Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাইমন বলিভার: স্বাধীন দক্ষিণ আমেরিকার স্বপ্নদ্রষ্টা (১ম পর্ব)

মোহাম্মদ বিন সৌদ, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, আমেরিগো ভেসপুচি, সম্রাট চিন (কিন), সাইমন বলিভার- ভিন্ন দেশে ভিন্ন সময়ে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তিদের মধ্যে একটি সাধারণ মিল হচ্ছে, এদের সকলের নামানুসারে একটি দেশের নাম রাখা হয়েছে। ক্রমানুসারে সৌদি আরব, কলম্বিয়া, যুক্তরাষ্ট্র (আমেরিকা), গণচীন দেশগুলোর নামকরণে সাইমন বলিভার বাদে বাকিদের নামের ভূমিকা রয়েছে।

পৃথিবীতে মতান্তরে ২৫টি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নামকরণে এভাবে ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নাম ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এ তালিকায় সাইমন বলিভার সবার থেকে একটু আলাদা। তার নামে একটি নয়, বরং দু’টি দেশের নাম রাখা হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার স্বাধীনতার মানসপুত্র হিসেবে পরিচিত সাইমন বলিভারের সম্মানে বলিভিয়া এবং বলিভারিয়ান রিপাবলিক অভ ভেনেজুয়েলা- এই দু’টি দেশের নাম রাখা হয়েছে। তবে তার অসামান্য সংগ্রামের গণ্ডি শুধু এই দুই দেশের সীমানায় আবদ্ধ ছিল না। পুরো মহাদেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া এই সংগ্রামী ব্যক্তিকে বলা হয় ‘এল লিবারতাদোর’ বা মুক্তিদাতা।

বলিভিয়া ও ভেনেজুয়েলার পতাকাপিন; Image Source: Crossed Flag Pins

সাইমন বলিভার কে?

বিশ্ব রাজনীতির আঙিনায় সাইমন বলিভার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি দক্ষিণ আমেরিকার মোট ছয়টি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন ইউরোপীয় শাসনমুক্ত একটি মহাদেশের, যেখানে সকলে একটি স্বাধীন পরিচয়ে একতাবদ্ধ হয়ে বসবাস করবে। তার জন্ম ১৭৮৩ সালের ২৪ জুলাই, বর্তমান ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসের ক্রিওলেস নামক অঞ্চলে। ডন হুয়ান ভিসেন্তে বলিভার এবং তার স্ত্রী মারিয়া দে লা কনসেপসিয়নের চার সন্তানের মধ্যে ২য় ছিলেন তিনি।

তৎকালীন ভেনেজুয়েলার সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর একটি ছিল বলিভার পরিবার। সোনা এবং তামা ব্যবসার একচ্ছত্র অধিপতি ছিল এ পরিবার। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশু সব ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ করে একদিন যুদ্ধ সংগ্রামে জীবন কাটাবে, একথা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। তার পুরো নাম ছিল সাইমন হোসে আন্তোনিও ডি লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ বলিভার ই পালাসিওস। জন্মের তিন বছরের মাথায় বাবা এবং নয় বছরের মাথায় মাকে হারান তিনি। এরপর তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন এক চাচা।

সাইমন বলিভার; Image Source: Wikimedia Commons

চাচার পরামর্শে সাইমন রদ্রিগেজ নামক একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। একজন ধনীর দুলাল থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং বিপ্লবী চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার পেছনে এই শিক্ষকের ভূমিকা ছিল অন্যতম। তিনি তাকে তৎকালীন স্বনামধন্য লেখক, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদদের কাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তার পাঠ্যবিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ভলতেয়ার এবং রুশোর প্রবন্ধ। ফরাসি বিপ্লবের পেছনে এই দুই লেখকের অনবদ্য অবদানের কথা তখন বলিভারের অজানা ছিল না।

কিন্তু কয়েক বছর পর তার শিক্ষকের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ ওঠে। স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা সাইমন রদ্রিগেজ প্রাণভয়ে পালিয়ে যান। ফলে তার শিক্ষাজীবনের খানিকটা ছেদ পড়ে। পরে পারিবারিক অর্থায়নে তাকে শিক্ষালাভের জন্য ইউরোপের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি স্থানীয় ধনী পরিবারের ব্যক্তিবর্গের সাথে চলাফেরা করেন এবং শিক্ষাজীবন শেষে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা মারিয়া তেরেসা দেল তোরো আলাইজাকে বিয়ে করেন।

বলিভারের বিয়ের অনুষ্ঠান; Photograph: Santy Cardenas

১৮০২ সালে নবদম্পতি জাহাজে চেপে পাড়ি দেন কারাকাসের উদ্দেশে। দেশে ফিরে সংসারকর্মে ব্যস্ত থাকবেন এবং একটি সুন্দর পরিবার গড়ে তুলবেন, এমনই ছিল তার পরিকল্পনা। কিন্তু কপালে সেই সুখ সইল না। দেশের ফেরার পরই পীতজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তার স্ত্রী। এ শোক সইতে না পেরে তিনি ইউরোপে ফিরে গেলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, সেখানকার রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন। ইউরোপে পৌঁছানোর পর তিনি বেশ কিছুদিন ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট নামক এক প্রকৃতিবিদের সাথে পরিচিত হন। তিনিও সদ্য দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইউরোপে ফিরেছিলেন। তাই দু’জনের আড্ডা বেশ জমে উঠল। কথায় কথায় ভেনেজুয়েলার রাজনীতি নিয়ে আলাপ উঠল। তখন ফন হামবোল্ট মন্তব্য করে বসলেন,

“আমি মনে করি তোমার জন্মভূমি স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু আমি এখনও এমন কারো খোঁজ পেলাম না, যে এই স্বাধীনতা এনে দিতে পারবে।”

আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট; Painting: Joseph Karl Steiler

ফন হামবোল্টের এ মন্তব্য আড্ডার খাতিরে করা হলেও তা বলিভারের মনে গেঁথে যায়। তিনি স্পেন অধীনস্থ জন্মভূমির ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বের সাথে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।

বিপ্লবের অনুপ্রেরণা

১৮০৪ সালে ফ্রান্সের সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন লিটল কর্পোরাল খ্যাত নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ফ্রান্সের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সাইমন বলিভার। নেপোলিয়ন তার কাছে ছিলেন একজন প্রবাদপুরুষ। যদিও নেপোলিয়নের সম্রাট হয়ে যাওয়ার ঘটনা তার আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল, কিন্তু একটি জাতির উপর একজন ব্যক্তির অসীম ক্ষমতা এবং প্রভাব দেখে মনে মনে অনুপ্রাণিত হতেন তিনি। নেপোলিয়ন নামক নক্ষত্র যেন পুরো ফরাসি জাতির প্রতিনিধি হয়ে জ্বলছিল উজ্জ্বল হয়ে। বলিভার নিজেও এমন কীর্তির জন্য পিপাসু ছিলেন। বিলাসবহুল জীবনের প্রতি তার মোহ ছিল না। তার সকল আগ্রহ ছিল স্বাধীনতাকামী খ্যাতির প্রতি। তিনি দক্ষিণ আমেরিকায় বিপ্লব ঘটিয়ে অত্যাচারী স্প্যানিশ শাসকদের হাত থেকে মুক্ত করার ছক কষতে থাকেন।

নেপোলিয়নের মাথায় মুকুট পরানো হচ্ছে; Illustration: Ashley Doran

এসময়ে তার বাল্যকালের শিক্ষক সাইমন রদ্রিগেজের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ হয়। দুজনের মধ্যে এ বিষয়ে বিস্তর আলাপ হয়। বলিভারের বিপ্লবের ধারণা এবং তত্ত্ব গুরু রদ্রিগেজের মনে ধরে যায়। এবার তারা একটি নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেন, যা সাইমন বলিভারের বিপ্লবের সূচনার সাক্ষী হয়ে থাকবে চিরকাল। ১৮০৫ সালের ১৫ আগস্ট গুরু-শিষ্য মিলে ভ্রমণ করেন ইতালির রোমে। সেখানে মন্টে সাক্রো নামক একটি পাহাড়ে চলে যান তারা। বলে রাখা ভালো, রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এই পাহাড় স্বাধীনতা এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে বিবেচ্য।

বলিভারের শপথ নেওয়ার দৃশ্যের চিত্রায়ন; Photograph: Captura de pantalla  

এখানে বলিভার হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত গুরুর হাতে রেখে দৃঢ় চিত্তে শপথ করেন, নিজের দেশকে ভিনদেশীদের হাত থেকে মুক্ত করবেন। এরপর তিনি প্যারিসে ফিরে দেশে পাকাপাকিভাবে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। একসময়ের ধনীর দুলাল বলিভার ১৮০৭ সালে দেশে ফিরে আসে বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত এক নতুন মানুষ হিসেবে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু

বলিভারের প্রত্যাবর্তনের এক বছরের মাথায় স্পেনের রাজনীতিতে বড় রকমের পালাবদল ঘটে যায়। ফ্রান্স সেবার স্পেন আক্রমণ করে বসে। এর ফলে ভেনেজুয়েলার ঔপনিবেশিক এই দেশটির ক্ষমতা বহুলাংশে কমে যায়। এদিকে কারাকাসের নগর কাউন্সিল পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে স্প্যানিশ ভাইসরয়কে দেশ থেকে বিতাড়িত করে দেয়। কিন্তু নতুন ত্রাস ছিল ফ্রান্সের আগ্রাসন। তাই ভেনেজুয়েলাকে ফ্রান্সের দখল থেকে বাঁচাতে আরেকটি পরাশক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রয়োজন। তরুণ বিপ্লবী সাইমন বলিভার এ সময় লন্ডনে চলে যান। সেখানে ব্রিটিশ সরকারের সাথে জরুরি সভা করেন এবং ফ্রান্সের আগ্রাসন রুখে দেওয়ার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন।

তার আবেদন নামঞ্জুর করে দেয় ব্রিটিশরা। তবে যাত্রা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি। তার সাথে দেখা হয় ফ্রান্সিসকো ডি মিরান্দা নামক এক নির্বাসিত স্বদেশী বিপ্লবীর। বলিভার তাকে দেশে ফিরে এসে নব্য স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতা হওয়ার অনুরোধ করেন। তিনিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মতি জানিয়ে ভেনেজুয়েলার উদ্দেশে রওনা দেন।

ফ্রান্সিসকো ডি মিরান্দা; Image Source: The British Empire

ওদিকে স্প্যানিশদের বিতাড়িত করার পর ভেনেজুয়েলার মঞ্চ সরগরম। নতুন সরকার গঠনের পর সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। গঠিত হয়েছে জাতীয় সংসদ। সংসদ সদস্য না হয়েও সাইমন বলিভার তার জীবনের প্রথম উন্মুক্ত বক্তব্য রাখেন ১৮১১ সালে। তিনি সেদিন দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন,

“আসুন ,আমরা ভয়কে জয় করে আমেরিকার স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করি। এ কাজে বিলম্ব করা মানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া।” 

সংসদের বরাতে ১৮১১ সালের ৫ জুলাই ভেনেজুয়েলাকে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতার আনন্দে বলিভার সেদিন তার সকল ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দেন। কিন্তু তখনও স্প্যানিশ ত্রাস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল না। ভেনেজুয়েলা তাই তার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সেনা মোতায়েন করে কড়া পাহারা বহাল রেখেছিল। দেশটির সেনাপতি হন মিরান্দা এবং বলিভার কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদবী ধারণ করে পুয়ের্তো কাবেহো বন্দরের দায়িত্ব লাভ করেন।

ভেনেজুয়েলায় থেকে যাওয়া বিপ্লব বিরোধীদের পরিণতি নিয়ে মিরান্দা এবং বলিভারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এরপর থেকে দু’জনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯ জুলাই স্প্যানিশ বাহিনীর আক্রমণ হয় পুয়ের্তো কাবেহো বন্দরে। অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেদিন বলিভার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান। যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় এবং স্প্যানিশ বাহিনী বন্দরটির চারপাশে অবরোধ আরোপ করে।

বর্তমানের পুয়ের্তো কাবেলো বন্দর; Photograph: Alexander Kaut

টালমাটাল ভেনেজুয়েলা

ভেনেজুয়েলার কোষাগার তখন শূন্যের কোঠায়। তার উপর স্প্যানিশ অবরোধে নতুন দেশটির অর্থনীতি একদম ভেঙে গেল। অবরোধ চলমান অবস্থায় ১৮১২ সালের ২৬ মার্চ, কারাকাসে আঘাত হানে এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প। এতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। কাকতালীয়ভাবে যে অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়, তা ছিল স্বাধীনতাকামীদের অঞ্চল। অপরদিকে বিপ্লব বিরোধী স্প্যানিশ এবং স্পেন সমর্থকদের অঞ্চলে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রচারিত হলো নানা কুসংস্কার। ফলে, জাতীয় ঐক্য ভেঙে পড়ে।

স্প্যানিশ সেনাপতি হুয়ান ডোমিঙ্গো ডি মন্টেভার্দে এ সুযোগে তিন হাজার সেনা নিয়ে ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ করেন। তখন মিরান্দার অধীনে ছিল পাঁচ হাজারের বেশি সৈন্য। কিন্তু অতি সাবধানী মিরান্দা যুদ্ধে পূর্ণশক্তি ব্যবহার না করে উল্টো স্প্যানিশদের সাথে এক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে করে ভেনেজুয়েলা পুনরায় স্প্যানিশদের দখলে চলে আসে।

ভাইসরয়কে বিতাড়িত করার পর ভেনেজুয়েলায় ১ম প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়; Painting: Juan Lovera

এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ বলিভার তার অনুগত সেনাদের জড়ো করে মিরান্দাকে গ্রেপ্তার করেন এবং স্প্যানিশদের হাতে সোপর্দ করে দেন। জীবনের বাকি সময় সেনাপতি মিরান্দা স্প্যানিশদের অন্ধকার কারাগারে বন্দি থাকেন। ভেনেজুয়েলার স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নভঙ্গ হলেও হাল ছাড়েননি বলিভার। তিনি দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান নিউ গ্রানাডার কার্টাজেনা অঞ্চলে। তৎকালীন নিউ গ্রানাডা রাজ্য বর্তমান সময়ের কলম্বিয়া, পানামা, ইকুয়েডর এবং ভেনেজুয়েলার কিছু অংশ জুড়ে ছিল। এখানে তিনি তার বিখ্যাত রাজনৈতিক প্রবন্ধ ‘দ্য কার্টাজেনা ম্যানিফেস্টো’ রচনা করেন। সেখানে তিনি ভেনেজুয়েলা পতনের পেছনে শক্তিশালী সরকারের অভাবকে দায়ী করেন। তিনি স্প্যানিশদের বিতাড়িত করতে মহাদেশের সকলকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

ভেনেজুয়েলা পুনরুদ্ধার অভিযান এবং ব্যর্থতা

নতুন দেশে গিয়ে ভেনেজুয়েলা পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন করে সৈন্য যোগাড় করতে থাকেন বলিভার। এরপর তিনি ১৮১৩ সালে পুনরায় ভেনেজুয়েলা আক্রমণ করেন। স্প্যানিশদের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ৬ আগস্ট রাজধানী কারাকাসে প্রবেশ করেন তিনি। কারাকাসকে শত্রুমুক্ত করার পর তাকে স্থানীয়রা ‘এল লিবারতাদোর’ বা মুক্তিদাতা উপাধি প্রদান করে। দেশটির একনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি।

কিন্তু, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন- এ কথা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলেন বলিভার। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভেনেজুয়েলায় গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেল। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ফের স্প্যানিশ আগ্রাসন ঘটে এবং বলিভার বাহিনী পরাস্ত হয়। কৌশলে স্প্যানিশদের চোখে ধুলো দিয়ে নিউ গ্রানাডায় পালিয়ে যান বলিভার। এখানে তিনি স্থানীয় সরকারের আহ্বানে কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী দলকে বর্তমান কলম্বিয়ার বোগোতা থেকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু, বিপ্লবীদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়ে জ্যামাইকা পালিয়ে যান।

প্রাক্তন নিউ গ্রানাডার মানচিত্র; Image Source: Wikimedia Commons

বলিভার বুঝতে পারলেন, তিনি শুধু সমরযুদ্ধে জয়ী হয়ে ভেনেজুয়েলা স্বাধীন করতে পারবেন না। তিনি এবার কলম হাতে নিলেন। ‘দ্য লেটার ফ্রম জ্যামাইকা’ নামে একটি রাজনৈতিক চিঠি রচনা করে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি স্প্যানিশদের সাথে ভেনেজুয়েলার সম্পর্ক মৃতপ্রায় বলে মন্তব্য করেন। এ ঐতিহাসিক চিঠিতে তিনি স্প্যানিশদের অবশ্যম্ভাবী পতনের কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের আদলে আমেরিকায় স্বাধীন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আলোকপাত করেন। তবে রাজার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার প্রস্তাব দেন তিনি।

ব্রিটিশ সরকার তাকে সাহায্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র থেকেও কোনো সহায়তার আশ্বাস পাননি তিনি। ওদিকে ১৮১৫ সালে এক বিশাল সুসজ্জিত সেনাবাহিনী পাঠায় স্পেন। উপায় না দেখে বলিভার এবার হাইতি সরকারের দ্বারস্থ হন। সম্প্রতি ফরাসি আগ্রাসন থেকে মুক্ত হওয়া হাইতি বলিভারকে সাদরে গ্রহণ করে নেয় এবং অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে।

নিউ গ্রানাডায় অভিযান

সাইমন বলিভার তার মুক্তিকামী সহযোদ্ধাদের বলেন

“নিয়তি আমাকে তোমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে পাঠিয়েছে। যুদ্ধ করো এবং বিজয় তোমাদের সুনিশ্চিত। কারণ সৃষ্টিকর্তা তাকেই বিজয়ী করেন, যারা একাগ্রচিত্তে চেষ্টা চালিয়ে যায়।”  

পরবর্তী তিন বছর ধরে স্প্যানিশদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন সাইমন বলিভার। বেশকিছু খণ্ডযুদ্ধে জয়ী হলেও সামগ্রিকভাবে স্প্যানিশদের পরাজিত করা যাচ্ছিল না। স্প্যানিশদের অন্তরালে থাকার জন্য তিনি ১৮১৭ সালে অরিনোকো নদীর অববাহিকায় নিজের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেখান থেকে মুক্তিকামী ধ্যানধারণা এবং প্রবন্ধ সংকলিত করে নিয়মিত পত্রিকা বের করতে থাকেন। এসব পত্রিকা বিপ্লবীদের মাঝে বিতরণ করা হতো। তখন তার অধীনে দুটো দল ছিল। এই দুই দলের নেতা ছিলেন হোহে আন্তোনিও পায়েজ এবং ফ্রান্সিসকো ডি পাউলা সান্তান্দার। দীর্ঘ চার বছরের সংঘাত শেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার নিউ গ্রানাডার কেন্দ্রীয় ভাইসরয়ালটিকে আক্রমণ করে দেশ থেকে উৎখাত করবেন। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ।

দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে নিউ গ্রানাডা মুক্ত করেন বলিভার; Image Source: Heritage Image Partnership Ltd

বলিভার বাহিনীর এ আক্রমণকে সমরযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে সাহসী অভিযান হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তখন এ অঞ্চলে বর্ষাকাল চলছিল। নদীনালা পানিতে ভরপুর ছিল। তাই আড়াই হাজার সৈন্যের ছোট একটি দল নিমজ্জিত পথ দিয়ে বহু কষ্টে অগ্রসর হতে থাকে। কোমর উচ্চতার পানিতে ডুবে টানা সাতদিন পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকে দলটি। তারা চামড়ার নৌকায় চড়ে ১০টি নদী অতিক্রম করে। বলিভার তার বাহিনী নিয়ে পিসবা নামক গিরিপথ দিয়ে অগ্রসর হন।

কনকনে ঠাণ্ডা এবং জোরালো বায়ুর কারণে পথ অত্যন্ত দুর্গম ছিল। স্প্যানিশরা স্বপ্নেও ভাবেনি, এমন পথ দিয়ে বলিভার বাহিনী এসে তাদের আক্রমণ করে বসবে। অনেকটা অপ্রস্তুত স্প্যানিশদের উপর চড়াও হয়ে যায় বলিভার বাহিনী। পথিমধ্যে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে শত্রুদের অতর্কিতে হামলা চালনোর সুবিধা বড় হয়ে উঠল। ১৮১৯ সালের ৭ আগস্ট, বয়াচা অঞ্চলে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শক্তিশালী স্প্যানিশরা সাইমন বলিভারের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এর তিনদিন পর বিজয়ী বলিভার বোগোতা শহরে প্রবেশ করেন। দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসে এ ঘটনা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বোগোতায় সাইমন বলিভারের মূর্তি; Photograph: Nirian

উড়ল মুক্তিকেতন

তবে যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি, এ কথা ভালোভাবেই জানতেন বলিভার। এবার তিনি আগের ভুল করলেন না। শুরুতেই নব্য অধিকৃত অঞ্চল শাসনের জন্য একটি কার্যকরী কংগ্রেস গঠন করলেন। তিনি নিজে রাষ্ট্রপতি এবং সামরিক একনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন। উপরাষ্ট্রপতি করা হয় সান্তান্দারকে। নিউ গ্রানাডার কলম্বিয়া, পানাম, ভেনেজুয়েলা এবং ইকুয়েডরের কিটো অঞ্চল একত্র করে তিনি ‘গ্রান কলম্বিয়া’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেন। তবে এসব অঞ্চলে তখনও স্প্যানিশ সমর্থক বাহিনী অবস্থান করছিল।

তাই এ অর্জন অনেকটাই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কাগজের অর্জন সত্য হতে বেশি দেরি হয়নি। ১৮২০ সালে স্পেনে শুরু হয় নতুন বিপ্লব। এর ফলস্বরূপ স্প্যানিশ রাজা ৭ম ফার্দিনান্দ লিবারেলদের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। সাইমন বলিভার স্পেনের কোন্দলের সুবিধা আদায় করলেন নিজের দেশে। রাজার সিদ্ধান্তে অনেকটা হতাশ থাকা স্প্যানিশ বাহিনীকে তিনি ছয় মাসের যুদ্ধবিরতির আহ্বান করেন। সেনাপতি মোরিলো এবং সাইমন বলিভার ভেনেজুয়েলার সান্তা আনাতে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

গ্রান কলম্বিয়ার মানচিত্র; Image Source: Population Data

দেখতে দেখতে ছ’মাস শেষ হয় গেল। ফের শুরু হলো যুদ্ধ। কিন্তু এ সময়ে বলিভার বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের প্রস্তুতি ছিল আগের তুলনায় ভালো, সৈনিকেরাও ছিল আরও পরিণত। যার প্রমাণ মিলল যুদ্ধক্ষেত্রে। ১৮২১ সালের জুন মাসে ঘটা এ যুদ্ধকে ইতিহাসবিদরা বলেন ‘কারাবোবোর যুদ্ধ’। স্প্যানিশদের শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে সেদিন বলিভারের জন্মভূমি সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা লাভ করেছিল।

সে বছরই গ্রান কলম্বিয়ার সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। উপরাষ্ট্রপতির হাতে শাসনভার অর্পণ করে তরুণ সেনানায়ক আন্তোনিও হোসে ডি সুক্রেকে সাথে নিয়ে তিনি এবার ইকুয়েডরকে স্বাধীন করার জন্য অগ্রসর হন। রাজধানী কিটোর প্রবেশদ্বারে আক্রমণ করেন বলিভার। আর প্রশান্ত মহাসাগরের তীরের দিক থেকে আক্রমণ চালান সুক্রে। ১৮২২ সালের ২৪ মে ইকুয়েডর বিজিত হয়। পরদিন রাজধানী কিটোতে আত্মসমর্পণ করে স্প্যানিশরা।

কারাবোবোর যুদ্ধ; Image Source: CGTN

যুদ্ধ জয় ছাড়াও কিটোতে বলিভারের অন্যরকম একটি অর্জন হয়েছিল। তিনি সেখানে ম্যানুয়েলা সাইয়েঞ্জ নামক এক বিপ্লবী নারীর সাক্ষাৎ পান। তিনি সাইমন বলিভারের কাছে প্রেমের প্রস্তাব দেন, বলিভারও তার ভালোবাসায় সাড়া দেন।

ম্যানুয়েলা সাইয়েঞ্জ; Image Source: Wikimedia Commons

ইকুয়েডর বিজয় ছিল সাইমন বলিভারের বিস্তৃত স্বপ্নের একটি অংশমাত্র। তার কাজ তখনও শেষ হয়নি। সংযুক্ত দক্ষিণ আমেরিকার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। কিন্তু মহাদেশের অনেক দেশে তখনও স্প্যানিশ রাজত্ব চলছিল। তিনি সেসব দেশ স্বাধীন করার জন্য তার চলমান বিপ্লবকে আরও বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নেন। তার পরবর্তী যাত্রায় সঙ্গী হন ম্যানুয়েলা সাইয়েঞ্জ। (এরপর দেখুন ২য় পর্বে)

This is the first part of the two-part biography of Simon Boliver, the famous revolutionary leader, who freed Latin America from the grasp of Spain. He is considered The Liberator of the Latin American people. 

All the references are hyperlinked inside the article.

Featured Image: Boliver Archive

Related Articles