স্যার রোনাল্ড রস (২য় পর্ব): ম্যালেরিয়া গবেষণায় বারংবার ব্যর্থতা

১৮৮৮ সালে রোনাল্ড রস ইংল্যান্ডে ফিরে ভর্তি হন ‘পাবলিক হেলথ’-এ ডিপ্লোমা কোর্সে। সেইসাথে অবসরগুলোতে শখের বসে সাহিত্যচর্চা আর সঙ্গীতচর্চাও চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। ডিপ্লোমা কোর্স শেষে পরের বছর বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে আসেন কর্মস্থল ব্যাঙ্গালুরুতে।

সামরিক হাসপাতালে কাজের পাশাপাশি তিনি আবারো মন দেন ম্যালেরিয়া সংক্রমণ প্রক্রিয়ার গবেষণায়। তার প্রকাশিত প্রথম গবেষণাপত্রে তিনি মত ব্যক্ত করেন, মশার কামড়ে বিষাক্ত কোনো পদার্থ মশা থেকে মানুষের রক্তে চলে আসে, যার দরুন ম্যালেরিয়া সংক্রমিত হয়। ইতোমধ্যেই চার্লস ল্যাভেরন নামক একজন ফরাসি চিকিৎসক ম্যালেরিয়া রোগের কারণ হিসেবে ম্যালেরিয়া পরজীবী আবিষ্কার করেছেন। ভারতীয় মেডিকেল জার্নালে এই তথ্য প্রকাশিত হলেও রোনাল্ড রস একমত হতে পারছিলেন না। যাকেই সামনে পেতেন, তার আঙুল থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত নিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে তাকিয়ে থাকতেন দীর্ঘ সময় ধরে। সুস্থ-অসুস্থ কারো রক্তে যদি সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতির ক্ষুদ্র জীবগুলোর দেখা মেলে একটিবার, যেগুলোর কথা ল্যাভেরন তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন।

চার্লস ল্যাভেরন; Image Source: London School of Hygiene & Tropical Medicine

দিনের পর দিন বহু মানুষের রক্ত পরীক্ষা করেও ল্যাভেরনের অর্ধচন্দ্রাকৃতির ম্যালেরিয়া পরজীবীগুলোর দেখা না পেয়ে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ভাবতে শুরু করেন, ল্যাভেরন সাহেব গবেষণায় ব্যবহৃত ম্যালেরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে হয়তো এমনি সেই পরজীবীগুলো অবস্থান করেছিলো। ম্যালেরিয়া রোগের সাথে এই পরজীবীগুলোর কোনো যোগসাজশ থাকতে পারে না। তিনি এ-ও ভাবেন, ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছেন হয়তো চার্লস ল্যাভেরন।  

ল্যাভেরনের তথ্যকে ভুল প্রমাণের জন্য উঠেপড়ে লাগেন তিনি। হতে পারে যে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের ত্রুটির কারণে তিনি ল্যাভেরন সাহেবের পরজীবীগুলোর দেখা পাচ্ছিলেন না। তিনিও জেদ ধরে বসলেন, পরজীবীগুলোর দেখা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি ল্যাভেরনের গবেষণা মানবেন না। কাজকর্মে আবারো আগ্রহ হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন রোনাল্ড। সহকর্মীরা তার এ দুরবস্থার কথা জানতে পেরে পরামর্শ দেন, তিনি যেন একবার লন্ডনে চিকিৎসক প্যাট্রিক ম্যানসনের সাথে সাক্ষাৎ করেন, সে সময়ে ম্যালেরিয়ার মতো গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের রোগগুলোর উপর ড. ম্যানসনকে একজন দক্ষ চিকিৎসক মানা হতো। তাই রোনাল্ড সামরিক বাহিনী থেকে দ্বিতীয়বারের মতো ছুটি নিয়ে ১৮৯৪ সালে আবারো ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে।

ড. প্যাট্রিক ম্যানসনের সাথে যোগাযোগ করলে, তিনি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে রোনাল্ডকে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর রক্তে সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতির পরজীবীগুলো দেখার ব্যবস্থা করেন। দেখার সঙ্গে সঙ্গে রোনাল্ড বুঝে যান, এতদিন তিনি ভুল ছিলেন, কেননা তার পুরো কর্মজীবনে কোনো সুস্থ মানুষের রক্তে তিনি এমন আকৃতির দেখা পাননি। রোনাল্ড ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে শুরু করলেন ম্যানসনের গবেষণাগারে। ম্যালেরিয়ার প্রতি তার এত আগ্রহ দৃষ্টি এড়ায়নি ম্যানসনের, তার শিক্ষানবিশ হবার যোগ্য মনে হলো রোনাল্ড রসকে। ম্যানসন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এ পর্যন্ত যা যা তথ্য ম্যালেরিয়া গবেষণায় খুঁজে পেয়েছেন, তা রোনাল্ডের সাথে পরামর্শ করবেন।

ড. প্যাট্রিক ম্যানসন একদিন রোনাল্ডকে ডেকে বলেন যে, তিনি ধারণা করছেন, ফাইলেরিয়া পরজীবী যেরকম করে মশা দ্বারা বাহিত হয়, ঠিক ওভাবেই ম্যালেরিয়াকেও মশা বহন করে কি না। হতে পারে যে, কোনো মশা ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীকে কামড়ালে রক্তের সাথে সাথে ম্যালেরিয়া পরজীবী মশার দেহে চলে আসে। মশাটি যখন কোনো জলাশয়ে ডিম পাড়ে, সেই ডিমের সাথে পরজীবীগুলোও জলাশয়ের সাথে মিশে যায়। আর সে জলাশয়ের পানি পান করার ফলে ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়।

ড. প্যাট্রিক ম্যানসন, ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জনক এবং স্যার রোনাল্ড রসের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী শিক্ষক;
Image Source: School of Tropical Medicine

ম্যানসনের এ ধারণা শুনে রোনাল্ডের মাথায় আলো জ্বলে ওঠে। এমনটা কেন এতদিন মনে হলো না তার! ম্যালেরিয়া গবেষণায় নতুন দিশা খুঁজে পান তিনি। ম্যানসনের বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিল যে তার কথাগুলো শোনামাত্র রোনাল্ডের কাছে জ্বলন্ত সত্য মনে হচ্ছিলো। যদি ম্যানসনের এ ধারণা প্রমাণ করা যায় কোনোভাবে, তবে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি উন্মোচন করা সম্ভব। ম্যানসনের গল্প এখানেই শেষ নয়, একথা অনস্বীকার্য যে, রোনাল্ডের অসামান্য কীর্তির পেছনে ছিল তারই দিক-নির্দেশনা। রোনাল্ডের পুরো গবেষণা চলাকালীন ম্যানসন নানাভাবে রোনাল্ডকে সাহায্য করেছেন, রোনাল্ডও নিষ্ঠার সাথে লেগে রইলেন এর শেষটা দেখবার জন্য। আর এভাবেই একদিন সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি।

নবোদ্যমে গবেষণায় মন দিতে তিনি আবারো ১৮৯৫ সালে কর্মস্থল ব্যাঙ্গালুরুতে ফিরে আসেন। রোনাল্ডের সামরিক হাসপাতালে যতজন ম্যালেরিয়া রোগী আসত, সবার আঙুল থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করে দিলেন তিনি। বারবার আঙুলে সূঁচ ঢুকিয়ে রক্ত নেয়া হবে, এ ভয়ে তটস্থ থাকতো ম্যালেরিয়া রোগীরা। তবে প্রতিবার সূঁচ ঢুকিয়ে রক্ত নিতে দিলে রোনাল্ড এক রূপি করে পারিশ্রমিকও দিতেন রোগীদের।

ম্যানসনের পরামর্শ মোতাবেক রোনাল্ড এক ম্যালেরিয়া রোগী, যার রক্তে সেই অর্ধচন্দ্রাকার পরজীবী বিদ্যমান; তাকে একটি মশারির ভেতর রেখে বেশ কিছু মশা ঢুকিয়ে রোগীটিকে কামড়াতে দিলেন। মশা কামড়ে রক্ত নেবার পর, সে মশাকে ধরে শোষিত রক্ত পরীক্ষা করে হতবাক হয়ে গেলেন রোনাল্ড। ঠিক তা-ই হয়েছে, যা ম্যানসন ধারণা করেছিলেন; মশার শোষণকৃত রক্তে সেই অর্ধচন্দ্রাকার পরজীবী রয়েছে। রোনাল্ড মশাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন জন্মস্থান থেকে, লার্ভা হতে সদ্য বড় হওয়া মশার দেহে আগে থেকে পরজীবী থাকার সম্ভাবনাও নেই। ম্যানসনকে চিঠি লিখে ব্যাপারগুলো জানালে, তিনি রোনাল্ডকে উত্তরে লিখলেন, এরপর কী করতে হবে।

রোনাল্ড আবারো একইভাবে ম্যালেরিয়া রোগীকে মশা কামড়াতে দিলেন, তবে এবার মশাগুলোকে না মেরে জীবন্ত অবস্থায় পানিভর্তি একটি বোতলে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে দিলেন। মশাগুলো ডিম পেড়ে মারা যাবার পর, রোনাল্ড অপেক্ষা করলেন ডিম ফুটে লার্ভার বেরিয়ে আসা পর্যন্ত। লার্ভা বেরিয়ে এলে সে পানি তিনি নিজের তিনজন অনুচরকে পান করতে বললেন। সে পানি পান করে একজনের একটু জ্বরমতো হয়েছিল, বাকি দু’জন সম্পূর্ণ সুস্থই রইল। কিন্তু পরবর্তী তিনদিন পরীক্ষা করেও তিনজনের কারো রক্তেই অর্ধচন্দ্রাকার পরজীবীর কোনো দেখা পাওয়া গেল না।

আশানুরূপ ফল না পেয়ে রোনাল্ড আবারো হতাশ হয়ে পড়লেন। এসময়ে ম্যানসন তাকে চিঠিতে লিখলেন, তিনি যাতে নতুন করে কাজ শুরু করেন। তিনি হাল ছেড়ে দিলে হয়তো অন্য কোনো দেশের বিজ্ঞানী এ সমস্যার সমাধান করে বসবে।

ঠিক সেসময়েই গবেষণায় ভাঁটা পড়ে রোনাল্ডের। ব্যাঙ্গালুরুতে কলেরা মহামারি দেখা দেয়, যার ফলে সামরিক কর্তৃপক্ষ রোনাল্ডকে দায়িত্ব দেয় কলেরা নিয়ন্ত্রণের জন্য। উপরমহলের নির্দেশে মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করে অবসর সময় যেটুকু পেতেন, ম্যালেরিয়া নিয়েও গবেষণা চালিয়ে গেলেন তিনি। বছরখানেক পর তিনি ম্যানসনকে চিঠিতে লিখলেন, ম্যালেরিয়া পরজীবী মিশ্রিত পানি খেয়ে কেউ আক্রান্ত হচ্ছে না। রোনাল্ডের কেন যেন বারংবার মনে হচ্ছিল, একটি মশা কাউকে কামড়ানোর সময় কিছু লালারস মানুষটির রক্তে প্রবেশ করিয়ে দেয়। হয়তো ম্যালেরিয়াবাহী একটি মশার লালারসের সাথে মিশে সেই পরজীবীগুলো মানবদেহে প্রবেশ করছে।

এই ধারণাটিও পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন তিনি। একজন ম্যালেরিয়া রোগীর শরীর থেকে রক্ত শোষণকারী ম্যালেরিয়াবাহী মশাকে ছেড়ে দিলেন সুস্থ কাউকে কামড়ানোর জন্য। কিন্তু এবারও ফলাফল শূন্য। সুস্থ মানুষটির দেহে ম্যালেরিয়ার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। রোনাল্ডের এই ধারণাটিই সঠিক ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, পরীক্ষায় ব্যবহৃত মশা নির্বাচন ভুল ছিল। তিনি ধারণাটি পরীক্ষা করতে ব্যবহার করেছিলেন ‘কিউলেক্স’ মশা, যা মানুষে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ করে না। তিনি তখনো তা বুঝতে পারেননি।

ম্যানসন আবারো রোনাল্ডকে চিঠিতে লেখেন, তিনি যেন ম্যালেরিয়া সংক্রমণ পরীক্ষা আপাতত রেখে দিয়ে মশার দেহে পরজীবীগুলোর পরিণতি কী হয়, তা নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন।

১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবশেষে রোনাল্ড বুঝতে পারেন, ম্যালেরিয়া পরজীবীগুলো আসলে মশার দেহে কী করে।

মশা নির্বাচনেই গলদ ছিল; Image Source: Quote Fancy

দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তি এখানেই। এ পর্বে আমরা জানলাম, রোনাল্ড রসের ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণায় কী কী ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী পর্বে আমরা জানব, ব্যর্থতা কাটিয়ে কীভাবে ধীরে ধীরে তিনি সাফল্যের দিকে ধাবমান হয়েছিলেন।

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে:

১. স্যার রোনাল্ড রস(১ম পর্ব): বহুমুখী প্রতিভাধর একজন চিকিৎসক 

This is the 2nd part of the biography and lifeworks of Sir Ronald Ross, remarkably known for discovering the complete life cycle of malaria parasite and successful prevention criteria of mosquito breeding. He also founded the epidemiological tools for malariometry, won Nobel Prize in Medicine for astonishing works no malaria parasite.

All the references are hyperlinked inside the article.

Featured Image: Topical Press Agency/Getty Images

Related Articles