Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলার গর্ব চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান

আমাদের শিল্প সাহিত্য জগতের এক অনন্য নাম এস এম সুলতান। পুরো নাম শেখ মোহম্মদ সুলতান। যদিও শৈশবে তার বাবা নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া। এই গুণী শিল্পীর জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট, নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে। নড়াইলে রয়েছে খরস্রোতা অপরূপ এক নদী চিত্রা। সেই চিত্রার সঙ্গে একসাথেই বেড়ে উঠতে থাকলেন এস এম সুলতান। পারিবারিক সামর্থ্য না থাকলেও তাকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু স্কুলের ধরাবাঁধা নিয়মে শিক্ষালাভ ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ। পাখির মতো মুক্ত প্রাণ নিয়েই যেন সুলতানের জন্ম।

বাবা শেখ মোহম্মদ মেসের আলী ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। কিন্তু সুলতানের কাছে তার বাবা ছিলেন একজন শিল্পী। তৎকালীন জমিদার বাড়ির অনেক নকশা সুলতানের বাবার করা। সুলতান সেসব কাজ দেখেছেন একদম কাছ থেকে যা তাকে পরবর্তীতে শিল্পী হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

ভর্তি হলেও স্কুলের বাঁধাধরা নিয়মে পড়ালেখা তার ভালো লাগতো না। সময় কাটতো প্রকৃতিকে অনুভব করে। কখনো ক্লাসে বসে আবার কখনো চিত্রা নদীর পাড়ে বসে স্কেচ করতেন। স্কুলের শিক্ষক রঙ্গলাল ব্যাপারটি খেয়াল করলেন। সুলতানের খাতা দেখে বুঝতে পারলেন তার মধ্যে এক শিল্পী বাস করছে। তিনি সুলতানের ভেতরের সেই সত্ত্বাকে গড়ে তুলেতে চাইলেন। তিনি সুলতানকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে রঙ্গলাল সুলতানকে তার সব জ্ঞান উজাড় করে দিলেন।

সুলতানের সাথে রঙ্গলালের বড় মেয়ে অররা একসাথে পড়তো। অররার সাথে সুলতানের প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু রঙ্গলাল তাদের সম্পর্ক মেনে নেননি কখনো। অররার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। ফলে মনের কষ্টে জর্জরিত হয়ে তিনি নড়াইল চলে আসলেন। সাথে নিয়ে আসেন অররার হাতে বানানো নকশীকাঁথা। তিনি এই কাঁথা মাথার নিচে দিতেন।

কলকাতায় গিয়ে আর্ট শিখতে চাইলেও সেই আর্থিক সঙ্গতি ছিলো না সুলতানের। এক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করেন এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।  সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা তার ছিলো না। সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য তাকে সহযোগিতা করেন শিল্প সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দী। এ সময় শাহেদ সোহরাওয়ার্দী তার লাল মিয়া নাম পাল্টে এস এম সুলতান (শেখ মোহাম্মদ সুলতান) রাখেন।

আর্ট স্কুলে ভালো করলেও ফাইনাল পরীক্ষার আগে আর্ট স্কুল ছেড়ে তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। কাশ্মীরে আদিবাসীদের সাথে থাকতে শুরু করেন। আঁকতে শুরু করেন তাদের জীবনযাত্রা। বোহেমিয়ান ছিল তার জীবনধারা। প্রচারবিমুখ এ মানুষটি তার কাজের প্রতিও ছিলেন বেখেয়ালী। জীবনে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। যে জায়গায় কাজ করেছেন সেখানেই তা ফেলে এসেছেন। এভাবে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে সুলতানের অনেক কাজ।

সুলতানের আত্মপ্রতিকৃতি

কানাডার এক নারী মিসেস হাডসনের সহযোগিতায় সুলতানের প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় সিমলায়। ১৯৪৭ সালে সুলতানের একক চিত্র প্রদর্শনী হয় লাহোরে। সুলতানের ছবি পিকাসো, সালভাদর দালির মতো শিল্পীর সাথে একই সাথে প্রদর্শিত হয় ইউরোপের এক প্রদর্শনীতে। দেশে-বিদেশে প্রায় ২০টি চিত্র প্রদর্শনী শেষে ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে আসেন সুলতান। ফিরে এসে ঢাকায় তিনি কোনো চাকরি পাননি। কারণ শিক্ষকতা করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা তার ছিল না। পরে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে তার জায়গা-জমিও বেদখল হয়ে যায়।

দেশ-বিদেশের খ্যাতি তাকে গ্রাম থেকে দূরে রাখতে পারেনি। তার চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল আলাদা। তিনি শহর আঁকতেন না। তথাকথিত আধুনিক চিত্রকলার অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ধরণ তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি সেভাবেই ছবি এঁকেছেন যা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। তিনি আঁকতেন মানুষ, কৃষক, নারী, শিশু, গাছপালা, গ্রামের দৃশ্য এসব। তার ছবি দেখলেই বোঝা যায় প্রকৃতির প্রতি তার সমর্পণ কেমন ছিল।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন,

“তার কাছে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি। তার আধুনিকতা ছিল জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং ঔপনিবেশিক সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন। এটাই তার কাছে ছিল ‘আধুনিকতা’, অর্থাৎ তিনি ইউরোকেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।”

সুলতানের আঁকা স্কেচ; Source: Great Master SM Sultan

এস এম সুলতানের আঁকার ধরনে ছিল বৈচিত্র্যতা। তার হাতে গ্রামের কৃষক, তাদের স্ত্রী সন্তান সন্ততি এমনকি গরুটা পর্যন্ত হয়ে উঠতো সাধারণের চেয়ে অনেক বড়। পেশীবহুল পুরুষ এবং স্বাস্থ্যবান নারী তার ছবিতে ফুটে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবে কৃষকরা সুবিধা বঞ্চিত। তারা কৃশকায়, তাদের বলদগুলোও কৃশকায়। তাই সুলতান তার কল্পনায় তাদেরকে বলশালী করেছেন। কারণ দেশ গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে কৃষকেরা।  তিনি তার চিত্রকলার এই ধরন সম্বন্ধে বলেন-

“আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃশকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো- সেগুলোও রোগা। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা আমার কল্পনার ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি সেভাবেই তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের এই কৃষক সম্প্রদায়ই একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিল। দেশের অর্থবিত্ত এরাই যোগান দেয়। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ন কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়। ওদের বলিষ্ঠ হওয়া উচিত।”

সুলতানের ছবিতে পেশীবহুল কৃষক

সুলতান সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন না। তিনি চাইলে বিলাসী জীবন যাপন করতে পারতেন। নিজের খ্যাতি ও সমাদরকে পুঁজি করে সবার মধ্যমণি হয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি সবকিছু ছেড়ে গ্রহণ করেছেন সংগ্রামের পথ, কষ্টের পথ। তিনি জীবনের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছেন। তাই তার কাজকর্ম ছিল তথাকথিত স্বাভাবিক থেকে আলাদা। তিনি জঙ্গলের মধ্যে গাছের নীচে বসে রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। তার থাকার ঘর ছিল সাপখোপে ভর্তি। শিব মন্দিরেও থেকেছেন। পুষতেন অনেকগুলো বিড়াল। তার একটি ছোট চিড়িয়াখানা ছিল। বাঁশি বাজাতে পারতেন অদ্ভুত সুন্দরভাবে। বাজাতে পারতেন তবলাও। শাড়ি পরে পায়ে ঘুঙুর দিয়ে নাচতেন অদ্ভুতভাবে। গায়ে পরতেন আলখাল্লা। মাথায় লম্বা চুল। নিজের তৈরি জগতেই যেন বুঁদ হয়ে থাকতেন সুলতান।

সুলতানের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘চর দখল’।

দেশে ফিরে এসে তিনি হঠাৎ শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। স্কুল তৈরি করলেন বেশ কয়েকটি। নন্দন কানন প্রাইমারি স্কুল, নন্দন কানন হাই স্কুল এবং কুড়িগ্রাম ফাইন আর্ট স্কুল। ১৯৭৩ সালে যশোরে ‘একাডেমী অব ফাইন আর্ট স্কুল’ তৈরি করেন যা বর্তমানে চারুপীঠ নামে পরিচিত। প্রতি শুক্রবার শিশুদের ছবি আঁকা শেখাতেন তিনি। ছোট ছেলেমেয়েদের আঁকার জন্য তিনি তৎকালীন বারো লক্ষ টাকা ব্যয় করে নৌকা তৈরি করেন। সেই নৌকায় একসাথে অনেক ছেলেমেয়ে ছবি আঁকতে পারতো। সুলতান বলেন,

“যে শিশু সুন্দর ছবি আঁকে, তার গ্রামের ছবি আঁকে, সে সুন্দর ফুলের ছবি আঁকে, তার জীবজন্তুর ছবি আঁকে, গাছপালার ছবি আঁকে, সে কোনোদিন অপরাধ করতে পারে না, সে কোনোদিন কাউকে ব্যথা দিতে পারে না।”

সুলতানের তৈরি নৌকা; Source: jessore.info

দেশে-বিদেশে অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন সুলতান। ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার সুলতানকে ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট সম্মাননা প্রদান করে। গুণী এ শিল্পী পেয়েছেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী তাকে ‘আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স’ ঘোষণা করে। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার ‘গ্যালারি টনে’ ছিল সুলতানের শেষ চিত্র প্রদর্শনী। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর সুলতান এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। রেখে যান এক ইতিহাস, এক আদর্শ। যে আদর্শ যুগ যুগ ধরে অনাগত শিল্পীদের শেখাবে কীভাবে নিঃস্বার্থভাবে শিল্পের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়। কীভাবে জীবনকে আরো কাছ থেকে দেখতে হয়।

সুলতানের কবরের ফলক; Source: Youtube

Related Articles