Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সালমান শাহ: অকালে ঝরে যাওয়া নক্ষত্র

‘আমি আর বাঁচতে চাই না। সালমান শাহ যেভাবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, আমিও সেভাবে বিদায় নিলাম’। এই চিরকুটটি হাতে নিয়ে গলায় ওড়না জড়িয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে সালমানভক্ত নবম শ্রেণীর ছাত্রী লিপি রানি সাহা (১৫)। ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল শনিবার রাত আটটায় শহরের পাতিলবাড়ি রোড গ্রামে। মৃত্যুর সময় লিপির বুকে সালমান শাহ’র একটি ছবি ও হাতে ঐ চিরকুটটি ছিলো। লিপি নরসিংদী উচ্চ বালিকা বিদ্যানিকেতনের ছাত্রী।

এদিকে চিত্রনায়ক সালমানের মৃত্যু সংবাদে গতকাল শনিবার দুপুরে ঈশ্বরদীতে দুলু খাতুন (১৩) নামের এক স্কুলছাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আধঘন্টা পরে তার জ্ঞান ফেরে।

ভোরের কাগজ
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬

এটা তো মাত্র একটা সংবাদ। এরকম অসংখ্য আত্মহত্যা ও অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সংবাদ প্রকাশ হয়েছিলো বিভিন্ন পত্রিকায় ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পর। আত্মহত্যা কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু কাউকে কত বেশি পরিমাণে ভালোবাসলে মানুষ অপরিচিত, অচেনা কোনো মানুষের মৃত্যু-সংবাদ শুনে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এটা ভাবলেই অবাক হতে হয়। শুধু তা-ই নয়, এতো বছর আগে যে মানুষটি না ফেরার দেশে চলে গেলেন, এখনও তাকে নিয়ে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়া আর সাধারণ মানুষ কতটা মাতামাতি করেন, কতটা কষ্ট পান তার অকাল মৃত্যুতে সেটা দেখলেই কেবল বোঝা যায় সালমান শাহ নামক মহাতারকার মৃত্যুতে এই দেশ আসলে কী হারিয়েছে!

১৯৯২ সালের কথা। তৎকালীন খ্যাতনামা এক প্রযোজনা সংস্থা ভারত থেকে বলিউডের তিনটি সিনেমার পেটেন্ট কিনে আনে ঢালিউডে রিমেক করার জন্য। সেখান থেকে একটি সিনেমা বানানোর দায়িত্ব পড়ে গুণী পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের হাতে। কিন্তু তিনি তখনকার কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর ওপর ভরসা না করতে পেরে নতুন মুখের সন্ধান করতে থাকেন। এর মধ্যে নায়িকা হিসেবে নবাগত মৌসুমীকে পেয়ে যান। নায়ক নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। অনেককে দেখলেও পছন্দ হচ্ছিল না কাউকেই। আবার রিমেক সিনেমা হওয়ায় ফিরিয়েও দিচ্ছিল কেউ কেউ।

একদিন দেখেন ইমন নামের একটি ছেলেকে, যার পুরো নাম চৌধুরী মোহাম্মদ সালমান শাহরিয়ার। দেখেই পছন্দ হয়ে যায় তার। নায়ককে প্রথমে ‘সনম বেওয়াফা’র রিমেক করার প্রস্তাব দিলেও তিনি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ সিনেমাটি পছন্দ করেন। তিনি জানান, সিনেমাটি তার ছাব্বিশবার দেখা হয়ে গেছে। পরিচালক সোহান তার সম্মতিতেই সিদ্ধান্ত নেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমাটি বানানোর। ১৯৯৩ সালের ২৫শে মার্চ মুক্তি পায় ছবিটি। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। দারুণ জনপ্রিয় হয় চলচ্চিত্রটি। চারদিকে হইচই পড়ে যায় সালমান শাহকে নিয়ে। একের পর এক চলচ্চিত্র উপহার দিতে থাকেন তিনি।

মোট ২৭টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো তার। দুয়েকটা বাদে যার সবগুলোই ছিলো সুপার হিট। অভিনয় দক্ষতা, সংলাপে সাবলীলতা, সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়া স্টাইল, ফ্যাশন দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে যিনি আসন গেড়ে বসেছিলেন, ক্রমেই বাংলা সিনেমাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন নতুন উচ্চতায়। একঘেয়ে অভিনয় আর স্টাইল দেখতে দেখতে ক্লান্ত দর্শকদের সামনে তিনি হয়ে আসেন নতুনের আবাহন হিসেবে। তার রোমান্টিক, মেলোড্রামা, ফ্যামিলি ড্রামা, অ্যাকশন, প্রতিবাদ সব চরিত্রেই ছিলো নতুত্বের স্বাদ। তার কাউবয় হ্যাট, গগলস, লং কোটে ডিটেকটিভ লুক, হুডি শার্ট, ব্যাক ব্রাশ করা চুল, কানে দুল, ফেড জিন্স, মাথার স্কার্ফ, ফ্যাশন সেন্স- সবকিছু মিলিয়ে এক অদেখা জোনের মধ্যে দর্শকেরা পড়ে গিয়েছিলো। ফলে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন তারুণ্যের স্টাইল আইকন।

তারুণ্যের স্টাইল আইকন বলতে এখনও সালমান শাহকে বোঝানো হয়; Image Source: sonalinews.com

২৭টি সিনেমার মধ্যে ১৪টিতেই জুটি বেঁধে অভিনয় করেছিলেন নায়িকা শাবনুরের সাথে। কবরী-রাজ্জাক জুটির পর সালমান-শাবনুর জুটিটাই এদেশের দর্শকদের পছন্দের শীর্ষে এখনও রয়ে গেছে। শাবনুর ছাড়াও মৌসুমী, শাহনাজ, লিমা, কাঞ্চি, শাবনাজ, বৃষ্টিসহ কয়েকজন নায়িকার সাথে জুটি বেঁধেছেন। রোমান্টিক ও মেলোড্রামায় বেশি কাজ কারলেও তার চরিত্রগুলোতে বৈচিত্র ছিলো দেখার মতো। কখনও ছাত্রনেতা, কখনও প্রতিবাদী যুবক, কখনও গ্রামের ছেলে, কখনও প্রেমের জন্য ঘরছাড়া তরুণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

সালমানের সিনেমায় শুধু অভিনয় আর ফ্যাশন নয়, গানও ছিলো আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তার প্রতিটি সিনেমাই ছিলো দারুণ সব গানে ভরপুর। অনেক গানই কালজয়ীতে রূপ নিয়েছে ইতিমধ্যেই। তরুণ শিল্পীরা এখন চলচ্চিত্রের গান গাইতে গেলেই সালমান অভিনীত সিনেমার গানগুলোই বেশি গেয়ে থাকেন। সালমান শাহ কতটা জনপ্রিয় সেটা এই সময়ের অভিনেতাদের জিজ্ঞেস করলেই বোঝা যায়। বাংলা চলচ্চিত্রে এখন যারা কাজ করছেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা সবাই বলেন সালমান তাদের আইডল, তাকেই অনুসরণ করেন তারা।

সালমানের মধ্যে কী এমন ছিলো যার জন্য তাকে আইডল হিসেবে দেখে সবাই? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় সালমানের সিনেমাগুলোতে। অনেকে সালমানকে শুধু স্টাইল আইকন হিসেবেই বিবেচনা করেন। অথচ তার সহজাত অভিনয় দক্ষতা ও চরিত্রের ভেতরে ঢুকে গিয়ে একদম চরিত্রে মিশে যাওয়ার গুণটা ছিলো প্রবল। তার প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত যারা দেখেছেন, তারা খেয়াল করে থাকবেন যে সেখানে সালমান এতটাই সপ্রতিভ ও সহজাত ছিলেন যে কারও মনে হওয়ার উপায় ছিলো না ওটাই ছিলো তার প্রথম চলচ্চিত্র। অনেক বড় বড় অভিনেতার প্রথম সিনেমায় জড়তা থাকে, দেখলেই বোঝা যায় নতুন এসেছেন। কিন্তু সালমান শাহ কোনো জড়তা ছাড়া অভিনয় করে গেছেন প্রথম সিনেমাতেই।

আবার, বিক্ষোভ সিনেমায় তাকে একজন ছাত্রনেতা হিসেবে দেখা যায়। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যিনি দেশপ্রেমের চেতনায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে থাকেন। পুরো ছবিতেই তার উপস্থিতি ও অভিনয় দক্ষতা ছিলো প্রশংসিত। ওদিকে সত্যের মৃত্যু নেই সিনেমায় তিনি সমাজের একজন প্রতিবাদী যুবকের চরিত্রে দারুণ নান্দনিক অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। মায়ের চিঠি হাতে জেলখানায় আব্দুল মান্নান রানার গাওয়া তার ঠোঁটে ‘চিঠি এলো জেলখানাতে’ গানটি দেখে সে সময় কাঁদেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বিচার হবে, সুজন-সখী সিনেমায় গ্রামের ছেলে হিসেবেও ছিলেন বেশ সাবলীল। অসাধারণভাবে গ্রামীণ ভাষায় সংলাপ বলার ধরন দেখে কেউ বুঝতে পারবে না শহরের একজন স্মার্ট ও সুদর্শন মানুষ ছিলেন তিনি।

আর রোমান্টিক সিনেমার কথা কী বলবো। এটা তো তার অভিনয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী জোনই ছিলো বলা যায়। সালমান-শাবনুর কিংবা সালমান-মৌসুমীর রোমান্স দেখে হৃদয়ে প্রেম জাগেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ছিলো মুশকিল। মোটকথা, একজন ভার্সেটাইল অভিনেতা বলতে যা বোঝায় সালমান শাহ ছিলেন তেমনই একজন। হয়তো অফ ট্র‍্যাকের সিনেমা করেননি, হয়তো একসময় করতেন। কিন্তু চার বছরের ছোট্ট ফিল্ম ক্যারিয়ারে যা করে গেছেন, সাথে যেসব নাটকে অভিনয় করে গেছেন সেগুলোই তাকে চির অমর অভিনেতার সম্মানে ভূষিত করার জন্য যথেষ্ট।

সালমা-শাবনুর জুটি বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা জুটি হিসেবে বিবেচিত; Image Source: bd-journal.com

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিলো শুক্রবার। শুক্রবারে বিটিভিতে তখন বাংলা সিনেমা দেখার জন্য সবাই বসে থাকত। বাংলা সিনেমার মাঝখানেই বিকেল পাঁচটার খবরে সংবাদ পাঠকের কণ্ঠে ভেসে এলো দুঃসংবাদটা। প্রিয় নায়ক সালমান শাহ আর নেই। আকাশ ভেঙে পড়ল চলচ্চিত্রপ্রেমী প্রতিটি মানুষের মাথায়। এ কীভাবে হতে পারে? সালমান কীভাবে এভাবে চলে যেতে পারেন! অনেকে বিশ্বাস করছিলো না, অনেকে গুজব বলে উড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু যা ঘটে গেছে সেটা কোনো গুজব ছিলো না, ছিলো সত্য। অনেক নিষ্ঠুর সত্য। সেদিন আনুমানিক সকাল ১১টায়ই তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।

মৃত্যুর পর সালমানের বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরী রমনা থানায় অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন। ময়নাতদন্ত শেষে রিপোর্ট আসে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু হয়েছে তার। কিন্তু সালমানের মা-বাবা দুজনেই রিপোর্টে সন্দেহ প্রকাশ করে নারাজি জানান। ফলে বিচারক তার লাশ কবর থেকে তুলে আবারও ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন। সিলেটের ওসমানি মেডিকেলের ময়না তদন্তকারী ডাক্তার ‘কৌশলগত কারণে’ তখন ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। ফলে সন্দেহটা গাঢ় হয়।

সালমানের বাবা-মায়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের হাত থেকে সিআইডির হাতে যায়। সিআইডি তদন্ত করাকালীন হঠাৎ করেই আবার মামলাটি সিআইডি থেকে গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তরিত হয়। গোয়েন্দা পুলিশ এটাকে আত্মহত্যা উল্লেখ করে চার্জশিট দিলে সেটা প্রত্যাখ্যান করে সিলেটে সংবাদ সম্মেলন করেন সালমানের বাবা-মা। মামলার বাদী সালমানের বাবা মারা যান ২০০২ সালে। এরপর থেকে মা নীলা চৌধুরী মামলাটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

বারবার পুলিশ ‘দায়সারাভাবে’ রিপোর্ট দিয়ে গেছে, বারবার নীলা চৌধুরী তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবশেষে ২০১৭ সালে মামলাটি পুলিশের নতুন গোয়েন্দা সংস্থা পিবিআই তথা পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরমধ্যেই আসে তোলপাড় করা এক খবর। ২০১৭ সালের ৭আগস্ট একসময়ের সালমান শাহর প্রতিবেশী ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রাবেয়া সুলতানা রুবি এক ফেসবুক লাইভে দাবি করেন সালমান শাহকে খুন করা হয়েছে, তিনি আত্মহত্যা করেননি। তার স্বামী টাকার বিনিময়ে কাজটা করেছেন বলেও দাবি করেন। সালমান মৃত্যুরহস্যে যোগ হয় নতুন মাত্রা। কিন্তু দুদিন পরই তিনি আবার লাইভে গিয়ে অনেক অসংলগ্ন কথা বলে দায় এড়ান। এরপর পিবিআই তদন্ত করে যাচ্ছে এখনও। বারবার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার তারিখ ঘোষণা করে আবারও পেছানো হচ্ছে।

স্ত্রী সামিরার সাথে সালমান; Image Source: dailystar.net

সালমান শাহর বাবা-মায়ের মতো বহু ভক্ত বিশ্বাস করেন না তিনি আত্মহত্যা করেছেন। সালমানের মৃত্যুর পর মৃত্যুশোক সইতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা করেছে, অনেকে অসুস্থ হয়ে গেছেন। এখনও বহু ভক্ত সিলেটে হযরত শাহজালালের (রহ) মাজারে তার কবরে গিয়ে নীরবে অশ্রু ফেলেন, এখনও অনেকে তার ‘হত্যাকারীদের’ শাস্তি দাবিতে রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করেন। তারা বিশ্বাস করতে পারেন না তাদের প্রিয় নায়ক নিজেই নিজের জীবন শেষ করে দেবেন। কারণ মৃত্যুর মাত্র ক’দিন আগে মৃত্যু নিয়ে সালমান শাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এখনই এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নই, কাম্যও নয়। শুধু আমার নয়, কারও ভাগ্যে যেন বিধাতা অকাল মৃত্যু না লিখেন।’ বাঁচার জন্য এমনই যার আকুতি, তিনি কেন আত্মহত্যা করবেন এই প্রশ্নের উত্তরই ভক্তরা খুঁজে পান না!

সালমান শাহর জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর সিলেট নগরীর দাড়িয়াপাড়ায়। বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, মা নীলা চৌধুরী করতেন রাজনীতি, একাধিকবার সংসদ নির্বাচনও করেছেন। একমাত্র ছোট ভাইয়ের নাম চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরান (ইভান)।

সালমান পড়াশোনা করেন খুলনার বয়রা মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে। একই স্কুলে তার প্রথম ছবির নায়িকা মৌসুমীও তার সহপাঠী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ঢাকার ধানমণ্ডি আরব মিশন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি ও ধানমণ্ডির ড. মালেকা সায়েন্স কলেজ থেকে বি.কম পাস করেন। ১২ই আগস্ট ১৯৯২ সালে তিনি তার খালার বান্ধবীর মেয়ে সামিরা হককে বিয়ে করেন। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরার মেয়ে সামিরা ছিলেন একজন বিউটি পার্লার ব্যবসায়ী। তিনি সালমানের ২টি চলচ্চিত্রে তার পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করেন এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্রের তার স্টাইল ও ফ্যাশন নিয়ে পরামর্শ দেন বলে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সালমান নিজেই।

বলিউডের কিং খান খ্যাত শাহরুখ খানের আমন্ত্রণে মুম্বাইয়ে সস্ত্রীক সালমান; Image Source: bmdb.com.bd

সালমান শাহর অভিনয় জীবন শুরু হয় বিটিভিতে, ১৯৮৫ সালে। হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় ‘কথার কথা’ নামক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হতো তখন। সে অনুষ্ঠানের একটি গানে মাদকাসক্ত এক তরুণের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। যে গানটি গেয়েছিলেন স্বয়ং হানিফ সংকেত। ১৯৮৫ সালে বিটিভির আকাশ ছোঁয়া নাটকের মাধ্যমে তার অভিষেক হয় টিভি নাটকে। এরপর পরে দেয়াল (১৯৮৫), সব পাখি ঘরে ফিরে (১৯৮৫), সৈকতে সারস (১৯৮৮), নয়ন (১৯৯৫), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬) নাটকেও অভিনয় করেন। ‘নয়ন’ নাটকটি সে বছর শ্রেষ্ঠ একক নাটক হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া তিনি ১৯৯০ সালে মঈনুল আহসান সাবের রচিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘পাথর সময়’ ও ১৯৯৪ সালে ‘ইতিকথা’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেন। প্রেমযুদ্ধঋণশোধ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকও করেন তিনি। মিল্ক ভিটা, জাগুয়ার কেডস, ইস্পাহানি গোল্ড, স্টার টি, কোকাকোলা, ফানটাসহ কয়েকটি পণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয়ও করেছেন।

সালমানের মৃত্যুর পর অভাবনীয় কিছু বিষয় ঘটতে থাকে বাংলা চলচ্চিত্রে। তার শেষ করে যাওয়া সিনেমাগুলো ও অসমাপ্ত বেশিরভাগ সিনেমা জোড়াতালি দিয়ে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু সবগুলোই ব্যাপক আকারে ব্যবসা করে। তার সিনেমার সাফল্যের তোড়ে অনেক বড় বাজেটের সিনেমাগুলোও তখন বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। সালমানের সিনেমাই একটানা চলতে থাকে সকল হলে। প্রযোজক, পরিচালক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাই বুঝতে পারেন কী মূল্যবান সম্পদ হারালেন তারা। তার অভাবে সেই যে বাংলা চলচ্চিত্রে নামতে শুরু করল, আজ সেখানে একেবারে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। শত শত হল বন্ধ হয়ে গেছে এখন। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোও জরাজীর্ণ, নড়বড়ে। অথচ সালমান বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের চলচ্চিত্র আজ বলিউডের সাথেও টক্কর দিতে পারতো বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন।

সিলেটে হযরত শাহজালালের  (রহ)মাজার-প্রাঙ্গনে সালমান শাহর কবর, যেখানে নিয়মিতই অনেক ভক্ত গিয়ে জিয়ারত করে থাকেন, জানান প্রিয় নায়কের প্রতি শ্রদ্ধা; Image Source: sonalinews.com

সালমানের মৃত্যু-সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল দেশ ও বিদেশের নানা পত্রিকায়। বিবিসি, এমনকি বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনেও প্রকাশিত হয়েছিলো তার মৃত্যু-সংবাদ। ২৩শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয় সালমান শাহ ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা তারকা। ২৫ বছর বয়সী এই অভিনেতার মৃত্যুতে সারা দেশ কীভাবে শোকের ছায়ায় আচ্ছন্ন ও কয়েকজন তরুণীর আত্মহত্যার কথাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে। টাইম ম্যাগাজিন একটা ব্যাপার অবশ্য উল্লেখ করেনি যে, এই উপমহাদেশে অনেক তারকাই অকালে মারা গেছেন। কিন্তু আর কারও জন্যই এভাবে ভক্তরা নিজেদের আত্মাহুতি দিয়েছেন এটা বিরল ঘটনা।

ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটেছিল তার। মাত্র চারটি বছর ছিল তার অভিনয়জীবনের ব্যাপ্তি। কিন্তু এই চারটি বছরে যা করে গেছেন, রেখে গেছেন, মৃত্যুর তেইশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আজ তার শূন্যস্থানটা কেউ পূরণ করতে পারেনি। তার মানের না হোক, কাছাকাছি কেউও আজও বাংলা চলচ্চিত্রে আসেনি- এটাই আফসোসের। আজকের ধ্বসে যাওয়া বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে তার মতো কাউকেই প্রয়োজন, যে আবারও চলচ্চিত্রে একটা বিপ্লব ঘটাতে পারবে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে দেবে পুরো চলচ্চিত্রাঙ্গন।

নক্ষত্রেরও পতন হয়, সবার প্রিয় নায়ক সালমান শাহর পতনটা হয়তো এভাবে না হলেই ভালো হতো। কিন্তু মানুষের সব আশা তো পূরণ হয় না। ঢালিউডের ইতিহাসে অনেক নায়কই অতীতে অকালে মারা গেছেন। কিন্তু মৃত্যুর ২৩ বছর পরও এত জনপ্রিয়তা আর কোনো নায়কের আছে কী না তাতে সন্দেহ আছে যথেষ্ট। বাংলা সিনেমা যতদিন বেঁচে থাকবে, বেঁচে থাকবে সিনেমাপ্রেমীরা; ততদিন বেঁচে থাকবেন সালমান শাহও। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ পর্যন্ত আমাদের মতো সিনেমাপ্রেমীরা সালমান শাহকে ভালবেসে যাবে তা অকপটেই বলা যায়।

Related Articles