Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্যার উইনস্টন চার্চিল: ব্রিটেনের মানসপুত্র

স্যার উইনস্টন চার্চিল একজন ব্রিটিশ লেখক, কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক। তিনি দুবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনীকে হারাতে মিত্রবাহিনীর অন্যতম বৃহৎ শক্তি ছিল যুক্তরাজ্য, যাকে সংগঠিত করেছিলেন স্যার উইনস্টন চার্চিল। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও সাহিত্যকর্ম ছিল অনন্য।

জন্ম, শৈশব ও পড়ালেখা

স্যার উইনস্টন চার্চিলের পুরো নাম উইনস্টন লিওনার্ড স্পেন্সার চার্চিল। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান চার্চিল ১৮৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর অক্সফোর্ডশায়ারে দাদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। দাদা জন স্পেন্সার চার্চিল ছিলেন সেসময়কার ডিউক। বাবা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ লর্ড র‍্যান্ডলফ চার্চিল ও মা জেনি জেরোমের দুই ছেলের মধ্যে উইনস্টন চার্চিলই বড়, ছোট ভাই জ্যাক চার্চিল (১৮৮০-১৯৪৭) মিলিটারি অফিসার ছিলেন।

চার্চিলের শৈশব, কৈশোর দুই-ই কাটে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে। তখনকার ডিউক ছিলেন তার দাদা, আর তারই রাজনৈতিক কর্মকর্তা ছিলেন তার বাবা। স্বাধীনচেতা চার্চিল পড়ালেখায় ছিলেন বরাবরই উদাসীন। আর তার ছাপও পড়লো পরীক্ষার ফলাফলে। ১৮৮৮ সালে লন্ডনের হ্যারোও আবাসিক স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু এর কয়েক সপ্তাহ পরই তিনি যোগদান করেন হ্যারোও রাইফেল কর্পোরেশনে এবং কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন সেনাবাহিনীকে। বাবা-মাকে খুব বেশি কাছে পাননি চার্চিল, তবুও তাদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। এমনটাও কথিত আছে যে, চার্চিল তার বাবাকে চিনেছেন অন্যদের মুখ থেকে, বাবা-ছেলের ঘনিষ্ঠতা থেকে নয়। মা জেনিন জেরোমও খুব একটা যেতেন না ছেলেকে দেখতে, যদিও চার্চিল প্রায়ই মাকে চিঠি লিখতেন। তার যখন ২১ বছর বয়স, তখন তার বাবা মারা যান, যার ফলে বাবা-ছেলের দূরত্বটা কখনোই মেটেনি।

শিশু চার্চিল; Source: pinterest

সেনাবাহিনীতে যোগদান ও দাম্পত্য জীবন

চার্চিল তার ঘটনাবহুল সৈনিক জীবনকে খুবই উপভোগ করছিলেন। ১৮৯৫ সালের পর ব্রিটেনের চতুর্থ রানীর নিজস্ব অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগদান করেন এবং সুদানের সীমান্তে অবস্থান করেন, যেখানে তিনি অমদুরমানের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে পাইওনিয়ার মেইল এবং ডেইলি টেলিগ্রাফকে নিয়মিত প্রতিবেদন লিখতেন। এসকল অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তিনি লিখেছেন ‘দ্য ম্যালাকান্ড ফিল্ড ফোর্স’ (১৮৯৮), ‘দ্য রিভার’ (১৮৯৯) এর মতো বিখ্যাত বই।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অধিক সমাদৃত স্যার উইনস্টন চার্চিল সাহিত্যকর্মেও ছিলেন জগতখ্যাত। ১৮৯৯ সালে চার্চিল সেনাবাহিনী ত্যাগ করে মর্নিং পোস্টের একটি রক্ষণশীল দৈনিক পত্রিকায় যোগদান করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বোয়ার যুদ্ধ চলাকালে একটি স্কাউটিং অভিযানে তিনি আটক হন। মোজাম্বিকের পর্তুগিজ অঞ্চল থেকে ৩০০ মাইল ভ্রমণ করে তিনি আবার ব্রিটেনে ফিরে আসেন। এই অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন তার বই ‘লেডিস্মিথ’ (১৯০০) এ। ১৯০৮ সালে উইনস্টন চার্চিল ক্লেমেন্টিন ওগিলভি হজিয়েরকে বিয়ে করেন। পাঁচ সন্তানের বাবা-মা ছিলেন ইতিহাসখ্যাত এই দম্পতি।

সেনাবাহিনীর পোশাকে চার্চিল; Source: pinterest

রাজনীতিতে যোগদান

১৯০০ সালে ম্যানচেস্টারের ওল্ডহ্যামের কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য হিসেবে যোগ দেন উইনস্টন চার্চিল। বাবার স্বাধীন চেতনাকে অনুসরণ করে সামাজিক সংস্কারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন নিজেকে। তার এই স্বাধীনচেতা ভাবনার সাথে মিল না থাকায় তিনি কনজারভেটিভ পার্টি ছেড়ে ১৯০৪ সালে লিবারেল পার্টিতে যোগ দেন। ১৯০৮ সালে লিবারেল পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বোর্ড অফ ট্রেডের সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সদ্য নিযুক্ত চ্যান্সেলর লয়েড জর্জের সাথে নৌবাহিনী সম্প্রসারণের বিরোধিতা করেন তিনি। এছাড়াও কারাগার ব্যবস্থার জন্য বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেন। তিনিই প্রথম শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি চালু করেন এবং শ্রম বিনিময় ও বেকারত্ব বীমা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯১১ সালে এডমিরালটির প্রথম লর্ড হিসেবে নিযুক্ত হন উইনস্টন চার্চিল। ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে আধুনিকায়নে সহায়তা করেন এবং যুদ্ধজাহাজগুলোতে কয়লাভিত্তিক ইঞ্জিনের পরিবর্তে তেলে চালিত ইঞ্জিন ব্যবহারের নির্দেশ দেন, যা ছিল একটি অভাবনীয় সিদ্ধান্ত।

সংসদ সদস্য হিসেবে নিযুক্ত চার্চিল; Source: getty images

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

চার্চিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু অবধি নিজ পদে বহাল থাকেন, কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিপদজনক গালিপোলির যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণ দর্শাতে বাধ্য করেন তৎকালীন সরকারকে। যার দরুন ১৯১৫ সালের শেষের দিকে সরকার থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। অল্প সময়ের জন্য তিনি আবার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯১৭ সালে পশ্চিমা ফ্রন্টের রয়েল স্কট ফিউসিলিয়ার্সের যুদ্ধে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ পর্যবেক্ষণে একটি ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব পালন করেন সাবেক এই সেনা সদস্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরে তিনি অস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

সহধর্মিণীর সাথে স্যার উইনস্টন চার্চিল; Source: pinterest

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিনই চার্চিল এডমিরালটির প্রথম লর্ড ও যুদ্ধ সভার সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৪০ এর এপ্রিলে তিনি সামরিক সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন। মে মাসের দিকে জাতীয় সংসদে নরওয়েজিয় সংকটের কারণে প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেইনের উপর সবাই আস্থা হারিয়ে ফেলে। একই কারণে ১৯৪০ সালের ১০ মে রাজা ষষ্ঠ জর্জ চার্চিলকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই জার্মান সেনাবাহিনী নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গ আক্রমণ করে, যা মিত্রবাহিনীর ওপর প্রথম বড় আক্রমণ ছিল।

দুদিন পর অ্যাডলফ হিটলারের জার্মান বাহিনী ফ্রান্সে প্রবেশ করে। ব্রিটেন তখন হিটলারের জার্মান সেনাবাহিনীকে একাই প্রতিহত করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হওয়ার পর তৎক্ষণাৎ তিনি লেবার, লিবারেল ও কনজারভেটিভ পার্টির নেতাদের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবানদের নিযুক্ত করেন গুরুত্বপূর্ণ সব পদে। ১৯৪০ সালের ১৮ জুন ‘হাউজ অফ কমন্স’ এ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন স্যার উইনস্টন চার্চিল। ততদিনে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্মিলিত হয়ে গেছেন।

১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে প্রবেশ চার্চিলকে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তার সুকৌশলী যুদ্ধনীতি ও মিত্রপক্ষের সম্মিলিত জোটের কাছে জার্মান বাহিনী পরাজিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে সামাজিক সংস্কারের পরিকল্পনা করেন তিনি, কিন্তু তা তিনি সাধারণ জনতাকে বোঝাতে পারেননি। যার ফলে ১৯৪৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। পুনরায় প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচনে পরাজয়ের ছয় বছরের মধ্যে তিনি প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন এবং বৈশ্বিক সম্পর্কের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলছিলেন। ১৯৪৬ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘আয়রন  কার্টেন’ ভাষণ প্রদান করেন, যা ছিল ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্যের ওপর সতর্কবাণী। ১৯৫১ সালের নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন এবং দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন।

উইনস্টন চার্চিল ও জোসেফ স্ট্যালিন; Source: gettyimages

নোবেল বিজয় ও মৃত্যু

১৯৫৩ সালে ২য় রানী এলিজাবেথ স্যার উইনস্টন স্পেন্সার চার্চিলকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। একই সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৫ সালের ১৫ জানুয়ারি গুরুতর স্ট্রোক করেন চার্চিল, এর ঠিক ন’দিন পর ১৯৬৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ব্রিটেনের এই মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তার লন্ডনের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে সেন্ট মার্টিন চার্চের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তার ওপর লেখা হয়েছে বেশ কিছু বই। সম্প্রতি তার জীবনী নিয়ে বানানো ‘ডার্কেস্ট আওয়ার’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন গ্যারি ওল্ডম্যান এবং এতে এই অভিনেতা অস্কার লাভ করেন।

ডার্কেস্ট আওয়ার চলচ্চিত্রে গ্যারি ওল্ডম্যান; Source: The Guardian

ফিচার ইমেজ- reseauinternational.net 

Related Articles