Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হযরত উমার (রা): ন্যায়ের পথে অবিচল এক শাসক

হযরত আবু বকর (রা) যতটা পরিচিত ছিলেন তাঁর কোমল নম্র ব্যবহারের জন্য, ঠিক ততটাই লোকে ভয় পেতো হযরত উমার (রা)-কে তাঁর বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের জন্য। আবু বকর (রা)-এর মৃত্যুর পর তিনি মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বগুণে ইসলাম অনেক দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, নাটকীয় মৃত্যু তাঁকে বরণ করে নিতে হয় পারস্যের এক আততায়ীর হাতে। এ ঘটনাগুলো জানাবার জন্যই রোর বাংলা উপস্থাপন করছে হযরত উমার (রা)-এর শাসনকালীন জীবন।

ক্যালিগ্রাফিতে উমার (রা) এর নাম; source: Wikimedia Commons

৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন হযরত উমার (রা), তাঁর আগের দিন হযরত আবু বকর (রা) ইন্তেকাল করেছিলেন। হযরত উমার (রা) তাঁর শাসনে খুবই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন, তাছাড়া ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই তাঁর উপাধি ছিল ‘ফারুক’ (ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী)। শাসনের শুরুতে উমার (রা) কিন্তু খুব বেশি জনপ্রিয় ছিলেন না মদিনার গণ্যমান্য সাহাবীদের মাঝে, কারণটা ছিল তাঁর রাগী স্বভাব। কিন্তু এই কাঠিন্যই তাঁকে সাহায্য করে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখতে।

খুব অল্প সময়েই উমার (রা) জনগণের ভালোবাসা পেয়ে যান। শাসন নিয়ে হযরত আলী (রা)-এর সাথে একটু মনোমালিন্য যে ছিল না তা নয়, এজন্য তিনি খায়বার অঞ্চলের বিতর্কিত জমি আলী (রা)-কে দিয়ে দেন। হযরত আবু বকর (রা) এর সময় যে ‘রিদ্দা’ যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধ থেকে হাজার হাজার বেদুইন যুদ্ধবন্দী পাওয়া গিয়েছিল, তাদের সকলকে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্ত করে দেন। এতে বেদুইন গোত্রগুলোর মাঝে হযরত উমার (রা)-এর জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়।

পুরো সাম্রাজ্যকে নিয়মের মাঝে নিয়ে আসতে উমার (রা) প্রদেশগুলোকে অনেকগুলো ‘জেলা’তে ভাগ করেন। প্রদেশগুলোর শাসক ছিলেন তারই নিয়োগ করে দেয়া একেকজন গভর্নর বা ‘ওয়ালি’। প্রায় একশটির মতো ‘জেলা’ বা প্রধান শহর ছিল সাম্রাজ্য জুড়ে, যেগুলোর দায়িত্বে থাকতেন অপেক্ষাকৃত জুনিয়র গভর্নর বা ‘আমির’গণ। এছাড়াও নিয়ম রক্ষার্থে তিনি পুলিশি প্রথা চালু করেন প্রথমবারের মতো। আর বিচারকার্যের জন্য ‘কাযি’ বা ‘বিচারক’ তো ছিলেনই। আরবের প্রদেশ ছিল মক্কা আর মদিনা, ইরাকে ছিল বসরা আর কুফা, তাছাড়া জাজিরা আর সিরিয়া প্রদেশও ছিল, ফিলিস্তিনে ছিল ইলিয়া (জেরুজালেম) আর রামলা, মিসরে উত্তর মিসর আর দক্ষিণ মিসর এবং পারস্য বিজয়ের পর সেখানে তিনটি প্রদেশ হয়।

হযরত উমার (রা) এর তরবারি; source: Wikimedia Commons

ইরাকের বসরাতে ইসলামি শাসন শুরু হবার পর হযরত উমার (রা) সেখানে সুপেয় পানি আর চাষের জন্য খাল খনন করানো শুরু করলেন যেটি ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ

হযরত আবু বকর (রা) যে বাইজান্টিন সাম্রাজ্য আক্রমণ শুরু করে দিয়ে গিয়েছিলেন, উমার (রা) সেটা চালিয়ে যান। তাছাড়া পারস্য বিজয়ের কাজও শুরু করেন তিনি।

৬৩৬ সালে বাইজান্টিন সম্রাট হেরাক্লিয়াস মুসলিমদের কাছে হারানো জায়গাগুলো উদ্ধার করতে আক্রমণ চালান। কিন্তু ইয়ারমুক যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর কাছে বাজেভাবে হেরে যান তিনি। ঘটনাপ্রবাহে হযরত উমার (রা)-এর আদেশে সাহাবী আবু উবাইদা (রা) জেরুজালেম অধিকার করবার জন্য এগিয়ে যান মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে। সামনে সামনে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)। নভেম্বরে জেরুজালেমে এসে পৌঁছায় মুসলিম বাহিনী। ছয় মাস অবরোধ করে রাখার পর নগরকর্তা সোফ্রোনিয়াস আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন। তবে শর্ত একটাই, হযরত উমার (রা)-কে নিজে আসতে হবে, তাঁর হাতেই সমর্পণ করবেন।

সোফ্রোনিয়াস অবাক বিস্ময়ে দেখলেন কোনো জাঁকজমক ছাড়াই হযরত উমার (রা) তাঁর দাস আর গাধা নিয়ে জেরুজালেম এসেছেন। তিনি ঘুরিয়ে দেখালেন পবিত্র শহরটি। যখন নামাজের সময় হলো, তখন সোফ্রোনিয়াস তাঁকে চার্চে আহ্বান করলেন, কিন্তু উমার “না” বললেন। তিনি জানালেন, এখন যদি তিনি এই চার্চে নামাজ আদায় করেন, তাহলে পরে মুসলিমরা এই চার্চ ভেঙে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। এতে খ্রিস্টানরা তাদের পবিত্র স্থান হারাবে। উমার (রা) এখানে কোনো জবরদস্তি করানো থেকে বিরত করলেন এ কারণে যে, এটাই সেই জায়গা যেখানে খ্রিস্টানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে যীশু খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন আর এখানের গুহাতেই তাঁর দেহ রাখা হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই চার্চ এখনো আছে, নাম হলো Church of the Holy Sepulchre.

Church of the Holy Sepulchre; source: L ost Islamic History 

হযরত উমার (রা) চার্চের বাইরে বেরিয়ে নামাজ পড়লেন। পরে সেখানে আরেকটি মসজিদ বানানো হয়, নাম দেয়া হয় ‘মসজিদে উমার’। তবে উল্লেখ্য, কয়েক শতক পর (১০০৯ সালে) ফাতিমীয় খলিফা আল হাকিম উমার (রা) এর কথা সম্পূর্ণ অমান্য করে এই চার্চ ধ্বংস করে দেন, পরবর্তীতে তাঁর পুত্র খলিফা আজ-জহির চার্চটি আবার নির্মাণ করার অনুমতি দেন। ১০৪৮ সালে সেটি বানানো শেষ হয়।

মসজিদে উমার, জেরুজালেম; source: Lost Islamic History

ইহুদীদের জন্যও জেরুজালেম খুব পবিত্র জায়গা। খ্রিস্টান অধিকার থেকে মুক্ত করে উমার (রা) এ স্থানে ইহুদীদের পুনর্বাসনের জায়গা করে দেন। ৭০টি ইহুদী পরিবার এখানে চলে আসে।

জেরুজালেমের সবচেয়ে পবিত্র জায়গাতে খ্রিস্টানরা ইহুদীদের অপমান করবার জন্য ময়লা ফেলার জায়গা করে রেখেছিল। ইহুদী থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া সাহাবী কা’ব (রা) এর পরামর্শে সেখানে তিনি মসজিদ নির্মাণ করেন, যার নাম হয় মসজিদুল আকসা।

উল্লেখ্য, শাসনামলের শুরুতেই উমার (রা) সেনাপতি হিসেবে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা)-কে সরিয়ে আবু উবাইদা (রা)-কে পদ দেন। এর কারণ ছিল, লোকে ভাবতে পারে যে কেবল খালিদ (রা) এর বীরত্বের জন্যই বুঝি ইসলামের এত জয় আসছে।

হযরত উমার (রা) এর শাসনামলে দ্রুত হারে ইসলামি সাম্রাজ্য প্রসারিত হতে থাকে। তিনি আদমশুমারি করে মুসলিম জনসংখ্যা গণনা করেন। ৬৩৮ সালে তিনি একই সাথে মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নববী (‘নবীর মসজিদ’) বড় করে তোলেন। তিনি নাজরান আর খায়বারের ইহুদী ও খ্রিস্টান গোত্রগুলোকে সিরিয়া আর ইরাকে অবস্থান দেন।

৬৩৮ সালে তিনি ঘোষণা করলেন, তখন থেকে ইসলামিক পঞ্জিকা হিসেবে সাল গণনা শুরু হবে এবং সেটা হবে হিজরতের বছরকে প্রথম বছর ধরে। সে হিসেবে সেটা ছিল হিজরি ১৭ সাল।

৬৪১ সালে উমার (রা) বাইতুল মাল গঠন করেন। সেখান থেকে বাৎসরিক ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। এক বছর পর তিনি দরিদ্র, অভাবী ও বয়স্কদের জন্য ভাতা দিতে শুরু করলেন।

ওদিকে আবার ফিরে যাই রাজ্য বিস্তারের ঘটনায়। ৬৩৩ সালে পারস্য বিজয়ের যে প্রাথমিক ধাপ শুরু হয়েছিল, সেটা চলে ৬৫২ সাল পর্যন্ত! ধীরে ধীরে মেসোপটেমিয়াতে দুটো আক্রমণ করা হয় ৬৩৩ ও ৬৩৬ সালে। এরপর ৬৪২ সালে নাহাভান্দ এর যুদ্ধ হবার পর চুড়ান্তভাবে পারস্য বিজয় শুরু হয়। প্রতাপশালী সাসানীয় সাম্রাজ্যের হাত থেকে পারস্য কেড়ে নিতে থাকে মুসলিম বাহিনী। প্রথমে ফার্স দখল করে নেয়া হয়, এরপর ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পূর্ব পারস্য, সাকাস্তান, আজারবাইজান, আরমেনিয়া এবং খোরাসান জয়ের মাধ্যমে পারস্য পুরোপুরি মুসলিমদের অধিকারে চলে আসে। কিন্তু পারস্যের (বর্তমানে ইরান) মানুষজন সেটা আদৌ মেনে নিতে পারেনি, একটা চাপা ক্ষোভ কাজ করত উমার (রা) এর বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, সেখানকার মানুষ পূর্বে পারসিক জরথুস্ট্রুর ধর্ম মেনে চলত।

উমার (রা) এর শাসনামলে মুসলিম সাম্রাজ্য; source: Wikimedia Commons

এর মাঝে ৬৩৮ সালে আরবে বড় রকমের এক দুর্ভিক্ষ হলো। বেদুইনরা গণহারে মারা যেতে থাকে। সঞ্চিত খাবার সব শেষ হয়ে যায় মদিনায়। উমার (রা) তখন সিরিয়া, ফিলিস্তিন আর ইরাক থেকে সাহায্য চাইলেন। তাঁর এই ত্বরিত পদক্ষেপে আরবের দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকেরা আবার খেতে পায়। সবার আগে সাহায্য পাঠিয়েছিলেন সিরিয়ার গভর্নর আবু উবাইদা (রা)। দুর্ভিক্ষ শেষ হতে না হতেই সিরিয়া আর ফিলিস্তিনে শুরু হয় ভয়ানক প্লেগ। উমার (রা) তখন সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে চিঠি পান আবু উবাইদা (রা) এর কাছ থেকে যেন তিনি মদিনা ফিরে যান। কিছুদিন আগেই মদিনাকে সাহায্য করা আবু উবাইদা (রা) এই প্লেগে মারা গেলেন। শুধু তিনি নন, সিরিয়ার ২৫ হাজার মুসলিম মারা যায়। উমার (রা)-কে ৬৩৯ সালে সিরিয়ার প্রশাসন আবার ঢেলে সাজাতে হয়, কারণ বেশিরভাগ প্রশাসক যে মারা গেছেন!

এ পর্যায়ে এসে আমাদের একটু পেছনের ঘটনা জানতে হবে। মনে আছে পারস্য বিজয় করতে যে বছরের পর বছর লেগে গিয়েছিল? পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিখ্যাত সেনাপতি রুস্তম মারা যান মুসলিম বাহিনীর সাথে যুদ্ধে সেই ৬৩৬ সালেই। কিন্তু একজন অভিজাত বংশীয় পারসিক ছিলেন যিনি কিনা প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই বেঁচে গিয়ে পরের যুদ্ধে পূর্ণ উদ্যমে আবার আক্রমণ করতেন। তাঁর নাম ছিল হরমুজান। একদম শেষ যে যুদ্ধ তিনি করছিলেন, সেটা ছিল ৬৪২ সালে, শুশ্তারের যুদ্ধ। মুসলিম বাহিনী পারস্যের বাহিনীকে পরাজিত করে ফেলবার ঠিক আগে দুর্গে থাকা হরুমুজানের লোকেরা নিজেরাই পরিবারের মানুষদের হত্যা করে নিজেরা আত্মহত্যা করেন, যেন মুসলিম বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের গ্লানি সহ্য করতে না হয়। কিন্তু হরমুজান আত্মসমর্পণ করেন।

এখানেই হরমুজান আত্মসমর্পণ করেন; source: Wikimedia Commons

এরপরের কাহিনী মোটামুটি অনেকেরই জানা। শাস্তি হিসেবে তাঁর মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য। উমার (রা) এর দরবারে তাঁকে এনে উপস্থিত করা হলো। হরমুজান তাঁর সামনে পানি পান করতে চাইলেন, তাঁকে পানি দেয়া হলো। তিনি আশপাশে তাকালেন, যেন আশংকা করছেন, পানি পানরত অবস্থাতেই তাঁকে হত্যা করে হবে। উমার (রা) বললেন, “ভয় করো না, পানিটা শেষ করা পর্যন্ত তোমাকে কেউ কিছু করবে না।” সাথে সাথে হরমুজান পানি ফেলে দিলো। এখন উমার (রা) যে কথা দিয়েছেন সেটা রাখতে হলে আর তাঁকে হত্যা করতে পারবেন না।

সত্যি সত্যি উমার (রা) তাঁকে মারতে পারলেন না। তিনি পরে মৃত্যু এড়াতে ইসলাম গ্রহণও করেছিলেন। পেনশনও নিতেন রাষ্ট্র থেকে। কিন্তু তিনি মন থেকে মুসলিম হয়েছিলেন কিনা সে সন্দেহ রয়ে যায়।

৬৪৪ সালের অক্টোবরে উমার (রা) মক্কায় হজ্ব করতে যান। কথিত আছে, কে যেন চিৎকার করে বলে ওঠে, এটাই তাঁর শেষ হজ, আর কখনো এখানে আসবেন না উমার। কংকর ছুড়ে মারার এক পর্যায়ে কে যেন তাঁর মাথায় পাথর ছুড়ে মারে। উমার (রা) এতে আহত হন।

৬৩৬ সালে যখন পারস্যের রুস্তম পরাজিত হন, তখন তাঁর বাহিনীর এক সেনা ক্রীতদাস হিসেবে মুসলিমদের অধিকারে আসে। তার নাম ছিল ফিরোজ ওরফে আবু লুলু। তাঁকে মুগিরা (রা) এর অধিকারে দেয়া হয়। ফিরোজ অবশ্য মুসলিম ছিল না।

একদিন ফিরোজ হযরত উমার (রা) এর কাছে এলো এবং বলল যে মুগিরা (রা) তার উপর বেশি কর আরোপ করেছেন। উমার (রা) মুগিরার উত্তর তলব করলেন। মুগিরা (রা) এর উত্তর সন্তোষজনক ছিল। উমার (রা) তখন ফিরোজকে বললেন, “তুমি নাকি ভালো বায়ুকল বানাও, আমাকেও বানিয়ে দাও একটা।” ফিরোজ উত্তর দেয়, “আমি এমন কল আপনাকে বানিয়ে দেব যে সারা বিশ্ব মনে রাখবে।”

উমার (রা) জানতেন না ফিরোজকেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে উমার (রা)-কে হত্যার, পারস্য জয়ের প্রতিশোধ হিসেবে। সেদিন রাত্রে হযরত আবু বকর (রা) এর পুত্র আব্দুলরাহমান দেখলেন হরমুজান, ফিরোজ আর জাফিনা (খ্রিস্টান) এক জায়গায় জটলা হয়ে কথা বলছে। এমনিতে এটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু তাঁর উপস্থিতি টের পেতেই ফিরোজের হাত থেকে একটা দুই-মুখা ছোড়া পড়ে গেল। এই ছোরাটা যে হরমুজানের ছোরা সেটা তিনি জানতেন। কিন্তু এখানে কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছিল না যে সেটা দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে।

পরদিন ভোরবেলা, ৬৪৪ সালের ৩১ অক্টোবর। ফিরোজ মসজিদে নববীতে গিয়ে ফজরের নামাজে ইমামতি করতে থাকা উমার (রা)-কে উপর্যুপরি ছয় বার আঘাত করল পেটে এবং শেষে নাভিতে। নাভির ক্ষতটা ছিল মরণক্ষত। উমার (রা) পড়ে গেলেন। ফিরোজ পালাতে গেল। কিন্তু চারপাশে এতো মানুষ ছিলো যে সে পালাতে পারল না। কিন্তু পালাতে গিয়ে আরো ১২ জনকে আঘাত করল যার ৬ বা ৯ জন পরে মারা যান। তারপর নিজের ছোরা দিয়ে আত্মহত্যা করে ফিরোজ।

পরে আব্দুলরাহমান সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, এ ছোরাই তিনি ফিরোজের হাতে দেখেছিলেন সেই রাতে, যেখানে হরমুজান আর জাফিনা ছিলেন।

এ ঘটনা জানবার পর উমার (রা) এর পুত্র উবাইদুল্লাহ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে হরমুজান ও জাফিনাকে হত্যা করেন। এমনকি ফিরোজের কন্যাকেও হত্যা করে ফেলেন প্রতিশোধের আগুনে, যদিও কথিত আছে সেই কন্যা মুসলিম ছিলেন। প্রমাণ ব্যতীত এই প্রতিশোধ-হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত উমার (রা) নিজ পুত্রকে কারাবন্দী করবার নির্দেশ দেন, এবং বলে যান পরবর্তী খলিফা যা ভালো মনে করেন সেটাই সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁর ব্যাপারে।

আততায়ী ফিরোজের কথিত সমাধি ইরানের কাশান থেকে ফিন্স যাবার পথে পড়ে। অনেকটা মাজারের মতো। ইরানের শিয়া মতবাদে হযরত উমার (রা)-কে অন্যায় খলিফা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উমার (রা)-কে হত্যা করায় ফিরোজের উপাধি হয় বাবা সুজাউদ্দিন (‘ধর্মের বীর রক্ষক’)। উমার (রা) এর মৃত্যুদিবস ৯ রবিউল আওয়াল কিছু কিছু ইরানি গ্রামে উদযাপিত হয়। আগে অনেক জায়গায় হতো, কিন্তু কিছু আরব বিদ্রোহের পর সেটা নিষিদ্ধ করা হয়। এই উদযাপনের নাম জাশ্নে ওমার কোশি (‘উমার নিধন উদযাপন’)। ২০১০ সালে ফিরোজের মাজার ধ্বংস করবার জন্য International Union for Muslim Scholars অনুরোধ জানায়। কিন্তু ইরান এটাকে ইরান-বিরোধী দাবি হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে। প্রখ্যাত আল-আযহার ইউনিভার্সিটিও এই মাজার ধ্বংস করতে বলে। এর ফলে ইরান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে। তবে শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালে মাজারটি বন্ধ করে ইরান। এখন সেটা স্থানীয় পুলিশের হেড অফিস।

শিয়া মতবাদে উমার (রা)-কে কিছু কারণে অত্যন্ত ঘৃণা করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, গাদির খুম এর একটি বিখ্যাত ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতে ফাতিমা (রা), আলী (রা) ও তাঁর পক্ষের লোকজন মনে করেছিলেন আলী (রা) হবেন প্রথম খলিফা। যদিও আলী (রা) পরবর্তীতে আবু বকর (রা) এর কাছে বাইয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু শিয়া মতবাদে এখনও সেটাই বিশ্বাস করা হয়। এজন্য প্রথম তিন খলিফাকে তারা অস্বীকার করে, এবং ব্যক্তিবিশেষে অভিসম্পাত বর্ষণ করে থাকে। অবশ্য হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর হাদিস অনুযায়ী তাঁরা সকলেই নিশ্চিত বেহেশতবাসী ১০ জনের মধ্যে অন্তর্গত। শিয়া মতবাদ অনুযায়ী, যখন আবু বকর আলী (রা) এর আনুগত্য আনতে ফাতিমা (রা) এর বাসায় যান তখন সেখানে আলী (রা)-ও অবস্থান করছিলেন। বলা হয়, উমার (রা) হুমকি দেন বাসা পুড়িয়ে দেবার যদি আলী (রা) বেরিয়ে না আসেন। বেরিয়ে না আসাতে উমার (রা) নাকি দরজা লাথি দিয়ে ঢুকে পড়েন যার ফলে ফাতিমার গায়ে আঘাত লাগে, ফলশ্রুতিতে এক পর্যায়ে তাঁর গর্ভপাত হয়, তাঁর সন্তান মুহসিন গর্ভে ছিল। কোনো কোনো শিয়া মতে বলা হয়, আলী (রা) তরবারি তুলে দৌড়ে আসেন, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলা হয় জুবাইর (রা) উমার (রা)-কে মুকাবিলা করতে যান তরবারি হাতে। তবে সুন্নি মতবাদ অনুসারে এরকম কোনো ঘটনা আদৌ ঘটেনি। তবে হ্যাঁ, আলী (রা) আবু বকর (রা) থেকে কিছু দূরত্ব বজায়ে থাকতেন, তবে সেটা ফাতিমা (রা) এর স্বার্থে, নিজের স্বার্থে নয়। নবী (সা) এর মৃত্যুর পর নবীকন্যা ফাতিমা (রা) যখন সম্পদের উত্তরাধিকার আনতে যান, তখন আবু বকর (রা) জানান যে নবী (সা) তাঁকে জানিয়েছিলেন, “আমরা নবীগণের (সম্পদের) কোন উত্তরাধিকারী নেই; আমরা যা কিছু রেখে যাই তার সবই জাকাত হিসাবে বায়তুল।” এ কারণে আবু বকর (রা) এর সাথে রাগ করে ফাতিমা (রা) আর কথা বলেননি। তবে, আলী (রা) এবং উমার (রা) এর ভালো সম্পর্ক ছিল, এমনকি আলী (রা) এর মেয়েকে তিনি বিবাহ করেছিলেন পর্যন্ত।

ওদিকে উমার (রা) তিন দিন পর এই ক্ষত থেকে মারা যান। দিনটি ছিলো ৬৪৪ সালের ৩ নভেম্বর বুধবার। মারা যাবার আগে তিনি অনেক কিছুই বলে গিয়েছিলেন। এটাও বলেছিলেন, অন্তত এমন কারও হাতে তিনি মারা যাচ্ছেন না যে কিনা নিজেকে মুসলিম বলে।

উমার (রা) ছয়জনকে নিয়োগ দিলেন একটি কমিটি গঠন করতে। এদের মাঝেই নিজেরা আলোচনার মাধ্যমে খলিফা নির্বাচিত করবেন। এ ছয়জনই ছিলেন সেই ১০ সাহাবীর অন্তর্গত যাদের সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলে গিয়েছিলেন যারা নিশ্চিত বেহেশতে যাবেন। তালিকায় আরও একজন ছিলেন, কিন্তু তাঁকে উমার (রা) বাদ দেন আত্মীয় বিধায়। কারণ তিনি চাননি নিজের আত্মীয় কাউকে খলিফা নিয়োগ দিয়ে যেতে।

উমার (রা) চাইলেন তাঁর কবর যেন আবু বকর (রা) আর হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর কবরের পাশেই হয়। যেহেতু এ কবর দুটো ছিল আইশা (রা) এর প্রাক্তন ঘরে, তাই তিনি তাঁর কাছেই অনুমতি চাইতে পাঠালেন কাউকে। ক্রন্দনরত আইশা (রা) জানালেন, তিনি নিজের কবরের জন্য সেই ঘরের বাকি জায়গাটা রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু উমার (রা) অধিকতর শ্রেয়, অবশ্যই তাঁর কবর ওখানে হবে।

৩ তারিখ উমার (রা) মারা যাবার পর তাঁকে মসজিদে নববীতে রাসুল (সা) এর পাশে সমাহিত করা হয়।

ডান দিক থেকে প্রথম জানালা দিয়ে উঁকি দিলে আপনি হযরত উমার (রা) এর কবর দেখতে পারবেন; source: Wikimedia Commons

উকবা ইবনে আমির (রা) হতে বর্ণিত এক হাদিসে আছে, রাসুল (সা) বলেছিলেন, “আমার পরে যদি কেউ নবী হত, তবে সে হতো উমার।” [আহমাদ (১৭৪০৫), তিরমিজি (৩৬৮৬), আল হাকিম (৪৪৯৫)]

উমার (রা) এর বিখ্যাত একটি উক্তি রয়েছে, তিনি বলেছিলেন সেই দুর্ভিক্ষের সময়, “আজ যদি ফোরাতের তীরে একটা কুকুর না খেতে পেয়ে মারা যায়, তবে তার জন্য আমি উমার আল্লাহ্‌র কাছে দায়ী থাকব।”

শেষ করছি কবি নজরুলের একটা কবিতাংশ দিয়েঃ

“ইসলাম – সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।
আজ বুঝি – কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-
‘মোর পরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর’।”

পরের পর্ব: হযরত উসমান (রা)

 

This article is in Bangla language. It's an episode of a series article about four caliph of Islam.

Featured Image: islamnews

For references please check the hyperlinks inside the article.

First episode: Hazrat Abu Bakar (R) 

Third episode: Hazrat Usman (R)

Related Articles