Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো: প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যর জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা

স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো এমন একজন মানুষ যার কারণে পৃথিবীর সাধারণ মানুষরা প্রকৃতির পাঠশালার প্রতি সচেতন হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির বিস্ময় ও রহস্যকে জানার জন্য, মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যারা আজ ঘুরে বেড়ান, কষ্ট সহ্য করেন তাদের কাছে স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা। তার আবিষ্কারমনস্ক, অভিযানপ্রিয় ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ডকুমেন্টারিগুলোর প্রশংসা করেন না এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রকৃতির বিষয় নিয়েও যে এত আনন্দদায়ক ও বিস্ময়কর টিভি অনুষ্ঠান হতে পারে তা তার আগে আর কেউ ভাবেনি।

স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো ১৯৫২ সালে বিবিসিতে একজন নবীশ প্রশিক্ষণ কর্মী হিসেবে যোগ দেন। যোগদানের আগে তিনি কেবলমাত্র একটি টিভি অনুষ্ঠান দেখেছিলেন। ‘এনিমেল, ভেজিটেবল, মিনারেল’ নামের একটি অনুষ্ঠান দিয়ে তার ক্যারিয়ারের সূচনা হয়। ১৯৫৪ সালে ২৮ বছরের যুবক ডেভিড অ্যাটেনবরোর প্রযোজনায় বিবিসিতে প্রথম প্রচারিত হয় ‘জু কোয়েস্ট’।

অনুষ্ঠানটিকে স্টুডিও থেকে সরাসরি সম্প্রচারের সময় ধারণকৃত ফুটেজের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাণীকে উপস্থাপন করা হয়। প্রোগ্রামটি তৈরিতে লন্ডন চিড়িয়াখানার রেপ্টাইল হাউজের কিউরেটর জ্যাক লেস্টার তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। জু কোয়েস্ট অনুষ্ঠানটিতে শিম্পাঞ্জি, অজগর, বার্ড অব প্যারাডাইজসহ অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণী দেখানো হয়। অনুষ্ঠানটি তুমুল জনপ্রিয় হয় এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান নির্মাতা থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শকও বুঝতে পারলো আর দশটি অনুষ্ঠানের মতো বন্যপ্রাণী বিষয়ক অনুষ্ঠানও চিত্তাকর্ষক ও আনন্দদায়ক করে নির্মাণ করা সম্ভব। বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতি ও প্রাণী বিষয়ক আজকের সব অনুষ্ঠানের পূর্বসূরি হচ্ছে ‘জু কোয়েস্ট’ প্রোগ্রামটি।

Zoo Quest অনুষ্ঠান ধারণের সময়কার ছবি; Image Source: BBC One

ডেভিড অ্যাটেনবরো যখন বিবিসি-টু এর কন্ট্রোলার হিসেবে কাজ করছিলেন, তখন তিনি ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি হিসেবে রঙিন টেলিভিশনের সম্ভাবনা বুঝতে পারেন। প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মান প্রচার মাধ্যমকে পেছনে ফেলে তাদের তিন সপ্তাহ আগে সমগ্র ইউরোপে তিনি প্রথমবারের মতো রঙিন টিভি অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেন। তার দেওয়া ধারণা মতে, শিল্পকলার ইতিহাসবিদ কেনেথ ক্লার্ক ধারাবাহিক ‘সিভিলাইজেশন’ এর বিষয়বস্তু লেখেন ও উপস্থাপন করেন। পঞ্চাশ মিনিট দীর্ঘ ও তেরো পর্বে বিভক্ত এই প্রোগ্রামটি ইউরোপের অন্ধকার যুগ, রেনেসাঁ, রোমান্টিক, ইম্প্রেশনিস্ট ছবির নিদর্শন ছাড়াও গ্রিক, রোমান, মিশরীয় ও চীনা সভ্যতার ইতিহাসকেও বেশ সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করে।

এর পরপরই প্রচারিত মানবতাবাদী বিজ্ঞানী জ্যাকব ব্রনোস্কি পরিচালিত ‘দ্য অ্যাসেন্ট অব ম্যান’ অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয়তা পায়। ডেভিড অ্যাটেনবরোর এ ধরনের বিষয়গুলোকে কীভাবে উপস্থাপন করলে দর্শকপ্রিয়তা পাবে সে সর্ম্পকে ভালো ধারণা রাখতেন। সফলভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও  উপস্থাপন করানোর মাধ্যমে বিজ্ঞান, প্রকৃতি, সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান ও প্রামাণ্যচিত্রকে তিনি ধীরে ধীরে মূল ধারার অনুষ্ঠান হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলেন। ইতিহাস, শিল্পকলা, রাজনীতির বর্তমানে প্রচলিত জনপ্রিয় সব প্রামাণ্যচিত্রের পূর্বসূরী হিসেবে ‘সিভিলাইজেশন’ সিরিজটিকে ধরা হয়ে থাকে।

মন্টি পাইথন’স ফ্লায়িং সার্কাস; Image Source: IMDb

বিবিসির অনুষ্ঠান বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় অ্যাটেনবরো উদ্যোগী হয়ে অনেক ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ‘মন্টি পাইথন’স ফ্লায়িং সার্কাস‘ নামের অভিনব একটি রম্য অনুষ্ঠান সম্প্রচার ব্যবস্থা করেন, যাতে জন ক্লিস, মাইকেল প্যালিন, টেরি জোনস, এরিক আইডেল, গ্রাহাম চ্যাপম্যান ও টেরি গিলিয়ামের মতো বড় তারকারা অভিনয় করেন। অনুষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী খ্যাতিলাভ করে এবং পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের রম্য অভিনয়কে প্রভাবিত করে। পাশ্চাত্য সভ্যতার উন্নাসিক মানসিকতা, ব্যতিক্রম কথোপকথন আর অভূতপূর্ব প্রহসনধর্মী উপস্থাপনার এ অনুষ্ঠানটি ব্রিটিশ জাতির সংস্কৃতি ও রসবোধকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছিল।

উটের দেহাবশেষে বিয়ার গ্রিলসের রাত্রি যাপনের বহু আগে থেকে অ্যাটেনবরো অনেক দুর্গম বনাঞ্চল থেকে বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা তুলে আনার কাজ করছেন। বিবিসির নির্বাহীর কাজটি ছেড়ে দেওয়ার পর অ্যাটেনবরো একজন অভিযাত্রী পর্যটক হিসেবে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন এবং নতুন নতুন টিভি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবীর নতুন রূপকে আমাদের সামনে উপস্থাপন শুরু করেন। এমনও অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিস্তারিত বিবরণ তার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যার সম্পর্কে ইউরোপের কোনো ধারণাই ছিল না। সলোমন দ্বীপপুঞ্জে আদিবাসীদের সংস্কৃতি অনুধাবন করতে গিয়ে তিনি স্বল্প পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। জীবনধারণের আমাদের আত্মকেন্দ্রীক উচ্চকিত ধারণার বাইরেও যে মানুষের সংস্কৃতি আর অর্জনের আরো বহুমুখিতা থাকতে পারে, তা তিনি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

BBC Earth এর প্রযোজনায় নির্মিত ‘দ্য প্রাইভেট লাইফ অফ প্ল্যান্টস’; Image Source: Reliance Home Videos

বর্তমানে টেলিভিশন সিরিজের বিষয় হিসেবে প্রাকৃতিক ইতিহাসের যে জনপ্রিয়তা, তা আজকের অবস্থায় নিয়ে আসতে স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো নিরলস কাজ করে গেছেন। ডেভিড অ্যাটেনবরো ১৯৭৯ সালে অভূতপূর্ব ক্যামেরা কৌশল আর অভিনব ছবির মাধ্যমে প্রাণীজগতের অকৃত্রিম বিবরণ সমৃদ্ধ প্রামাণ্যচিত্র ‘লাইফ অন আর্থ’ নির্মাণ করেন। বলা হয়, সে সময় প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এই প্রামাণ্যচিত্রটি সরাসরি উপভোগ করেছিলো।

বিভিন্ন সময়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীকে পরিচিত করার জন্য অ্যাটেনবরো খটমটে বৈজ্ঞানিক নামের পরির্বতের সহজ-সরল নাম ব্যবহার করেছেন যা পরবর্তীতে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৯৪ সালে ‘দ্য প্রাইভেট লাইফ অফ প্ল্যান্টস’ প্রামাণ্যচিত্র তৈরির সময় স্যার অ্যাটেনবোরো লক্ষ্য করেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সপুষ্পক উদ্ভিদকে ‘অ্যামরফোফেলাস টিটেনাম’ নামের একটি বেশ শক্ত নাম দেওয়া হয়েছে। তিনি তার স্ক্রিপ্টে নামটি পাল্টে রাখলেন ‘টিটাম অরাম’। অনেকের কাছে এটা অজানা যে, অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নামকরণে ডেভিড অ্যাটেনবরোর নাম ব্যবহার করা হয়েছে! এর মধ্যে আছে একটি উড়তে অক্ষম গুবরে পোকা, সূর্যমুখী ফুলের এক প্রজাতি এবং ‘অ্যাটেনবরোসোরাস’ নামে লম্বা গলার অধিকারী এক ডাইনোসর।

ডেভিড অ্যাটেনবরোর নতুন প্রজেক্ট: David Attenborough’s Great Barrier Reef: An Interactive Journey 

ডেভিড অ্যাটেনবরো এবং তার সহযোগীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও কার্যকরী উদ্যোগ ছাড়া আমরা সম্ভবত এই গ্রহের অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেই পারতাম না। ১৯৫০ সাল থেকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘জু কোয়েস্ট’, টেলিভিশন পর্দায় প্রথমবারের মতো কমোডো ড্রাগনের উপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের মতো বহু চমকে দেওয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি আমাদের প্রকৃতি সর্ম্পকে জানিয়েছেন।

২০০১ সালে তার পরিচালিত অনুষ্ঠান ‘ব্লু প্ল্যানেট’ এবং ২০১৭ এর ‘ব্লু প্ল্যানেট ২’ এর মাধ্যমে তিনি এক নতুন অদেখা জগত সম্পর্কে  আমাদের অন্তর্দৃষ্টি জাগরণের উদ্যোগ নেন। এই ধারাবাহিকের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো গভীর সাগরের অদেখা বিস্ময়কর জগৎ দেখে কোটি মানুষ শিহরিত হয়ে ওঠে। হেয়ারি অ্যাংগলার ফিশ ও ডাম্বো অক্টোপাসের মতো সামুদ্রিক প্রাণীকে তিনিই প্রথমবারের মতো ক্যামেরায় ধারণ করেন। বলা হয়, অ্যাটেনবরো ছাড়া আর কোনো মানুষ আমাদের পরিপার্শ্ব সম্পর্কে সচেতন করতে এত কঠোর পরিশ্রম করেননি।

‘ব্লু প্ল্যানেট’ মিনি টিভি সিরিজ; Image Source: YouTube

রঙিন সম্প্রচার থেকে থ্রিডি টেলিভিশন- প্রায় সব ক্ষেত্রে ডেভিড অ্যাটেনবরো সম্প্রচার প্রযুক্তির নতুন ও আকর্ষণীয় দিগন্ত উন্মোচন করে দর্শকদের ধন্য করেছেন। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের অজানা জগত আবিষ্কার করতে পানির ১,০০০ ফুট নিচে এক মিনি সাবমেরিনের মাধ্যমে ডাইভিং করে ঐ অঞ্চলে গভীর ডাইভিংয়ে এযাবৎকালের রেকর্ড ভেঙে বসেন। সাম্প্রতিক সময়ে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষকে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে সাহায্য করছেন। অনেকেই আশা করছেন, স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো নির্মিত নতুন নতুন প্রামাণ্যচিত্র থেকে ভবিষ্যতের সম্প্রচার প্রযুক্তির নতুন কোনো পরিবর্তনের আভাসও হয়তো আমরা পাবো।

মজার মানুষ স্যার ডেভিড এটেনবরো, বাকিংহাম প্যালেসে দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন; Image Source: Metro/Getty Images
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওমাবার সাথে একান্ত আলাপচারিতায়; Image Source: YouTube

স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো সবসময় বলে এসেছেন, তিনি টিভি প্রোগ্রামের উপস্থাপক হয়েছেন বলে প্রকৃতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠেননি। বরং তার মাথায় সব সময় প্রকৃতির রহস্য উপভোগের বিষয়টি কাজ করেছে। এটা তার জীবনে প্রেমের মতো পরমানন্দদায়ক। সময়ের সাথে তার প্রিয় প্রাণীজগতের ওপর আসন্ন সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কা সর্ম্পকে তিনি অত্যন্ত সচেতন। পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে তার তৈরি প্রামাণ্যচিত্রগুলো সাবলীল ভঙ্গিতে দর্শকদের চিন্তাকে উস্কে দিয়ে চলেছে। বর্ণনাশৈলীর এমন সারল্য ও গভীরতা বিপন্ন পরিবেশ রক্ষায় আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তোলে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বহু রাষ্ট্রপ্রধান তার অনুরাগী। অজস্র ভক্ত ও অনুরাগীকে জীবনের বিস্তৃতি ও প্রকৃতির বৈচিত্র্য বিষয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার ক্ষেত্রে স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো এ সময়ের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত।

This article is in Bangla language. The article describes Sir David Attenborough's astonishing work on animal and nature. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: Attenborough's Reef

Related Articles