Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শাহরুখ খান: একদা রাজা, সর্বদাই রাজা

আজ এমন এক প্রেমিকের গল্প শোনাবো যার প্রেম ‘স্বদেশ’ এর গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘পারদেশ’ এর মানুষকেও শিখিয়েছে কিভাবে ‘মোহাব্বাতে’ হয়, কিভাবে ‘ডর’কে জয় করে জীবনের পথে ‘চালতে চালতে’ নিজের ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া’কে জয় করতে হয়। যার প্রেম দেখে মনে ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’, যার প্রেম দেখে ভালবাসার জন্য ‘দেবদাস’ হতে ইচ্ছে হয়, প্রিয় মানুষটিকে বলতে ইচ্ছে হয় ‘ম্যায় হু না’! বলছিলাম রাহুল (নাম তো শুনা হোগা?), রাজ, কবির খান, রিজওয়ান খান তথা বলিউডের মহানায়ক শাহরুখ খানের কথা।

কেউ তাকে বলে ‘অতি-অভিনেতা’, আবার কেউ তাকে বলে অভিনয় জগতের ঈশ্বর। কেউ যখন তাকে তার মন্দ চলচ্চিত্রের জন্য গালি দিচ্ছে, তখন কেউ আবার তার অসাধারণ চলচ্চিত্রগুলোকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছে। কেউ বলছে ‘বুড়ো’, তো কেউ দাবি করছে ‘চিরতরুণ’। কিন্তু যে যাই বলুক, তিনি শাহরুখ খান ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। নিন্দুকের কথায় তিনি যেমনি কান দেন না, তেমনি গাঁ ভাসান না ভক্তদের অতি আদুরে প্রশংসা-বাক্যে। তাই তো আজ তার সাফল্য আকাশ ছুঁয়েছে। তিনি আজ বলিউডের বাদশা, খানদের রাজা।

কিংবদন্তির জন্ম

শিশু শাহরুখ খান; ছবিসূত্রঃ it.pinterest.com

১৯৬৫ সালের ২রা নভেম্বর, নয়াদিল্লীর তালভার নার্সিং হোমে জন্ম হয় একটি শিশুর। শিশুটির মা পরবর্তীতে তার জন্মের গল্প বলতে গিয়ে এতোটুকুই মনে করতে পেরেছিলেন যে, কোনো এক নার্স নাকি বলেছিল সে বড় হয়ে অনেক বিখ্যাত হবে। হ্যাঁ, সেই শিশুটিই আজকের শাহরুখ খান।

শৈশব তার কেটেছে দিল্লীর রাজিন্দর নগরে। নিজের জীবনীতে সেই বাড়ির নাম্বারটিও লিখেছেন তিনি, এফ-৪৪২। বাড়ির পাশে ‘টিনি টটস’ নামে একটি প্লে স্কুলে প্রাথমিক পড়ালেখা শুরু করেন। কোনো এক আইরিশ ব্যক্তি ও তার ভাইয়ের দ্বারা পরিচালিত ‘সেইন্ট কলাম্বিয়া স্কুলে’ তিনি মাধ্যমিক পড়ালেখার জীবন শুরু করেন। তার বাবা মীর তাজ মোহাম্মদ ছিলেন পাঠান বংশীয়। তিনি পরিবহন ব্যবসা করতেন। শাহরুখের মা লতিফ ফাতিমা একজন সরকারি প্রকৌশলীর মেয়ে ছিলেন। তাদের বিয়ে হয় ১৯৫৫ সালে। তার বড় এক বোনও রয়েছে, নাম শাহনাজ লালারুখ।

শাহরুখ খানের বাবা তাজ এবং মা ফাতিমা; ছবিসূত্রঃ.lightscamerabollywood.com

সেইন্ট কলাম্বিয়া স্কুল ও শাহরুখ

ছোটবেলা থেকেই শাহরুখ ছিলেন খুবই কেতাদুরস্ত। বিশেষ করে চুলের যত্ন করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাবধান। কিন্তু কলাম্বিয়া স্কুলে গিয়েই যেন সব অন্যরকম হয়ে গেল। সেই স্কুলের ছাত্রদের মেনে চলতে হতো কঠোর নিয়মকানুন। ইউনিফর্মের সাথে চুলের প্রতিও বিশেষ নজর দিত স্কুল কর্তৃপক্ষ। শাহরুখ তাই বিপদে পড়লেন। বড় চুল রাখার কারণে প্রায়ই তাকে এসেম্বলি থেকে সোজা নাপিতের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হতো। শাহরুখ বেশ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তবে পড়ালেখায় তার মন একদমই বসতো না। বছর জুড়ে নিজের ইচ্ছেমতো পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কাজ করে বেড়াতেন আর পরীক্ষার আগের রাতে চোখের পাতা ফেলার সময় পেতেন না, একেবারে পরীক্ষা দিয়ে এসেই চোখ বন্ধ করতেন!

হিন্দিতে খুবই দুর্বল ছিলেন শাহরুখ। সবসময় হিন্দিতে ফেল করতেন। একবার পরীক্ষার আগে তার মা তাকে বললেন হিন্দিতে ভাল মার্ক পেতে পারলে তাকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যাবেন। তখনো পর্যন্ত সিনেমা হলে যাননি শাহরুখ। তাই পরীক্ষার আগে হিন্দি পড়ায় আদা জল খেয়ে লেগে গেলেন এবং হিন্দিতে খুবই ভাল ফলাফল করলেন। কথামতো তার মা ফাতিমা তাকে নিয়ে গেলেন একটি থিয়েটারে। আর প্রথমবারের মতো হিন্দি চলচ্চিত্র দেখেই প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি। এ ব্যাপারে একবার এক ইন্টারভিউয়ে তিনি বলেছিলেন, সেদিনের সেই সিনেমাটিই তার মনে সিনেমা প্রীতি সৃষ্টি করেছিল। একবার ভাবুন তো, ফাতিমা তার ছেলেকে যদি সেদিন থিয়েটারে না নিয়ে যেতেন, তাহলে হিন্দি চলচ্চিত্র কি হারাতো!

বড় হয়ে যিনি ‘রোম্যান্স এর রাজা’ হবেন, কৈশোরেই তার মধ্যে দেখা যেত সেই আভাস। স্কুলের দেয়ালে বসে তিনি ‘ফ্লায়িং কিস’ পাঠাতেন তার চেয়ে বয়সে বড় মেয়েকেও যদি মেয়েটিকে তার মনে ধরে যেতো। তবে একবার এক মেয়ে তার বাবার কাছে নালিশ করলে তার ‘ফ্লায়িং কিস’ বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। কিন্তু সাহসী শাহরুখ বাবার কাছে স্বীকার ঠিকই করেছিলেন যে বয়সে বড় আপুটিকে তার মনে ধরেছিল!

ফুটবলে তার প্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন পেলে, ম্যারাডোনা, সক্রেটিসের মতো কিংবদন্তিরা। আর নিজ দেশে তার প্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন আসলাম শের খান যার মতো হবার জন্য মনে মনে স্বপ্ন বুনতেন কিশোর কিং খান। অন্যদিকে নিজের দুনিয়ায় তার প্রিয় মুখ ছিলেন বলিউডের সাবেক অভিনেত্রী মুমতাজ। শাহরুখ তার রেডিওতে তার গান শুনে এতোটাই উন্মাদের মতো নাচতেন যে তিনি অনেক সময় বলে থাকেন, “আমি নাচ যতটুকু শিখেছি তার অর্ধেকই মুমতাজের ছবির গান শোনার সময়।” তার প্রিয় গানটি ছিল শামী কাপুরের একটি ছবির। সে গানটির লাইনগুলো নাকি এখনো অবসরে গেয়ে ওঠেন শাহরুখ। দুটো লাইন না লিখে পারছি না।

“চাক্কে পে চাক্কা, চাক্কে ম্যায় গাড়ি,
গাড়ি পে নিকলি, আপনি সাওয়ারি”

উচ্চ শিক্ষায় খান

কপিল দেব, সোহেল খানের সাথে ফুটবল খেলছেন শাহরুখ; ছবিসূত্রঃ pinterest.com

স্কুলে সেরা ফলাফল করে এবং অসংখ্য পুরস্কার জিতে শাহরুখ ভেবেছিলেন দেশের সেরা কলেজে তিনি খুব সহজেই সুযোগ পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় তার ফলাফল সেরা কলেজে ভর্তি হবার মতো হয়নি। তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ইংরেজি সাহিত্যেই খারাপ করেছিলেন। কিন্তু তার ইচ্ছা তিনি সেখানে ভর্তি হবেনই। তাই স্কুলের অর্জনগুলো (সার্টিফিকেট, পুরস্কার) দেখালেন প্রিন্সিপ্যালকে। হিতে বিপরীত হলো। প্রিন্সিপ্যাল তার সাথে বাজে আচরণ করলেন। পরে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হ্যানসরাজ কলেজ’ এ ভর্তি হন। একই সাথে বিজ্ঞান পড়ার ইচ্ছাই মিটিয়ে ফেলে ভর্তি হন অর্থনীতিতে।

হ্যানসরাজ কলেজে শাহরুখ খান; ছবিসূত্রঃindiatvnews.com

হ্যানসরাজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স পাস করেন শাহরুখ। এ সময় তিনি একই সাথে ক্রিকেট, ফুটবল এবং হকিতে বেশ দক্ষতা অর্জন করেন। একসময় তিনি খেলাধুলার জগতে নিজের ক্যারিয়ার বানাবেন বলেই ভাবতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু পিঠের ব্যাথা এবং আর্থ্রাইটিস এর মতো সমস্যা তার খেলাধুলায় বাধ সাধে। অনার্স শেষে তিনি ‘জামিয়া মিল্লা ইসলামিয়া’ নামক একটি গণযোগাযোগ গবেষণা কেন্দ্রে মাস্টার্স পড়ার জন্য ভর্তি হন। চলচ্চিত্র এবং সাংবাদিকতা, এই দুটি বিষয়ে তিনি পড়াশুনা শুরু করেন। কিন্তু প্রথম বর্ষ শেষেই ভাইস-প্রিন্সিপ্যালের সাথে মনোমালিন্যের কারণে মাঝপথেই মাস্টার্স কোর্স বন্ধ করে দেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার এখানেই শেষ হয়।

টিভি সিরিজ

‘ফৌজি’র একটি দৃশ্যে শাহরুখ খান; ছবিসূত্রঃthereel.scroll.in

১৯৮৮ সালে শাহরুখ খান জীবনে প্রথম ‘দিল দরিয়া’ নামক একটি টিভি ধারাবাহিকে কাজ করার চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু নানা সমস্যায় এর কাজে বিলম্ব ঘটায় শেষ পর্যন্ত ১৯৮৯ সালে ‘ফৌজি’ নামক ধারাবাহিকেই তার অভিনয় জীবনের শুরু হয়। এই নাটকে তিনি ‘অভিমান্যু রায়’ নামের এক আর্মি ক্যাডেট চরিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনয় এতোটাই নজর কাড়া হয় যে, অনেক সমালোচক তার অভিনয়ের প্রশংসা করতে গিয়ে কিংবদন্তি অভিনেতা দীলিপ কুমারের সাথে তুলনা করেন। দ্রুতই তিনি কাজ করেন ‘সার্কাস’ নামের আরেকটি ধারাবাহিকে। সিনেমায় কাজ করার প্রস্তাব আসলেও তখনো তিনি নিজেকে উপযুক্ত মনে করতেন না। সার্কাসের পরেই তিনি ‘উমিদ’ নামে আরেকটি ধারাবাহিকে পার্শ্বচরিত্রে কাজ করেন।

চলচ্চিত্রে আগমন

১৯৯১ সালে মা মারা গেলে শাহরুখ খান তার সিদ্ধান্ত বদলে চলচ্চিত্রে কাজ করবেন বলে দিল্লী থেকে মুম্বাই পাড়ি জমান। ‘ফৌজি’র বদৌলতে তিনি যে সুনাম অর্জন করেছিলেন তা তার জন্য সহায়ক হলো। তিনি দ্রুত চারটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে গেলেন। তার মধ্যে প্রথমটি ছিল সাবেক বলিউড অভিনেত্রী হেমা মালিনীর প্রথম পরিচালনা, ‘দিল আসানা হ্যায়’, যদিও তার বলিউড অভিষেক হয় ‘দিওয়ানা’ (১৯৯২) ছবিটির মাধ্যমে। রিষি কাপুরের সাথে দ্বিতীয় প্রধান নায়কের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন এবং সে বছর সেরা উদীয়মান অভিনেতা হিসেবে ‘ফিল্মফেয়ার’ পুরস্কার লাভ করেন।

প্রধান চরিত্রে প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘চমৎকার’। অন্যদিকে একই বছর তার তৃতীয় ছবি হিসেবে মুক্তি পায় ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ ছবিটি, যেখানে তিনি জুহি চাওলার সাথে অভিনয় করেন। ততদিনে বলিউড পাড়ায় তার অভিনয়ের বেশ জোর গুঞ্জন চলছে। তার অভিনয়ে নতুনত্ব যেমন- ঠোট কাঁপানো, আবেগপূর্ণ দৃশ্যে চোখের কম্পন, কথা বলার সময় বিশেষ ভঙ্গীতে গলার স্বর পরিবর্তন, সবই বড় পর্দায় তাকে নিয়ে যেত গতানুগতিক ধারার বাইরে।

পরিবারের সাথে শাহরুখ খান; ছবিসূত্রঃindianexpress.com

১৯৯১ সালের ২৫ অক্টোবর তিনি বিয়ে করেন গৌরি খানকে, যিনি একজন পাঞ্জাবি হিন্দু ছিলেন। বিয়েও করেন হিন্দু রীতিতেই। সময়ের আবহে তাদের দাম্পত্য জীবন বলিউড ইতিহাসের অন্যতম সুখী হিসেবে প্রমাণিত হয়। তাদের ঘরে জন্ম হয় আরিয়ান, সুহানা এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে আব্রাম খানের।

‘এন্টি হিরো’ শাহরুখ খান

১৯৯৩ সালে শাহরুখ খান নিজেকে একজন চমৎকার অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন ‘এন্টি হিরো’ হিসেবে কাজ করে। একই বছরে তিনি কাজ করেন ‘ডর’ এবং ‘বাজিগর’ এর মতো বক্স অফিস হিট একই সাথে ব্যাপক প্রশংসিত দুটি চলচ্চিত্রে। ‘ডর’ এর জন্য তিনি সেরা ‘ভিলেন’ এর নমিনেশন পান ফিল্মফেয়ারে। তবে বাজিগরে তার অসাধারণ অভিনয় তাকে এনে দেয় ক্যারিয়ারের প্রথম সেরা অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। ‘দীপা সাহির’ সাথে ‘মায়া মেমসাব’ ছবিতে একটি বিতর্কিত দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য একই বছর অনেক সমালোচনাও শুনতে হয় খানকে। ১৯৯৪ সালে তিনি ‘আনজাম’ ছবিতে আরও একবার এন্টি হিরো হিসেবে আবির্ভূত হন এবং ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন।

প্রেমিক শাহরুখের আবির্ভাব

‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’র একটি পোস্টার; ছবিসূত্রঃzeenews.india.com

১৯৯৪ সালে যখন একের পর এক এন্টি হিরোর চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন, তখনই তিনি ‘কাভি হা কাভি না’ ছবিটিতে প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের রোমান্টিকতার পরিচয় দেন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালটি ছিল শাহরুখ খানের জীবন পাল্টে দেয়ার বছর। প্রথমে তিনি অভিনয় করেন পরিচালক রাকেশ রোশানের পরিচালিত ‘করন অর্জুন’ ছবিতে যা বক্স অফিসে হিট হয়। বছরের শেষ দিকে মুক্তি পায় আদিত্য চোপড়া পরিচালিত ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সেরা ছবিগুলোর একটি, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’। ছবিটিতে শাহরুখ খান অভিনয় করেন ‘রাজ’ আর কাজল অভিনয় করেন ‘সিমরান’ চরিত্রে। মুক্তি পাবার সাথে সাথেই ছবিটি বক্স অফিস মাত করে। একদিকে বক্স অফিসে ঝড় তুলেছিল অন্যদিকে সমালোচকদের প্রশংসার বৃষ্টিতে ভিজেছিল এই ছবিটি। বিশ্বজুড়ে ১৯ মিলিয়ন ডলার তথা ১২২ কোটি ভারতীয় রূপি আয় করে ছবিটি তখনো পর্যন্ত ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি আয় করা ছবি হবার গৌরভ লাভ করে। ‘মারাঠা মন্দির’ নামক সিনেমা হলে ছবিটি চলেছিল টানা ১০০০ সপ্তাহ! বলা হয়ে থাকে আদিত্য চোপড়া পরিচালিত এই ছবিটিই আসলে শাহরুখ খানকে ‘রোমান্টিক হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ছবিটি মোট দশটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছিল, শাহরুখ জিতেছিলেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার।

পরের বছর খুবই বাজে কাটে শাহরুখ খানের। তবে দুর্দান্তভাবে ফিরে আসেন ১৯৯৭ সালে। যশ চোপড়া পরিচালিত ছবি ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ ছবি দিয়ে তিনি দর্শকদের প্রেমে পাগল করে দেন আর ঘরে তোলেন নিজের তৃতীয় সেরা অভিনেতার জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।

দিলওয়ালে দুলহানিয়া দিয়ে শাহরুখ খান প্রমাণ করেছিলেন যে তিনি বলিউডে এসেছেন রাজার মতো রাজত্ব করতে। এবং তিনি তা করেছেন ও। ক্যারিয়ারে খুব একটা উত্থান পতনের দেখা পাননি তিনি। ‘অশোকা’, ‘বাদশাহ’, ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’র মতো ছবিগুলো যখন বক্স অফিসে ফ্লপ হচ্ছিল, তখন এদের মাঝেই তিনি উপহার দিচ্ছিলেন ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’, ‘কাভি খুশি কাভি গাম’, ‘মোহাব্বাতে’, ‘কাল হো না হো’ এর মতো বক্স অফিস কাঁপানো ছবি। ২০০১ সালে তার অভিনীত এবং সঞ্জয় লীলা বানসালী পরিচালিত ছবি ‘দেবদাস’ ছিলে সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবি। ছবিটি দশটি ফিল্মফেয়ার জেতে এবং শাহরুখকে তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার সহ একাধিক পুরস্কার এনে দেয়। তাছাড়া ছবিটি সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে সম্মানজনক ‘বাফটা’ পুরস্কার পায় (বিদেশী ভাষার ছবি হিসেবে)।

দেবদাস ছবির একটি দৃশ্যে শাহরুখ খান;ছবিসূত্রঃ movies.ndtv.com

২০০৪ সাল সম্ভবত তার ক্যারিয়ারের সেরা বছর। সে বছর মুক্তি পায় তার তিনটি ছবি, ‘ম্যায় হু না’, ‘ভীর জারা’ এবং ‘স্বদেশ’। প্রতিটি ছবির জন্যই তিনি ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান এবং ‘স্বদেশ’এর জন্য পুরস্কার জেতেন। স্বদেশ ব্যতীত দুটি ছবিই বক্স অফিসে খানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। কিন্তু বক্স অফিসে ব্যর্থ হলেও স্বদেশকে অনেকে শাহরুখের জীবনের সেরা পারফরম্যান্স বলে থাকেন। ২০০৫ সালে তার অভিনীত ছবি ‘পাহেলি’ ভারতীয় ছবিগুলোর মধ্যে অস্কার পুরস্কার নমিনেশন পায়।

২০০৭ সালে শাহরুখ খান অভিনয় করেন ‘চাক দে ইন্ডিয়া’ ছবির অমর চরিত্র ‘কবির খান’ এর ভূমিকায়। এই ছবিটি বক্স অফিসের পাশাপাশি খানকে এনে দেয় ফিল্মফেয়ারসহ অসংখ্য পুরস্কার। এরপর ‘রাব নে বানা দি জোড়ি’ এবং ‘ওম শান্তি ওম’ ছবি দুটিও ছিল বক্স অফিস হিট। ২০১০ সালে তার অভিনীত ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। ছবিটিতে তিনি ‘রিজওয়ান খান’ নামক এক অটিস্টিক ব্যক্তির চরিত্র অবিশ্বাস্য রকমের নৈপুণ্যের সাথে ফুটিয়ে তোলেন। ‘দ্য আলকেমিস্ট’ এর লেখক পাওলো কোয়েলহো বলেন- “মাই নেম ইজ খান ছবিটির জন্য শাহরুখ খান এর অস্কার প্রাপ্য”।

‘মাই নেম ইজ খান’ ছবির একটি দৃশ্যে শাহরুখ খান; ছবিসূত্রঃ tribune.com.pk

২০১০ সালের পর থেকেই একটু যেন লাইনচ্যুত হন শাহরুখ খান। ‘রাওয়ান’ আর ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ এর মতো সিনেমাগুলো বক্স অফিসে সফল হলেও কেমন যেন ঠিক শাহরুখ খানের ছবি মনে হচ্ছিল না। এরপর ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ আর ‘দিলওয়ালে’ ছবি করে তিনি ক্রমাগত সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হন। ছবি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তার ব্যার্থতায় অনেকে বলিউডে তার ক্যারিয়ারের ইতি টেনে দেন। ‘ফ্যান’ প্রায় ১২ বছর পর তার প্রথম ছবি হিসেবে (প্রধান চরিত্রে) বক্স অফিসে ফ্লপ হয়। অসাধারণ অভিনয় করেও দুর্বল গল্পের ছবিতে কাজ করার জন্য তিনি সমালোচনার স্বীকার হন। অন্যদিকে বক্স অফিসে তার রাজত্ব চলে যায় তার সবচেয়ে বড় দুই প্রতিযোগী বলিউডের অপর দুই খান, সালমান খান এবং আমির খান এর কাছে। এতে অনেকেই তাই তার ক্যারিয়ারের শেষ দেখছেন।

টেলিভিশন, আইপিএল, রেড চিলি এবং অন্যান্য

২০১৪ সালের আইপিএল বিজয় উদযাপন করছেন শাহরুখ খান;ছবিসূত্রঃtalkingmoviez.com

ছোট পর্দায় কিন্তু কিং খান খুব একটা সফল ছিলেন না। তিনি ২০০৭ সালে অমিতাভের ‘কৌন বানেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন। পরের বছর ‘ক্যায়া আপ পাঞ্চভি পাস সে তেজ হ্যায়’ নামক একটি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হন যা মোটামুটি রকমের সফল হয়। কিন্তু ২০১১ সালে তার ছোট পর্দার রিয়েলিটি শো ‘জোড় কা ঝাটকা’ একেবারেই সাড়া ফেলতে পারেনি। ফলে ছোট পর্দায় কাজ সেখানেই শেষ করেন তিনি।

২০০৮ সালে শাহরুখ খান ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ তথা আইপিএলে দল কেনেন। জুহি চওলার সাথে যৌথ অংশীদারিত্বে প্রায় ৭৬ মিলিয়ন ডলারে ‘কলকাতা নাইট রাইডার্স’ দলটি কেনেন তিনি। প্রথম তিন আসরেই কলকাতার অর্জন ছিল শূন্য। কিন্তু শাহরুখ খানের ব্র্যান্ড ভ্যালু দলটিকে আইপিএলের সবচেয়ে দামি দলে (নেট ব্র্যান্ড মূল্য ৪৩ মিলিয়ন, ২০০৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী) পরিণত করে মাত্র দ্বিতীয় আসর থেকেই। ২০১২ এবং ২০১৪ সালে কলকাতা চ্যাম্পিয়ন হলে এর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়।

১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত শাহরুখ খান ‘ড্রিমজ আনলিমিটেড’ এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। পরে বিভিন্ন কারণে তিনি সেই কোম্পানি থেকে বেরিয়ে যান এবং স্ত্রী গৌড়ি খানের সাথে ‘রেড চিলিস এন্টারটেনম্যান্ট’ গড়ে তোলেন। এখনো পর্যন্ত রেড চিলি দশটির অধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে। এটি মূলত একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা, ভিজুয়াল গ্রাফিক্স এবং বিজ্ঞাপন প্রস্তুতকারক কোম্পানি।

এসআরকেঃ একটি ব্র্যান্ড

পেপসির বিজ্ঞাপনে শাহরুখ খান;ছবিসূত্রঃ cutesrk.blogspot.com

বিজ্ঞাপনের বাজারে একক রাজত্ব শাহরুখ খানের। সেটা কমেনি, বরং বাড়ছেই। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের শতকরা ছয় ভাগ শেয়ার তার একাই! নোকিয়া, পেপসি, ট্যাগ হিউয়ের, হিউন্দাই, ডিশ টিভি, ডে’কর, নেরোলাক, লাক্স এর মতো আরও অসংখ্য পণ্যের এনডোরস করেছেন শাহরুখ। গত বছর টিভি বিজ্ঞাপন থেকে তার বাৎসরিক আয় হয় ১৩১ মিলিয়ন ডলার যা তাকে ৭ম বারের মতো ভারতের সবচেয়ে বেশি ব্র্যান্ড ভ্যালু বিশিষ্ট তারকায় পরিণত করে, যেখানে গত বছর বক্স অফিসে তার চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে যাওয়া সালমান খানের আয় ছিল মাত্র ৫৯ মিলিয়ন ডলার!

ভারতে তো প্রথমই, বৈশ্বিকভাবেই শাহরুখ দ্বিতীয় ধনী অভিনেতা। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৬০০ মিলিয়নের অধিক। ভারতে সেরা একশ ধনীর তালিকায় কিংবা প্রভাবশালীর তালিকায় প্রতি বছরই তার নাম আসছে। ২০০৮ সালে তো বিশ্বের সেরা ৫০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায়ই তার নাম প্রকাশ করে ‘নিউজউইক’ পত্রিকা। বিবিসি, লস এঞ্জেলস টাইমস এর মতো প্রতিষ্ঠান তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র তারকা বলে ঘোষণা করেছে আগেই। তার ফ্যানবেস ছাড়িয়েছে শত কোটির মাইলফলক। যেখানেই তিনি যান, সাড়া পড়ে যায় তাকে নিয়ে। তাকে নিয়ে বানানো হয়েছে কতো ডকুমেন্টারি তার হিসাব নেই, লেখা হয়েছে বইও। কিছু বাজে ছবি করার জন্য হয়তো বক্স অফিসে নিজের উপর দর্শকের বিশ্বাসের স্থানটা হারিয়েছেন, কিন্তু তার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। তিনি যে রাজা, তার রাজত্বের শেষ নেই।

পুরস্কার ও সম্মাননা

শাহরুখ খানের পুরস্কারের সংখ্যা সঠিকভাবে গুগলও হয়তো বলতে পারবে না। তিনি যা ছুঁয়েছেন, তাই সোনায় রূপান্তরিত হয়েছে। জীবনে অর্জন করেছেন অসংখ্য সম্মাননা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় দিকেই। ক্যারিয়ারে মোট ৩৭৬ বার বিভিন্ন দিকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন যার মধ্যে ২৭৪ বারই জিতেছেন কোনো না কোনো পুরস্কার।

প্রথমে জাতীয় পর্যায়ের কথাই বলা যাক। আইফা, রাজীভ গান্ধী, বেস্ট ইন্ডিয়ান সিটিজেন ইত্যাদি সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হন এই মহাতারকা। তবে ২০০৫ সালে লাভ করেন সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার, ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা, ‘পদ্ম শ্রী’। যদিও কখনো ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জেতেননি, জিতেছেন সর্বোচ্চ ১৪টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। এছাড়াও স্টার, জি সিনে, গিল্ড, আইফা, স্টারডাস্ট ইত্যাদি পুরস্কারেও তার প্রাপ্তি রেকর্ড সংখ্যক।

আন্তর্জাতিক পুরস্কারের কথা বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসবে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা ‘লিজিয়ন অব অনার’ এর কথা। পেয়েছেন মরোক্কোর রাজ মোহাম্মদ VI এর হাত থেকে ‘এল’এতোইলি ডি’অর’ সম্মাননা। বেডফোর্ডশায়ার, জর্জটাউন এবং এডিনবারার মত নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানজনক ডক্টরেটে ভূষিত করে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন ফেলোশিপ। একমাত্র ভারতীয় নায়ক হিসেবে হয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার ‘শুভেচ্ছা দূত’, পেয়েছেন অত্যন্ত সম্মানজনক ‘ব্র্যান্ড লরিয়েট’ পুরস্কার।

তার সিনেমাগুলো নিয়ে খুব একটা বলা হলো না। যদি সম্ভব হয় অন্য কোনোদিন বলবো। আপাতত এখানেই শেষ করছি চলচ্চিত্র জগতের অতি পরিচিত মুখ, কালের অন্যতম সেরা নয়ক শাহরুখ খানের গল্প। যতিদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিনই ছবি করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন এই মহানায়ক। তাই তাকে নিয়ে লেখার এখানেই শেষ নয়। এক প্রজন্মের রাজা তিনি, তাই বলে অপর প্রজন্মে প্রজা হবেন কেন? তিনি রাজা ছিলেন, তার রাজত্ব এখনো আছে এবং যতদিন তিনি থাকবেন ততদিনই থাকবে। তার পাড় ভক্তরা তাই অনেকসময় বলে থাকে-

“জাব তাক হ্যায় জান,
এসআরকে রেহেঙ্গে কিং খান।”

তথ্যসূত্রঃ

১) en.wikipedia.org/wiki/Shah_Rukh_Khan#Other_work

২) imshahrukhkhan.com

৩) SRK’s Autobiography: 20 Years a Decade

Related Articles