Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পিথাগোরাস ও তার সংখ্যাপ্রেম নিয়ে অবিশ্বাস্য যত কাহিনী

পিথাগোরাসের নাম শোনেনি, এমন মানুষ পাওয়া ভার। অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি পার করা প্রতিটা মানুষই তার নাম শুনেছেন বিখ্যাত সেই পিথাগোরাসের উপপাদ্যের বদৌলতে। তার বাইরে যারা পিথাগোরাসের নাম শুনেছেন, তাদের নিকট তিনি নিশ্চিত এক ধাঁধাঁ! কারণ ইতিহাস পড়ে জানা যায় পিথাগোরাসের সমকালীন অনেক মানুষই তার মধ্যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করতো। তাছাড়াও তার অনুসারীরা তাকে আরও অনেক অলৌকিক গুণের অধিকারী বলে ভাবতো। কিন্তু সেসব কি আদৌ সত্য? আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে সেগুলোকে পৌরাণিক কথাবার্তা ছাড়া আর কী-ইবা ভাবা যায়!

পিথাগোরাস এমন একজন মানুষ যিনি প্রতিটি বস্তুর পেছনে সংখ্যা খুঁজতেন। হ্যাঁ, তিনি বিশ্বাস করতেন এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে সংখ্যাতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি বিষয়ই নির্ধারিত হয় কোনো জটিল সংখ্যার সুনির্দিষ্ট বিন্যাসে- এমনটাই বিশ্বাস করতেন পিথাগোরাস। ভাবুন তো একবার, সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়ে পিথাগোরাস এমন একটি বিশ্বাসের জন্ম দেন যা নিয়ে আজকের যুগের বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করে যাচ্ছেন! পিথাগোরাসের বিশ্বাস নয়তো কী? তিনিই তো বলেছেন সবকিছুর পেছনেই আছে সংখ্যা। আর আধুনিক বিজ্ঞানীরাও বিশ্বাস করেন মহাবিশ্বের সবকিছু সমীকরণের দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব। তারা সেই সমন্বয়কারী সূত্রেরই অন্বেষণ করছেন। শেষতক পাবেন কিনা বলা যাচ্ছে না, কিন্তু তারা যার পেছনে যে বিশ্বাসে ছুটছেন তা তো আদতে পিথাগোরাসই সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন।

পিথাগোরাসের বিশ্বাস; ছবিসূত্র: famousscientists

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সাথে পিথাগোরাসের বিশ্বাসকে মেলাবেন ভাল কথা, কিন্তু সকল ক্ষেত্রে তা করতে গেলে বিপদে পড়তে হতে পারে! হ্যাঁ, পিথাগোরাস অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত বিশ্বাসও করতেন যা আমরা আজকের পৃথিবীতে কুসংস্কার বলেই গণ্য করতে পারি। তার কিছু অদ্ভুত বিশ্বাস সম্পর্কে একটু ধারণা দেয়া যাক।

  • শিম খাওয়া পাপ! আপনি যাই করুন না কেন শিম খেতে পারবেন না।
  • নারীরা জোড় এবং পুরুষরা বিজোড় সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে!
  • তিনি পুনর্জন্ম তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। মানুষ মারা গেলে অন্য কোনো প্রাণীরূপে তার আত্মা পুনর্জন্ম লাভ করে এ ব্যাপারে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।
  • তার ধারণা তার অনেক অলৌকিক জ্ঞান ছিল। যেমন- তিনি যেকোনো পশু-পাখির কথা বুঝতে পারতেন, ভুমিকম্পের কথা আগে থেকে বলে দিতে পারতেন, নিজের পূর্ব জীবনের কথা মনে করতে পারতেন, বাতাসের প্রবাহ এবং সাগরের ঢেউ থামাতে পারতেন!

কী ভাবছেন? পিথাগোরাসের ঐশ্বরিক ক্ষমতার বাহার দেখে একটু কি বিস্মিত হলেন? রোমান ইতিহাসবিদ সিসেরো বলেন, “যখন কেউ তাকে তার কোনো তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতো, তখন তিনি নির্দ্বিধায় উত্তর দিতেন,’প্রভু বলেছেন;’ আর সেই প্রভু হচ্ছেন তিনি নিজে!”

পিথাগোরাসকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বারবার দ্বিধায় পড়তে হয়। কারণ তার ব্যাপারে অধিকাংশ তথ্যেরই কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। যা কিছু পাওয়া যায় তাও তার জন্মের শত বছর পর লিখিত। সেগুলো যথেষ্ট ভরসাযোগ্য কিনা তাও দেখার বিষয়। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে পিথাগোরাস এর জন্ম ৫৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রীসের সামোস দ্বীপে। তার বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। আরেক বিখ্যাত গণিতবিদ থেলিসের নিকট গণিত শিক্ষা লাভ করেন পিথাগোরাস। থেলিসের উপদেশে তিনি প্রাচীন মিশরে ভ্রমণে যান। ২২ বছর বয়সী পিথাগোরাস মিশরে গিয়ে কাটিয়েছিলেন তার জীবনের পরবর্তী ২২টি বছর। এ সময় তিনি গাণিতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন।

প্রাচীণ মিশর (কাল্পনিক ছবি); ছবিসূত্র: rosicrucian.org

তবে আপনি যদি ভেবে থাকেন পিথাগোরাস ইচ্ছাকৃতই এতো বছর মিশরে কাটিয়েছিলেন, তাহলে ভুল করছেন। তিনি যখন মিশরে যান, তখন মিশরে পারস্যের আক্রমণ হয়। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাবিলনে। উল্লেখ্য ব্যাবিলন ছিল তৎকালীন গণিতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ স্থান। ফলে পিথাগোরাসের জন্য মন্দের ভালোই হলো! তিনি সেখানে ১২ বছর কাটান এবং গণিত শিক্ষা লাভ করেন।

সম্ভবত ৫৬ বছর বয়সে পিথাগোরাস নিজের জন্মভূমি সামোসে ফিরে আসেন এবং গণিত ও জীবন সম্পর্কে নিজের দর্শন থেকে মানুষকে শিক্ষা দেন। তার দর্শন গড়ে উঠেছিল মূলত তার নিজের চিন্তা, গণিত এবং প্রাচীন মিশরীয় অতীন্দ্রিয়বাদী কল্প-কাহিনীর উপর ভিত্তি করে।

সামোস দ্বীপ, ব্যাবিলন এবং ক্রটন এর অবস্থান; ছবিসূত্র: faculty.etsu.edu

তবে সামোসে নিজের এই শিক্ষা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি পিথাগোরাস। মাত্র দুই বছরের মাথায় তিনি সামোস ছাড়তে বাধ্য হন। কারণ তার নতুন নতুন তত্ত্বে অনেক মানুষ অবিশ্বাস পোষণ করতো এবং তারা ক্রমশই তার শত্রু হয়ে ওঠে। সামোস ছেড়ে তিনি প্রাচীন গ্রীসের ক্রটন শহরে পাড়ি জমান যা বর্তমানে ইতালির অংশ।

চলুন এবার পিথাগোরাসের সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা যাক। পিথাগোরাসের নিকট ১০ ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ সংখ্যা। দশকে প্রথম চারটি অঙ্ক যোগ করে তৈরি করা যায় অর্থাৎ ১+২+৩+৪=১০। এই চারটি অঙ্ক দ্বারা আবার একটি নিখুঁত সমবাহু ত্রিভুজ তৈরি করা সম্ভব যাকে বলা হয় ‘টেট্রাকটিস‘। অন্যদিকে এই টেট্রাকটিসের সাথে রয়েছে স্বরগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র। এই যোগসূত্রকে পিথাগোরাস অলৌকিক মনে করতেন।

টেট্রাকটিস; ছবিসূত্র: OSIRIS ARISING – WordPress.com

পিথাগোরাসে গাণিতিক তত্ত্বগুলো প্রাচীন গ্রীসে গণিতশাস্ত্রের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটায়। পিথাগোরাসের কিছু সাফল্য সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।

  • পিথাগোরাস বিশ্বাস করতেন যে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বিষয়ের ভিত্তিমূলে রয়েছে সংখ্যা। আধুনিক বিজ্ঞানীদেরও তাই বিশ্বাস।
  • পিথাগোরাস বলেন যে, সংখ্যার নিজস্ব অস্তিত্ব রয়েছে। এর অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য কোনো বস্তুর সাথে যোগসূত্র স্থাপনের প্রয়োজন নেই। ৩ সংখ্যাটির অস্তিত্ব ‘৩টি’ পাখি/বাড়ি/গাড়ি ইত্যাদির সাথে তুলনা না করলেও থাকবে।
  • পিথাগোরাসের উপপাদ্য: কোনো একটি সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল ঐ ত্রিভুজের অপর দুই বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান। মূলত পিথাগোরাস এই উপপাদ্য ব্যাবিলন থেকে শিখেছেন। কিন্তু এর এরূপ নামকরণের কারণ এই যে, তিনিই প্রথম উপপাদ্যটি প্রমাণ করেন।
  • অমূলদ সংখ্যা আবিষ্কৃত হয় পিথাগোরীয়ান তত্ত্ব থেকেই। পিথাগোরাসের উপপাদ্যে যদি ত্রিভুজের ছোট দুই বাহুর মান ১ ধরা হয় তাহলে অতিভুজের মান দাঁড়ায় √২। এই √২ এমন এক সংখ্যা যাকে কোনো পূর্ণ সংখ্যার অনুপাতে প্রকাশ করা যায় না। যদি √২ কে দশমিক সংখ্যা হিসেবে লেখা হয়, তাহলে দশমিকের পরের অঙ্কগুলো চিরকাল এলোমেলো বিন্যাসে চলতে থাকবে। হিপেসাস নামক একজন পিথাগোরীয়ান (পিথাগোরাসের অনুসারী) প্রথম √২ কে অমূলদ সংখ্যা হিসেবে প্রমাণ করেন। কথিত আছে, এই আবিষ্কারের জন্য তাকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল! তবে এই তথ্যের বিপরীতে প্রমাণ খুবই অল্প। কিন্তু এই আবিষ্কার পিথাগোরাসের অনুসারীদের নিকট সংঘাতপূর্ণ ছিল। কেননা পিথাগোরাসের একটি মৌলিক বিশ্বাস ছিল যে পৃথিবীর সব কিছুই পূর্ণ সংখ্যার অনুপাতে তৈরি।
  • প্রতিসাম্যের কারণে পাশা খেলায় ব্যবহৃত পাঁচ প্রকারের নিয়মিত আকৃতি পাওয়া যায় যাদের বলা হয় ‘প্লেটনিক সলিড’। এর প্রথম তিনটি পিথাগোরাস নিজে আবিষ্কার করেন এবং বাকি দুটি তার অনুসারীরা। সলিডগুলো হচ্ছে টেট্রাহেড্রন (চতুস্তলক), কিউব (ঘনক), অক্টাহেড্রন (অষ্টতলক), ডোডেকাহেড্রন (দ্বাদশতলক) এবং ইকোসাহেড্রন (বিংশতলক)।

প্লেটনিক সলিড; ছবিসূত্র: TechnologyUK

  • পিথাগোরাস আরো বিশ্বাস করতেন, অন্য সকল কিছুর মতো সঙ্গীতও সম্পূর্ণরূপে সংখ্যার অনুপাত মেনে চলে। তিনি কামারের ভিন্ন ভিন্ন আকারের লৌহখন্ড পেটানো লক্ষ্য করতেন এবং তাদের মধ্যে ভিন্ন রকমের আওয়াজ থেকে তিনি ধারণা করতেন এর মাঝে নিশ্চিতভাবে কোনো গাণিতিক সম্পর্ক রয়েছে। তিনি নিজে একজন দক্ষ ‘লায়ার’ (প্রাচীন মিশরে ব্যবহৃত একধরণের বাদ্যযন্ত্র) বাদক ছিলেন। তিনি বাদ্যযন্ত্রের সুর এবং তারের দৈর্ঘ্য নিয়ে গবেষণা চালান। তার বিশ্বাস ছিল স্বরগ্রামগুলো পূর্ণ সংখ্যার অনুপাতেই নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে এই ব্যাপারটি প্রথম প্রমাণ করেন তার অনুসারী আর্কাইটিস।
  • জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েও পিথাগোরাস চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। তার ধারণা ছিল পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থান করে। তবে ফিলোলস নামক তারই এক অনুসারী তার এই তত্ত্বকে অস্বীকার করেন। ফিলোলস বলেন- পৃথিবী, সূর্য সবকিছুই ‘সেন্ট্রাল ফায়ার’ নামক কোনোকিছুকে প্রদক্ষিণ করছে।

পিথাগোরাসের জন্মের মতো মৃত্যু নিয়েও আছে সংশয়। অধিকাংশের মতে তার মৃত্যু হয় ৭৫ বছর বয়সে ৪৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তবে কেউ কেউ বলেন তিনি ১০০ বছরেরও অধিক বেঁচে ছিলেন। তিনি কোথায় মারা গিয়েছিলেন তা নিয়েও ইতিহাসবিদগণ দ্বিধাবিভক্ত। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত গ্রহণ করলে তিনি ক্রটন শহরে মারা যান। তার সমাধি সম্পর্কে ইতিহাসে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কুসংস্কার হোক কিংবা ভ্রান্ত বিশ্বাসই হোক, এসব পিথাগোরাসকে অমর হবার পথে বাধা দিতে পারেনি। গণিত শাস্ত্রে তার অবদান আজও আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

ফিচার ছবিসূত্র: famous-mathematicians.com

Related Articles