সাম্প্রতিক আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধ দক্ষিণ ককেশাস/ট্রান্সককেশিয়ার (এবং প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চলের) পরিস্থিতিকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে একটি রক্তাক্ত দাঙ্গার মধ্য দিয়ে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে জাতিগত সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে, এবং ১৯১৮–২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই সংঘাত স্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করে। এই দ্বন্দ্বের অন্যতম একটি কারণ ছিল জাতিগত আর্মেনীয়–অধ্যুষিত নাগর্নো–কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে বিরোধ।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বর্তমান আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের ভূমি রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, এবং এজন্য নিজেদের স্বার্থেই রুশরা আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে একটি 'অস্বস্তিকর শান্তি' (uneasy peace) বজায় রেখেছিল। কিন্তু ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে পুরোপুরি যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়, এবং ১৯২০ সালে বলশেভিক–নিয়ন্ত্রিত 'রুশ ফেডারেশন'–এর সক্রিয় সহায়তায় আর্মেনীয় ও আজারবাইজানি বলশেভিকরা রাষ্ট্র দুটির শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়ার পরই কেবল এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। সোভিয়েতরা আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের প্রতি একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, এবং নিজস্ব ভূরাজনৈতিক বিবেচনা থেকে নাগর্নো–কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করে, কিন্তু অঞ্চলটিকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে।
সোভিয়েত শাসনামলে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি বজায় রাখে, কিন্তু ১৯৮০–এর দশকে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে, এবং আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে নাগর্নো–কারাবাখ নিয়ে পুনরায় সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে এটি পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নেয়, এবং আর্মেনীয়দের নিকট আজারবাইজানিরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ১৯৯৪ সালে যখন এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে, তখন নাগর্নো–কারাবাখের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ এবং এর আশেপাশের ৭টি আজারবাইজানি জেলা আর্মেনীয়দের দখলে ছিল। ২০২০ সালে তুরস্কের সক্রিয় সহায়তায় আজারবাইজান আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের ওপর আক্রমণ চালায় এবং ৬ সপ্তাহের একটি যুদ্ধের পর ৭টি আজারবাইজানি জেলা ও নাগর্নো–কারাবাখের একাংশ পুনর্দখল করে নিতে সক্ষম হয়।
রুশ মধ্যস্থতায় ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের ব্যাপারে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সম্মতি প্রদান করে। এই সমঝোতা অনুযায়ী রাশিয়া নাগর্নো–কারাবাখে প্রায় ২,০০০ শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে। রাশিয়া দক্ষিণ ককেশাসে প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী, এবং এজন্য আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে নতুন করে একটি যুদ্ধ যাতে শুরু না হয় সেটি নিশ্চিত করা এই রুশ শান্তিরক্ষীদের দায়িত্ব। আর নাগর্নো–কারাবাখে মোতায়েনকৃত রুশ শান্তিরক্ষীদের কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল রুস্তম মুরাদভ।
রুস্তম উসমানোভিচ মুরাদভ ১৯৭৩ সালের ২১ মার্চ তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত রুশ ফেডারেশনের দাগেস্তান স্বায়ত্তশাসন প্রজাতন্ত্রের দেরবেন্তস্কি জেলার চিনার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা উসমান মুরাদভ ও মাতা উমিঝাত মুরাদোভা জাতিগতভাবে তাবাসারান এবং ধর্মগতভাবে সুন্নি মুসলিম। তিন ভাইয়ের মধ্যে রুস্তম মুরাদভ ছিলেন জ্যেষ্ঠ। উল্লেখ্য, 'তাবাসারান' উত্তর ককেশাসের একটি ক্ষুদ্র জাতি; যার জনসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। তারা মূলত ইসলাম ধর্মের সুন্নি মতবাদের অনুসারী এবং প্রধানত দাগেস্তানে বসবাস করে।
মুরাদভ ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি সামরিক সংক্রান্ত বিষয়াবলি নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। তার মা উমিঝাত মুরাদোভা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ছোটবেলায় মুরাদভের আচার–আচরণ ছিল একজন 'বাচ্চা জেনারেল'–এর মতো! মুরাদভ বর্তমান রাশিয়ার দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের রাজধানী মাখাচকালা শহরের ১৬ নম্বর স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে রোস্তভ প্রদেশের নভোচেরকাসস্ক শহরের ক্যাডেট স্কুলে অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি বর্তমান রাশিয়ার তাতারস্তান প্রজাতন্ত্রের রাজধানী কাজান শহরে অবস্থিত 'কাজান সুভোরভ মিলিটারি স্কুলে' অধ্যয়ন করেন এবং সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে একজন কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মুরাদভ নবগঠিত রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। রুশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে তিনি 'সেন্ট পিটার্সবার্গ হায়ার কম্বাইন্ড আর্মস কমান্ড স্কুলে' অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৯৫ সালে মস্কোয় অবস্থিত 'কম্বাইন্ড আর্মস অ্যাকাডেমি' থেকে উত্তীর্ণ হন। এসময় তিনি প্রথম চেচেন যুদ্ধে (১৯৯৪–১৯৯৬) অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথমে একটি প্লাটুন ও পরে একটি কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৯৬ সালে চেচনিয়ার ভের্খনি ৎসেন্তেরয় গ্রামে চেচেন মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি বিশেষ সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। প্রথম চেচেন যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তিনি রুশ সরকারের কাছ থেকে দুবার 'অর্ডার অফ কারেজ' এবং একবার 'অর্ডার অফ মিলিটারি মেরিট' অর্জন করেন। অবশ্য এই যুদ্ধে রুশ সরকারি বাহিনী পরাজিত হয় এবং চেচনিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধেও (১৯৯৯–২০০৯) মুরাদভ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ২০০০ সালে রুশ সৈন্যরা বিচ্ছিন্নতাবাদী 'ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্রে'র রাষ্ট্রপতি আসলান মাসখাদভের সদর দপ্তর দখল করে নেয় এবং প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কাগজপত্র হস্তগত করে। এই অভিযানে মুরাদভ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং অভিযান পরিচালনার সময় আহত হন। এই যুদ্ধে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্যও তিনি রুশ সরকারের কাছ থেকে নানা রকম পদক ও সম্মাননা লাভ করেন।
২০০৮ সালে মুরাদভকে রুশ সেনাবাহিনীর ২৪২ তম গার্ডস মোটর রাইফেল রেজিমেন্টের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়, এবং পরবর্তীতে তিনি ১৭ তম পৃথক গার্ডস মোটর রাইফেল ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি রুশ সেনাবাহিনীর ৩৬ তম গার্ডস মোটর রাইফেল ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। উল্লেখ্য, সোভিয়েত/রুশ সেনাবাহিনীতে 'গার্ডস' মর্যাদাপ্রাপ্ত ইউনিটগুলোকে সবচেয়ে সম্মানজনক ও এলিট ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১২ সালে মুরাদভ মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন, এবং রুশ 'কেন্দ্রীয় সামরিক জেলা'র ৪৭৩ তম লিসিচানস্ক ডিস্ট্রিক্ট ট্রেইনিং সেন্টারের প্রধান হিসেবে ২০১২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি মস্কোয় অবস্থিত 'মিলিটারি অ্যাকাডেমি অফ দ্য জেনারেল স্টাফ'–এ উচ্চতর অধ্যয়ন শুরু করেন এবং সেখান থেকে ২০১৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কার্যত মুরাদভ রুশ সশস্ত্রবাহিনীর সবচেয়ে বেশি উচ্চপ্রশিক্ষিত সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন। ২০১৫-১৭ পর্যন্ত তিনি রুশ 'কেন্দ্রীয় সামরিক জেলা'র ৪১ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির প্রথম উপপ্রধান ও চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি ইউক্রেনে চলমান গৃহযুদ্ধে সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনে ইউক্রেনে একটি 'রঙিন বিপ্লব' সংঘটিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের রুশপন্থী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে একটি পশ্চিমাপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকার দেশটির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। প্রত্যুত্তরে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা ঘোষণা করে ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়, এবং পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার সমর্থনপ্রাপ্ত ইউক্রেনীয় রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধের অবসান ঘটানোর লক্ষ্য 'মিনস্ক প্রোটোকল' স্বাক্ষরিত হয়, এবং পূর্ব ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য রুশ ও ইউক্রেনীয় সামরিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি যৌথ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গঠিত হয়। ২০১৬ সালে মুরাদভ এই কেন্দ্রে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০১৬ সালের ৫ মার্চ ইউক্রেনীয় সৈন্যরা রুশ পর্যবেক্ষকদের ওপর ব্যাপকভাবে গোলাবর্ষণ করে, এবং আক্রান্ত পর্যবেক্ষকদের মধ্যে মুরাদভও ছিলেন। কিন্তু প্রায় ২০ মিনিটব্যাপী এই গোলাবর্ষণে মুরাদভ বা অন্য কোনো পর্যবেক্ষক হতাহত হননি।
২০১৭ সালে মুরাদভ সিরিয়ায় প্রেরণ করা হয় এবং সেখানে তিনি সিরীয় সশস্ত্রবাহিনীর একজন সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় সিরীয় সরকার ও বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে, এবং ২০১৫ সালে রাশিয়া সিরীয় সরকারের সমর্থনে দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। মুরাদভ সিরিয়ায় বিশেষ সামরিক কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন, এবং ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর রুশ সরকার তাঁকে 'হিরো অফ দ্য রাশান ফেডারেশন' পদক প্রদান করে। উল্লেখ্য, এটি রাশিয়ার সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক পদক।
সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মুরাদভ রুশ 'কেন্দ্রীয় সামরিক জেলা'র ২য় গার্ডস রেড ব্যানার আর্মির কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে মুরাদভকে রুশ 'দক্ষিণাঞ্চলীয় সামরিক জেলা'য় বদলি করা হয় এবং সামরিক জেলাটির ডেপুটি কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সামরিক দিক থেকে রাশিয়া বর্তমানে পাঁচটি জেলায় বিভক্ত। রুশ ফেডারেশনের দক্ষিণাঞ্চল এই সামরিক জেলার অন্তর্ভুক্ত। আদিগেয়া, ইঙ্গুশেতিয়া, উত্তর ওসেতিয়া–আলানিয়া, কাবার্দিনো–বালকারিয়া, কারাচাই–চের্কেশিয়া, কালমিকিয়া, ক্রিমিয়া, চেচনিয়া ও দাগেস্তান প্রজাতন্ত্র, ক্রাস্নোদার ও স্তাভ্রোপোল সীমান্ত প্রদেশ, আস্ত্রাখান, ভোলগোগ্রাদ ও রোস্তভ প্রদেশ এবং সেভাস্তোপোল কেন্দ্রশাসিত শহর– রুশ ফেডারেশনের এই ১৫টি প্রশাসনিক বিভাগ 'দক্ষিণাঞ্চলীয় সামরিক জেলা'র অন্তর্ভুক্ত। এর পাশাপাশি আর্মেনিয়া, আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেতিয়ায় অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিগুলোও এই সামরিক জেলার আওতাধীন।
২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মুরাদভ লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। তিনিই প্রথম জাতিগত তাবাসারান, যিনি রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে এত উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এজন্য তার নিজ জাতির মধ্যে এবং নিজ প্রজাতন্ত্র দাগেস্তানের জনসাধারণের নিকট মুরাদভ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে মুরাদভ বিবাহিত এবং দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।
২০২০ সালের নভেম্বরে রুশ মধ্যস্থতায় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এই চুক্তি অনুযায়ী নাগর্নো–কারাবাখের অবশিষ্ট আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের ব্যাপারে উভয় পক্ষ সম্মতি প্রদান করে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়েই নাগর্নো–কারাবাখে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু বর্তমানে যুদ্ধে পরাজিত আর্মেনিয়ার জন্য এই প্রস্তাব গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না, কারণ নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশে রুশ সৈন্যদের উপস্থিতিই কেবল অঞ্চলটি সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেয়া থেকে আজারবাইজানকে বিরত রাখতে পারে।
অন্যদিকে, আজারবাইজান সাম্প্রতিক যুদ্ধে সামরিকভাবে বিজয়ী হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রুশ কূটনৈতিক চাপ, যুদ্ধোত্তর আজারবাইজানে মাত্রাতিরিক্ত তুর্কি প্রভাব বৃদ্ধি রোধ এবং নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়দের প্রতি গৃহীত সম্ভাব্য নীতি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা প্রভৃতি কারণে আজারবাইজানও নাগর্নো–কারাবাখে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের ক্ষেত্রে সম্মতি প্রদান করেছে।
মুরাদভকে নাগর্নো–কারাবাখে মোতায়েনকৃত রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছে। রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে এত জেনারেল থাকতে মুরাদভকে কেন এই দায়িত্ব প্রদান করা হলো? এর কারণ দুটি।
প্রথমত, মুরাদভ একজন ককেশিয়ান এবং ককেশাস অঞ্চলের স্থানীয় সমস্যা একজন জাতিগত ককেশিয়ান যত ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারবেন, একজন 'বহিরাগত' (নন–ককেশিয়ান) সামরিক কর্মকর্তার ক্ষেত্রে সেটা নাও সম্ভব হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ধর্মগতভাবে মুরাদভ একজন মুসলিম এবং এই হিসেবে মুসলিম–অধ্যুষিত আজারবাইজানের ভূমিতে সেনানায়ক হিসেবে একজন মুসলিমকে নিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে রাশিয়া নিজস্ব ভাবমূর্তি সমুন্নত করার প্রয়াস পেয়েছে। আজারবাইজানিদের ক্ষুদ্র একটি অংশ নাগর্নো–কারাবাখে রুশ উপস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, এবং সেখানে একজন খ্রিস্টান জেনারেলকে রুশ শান্তিরক্ষীদের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করলে তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আর্মেনীয়দের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাতে পারেন, এই আশঙ্কা থেকে আজারবাইজানিদের মুক্ত রাখার জন্য সেখানে একজন মুসলিম জেনারেলকে নিযুক্ত করা হয়েছে। বস্তুত বহু আগে থেকেই মুসলিম–অধ্যুষিত অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য রুশ রাষ্ট্র মুসলিম সৈন্য/সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে আসছে।
অবশ্য মুরাদভকে নাগর্নো–কারাবাখে রুশ শান্তিরক্ষীদের কমান্ডার নিযুক্ত করার পর তার জাতিগত পরিচিতি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। কিছু কিছু প্রচারমাধ্যমে তাকে জাতিগত আজারবাইজানি হিসেবে প্রচার করা হয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই আজারবাইজানিরা উল্লসিত হয়, এবং আর্মেনীয়দের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মুরাদভ যে আজারবাইজানি নন, বরং তাবাসারান, এই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়, এবং আর্মেনীয়রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে (অন্যদিকে আজারবাইজানিরা খানিকটা হতাশ হয়)।
অবশ্য এসব খুঁটিনাটি বিষয় মুরাদভের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ তার জন্য একটি কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। নাগর্নো–কারাবাখে মোতায়েনকৃত রুশ শান্তিরক্ষীর সংখ্যা মাত্র ১,৯৬০ জন। এত স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে অঞ্চলটিতে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়া ঠেকানো খুব একটা সহজ কাজ নয়, এবং আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যেকার তীব্র জাতিগত বিদ্বেষ এই সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও ইতোমধ্যেই আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় সৈন্যদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র সংঘর্ষ বন্ধ করার জন্য রুশ শান্তিরক্ষীদের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। তদুপরি, রুশ সৈন্যরা নাগর্নো–কারাবাখে যুদ্ধের সময় পুঁতে রাখা মাইন অপসারণের কাজে নিযুক্ত হয়েছে, এবং ইতোমধ্যেই একজন রুশ শান্তিরক্ষী এই কাজে প্রাণ হারিয়েছে। সুতরাং নাগর্নো–কারাবাখে শান্তিরক্ষা রুশদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়া আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয় রাষ্ট্রের ওপর নিজস্ব প্রভাব বজায় রাখতে আগ্রহী। এজন্য আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে নতুন একটি যুদ্ধ রোধ করা এবং নাগর্নো–কারাবাখ সংঘাতকে পুনরায় একটি 'হিমায়িত সংঘাতে' (frozen conflict) পরিণত করা মস্কোর উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মস্কোর জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলা অত্যন্ত কঠিন, এবং এজন্য রুশ শান্তিরক্ষী ও তাদের কমান্ডার মুরাদভের ওপরে এক গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে।
একটি সাক্ষাৎকারে মুরাদভ মন্তব্য করেছিলেন, "কেউ বীর হয়ে জন্মায় না, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে বীরে পরিণত হয়।" মুরাদভ এখন পর্যন্ত পূর্ব ইউক্রেনের শিল্প অঞ্চল থেকে লেভান্টের মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং আক্ষরিকভাবে 'রুশ ফেডারেশনের বীর' মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। নাগর্নো–কারাবাখে কি মুরাদভের রেকর্ড অক্ষুণ্ণ থাকবে? নাকি এই জটিল অঞ্চলের রাজনীতি তাকে ব্যর্থতার মুখোমুখি করবে? এই প্রশ্নের উত্তর নিকট ভবিষ্যতেই কেবল পাওয়া যেতে পারে।
This is a Bengali biographical article about Lieutenant General Rustam Muradov, the current commander of the Russian peacekeeping force in Nagorno-Karabakh.
Sources:
1. Alena Belyaeva. "A general from Dagestan who distinguished himself in Syria became a Hero of Russia." KP.ru, December 28, 2017.
2. Karina Mirzaeva. "Worthy Sons Are Mother's Wealth." Dagestanskaya Pravda, December 14, 2020.
3. Zubaidat Shabanova. "General Rustam Muradov: 'Heroes are not born...'" Zori Tabasarana, July 17, 2019.
Source of the featured image: Al Jazeera