Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সালভাদর ডালি: যার তুলির আঁচড়ে কল্পনা জীবন্ত হতো ক্যানভাসে

ক্রিকেটে যিনি ভালো খেলেন তিনি ক্রিকেট মাঠের শিল্পী। যিনি ভালো ফুটবল খেলতে পারেন তাকে বলা হয় ফুটবল মাঠের শিল্পী। সেরা বক্সিং চ্যাম্পিয়নকে রিংয়ের শিল্পী বলতেও বাঁধা নেই। সর্বত্র শিল্প আর শিল্পীর ছড়াছড়ি। তবে এই শিল্পকর্মটা আসলে আসে কোথা থেকে জানেন? আপনার, আমার, প্রত্যেকের মনের চেতন আর অচেতন অংশের বাইরের অংশ, অবচেতন মন থেকেই শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের উদ্ভব হয়। কারণ বাস্তবতাকে আরো চরমতম রূপে প্রক্রিয়াজাত করে আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে একপ্রকার ছবি তৈরি হয় যা আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু তা বাস্তব। যদি বাস্তব বলায় আপনার একান্তই আপত্তি থাকে তাহলে কোনো সমস্যা নেই, আপনার জন্য আছে মানানসই শব্দ ‘পরাবাস্তব’। আজ সেই পরাবাস্তব জগতের শ্রেষ্ঠ শিল্পীকে নিয়েই আলোচনা করা হবে।

সালভাদর ডালি (১৯০৪-১৯৮৯); ছবিঃ Bio

‘দ্য মেটামরফোসিস অব নারসিসাস’ নামটি অবশ্যই আপনার পরিচিত পাঠক। একইসাথে এই চিত্রকর্মের স্রষ্টা সালভাদর ডালির কথাও জানা নিশ্চয়ই। তিনি চিত্র শিল্পের দুনিয়ায় ‘পরাবাস্তব চিত্রকর্ম’ নামে এক নতুন ধারা অনুপ্রাণিত করে গেছেন। সে ধারায় গাঁ ভাসিয়েছে হয়েছে কত শত শিল্পী তার হিসাব নেই। কিন্তু ডালি? তাকে তো সমসাময়িক সমালোচকদের বিরামহীন সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। যতটা না তার উদ্ভট চিত্রকর্মের জন্য, তার চেয়ে বেশি তার অদ্ভুত, রহস্যময় স্বভাবের জন্য। কিন্তু সবকিছু তিনি হাস্যরসের দ্বারা উপেক্ষা করে কেবল ডুবে ছিলেন রঙ, তুলি আর ক্যানভাসে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীদের একজন এই সালভাদর ডালি ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রেনেসাঁর সময়কালীন চিন্তাচেতনা ও শৈল্পিক রুচি থেকে।

স্পেনের ফিগুয়েরেস গ্রাম, ফ্রান্সের সীমানা থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। সে গ্রামেই বসবাস করতেন একজন অতিমাত্রায় নিয়মতান্ত্রিক মধ্যবিত্ত আইনজীবী সালভাদর ডালি কুজি। অন্যদিকে তার স্ত্রী ডমেনেখ ফেরিস নিয়মতান্ত্রিকতার ধার ধারতেন না। আর এই দুই বিপরীত মেরুতে বসবাস করা দম্পতির ঘরে ১৯০৪ সালের ১১ মে জন্ম নেয় তাদের বৈপরিত্যের মাত্রা ছাড়িয়ে আরো এক ধাপ উপরে উঠে যাওয়া সালভাদর ডালি! এই মাত্রা ছাড়ানোটা সম্ভবত পিতা-মাতার বৈপরীত্যের কারণেই হয়েছিল। একদিকে সালভাদর কুজি চাইতেন ছেলেকে কঠোর নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে বড় করবেন, অন্যদিকে ফেরিস ছেলেকে অবাধ স্বাধীনতা দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। ফলে পিতামাতার মানসিক দ্বন্দ্বের অবশ্যম্ভাবী প্রভাব গিয়ে পড়ে ডালির শৈশবের উপর। অবশ্য কুজি ও ফেরিসের মধ্যে দাম্পত্য কলহ খুব একটা হতো না।

শৈশব থেকেই সালভাদর ডালি ছিলেন অতিমাত্রায় মেধাবী, তবে আক্রমণাত্মক। ফলে স্কুলে কারো সাথেই সদ্ভাব গড়ে ওঠেনি তার। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়লে প্রায়ই তাকে সহ্য করতে হতো সিনিয়র শিক্ষার্থীদের অপমান। অন্যদিকে বাসায় ডালির বাবাও তাকে তার অদ্ভুত আচরণ ও নিয়মানুবর্তী না হওয়ার জন্য নিয়ম করে কঠোর শাস্তি দিতেন! একদিকে স্কুলে, অন্যদিকে বাসায়- সর্বত্র প্রতিকূলতার শিকার হয়ে ডালি ক্রমশ খিটমিটে স্বভাবেরও হয়ে উঠছিলেন। কৈশোরে পিতার সাথে সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত হয়ে ওঠে ডালির। পিতা-পুত্র উভয়েই তখন ফেরিসের আনুকূল্যের জন্য একে অপরের সম্পর্কে কুৎসা রটনা করতেন তার কাছে!

পরিবারের সাথে শিশু ডালি; ছবিঃ HowlingPixel

“আমরা যেন ঠিক দুটি স্বচ্ছ পানির বিন্দুর মতোই সদৃশ ছিলাম। কিন্তু আমাদের প্রতিবিম্ব ছিল ভিন্ন!”

কথাগুলো ডালি বলেছিলেন তার ঠিক ন’মাসের বড় ভাই সালভাদরের সম্পর্কে, যিনি শৈশবে মারা যান। ডালির পিতামাতা ডালিকে প্রায়ই তার বড় ভাইয়ের কবরের পাশে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, “তোমার মাঝে তোমার ভাই পুনর্জন্ম লাভ করেছে।” আনা মারিয়া, ডালির ছোট বোনই ছিল তার শৈশবের একমাত্র খেলার সঙ্গী। প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশের পূর্বেই ডালি অসাধারণ সব চিত্রকর্ম আঁকতে শুরু করেন। এখানে তার পিতামাতার মতামত মিলেছিল এক বিন্দুতে। উভয়েই ডালিকে আঁকাআঁকির জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। যখনো ডালি স্কুলেই ভর্তি হননি, তখনই তার ছিল একটি নিজস্ব স্টুডিও যা তার বাবা-মা তাকে তৈরি করে দিয়েছিল।

সালভাদর ডালি প্রচুর পরিমাণে দিবাস্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন! তিনি এই স্বপ্নকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন এবং কোনো কারণে তার স্বপ্ন ভেঙে গেলে তিনি রাগে আগুন হয়ে যেতেন। তবে এই স্বভাবের জন্য স্কুলজীবনে যথেষ্ট সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে ডালিকে। ১৯১৬ সালে একটি আর্ট স্কুলে ভর্তি হবার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রকর্ম শেখা শুরু হয় ডালির। তবে এক বছরের মধ্যেই তিনি ক্লাসের সবচেয়ে ‘অমনোযোগী’ ও ‘অকর্মণ্য’ শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিত হলেন। ১৯১৯ সালে প্রথমবারের মতো ডালির একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ফিগুয়েরেস মিউনিসিপ্যালিটি থিয়েটারে। তবে এই প্রদর্শনীর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১৯১৭ সালের একক প্রদর্শনী যা কেবল পারিবারিক পরিসরে করা হয়েছিল। আক্ষরিক অর্থে সেটিই ছিল ডালির প্রথম প্রদর্শনী যা তাকে দিয়েছিল অশেষ অনুপ্রেরণা। অন্যদিকে মিউনিসিপ্যালিটি থিয়েটারের প্রদর্শনীটি হয়েছিল ডালির বাবার সহায়তায়। এতে করে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক অনেকটা উষ্ণ হয়। কিন্তু ১৯২১ সালে ফেরিস মারা গেলে সালভাদর কুজি ফেরিসের ছোট বোনকে বিয়ে করেন। আর এই ঘটনার পর কুজির সাথে তার পুত্র ডালির সম্পর্ক আর কোনোদিন ভালো হয়নি।

১৯২২ সালে ফিগুয়েরেস ছেড়ে মাদ্রিদ চলে আসেন ডালি। সেখানে ‘আকাডেমিয়া ডি সান ফার্নান্ডো’ আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় তিনি মেটাফিজিক্যাল এবং কিউবিজম চিত্রকর্মের উপর আকৃষ্ট হন। অন্যদিকে চালচলনে আনেন অস্বাভাবিক পরিবর্তন। বড়বড় চুলের সাথে তিনি লম্বা জুলফি রাখা শুরু করেন। আর পোষাক পরতেন ইংরেজ ফুলবাবুদের আদলে। খুব অল্প দিনেই অদ্ভুত আচরণের জন্য পরিচিত হয়ে উঠলেন ডালি। এক বছরের মাথায় শিক্ষকদের সাথে বাদানুবাদ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর অভিযোগে তাকে একাডেমি থেকে বহিষ্কার করা হয়। মাঝে কাতালানিয়ার স্বাধীনতাবাদীদের সাথে আন্দোলন করে জেলে কাটান কিছুদিন। পরে ১৯২৬ সালে তিনি আবার একাডেমিতে ফিরে আসেন। কিন্তু এবারে বহিষ্কৃত হন চিরস্থায়ীভাবে। কারণ এবারের অভিযোগ আরো গুরুতর। তিনি যে তার পরীক্ষকদের বলেছিলেন, “অনুষদের কেউ আমার চিত্রকর্ম পরীক্ষা করার যোগ্যতা রাখে না!”

আকাডেমিয়া ডি সান ফার্নান্ডো; ছবিঃ commons.wikimedia.org

সালভাদর ডালি স্কুল জীবনেই ‘দাদা আন্দোলন’ দ্বারা প্রভাবিত হন। দাদা আন্দোলন হচ্ছে একটি শিল্প সাহিত্যিক আন্দোলন যা সুইজারল্যান্ডের জুরিখ থেকে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ডালির প্রায় সকল কাজেই দাদা আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিশোর বয়সেই তিনি রাফায়েল, ব্রোঞ্জিনো, ডিয়েগো ভাস্কেজের মতো ভুবনখ্যাত শিল্পীদের ক্লাসিক্যাল শিল্পচর্চা শুরু করেন। তার বিখ্যাত বক্রাকার গোঁফ তিনি ভাস্কেজকে অনুকরণ করেই রেখেছিলেন। ১৯২৬-২৯ সালের মধ্যে ডালি বেশ কয়েকবার প্যারিসে ভ্রমণ করেন এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পাবলো পিকাসো, জোয়ান মিরো, রেনে ম্যাগ্রিতির মতো বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের সাক্ষাৎ পেয়ে ডালি অভিভূত হন। তিনি পিকাসোকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। পিকাসোর সাথে সাক্ষাতের পরবর্তী কয়েক বছর ডালির আঁকা ছবিগুলোতে পিকাসোর প্রভাব খুব সহজেই বোঝা যেত।

ডালির চিত্রকর্মে তখনো পর্যন্ত তিনটি বিষয় লক্ষ্য করা যেত- মানুষের সংবেদনশীলতা, যৌনতার প্রতীক এবং আইডিওগ্রাফি। ১৯২৯ সাল থেকে মূলত তিনি পরাবাস্তব চিত্রকর্ম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। পরাবাস্তব ছবির জগতে ডালির সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তার ‘প্যারানয়িক ক্রিটিকাল মেথড’। এই পদ্ধতির সারমর্ম হচ্ছে একজন শিল্পী নিজেকে এমনরূপে মানসিকভাবে প্রস্তুত করবেন যে তিনি তার অবচেতন মনে ইচ্ছানুযায়ী প্রবেশ করতে পারবেন এবং নিজের শিল্পকর্মকে অবচেতন ভাবনা দিয়ে আরো উন্নত করতে পারবেন। সে বছরই ডালি প্রথমবারের মতো সিনেমা জগতে পদার্পন করেন। তিনি পরিচালক লুইস বুনুয়েলের সাথে দুটি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। অনেক বছর পর ডালি বিখ্যাত ব্রিটিশ পরিচালক আলফ্রেড হিচককের সাথে ‘স্পেলবাউন্ড’ ছবিতে কাজ করেন। সে ছবির একটি স্বপ্নের দৃশ্যে ডালির চিত্রকর্ম সেট ডিজাইনিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।

সালভাদর ডালি ও তার স্ত্রী গালা; ছবিঃ Bob’s Blog

১৯২৯ সালে ডালির জীবনে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। তার সাথে পরিচয় হয় বিখ্যাত পরাবাস্তববাদী লেখক পল ইলুয়ার্ডের স্ত্রী দিমিত্রিয়েভনা ডায়াকোনোভার বা সংক্ষেপে যিনি গালা নামে পরিচিত ছিলেন। এই গালার সাথে ডালির প্রণয় গড়ে ওঠে এবং গালা তার প্রথম স্বামী ইলুয়ার্ডকে ডিভোর্স দিয়ে ডালির কাছে চলে আসেন। ১৯৩৪ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বলা হয়ে থাকে, গালার কারণে সালভাদর ডালি প্রকৃত অর্থে সালভাদর ডালি হয়েছেন। গালা ছিলেন অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ী যার ভালোবাসা ডালির ভেতরের শিল্পীসত্ত্বাকে প্রবলভাবে জাগিয়ে তুলেছিল। অন্যদিকে খিটখিটে মেজাজের ডালি ব্যবসা বাণিজ্য খুব একটা ভালো বুঝতেন না। গালাই ডালির ব্যবসা পরিচালনা করেন এবং অর্থনৈতিকভাবে ডালিকে সচ্ছলতা প্রদান করেন।

পারসিসট্যান্স অব মেমোরি; ছবিঃ Bob’s Blog

১৯৩০ সালে নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ তো বটেই, ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরাবাস্তব ছবি ‘দ্য পারসিস্ট্যান্স অব মেমোরি’ প্রদর্শন করেন ডালি। ছবিটিতে ছোট বড় কিছু দেয়াল ঘড়ি, পকেট ঘড়ি কে গলন্ত অবস্থায় দেখা যায়। অথবা ঘড়ি গুলো ছিল নমনীয় যেগুলো শুকাবার জন্য গাছের ডালে নেড়ে দেয়া হয়েছে। ছবিটির শত শত অর্থ আজ পর্যন্ত তৈরি করেছেন বোদ্ধারা। তবে একটি সাধারণ অর্থ যা অধিকাংশের মনে চলে আসবে তা হচ্ছে কোনোকিছুই অপরিবর্তনীয় নয়। সবকিছুই নমনীয় এবং নশ্বর। তবে ছবিটি প্রাথমিকভাবে সমালোচকদের নিকট ডালির অতিরঞ্জিত ‘আদিখ্যেতাপূর্ণ’ আচরণের মতোই ছিল। তার চিত্রকর্ম এবং তার চলনবলন, তার লম্বা গোঁফ, মাথায় টুপি আর হাতে লাঠি, সব কিছুই কুখ্যাতি অর্জন করতে লাগলো। ১৯৩৪ সালে জুলিয়ান লেভি আমেরিকার নিউইয়র্কে একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে ডালিকে আমন্ত্রণ জানালে ব্যাপক সমালোচনা হয়। অনেকে প্রদর্শনী বর্জন করেছিল বলেও শোনা যায়!

ছবিঃ Webneel

ত্রিশের দশকের শুরুতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাওয়া বইতে শুরু করেছিল। তখন পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন বুনুয়েল, পিকাসো আর মিরোর মতো বিখ্যাত চিত্রশিল্পীরা। এই আন্দোলনের সকল সদস্যই হিটলারের ফ্যাসিজমকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং নিজেদের দেশের একনায়ক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু ডালির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলো যে ডালি ফ্যাসিবাদের সমর্থক এবং ফ্রাঙ্কোর বিরোধী নন। এই অভিযোগে ১৯৩৪ সালে ডালির পরাবাস্তববাদী আন্দোলন এর সদস্যপদ বাতিল করা হয়। এই ঘটনা ডালিকে প্রচণ্ড রাগিয়ে দেয়। তিনি তখন ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যদেরকে ক্রুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন পরাবাস্তববাদী চিত্রকর্মের প্রদর্শনীতে অংশ নিতে থাকেন। এর মধ্যে ১৯৩৬ সালে লন্ডনের একটি প্রদর্শনীতে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেন ডালি। তিনি সেখানে যখন বক্তব্য প্রদান করেন তখন তার হাতে ছিল একটি বিলিয়ার্ড খেলার কিউ, সাথে ছিল দুটি বিশালাকারের রাশিয়ান শিকারি কুকুর এবং পরিধান করেছিলেন ওয়েটস্যুট বা ডুবুরীদের পোশাক! তার এই কিম্ভুতকিমাকার দর্শন যদিও শিল্পীদের বিরক্ত করেছিল, দর্শকরা কিন্তু বেশ মজা পেয়েছিলেন। পরে একবার তিনি স্বীকার করেন যে তার এই প্রতিকৃতির কারণ ছিল মানব মনের গভীরে নিমজ্জন!

দ্য গ্রেট মাস্টারবেটর; ছবিঃ WikiArt

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডালি তার স্ত্রী গালাকে নিয়ে আমেরিকা চলে যান। সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে প্রকাশ করেন নিজের আত্মজীবনী ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর ডালি’। এ সময় থেকেই ডালির মনোযোগ পরাবাস্তববাদ থেকে কিছুটা সরে আসে এবং তিনি প্রবেশ করেন তার ‘ক্লাসিক্যাল’ যুগে। ১৯৪৮ সালে ডালি কাতালানিয়া ফিরে আসেন। সে বছরই তিনি একটি সিরিজ আঁকা শুরু করেন যা পরবর্তী ১৫ বছর যাবত চালিয়ে যান। এই ধারাবাহিক ছবিগুলো মূলত বিজ্ঞান, ধর্ম ও ইতিহাস কেন্দ্রিক ছিল। এরূপ মোট ১৯টি অসাধারণ চিত্রকর্ম ধারাবাহিকভাবে বেরিয়ে আসে ডালির তুলি থেকে যেগুলোতে তিনি তার দক্ষতা আর কল্পনাশক্তির মিশেলে অত্যন্ত চমৎকারভাবে একরকম মায়া বা বিভ্রম সৃষ্টি করেছিলেন। ছবিগুলোতে মূলত ডিএনএ, অধিঘনক, জ্যামিতিক ও ধর্মীয় প্রতীকী আকৃতি ফুটে ওঠে।

ডালির একটি কিউবিস্ট পোর্ট্রেট অটোরেট্রাটো; ছবিঃ Pinterest

১৪ বছর বয়সে ডালির জীবনের প্রথম সার্বজনীন চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছিল তার গ্রাম ফিগুয়েরেস এর মিউনিসিপ্যালিটি ভবনে। সেই প্রদর্শনীর নাম রাখা হয় ‘ট্রিয়েটো মিউজিও ডালি’ বা ‘ডালি থিয়েটার মিউজিয়াম’। সেই ভবনটি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ষাটের দশকে ডালি সেটিকে পুননির্মাণ শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে ডালি থিয়েটার মিউজিয়ামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। ডালি এখানে নিজের অসংখ্য কাজ প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষণ করেন। অন্যদিকে বাড়িট নির্মিত হয়েছিল ডালিরই নকশা থেকে। পুরো বাড়িটিই ডালি তৈরি করেন পরাবাস্তববাদী ঢঙে। আর ডালির এই ট্রিয়েটো মিউজিওকেই বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরাবাস্তব বস্তু! তবে সে বছরই নিজের চিত্রকর্ম বিষয়ক ম্যানেজার পিটার মুরের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ভেঙে যায় ডালির। ফলে তার অধিকাংশ চিত্রকর্মের স্বত্ব তার অনুমতি ছাড়াই বিক্রি হয়ে যায় এবং তিনি আর্থিক সমস্যায় পড়েন। তখন তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন তার বন্ধু রেনল্ড ও বন্ধুপত্নী এলানর। এ দুজন ‘ফ্রেন্ডস অব ডালি’ নামক একটি সংস্থা খুলে ডালির জন্য আর্থিক সহায়তা জোগাড় করেন। এই সংস্থাই পরবর্তীতে ফ্লোরিডার পিটার্সবার্গে প্রতিষ্ঠা করে ‘সালভাদর ডালি মিউজিয়াম’।

ট্রিয়েটো মিউজিও ডালি; ছবিঃ Pinterest

সালভাদর ডালির জীবনের শেষাভাগটা বেদনাময়। ১৯৮০ সালে তিনি মোটর ডিজঅর্ডারে ভুগে চিরস্থায়ীভাবে কাঁপুনি রোগে আক্রান্ত হন। ফলে তুলি তুলে ধরার সামর্থ্যও হারিয়ে তিনি চিত্রাঙ্কন থেকে অবসর নেন। একজন শিল্পীর জন্য এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কিছু হতে পারতো না। কিন্তু প্রহসনের মাত্রা ছাড়াতে দু’বছর পর মারা যায় তার জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ, তার স্ত্রী গালা। এবার তিনি অতি শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। কিন্তু কষ্ট যেন তাকে কষ্ট দিয়ে তৃপ্ত হতে পারছিল না। আর তাই ১৯৮৪ সালে এক দুর্ঘটনায় তার দেহের অধিকাংশ অংশ পুড়ে যায়। এবার তিনি সম্পূর্ণরূপে হুইল চেয়ারে আবদ্ধ হন। আর আজীবন হাস্যরসাত্মক একজন কল্পনাপ্রবণ শিল্পীকে ঘরের কোণে বন্দ্বী করেই বিদায় নেয় দুর্দশার মেঘ। তুলির আঁচরে যিনি অবচেতন মনের কল্পনাকে ক্যানভাসে জীবন্ত করেছেন সে ডালির তুলি ধরতে না পারার কষ্ট অনুভব করা অসম্ভব। শেষ জীবনটা তিনি কাটান নীরবে নিভৃতে। ১৯৮৯ সালে যখন ৮৪ বছর বয়সী ডালি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তখন প্রকৃতপক্ষে তিনি কেবল তার দেহই ত্যাগ করেছিলেন। যেদিন থেকে ক্যানভাস আর তুলির সাথে সম্পর্ক শেষ হয়েছিল, সেদিন থেকেই আসলে আত্মার সাথে সম্পর্ক ঘুচে গিয়েছিল ডালির!

ফিচার ইমেজ- misucell.com

Related Articles