Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাদ্দাম হুসাইন: একজন শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক নাকি মানবতার শত্রু?

যখন সাদ্দাম হুসাইন ইরাকের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিলেন, তখনো কেউ জানত না যে আগামী বছরগুলোয় কী অপেক্ষা করে আছে। কেউ ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে তার ক্ষমতায় আরোহণের মধ্য দিয়ে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য প্রবেশ করতে যাচ্ছে নতুন যুগে। যে যুগ হবে যুদ্ধ, হত্যা এবং আঞ্চলিক সংঘাতে পরিপূর্ণ।

সাদ্দাম হুসাইন একচ্ছত্র ক্ষমতা লাভের পর ইরাকি জনগণকে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে পারলে হয়তো আজকের ইরাক উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেও হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়াতো। বস্তুত, তার শাসনামলের শুরুর বছরগুলোতে ইরাক সঠিক পথেই ছিল। সেই বছরগুলোয় ইরাকি জনগণ যে ইরাককে দেখেছিল, তা শুধু তারা কল্পনাতেই ভাবতে পারতো।

সাদ্দামের প্রসঙ্গ উঠলে একটি কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, ইরাক তার শ্রেষ্ঠ সময় এবং একইসাথে সবচেয়ে বাজে সময় পার করেছিল সাদ্দামের অধীনে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। বিশেষ করে ইরাকের চির বৈরী ধর্মীয় সংঘাত দমনে তার নেয়া পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত কার্যকর ছিল, যদিও সেগুলো বিতর্কের উর্ধ্বে নয়।

ইরাক-ইরান যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত দেশের কলকারখানার দ্রুত প্রসার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয়। তবে এই সুসময় ফুরিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। দ্রুতই তার স্থান দখল করে নেয় গুম-খুন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দ্বন্দ্ব এবং তীব্র যুদ্ধ। পরবর্তীতে পশ্চিমাদের সাথে যুদ্ধ দেশকে পর্যুদস্ত করে তোলে এবং তা পরিণত হয় এক বিরান মরুভূমিতে।

১৯৭৯ সালের ১৬ই জুলাই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দ আল-হাসান আল-বকর পদত্যাগ করলে বা বলা যায় পদত্যাগে বাধ্য হলে ইরাকের ক্ষমতায় আসেন তখনকার ডেপুটি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসাইন। ইরাকের ইতিহাসে শুরু হয় নতুন একটি অধ্যায়। একইসাথে বিশ্বের ইতিহাসেও যোগ হয় একটি নতুন পাতা।

বাগদাদের এক জনসভায় প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসাইন; Image Source : POLITICO

তবে এক মুহূর্ত দম ফেলার অবকাশ ছিল না সাদ্দামের। ছিল না উদযাপনের কোনো ব্যাপার। কারণ প্রতি মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতার ভয় তাকে তাড়া করে ফিরছিল। নিজের ছায়াকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। মাথার মধ্যে শুধু একটাই চিন্তা, কিছু একটা করতে হবে। কোনোভাবেই পিছিয়ে আসা যাবে না। কারণ তাতে করে ক্ষমতা এবং জীবন দুটোই হারাতে হতে পারে।

তারই মতো বাথ পার্টির অন্য সদস্যরাও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিলো। তবে তাদের আতঙ্কটা ছিল অন্য জায়গায়। তারা ভয় পাচ্ছিল সাদ্দামের রক্তচক্ষুকে। কার না কার উপর সাদ্দামের ক্রোধের খড়গ নেমে আসে কে জানে! এরূপ পরিস্থিতিতে জনগণও উৎকন্ঠায় সময় পার করছিল। তারা যেমন তাদের নতুন প্রেসিডেন্টকে ঘিরে নতুন আশার জাল বুনছিলো, আল-বকরের হঠাৎ পদত্যাগ এবং উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশ একইসাথে তাদেরকে শঙ্কিত করে তুলছিল।

এরই মধ্যে ২২ জুলাই, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার ষষ্ঠ দিনে সাদ্দাম হুসাইন বাথ পার্টির চারশোর বেশি নেতাকে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের নিকটে একটি সম্মেলন কেন্দ্রে জরুরি তলব করেন। সবাই উপস্থিত হবার পর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা পেছন থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সাদ্দাম নিজে ঐ সম্মেলনের প্রতিটি মুহূর্ত ভিডিও রেকর্ড করে রাখার নির্দেশ দেন। উপস্থিত সদস্যদের কেউই জানত না কী জন্য বা কেন তাদের ডাকা হয়েছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদ্দাম হুসাইন আসন গ্রহণ করেন। তার শান্ত চেহারা এবং বরফ শীতল দৃষ্টি যে কাউকে ভষ্ম করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। বললে হয়তো ভুল হবে না, সমগ্র বিশ্ব কোনো প্রেসিডেন্টের অমন শীতল এবং রক্ত হিম করা দৃষ্টি আগে কখনো দেখেনি। কোনো প্রকার ভূমিকার ধারে-কাছেও না গিয়ে তিনি শীতল এবং দৃঢ় কন্ঠে সম্মেলনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে দেন।

“চক্রান্তকারীদের স্বপ্ন অনেক। তবে আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই যে আমি নিজ হাতে অস্ত্র তুলে নিব এবং জীবনের শেষপর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব।”

১৯৭৯ সালের ২২ জুলাই বাথ পার্টির সম্মেলনে সাদ্দাম হুসাইন; Image Source : BBC.COM

এরপর তিনি মঞ্চে ডাকেন পূর্বেই আটককৃত বাথ পার্টির তৎকালীন একজন প্রভাবশালী নেতা মুহী আব্দেল-হুসাইনকে। সাদ্দাম তাকে চক্রান্তকারীদের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত করেন এবং কথা দেন যে, তাকে হত্যা করা হবে না, যদি তিনি চক্রান্তের পুরো ঘটনা সবার সামনে তুলে ধরেন এবং এর সাথে জড়িতদের নাম উল্লেখ করেন।

ভীত-সন্ত্রস্ত মুহী আব্দেল-হুসাইন নিজের জীবন বাঁচাতে ইরাককে সিরিয়ার সাথে একত্রীকরণের ষড়যন্ত্রের ঘটনা একে একে বর্ণনা করতে থাকেন এবং বলেন যে, জড়িতরা সবাই এই কক্ষেই অবস্থান করছে। এটা শোনার পর সবার মধ্যে ভয়ের চোরা স্রোত বয়ে যায়। তিনি একে একে জড়িতদের নামোল্লেখ করতে থাকেন। ঠিক এই সময় সাদ্দাম সামনে বসে থাকা বাথ পার্টির নেতাদের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটি কিউবান কোহিবা সিগার টানতে থাকেন। মুহী আব্দেল-হুসাইন একেকজনের নামোল্লেখ করেন আর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে হল থেকে বের করে নিয়ে যেতে থাকে। এভাবে একে একে ৬৮ জনকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়।

সমগ্র সম্মেলন কক্ষ তখন উত্তেজনায় কাঁপছিল। হঠাৎ একজন দাঁড়িয়ে যায় এবং বজ্রমুষ্ঠি উত্তোলন করে উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে, “বাথ পার্টি জিন্দাবাদ। সাদ্দাম হুসাইন জিন্দাবাদ।” সমগ্র কক্ষে তখন এই ধ্বনিই প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। “বাথ পার্টি জিন্দাবাদ। সাদ্দাম হুসাইন জিন্দাবাদ”। সমগ্র ব্যাপারটিই সাদ্দাম বেশ উপভোগ করছিলেন এবং নিবিষ্টচিত্তে সিগার টেনে যাচ্ছিলেন। আজকের এই দিনে তার চাওয়া শুধু একটাই, আর তা হলো বিশ্বস্ততা। যারা কক্ষে অবশিষ্ট ছিলেন তাদের হাতেও পথ খোলা ছিল মাত্র একটাই, আর সেটা হলো সাদ্দামের প্রতি নিঃশর্ত বিশ্বস্ততা।

৬৮ জনের মধ্যে ২২ জনকে তৎক্ষণাৎ ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে গুলি করে হত্যা করা হয়। যারা গুলি করেছিল তারা ছিল এই ২২ জনের একসময়ের সহকর্মী। তাদেরকে গুলি করতে বাধ্য করা হয়। এই ২২ জনের মধ্যে একজন ছিল মুহী আব্দেল-হুসাইন। বাকিদের স্থান হয় কারাগারে। ১ আগস্টের মধ্যে বাথ পার্টির উচ্চপদস্থ আরও ১০০ জনের মতো সদস্যেকে হত্যা করা হয়। অনেকেরই স্থান হয় কারাগারে, অনেককে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি ইরাকের মাটিতে। এতসব হত্যা, গুম-খুনের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হয় সাদ্দামের একচ্ছত্র রাজত্ব। পরবর্তী চব্বিশ বছরের মধ্যে ইরাকের আর কেউ তার বিরুদ্ধাচারণ করতে পারেনি, পারেনি তার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে। ২২ জুলাইয়ের ঘটনার মাধ্যমে তিনি দেশবাসীর মধ্যে যে ভয়কে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা তাদের মধ্যে সমানভাবে বিরাজ করেছিল পরবর্তী ২৪ বছর।

২২ জুলাইয়ের মতো আরও অসংখ্য গণহত্যা সাদ্দামের শাসনামল জুড়ে দেখতে পাওয়া যায়। এতসব হত্যাকান্ডের মাধ্যমে তিনি ইরাক জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। এরকমই একটি গণহত্যা সংঘটিত হয় ৮ জুলাই ১৯৮২ সালে, যা ‘দুজাইল গণহত্যা’ নামে পরিচিত। তখন ইরাক, ইরানের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত। দুজাইল নগরী ছিল ইরাকের শিয়া অধ্যুষিত একটি এলাকা। সেখানকার অসংখ্য পুরুষ ইরাকের বিপক্ষে ইরানের হয়ে যুদ্ধ করছিল। তাদের সমর্থন ছিল ইরানের পক্ষে। জনসমর্থন নিজের পক্ষে আনার জন্য সাদ্দাম ৮ জুলাই দুজাইল পরিদর্শনে যান। তিনি সেখানকার বেশ কিছু পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং জনগণের সামনে একটি বক্তৃতা রাখেন, যেখানে তিনি ইরাকের পক্ষে যারা যুদ্ধ করছে তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

দুজাইলে এক পরিবারের সাথে সাক্ষাতের সময় তোলা ছবি; Image Source : BBC NEWS

বক্তৃতা শেষে তিনি বাগদাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তার গাড়িবহর রাস্তায় চলা শুরু করলে ১২ জনের বেশি গুপ্তঘাতক তাদের উপর হামলা করে বসে। সাদ্দাম হুসাইন বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান তার দুই দেহরক্ষী। হামলার পর সাদ্দাম এক অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ নেন। দ্রুত ঐ স্থান ত্যাগ করার পরিবর্তে তিনি পুনরায় দুজাইল ফিরে যান এবং জনগণের সামনে আরও একটি বক্তৃতা রাখেন। তিনি শপথ করেন যে, তিনি অবশ্যই বিদ্রোহীদের সমূলে উৎপাটন করবেন। এছাড়াও এই হামলাকে তিনি ইরানের কাজ বলে দাবি করেন।

পরবর্তী দিন সরকারের এলিট রিপাবলিকান গার্ডের একটি বিশেষ ইউনিট দুজাইলে প্রবেশ করে এবং সন্দেহভাজন গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করা শুরু করে। তারা ৮০টি পরিবারের ৬০০ এর বেশি মানুষকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে নারী এবং শিশুরাও ছিল। তাদের সবাইকে বাগদাদ থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে আবু গারিব কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ৬০০ জনের মধ্যে ১৪৮ জনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হত্যা করা হয় তাদের। বাকিদেরকেও অমানুষিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং জীবনের একটা বড় সময় কারাগারেই কাটাতে হয়। পরবর্তীতে আমেরিকার হাতে বন্দী সাদ্দামকে এই দুজাইল গণহত্যার জন্য মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

এছাড়াও কুর্দিশ গণহত্যা এবং তাদের ওপর রাসায়নিক বোমা হামলা, ইরান এবং কুয়েতে ইরাকের যুদ্ধাপরাধ সাদ্দামের শাসনামলের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকা সাদ্দামকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম কুখ্যাত একনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার শাসনকাল ২,৫০,০০০ এর বেশি ইরাকি জনতার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

গণহত্যার মাধ্যমে দেশে নিজের আসন পাকাপোক্ত করার পাশাপাশি আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সাদ্দাম হুসাইন একটি পারমাণবিক  গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করেন। এর অংশ হিসেবে ১৯৭৬ সালে তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার তিন বছর আগে ফ্রান্সের কাছ থেকে ‘ওসিরাক’ নামক নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর ক্রয় করা হয়। যদিও ইরাক সবসময় দাবি করতো, এই পারমাণবিক প্রকল্প শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হবে, ইরান এবং ইসরায়েল তা বিশ্বাস করতে পারেনি।

১৯৮০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পর ইরান এই পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ করে এবং বেশ কিছু ক্ষতিসাধন করে। তবে ইরাক ফ্রান্সের সহায়তায় এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ৭ জুলাই ইসরায়েল একই স্থাপনায়’অপারেশন অপের’ পরিচালনা করে এবং এই পারমাণবিক স্থাপনা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়, যা ইরানের সাথে যুদ্ধরত ইরাকের পক্ষে আর নতুন করে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সাদ্দামকে পারমাণবিক বোমা তৈরির আকাঙ্ক্ষা সেখানেই ত্যাগ করতে হয়।

ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার পূর্বে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনা; Image Source : honvedelem.hu

এই একনায়কের শাসনামলে দুটি তথাকথিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমটি ১৯৯৫ সালে এবং দ্বিতীয়টি ২০০২ সালে। প্রথম নির্বাচনে তিনি ৯৯.৪৭% ভোটে পুনর্নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয়টিতে তিনি ১০০% ভোট পান! প্রায় দেড় কোটি ভোটারের মধ্যে কেউ “না” ভোট দেয়নি বা বলা যায় দেয়ার সাহস করেনি!

ব্যক্তিগত জীবনে সাদ্দাম হুসাইন ছিলেন দুই ছেলে উদয় হুসাইন, কুশে হুসাইন এবং তিন কন্যা রাঘা, রানা এবং হালা হুসাইনের জনক। তার প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল সাজিদা, দ্বিতীয় স্ত্রী সামিরা, তৃতীয় স্ত্রী নিদাল এবং চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন ওয়াফা। তার দুই ছেলে উদয় এবং কুশে ছিল বাবার মতোই কুখ্যাত। বিশেষ করে উদয় হুসাইন ছিলেন ইরাকি জনগণের জন্য এক মূর্তিমান আতঙ্ক। সামান্য কারণে নির্যাতন, হত্যা ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিয়ের আসর থেকে নববধূকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা ছিল তার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়! ছেলেদের একের পর এক কুকর্মের পরও সাদ্দাম হুসাইন ছিলেন প্রায় নিশ্চুপ। ছেলেদের তিনি প্রতিনিয়ত প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। যার ফলে ইরাকি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বেড়েছে বৈ কমেনি। ইরাকে আমেরিকার আগ্রাসনের সময় ২০০৩ সালের জুলাই মাসে এক বন্দুক যুদ্ধে উদয় এবং কুশে দুজনই নিহত হন।

(বাম থেকে) সাদ্দাম হুসাইনের দুই জামাতা হুসাইন কামাল, সাদ্দাম কামাল, মেয়ে রানা, বড় ছেলে উদয়, বড় মেয়ে রাঘা, ছোট ছেলে কুশে হুসাইনের স্ত্রী, কুশে হুসাইন, (সোফায় বসা বাম থেকে) সাদ্দাম হুসাইনের প্রথম স্ত্রী সাজিদা হুসাইন, সাদ্দাম হুসাইন এবং ছোট মেয়ে হালা হুসাইন; Image Source: Getty Images

নির্যাতন, গণহত্যা, গুম-খুন, যুদ্ধ এত কিছুর পরও যদি আমরা সাদ্দাম হুসাইনের ব্যাপারে পশ্চিমাদের মতো সরাসরি উপসংহারে চলে আসি এবং তাকে ‘দ্য বুচার অব বাগদাদ’ বা ‘বাগদাদের কসাই’ বলে অভিহিত করি, তাহলে হয়তো তার প্রতি সুবিচার করা হবে না। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সর্বদা বিবাদমান বেশ কিছু জাতিগোষ্ঠী বাস করে। সবার মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশ পরিচালনা অনেক সময়ই সম্ভব হয়ে ওঠে না। দেশের অখন্ডতা বজায় রাখতে গিয়ে প্রায়ই শাসককে কঠোরভাবে সকল বিদ্রোহ দমন করতে হয়। এসব বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে সাদ্দাম হুসাইন যে নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করেছেন তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না হলেও তিনি যে ইরাকের অখন্ডতা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছিলেন এবং বহিঃশত্রুদের হাত থেকে দেশবাসীকে দীর্ঘদিন মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। এ ব্যাপারে একজন ইরাকি নাগরিক কাদিম আল-জাবৌরি, যিনি সাদ্দামের শাসনামল দেখেছিলেন এবং একইসাথে সাদ্দাম পরবর্তী গণতান্ত্রিক ইরাকে বর্তমানে বাস করছেন, দুটি ভিন্ন শাসনামল সম্পর্কে ২০১৬ সালে বিবিসি নিউজকে দেয়া তার একটি সাক্ষাতকারের মাধ্যমে আমরা এই লেখার সমাপ্তি টানতে পারি।

বিবিসে নিউজকে দেয়া সাক্ষাতকারের সময় কাদিম আল-জাবৌরি; Image Source : hathalyoum.net

সাদ্দাম হুসাইন আমার পরিবারের ১৪ জনের বেশি সদস্যকে হত্যা করেছে। তাই যেদিন আমেরিকান বাহিনী ইরাকে আসলো এবং সাদ্দামের রাজত্বের অবসান ঘটালো, সেদিন আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম। আমি যখন শুনলাম যে আমেরিকান সৈন্যরা বাগদাদে পৌঁছে গেছে, তখন আমি হাতুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি এবং ফিরদাউস স্কয়ারে অবস্থিত সাদ্দামের মূর্তিকে আঘাত করতে থাকি। আমি সেটা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। ভেঙে পড়ার আগমুহূর্তে একজন আমেরিকান সৈন্য সাদ্দামের মূর্তির মুখে আমেরিকার পতাকা পরিয়ে দেয়। আমি সেটা সহ্য করতে পারিনি। আমি তাকে একটি ইরাকি পতাকা দেই এবং সে আমেরিকান পতাকার পরিবর্তে সাদ্দামের মুখে ইরাকি পতাকা পরিয়ে দেয়।

কিন্তু তার পর থেকে প্রতি বছর পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। হ্যাঁ, সাদ্দামের সময় দুর্নীতি, হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট ছিল। সাদ্দাম মানুষকে হত্যা করতো, তবে তা বর্তমান সরকারের মতো নয়। সাদ্দাম তো মারা গেছে, কিন্তু তার স্থান দখল করেছে আরও ১০০০ জন সাদ্দাম। আমি এখন মনে করি, ইরাককে আমাদের কাছ থেকে চুরি করা হয়েছে। কেউ যখন “বাগদাদের পতন” শব্দটি উচ্চারণ করে, তখন আমার কষ্ট হয়।

বুশ এবং ব্লেয়ার অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তারা ইরাককে ধ্বংস করেছে এবং আমাদেরকে মধ্যযুগে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি যদি সন্ত্রাসী হতাম তাহলে তাদের দুজনকে নিজ হাতে হত্যা করতাম।

এখন যখন আমি ফিরদাউস স্কয়ারের সামনে দিয়ে যাই তখন আমার খুব কষ্ট হয়। লজ্জা পাই। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি যে কেন আমি সাদ্দামের মূর্তিটি ভাঙলাম। যদি সম্ভব হয় তবে সাদ্দামের মূর্তিটি আমি আবার তৈরি করতে চাই এবং ফিরদাউস স্কয়ারে সেটিকে ফিরিয়ে আনতে চাই।

আগামী পর্বে ইরাক-ইরান যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

ফিচার ইমেজ: alaraby.co.uk

Related Articles