Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একনায়ক সাদ্দাম হুসাইনের উত্থান

ইরাকের সাবেক একনায়ক সাদ্দাম হুসাইন। টানা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরাকের শাসক ছিলেন। তার শাসনামলে ইরাকের এক শ্রেণির মানুষ যেমন সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা লাভ করেছিল অন্যদিকে আরেক শ্রেণির মানুষ ভীষণ অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুমের শিকার হয়েছিল। ২০০৩ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী ইরাক আক্রমণ করে এবং সে বছরের ডিসেম্বরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই নিন্দিত ও নন্দিত একনায়কের উত্থান কাহিনী নিয়ে আজকের আলোচনা। 

১৯৩৭ সালে সাদ্দাম হুসাইনের জন্মের কয়েক মাস আগে তার বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কয়েক মাস পর তার বড় ভাই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তার মায়ের পক্ষে এরকম দুটি ধাক্কা সামলানো কঠিন ছিল। তীব্র বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন তার মা। জন্মের পর সাদ্দামের লালন পালন করা তার পক্ষে বেশ কঠিন ছিল। তাই তাকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

৩ বছর বয়সে সাদ্দামকে বাগদাদে তার চাচার কাছে পাঠানো হয়। সেখানেই তিনি বড় হতে থাকেন। পরে তিনি ফিরে আসেন মায়ের কাছে। কিন্তু ততদিনে মা পুনরায় বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করেছেন। সৎ পিতার হাতে নিগৃহীত হয়ে সাদ্দাম পালিয়ে আসেন চাচার কাছে। চাচা খাইরাল্লাহ তালফা ছিলেন একজন সুন্নি মুসলমান এবং উগ্র আরব জাতীয়তাবাদী। তার রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা তরুণ সাদ্দামকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল।

তারুণ বয়সে সাদ্দাম হুসাইন; Image Source: Pinterest

চাচার সান্নিধ্যে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। ১৯৫৭ সালে ২০ বছর বয়সে ল স্কুলের পড়া ছেড়ে দেন এবং তার চাচার সমর্থিত বাথ পার্টিতে যোগ দেন। আদর্শগত দিক থেকে এই পার্টির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে আরব দেশগুলোর একত্রীকরণ।

তৎকালীন ইরাকি প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্দ আল-কারিম কাশিম। ইরাকি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তার আঁতাত এবং আরো কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাথ পার্টির সাথে তার বেশ টানাপোড়েন চলছিল। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৫৯ সালে সাদ্দাম হুসাইন এবং বাথ পার্টির কিছু সদস্য মিলে প্রেসিডেন্ট কাশিমকে হত্যার চেষ্টা করে।

তাদের পরিকল্পনা ছিল ‘আল-রশিদ’ স্ট্রিটে কাশিমের গাড়িতে হামলা চালাবে। গাড়ির পেছনের সিটে যারা থাকবে তাদেরকে গুলি করবে একজন এবং বাকিরা গুলি করবে গাড়ির সামনের সিট লক্ষ্য করে। সবকিছু ঠিকমতোই এগোচ্ছিল। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো মূল জায়গায়। পরিকল্পনা না করে সাদ্দাম অপরিপক্কের মতো গুলি ছুঁড়তে থাকেন। 

কিছুক্ষণ গুলি করার পর যখন চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেল তখন তারা ধরে নিয়েছিল গাড়ির ভেতরের সবাই মারা গেছে। নিশ্চিত না হয়েই তারা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। হাতে এবং কাঁধে গুলিবিদ্ধ হলেও প্রেসিডেন্ট এ যাত্রায় বেঁচে যান। তবে প্রাণ হারান তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক। সাদ্দাম নিজেও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।

অপারেশনে অংশ নেওয়া কয়েকজন গ্রেফতার হয়। তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু নানা কারণে এই দণ্ড কার্যকর করা হয়নি। সাদ্দাম তার কিছু সঙ্গী-সাথী নিয়ে কোনোভাবে সিরিয়া পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেখান থেকে ১৯৬০ সালে মিশরে চলে যান এবং ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন। এই সময়টিতে তিনি আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন।

যদিও তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়, কিন্তু সাদ্দামের ভয়ঙ্কর রণমূর্তি এবং লড়াকু মনোভাব দীর্ঘদিন ইরাকি জনগণ ভুলতে পারেনি।

১৯৬৩ সালে ইরাকি আর্মির সমর্থনে বাথ পার্টি ‘রামাদান বিদ্রোহের’ মাধ্যমে কাশিমের সরকারকে উৎখাত করে। বাথ পার্টির নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় আব্দুল সালাম আরিফ। তবে তিনি বাথ পার্টির সদস্য ছিলেন না। এ সময় সাদ্দাম আবার দেশে ফিরে আসেন এবং সরকারের অধীনে অপেক্ষাকৃত ছোট দায়িত্বে নিয়োজিত হন এবং দক্ষতার পরিচয় দেন।

১৯৬৩ সালের রামাদান বিদ্রোহের পর আব্দ আল কারিম কাশিমের মৃতদেহ (বামে); Image Source: vanityfair.it

নবগঠিত সরকার পার্টির অনুকূলে হলেও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কূল কিনারা করতে পারছিল না। ফলে সরকারের কর্মকাণ্ড ব্যহত হচ্ছিল। এ দ্বন্দ্বের জের ধরে ১৯৬৩ সালে পার্টির অন্যতম প্রধান নেতা আলী সালিহ আল-সাদি সহ বারো জনকে অস্ত্রের মুখে মাদ্রিদে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানে বসেই সাদি শুনতে পান, ইরাকের বাথ পার্টিতে ১৫ জনের নতুন কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। সেই কাউন্সিলের প্রধান নিযুক্ত হয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আহমেদ হাসান আল-বকর। বাগদাদ রেডিওতে এই ঘোষণা প্রচারের পর আল-সাদির হাজার হাজার সমর্থক রাস্তায় নেমে আসে। তবে আল-বকরের বাহিনী পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। পরদিন আল-সাদি ঘোষণা দেন, তিনি সিরিয়ান বাথ পার্টির সমর্থকদের নিয়ে ইরাকে ফিরে আসবেন।

তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দুল সালাম আরিফ (করমর্দনরত); Image Source: Twitter

পরিস্থিতি তখন উত্তপ্ত। সবাই অজানা আতঙ্কে ভীত। এরূপ পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নেন প্রেসিডেন্ট আরিফ।  ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে তিনি বাথ পার্টিকে সরকার থেকে বহিষ্কার করেন। বাথ পার্টির ১২ জন সদস্যকে সরকার থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। বিলুপ্ত করা হয় পার্টির মিলিশিয়া বাহিনী। বোমা ফেলা হয় বাহিনীর সদরদপ্তরে। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া হয় আল বকরকে। এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে মাদ্রিদ থেকে আর ফেরার সু্যোগ হয়নি আল-সাদির। নির্বাসিতই থেকে যান তিনি।

পার্টির এরকম দুরাবস্থায় অবস্থায় শক্ত হাতে হাল ধরেন হাসান আল-বকর। দলকে পুনরায় সংগঠিত করেন তিনি। দলে তার শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আল-বকরের সাথে সাথে সাদ্দামের শক্তিও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কারণ ততদিনে সাদ্দাম নিজেকে আল বকরের একজন বিশ্বস্ত সহযোগীতে পরিণত করেছেন। আল বকর নিয়মিত সাদ্দামকে গুরুতপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিতেন এবং সাদ্দাম সেগুলো দক্ষতার সাথে পালন করতেন।

১৯৬৪ সালে বাথ পার্টি সরকারকে উৎখাত করার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। অভ্যুথান ব্যর্থ হলে  আল বকর এবং সাদ্দামকে জেলে যেতে হয়। দুই বছরের দণ্ড হয় তাদের। ১৯৬৬ সালে সাদ্দাম জেল থেকে মুক্তি পেলে আল বকর তাকে ইরাকের বাথ পার্টির ডেপুটি সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন। এই পদে থাকাকালে সাদ্দাম সংগঠক হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেন এবং দলকে আরো সুসংগঠিত করেন।

১৯৬৮ সালে বাথ পার্টি আরো একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। সাদ্দাম এবং সালাহ ওমর আল-আলী সামনে থেকে এর নেতৃত্ব দেন। যদিও এর প্রধান ছিলেন আহমেদ হাসান আল-বকর। তবে এবার আর ১৯৬৪ সালের মতো ব্যর্থতা নয় বরং ভালোভাবে সফল হয় তারা। আরিফ সরকারের পতন ঘটে। আরিফ লন্ডনে পালিয়ে যান। সেখান থেকে চলে যান তুরস্কে। পুনরায় ক্ষমতায় আসে বাথ পার্টি। নতুন সরকারের প্রেসিডেন্ট হলেন আল-বকর এবং সাদ্দাম হলেন তার ডেপুটি।

প্রেসিডেন্ট আহমেদ হাসান আল-বকর (ডানে) এবং সাদ্দাম হুসাইন (বামে); Image Source: The Japan Times

১৯৬৮ সালে যখন বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে তখন ইরাক নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা ছিল প্রবল। জাতিগতভাবে সমগ্র ইরাক ছিল বিভক্ত। সুন্নি-শিয়া, আরব-কুর্দি বিরোধ ছিল চরমে। এরকম পরিস্থিতিতে সাদ্দাম প্রথমেই মনোনিবেশ করলেন দেশের স্থিতি আনয়নে। একইসাথে জোর দিলেন নিরাপত্তার দিকে। পুনরায় যেন আর কোনো অভ্যুথান ঘটতে না পারে সেজন্য সেনাবাহিনী এবং দলের মধ্যে চালানো হলো শুদ্ধি অভিযান। 

সাদ্দাম হুসাইন এবং কুর্দিস্তানি ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা মুস্তফা আল-বারজানি (২০ মার্চ ১৯৭০); Image Source: BBC

সাদ্দামের পৃষ্ঠোপোষকতায় নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং সবার জন্য বিনা খরচে আবশ্যিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। জীবনযাত্রার মান উন্ননের দিকে মনোনিবেশ করা হয়। কয়েক বছরের মধ্যে হাজার হাজার ছাত্র শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। সবার জন্য বিনা খরচে চিকিৎসা সেবা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কৃষিতে প্রচুর ভর্তুকি দেওয়া হয়।

১৯৭৩ সালের দিকে তেলের দাম বেড়ে গেলে সাদ্দাম ইরাককে তেলভিত্তিক অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তোলেন। দেশের আয় বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ফলে অবকাঠামোগত দিকে নজর দেওয়া সহজ হয়। সাদ্দামের পৃষ্ঠপোষকতায় বড় বড় দালান, বড় বড় কল-কারখানা,  নতুন নতুন রাস্তা-ঘাট গড়ে উঠতে থাকে। হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসে আরো উন্নত জীবন-যাপনের আশায়। কয়েক বছর আগের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কাটিয়ে ইরাকি জনমনে তখন নতুন ভোরের স্বপ্ন। 

১৯৭৪ সালে ভারত সফরে ইন্দীরা গান্ধীর সাথে সাদ্দাম হুসাইন; Image Source: Pinterest

১৯৭৬ সালে সাদ্দাম ইরাকি আর্মড ফোর্সের জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ধীরে ধীরে নিজেকে সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত করেন। এ সময় প্রেসিডেন্ট আল-বকর বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে পড়েন। সেই সুযোগে সাদ্দাম সরকারের মুখপাত্র হিসেবে দেশে এবং বিদেশে পরিচিতি লাভ করেন। ধীরে ধীরে সাদ্দাম হয়ে ওঠেন দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আল বকর তখন শুধু নামেমাত্র প্রধান। সাদ্দাম এ সময় দলের মধ্যে নিজের সমর্থন আরো বাড়াতে থাকেন এবং নিজের একটি শক্তিশালী সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তোলেন।

প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসাইন; Image Source: The Yale Reviews of International Studies

১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট আল-বকর সিরিয়া এবং ইরাককে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত নেন। এ লক্ষ্যে তিনি সিরিয়ার সাথে আলোচনা করতে থাকেন। এই একত্রীকরণ সংঘটিত হলে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদ হতেন সমগ্র রাষ্ট্রের ডেপুটি এবং আল-বকর হতেন প্রেসিডেন্ট। এমনটা হলে সাদ্দামের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব হয়ে যেত। তাই তিনি নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।

বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট আল বকরকে ক্ষমতা ছাড়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন এবং নানাবিধ ভয় ভীতি দেখাতে থাকেন। একসময় প্রেসিডেন্ট নতি স্বীকার করেন এবং ১৯৭৯ সালের ১৬ জুলাই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেন। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন সাদ্দাম হুসাইন আব্দ আল-মাজিদ আল-তিকরিতি। ইরাক তখন তার পদতলে। তিনিই তখন ইরাকের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

এ সর্বময় ক্ষমতা তিনি কীভাবে ব্যবহার করেছিলেন? এক মহান নেতা নাকি কুখ্যাত একনায়ক, কি হিসেবে ইতিহাস মনে রাখবে তাকে? ইরাকি জনগণই বা কীভাবে পেয়েছিল তাকে? এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে আগামী পর্বে।   

ফিচার ইমেজ- Pinterest

Related Articles