেন রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে মানুষকে রোগমুক্ত রাখতে। আর লুই পাস্তুর ছিলেন একজন রসায়নবিদ, খানিকটা শখের বসেই জীবাণুতত্ত্ব নিয়ে কাজ করতেন তিনি; রোগের বিরুদ্ধে প্রতিষেধকের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে চাইতেন তিনি। এসব নিয়েই দ্বন্দ্বের শুরুটা হয়েছিল।
রবার্ট কচ উল্লেখ করেন, লুই পাস্তুর একজন রসায়নবিদ, তার পক্ষে রোগ-জীবাণু নিয়ে জানার কথা নয়। তাছাড়া পাস্তুরের যে ব্যাকটেরিয়া কালচার পদ্ধতি, তা-ও সঠিক নয়। লুই পাস্তুরও এসমস্ত অভিযোগের সমুচিত জবাব দিতে শুরু করেন এক পর্যায়ে। এ বিরোধ চলতে থাকে বহুদিন, ফলস্বরূপ ফ্রান্সে অণুজীববিজ্ঞানের গবেষণায় রবার্টের পদ্ধতিগুলো বর্জন করা হয়; আর জার্মানিতে বর্জন করা হয় পাস্তুরের জলাতঙ্ক প্রতিষেধক।
যক্ষ্মার উপর রচিত গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পরের বছরই ভারতে কলেরা মহামারি দেখা দিলে, রবার্ট কচ কলেরা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ভারত থেকে এ মহামারি মিশরে ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন জার্মান সরকার অবস্থা বেগতিক দেখে রবার্ট কচকে দায়িত্ব দেন; তিনি যেন একটি গবেষক দল নিয়ে মিশরে গিয়ে কলেরার একটা সুরাহা করেন। রবার্ট কচ দায়িত্ব পেয়ে মিশরে যাবার কিছুদিন পর মিশরের কলেরা আক্রমণ স্তিমিত হয়ে এলে গবেষক দল নিয়ে তিনি চলে আসেন ভারতের কলকাতায়।
সেখানে মৃত ব্যক্তির অন্ত্র পরীক্ষা করে তিনি কমা আকৃতির একধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি টের পান। শতাধিক মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্তে বারবার একই ব্যাকটেরিয়া দৃশ্যমান হতে থাকে রবার্ট কচের অণুবীক্ষণযন্ত্রটির লেন্সের নিচে। ব্যাকটেরিয়াগুলো নিয়ে কালচার করে ব্যাকটেরিয়াটির বিভিন্ন আচরণ তিনি লিপিবদ্ধ করেন।
কিন্তু তিনি এটি বুঝতে পারছিলেন না যে, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো অন্ত্রের কোনোরকম ক্ষতিসাধন ছাড়াই কীভাবে ডায়রিয়ার সৃষ্টি করছে। এ নিয়ে গবেষণায়ও বেশিদূর এগোতে পারছিলেন না তিনি, অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রাণিদেহে কলেরা সংক্রমণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। সুস্থ মানুষের দেহেও কলেরা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানোর কোনো উপায় ছিল না তার হাতে।
রবার্ট কচ একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলেন, একটি রোগের পেছনে দায়ী জীবাণুটি অবশ্যই সেই নীতিমালাকে অনুসরণ করবে। সে অনুযায়ী, একজন আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ হতে ব্যাকটেরিয়া সুস্থ প্রাণিদেহে প্রবেশ করিয়ে উক্ত রোগের সংক্রমণ ঘটানোর কথা ছিল। কিন্তু তিনি কলেরার ক্ষেত্রে নীতিমালার এ শর্তটি কোনোভাবেই মানাতে পারছিলেন না। তিনি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন, কলেরার জন্য এই কমা আকৃতির ব্যাকটেরিয়াগুলোই দায়ী। তাই কোনো সুরাহা করতে না পেরে, তার প্রণীত নীতিমালার একটি ব্যতিক্রম হিসেবে কলেরা ব্যাকটেরিয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
পরবর্তী সময়ে ভারতীয় চিকিৎসক শম্ভুনাথ দে একটি বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে কলেরা সংক্রমণের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হন।
কলেরা ব্যাকটেরিয়ার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে রবার্ট কচ দেখতে পেয়েছিলেন, এই ব্যাকটেরিয়া অ্যানথ্রাক্সের মতো স্পোর তৈরি করে না, তবে পানির মাঝে সংক্রমণশীল হয়ে অবস্থান করতে সক্ষম। ১৭ জন কলেরা রোগীর সাথে আলাপ করে তিনি জানতে পারেন যে, তারা প্রত্যেকেই গ্রামের একটি জলাশয় হতে পানি পান করত। উক্ত জলাশয় পরীক্ষা করে দেখতে পান, কমাকৃতির সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো পানিতে উপস্থিত রয়েছে। মূল উৎস খুঁজতে গিয়ে রবার্ট লক্ষ করেন যে, গ্রামে প্রথমে যিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার ব্যবহৃত জামাগুলো এই পানিতেই ধোয়া হতো। আর এভাবেই হয়তো জলাশয়ে কলেরার সংক্রমণ ঘটে থাকতে পারে।
এখান থেকেই রবার্ট কচ প্রচার করতে শুরু করেন, কলেরা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে নিরাপদ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আট বছর পর ১৮৯২ সালে জার্মানির হ্যামবার্গে কলেরা মহামারি দেখা দিলে তখন রবার্ট কচের কলেরা গবেষণাকে কেন্দ্র করেই প্রতিরোধব্যবস্থা স্থাপন করা হয়।
কলকাতা থেকে ফিরে এলে রাষ্ট্রীয়ভাবে রবার্টকে সম্মানিত করা হয় এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি আবারও যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। এবার যক্ষ্মা প্রতিকারের উপায় খুঁজতে থাকেন তিনি।
প্রতিকার খুঁজে না পেলেও অজ্ঞাতভাবে তার এ গবেষণাটি ভিন্ন একদিকে মোড় নেয়। যক্ষ্মা ব্যাকটেরিয়া হতে একধরনের গ্লিসারিন জাতীয় পদার্থ নিঃসৃত করেন তিনি, যা ত্বকের নিচে প্রবেশ করা হলে যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীর দেহে কিছু প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়; কিন্তু সুস্থদেহে এমনটি করা হলে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না। রবার্ট কচ ভাবেন, যক্ষ্মা নির্ণয়ের জন্য এ পদ্ধতিটি অনুসরণ করা যেতে পারে। বর্তমানে এ পদ্ধতিটিকেই সামান্য সংস্কারের মাধ্যমে সুপ্তাবস্থায় থাকা যক্ষ্মা নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।
যক্ষ্মা নিয়ে তার পুনরায় গবেষণার কথা প্রকাশিত হলে, দেশের নানা প্রান্ত হতে এ রোগে আক্রান্ত মানুষেরা রবার্ট কচের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে। তখন তিনি অধ্যাপকের দায়িত্ব হতে পদত্যাগ করে পুরোপুরি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। এসময় তাকে বার্লিনের ‘সংক্রামক ব্যাধি ইনস্টিটিউট’-র প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে এর নাম পাল্টে এর নাম রাখা হয় ‘রবার্ট কচ ইনস্টিটিউট’।
এই সেই রবার্ট কচ ইনস্টিটিউট, যেখানে এমিল ভন বেরিং, রিচার্ড ফাইফার, অগাস্ট ওয়াসারম্যানের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানের বহু রথী-মহারথীর গবেষণা জড়িয়ে রয়েছে।
১৯১০ সালের ২৭শে মে, ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান চিকিৎসক ও অণুজীববিদ; ব্যাকটেরিয়ার গবেষণায় যিনি আলোর দিশারীরূপে পথিকৃৎ হয়ে আছেন আজও।
This is the second & last part of biography and lifeworks of Robert Koch, remarkably known for discovering the tuberculosis, anthrax & cholera bacilli. was awarded Nobel Prize in Medicine for astonishing works on tuberculosis.
References are hyperlinked inside the article.
Featured Image: The Microbial Menagerie