এই তো কিছুদিন হলো নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। পেয়েছে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতিও। ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। তথাপি দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হয়তো উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব এখনো হয়নি আমাদের। কিন্তু যখন কোনো বাংলাদেশি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পান, তখন সেটি কেবল সেই ব্যক্তির স্বীকৃতি থাকে না, সেই স্বীকৃতি যেন বাংলাদেশেরই হয়ে যায়।
সমগ্র দেশের মানুষ তার নাম উচ্চারণ করে গর্ব ভরে, তার মাঝে অনুপ্রেরণা খোঁজে এগিয়ে যাবার। এমন একজন মানুষের কথা আজ জানাবো, যিনি একাধারে মাইক্রোসফট বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, লাওস আর মিয়ানমারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শুধু তা-ই নয়, ইউনাইটেড নেশন টেক ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান, একটি ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজিক্যাল প্রতিষ্ঠান ডি-মানি ও ‘বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট, সহ-প্রতিষ্ঠাতা সিনটেক বাংলাদেশের, কাজ করেছেন ডেল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে।
একজন মানুষের পক্ষে একসাথে কত কিছু করা সম্ভব তা ভাবতে গিয়ে যদি বিভোর হয়ে যান, তাহলে এর চেয়ে বড় বিস্ময় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। যার কথা বলছিলাম তিনি বাংলাদেশের চিরায়ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর মাঝেই বেড়ে ওঠা একজন অনন্য নারী, যিনি তার অদম্য স্পৃহা, অফুরন্ত কর্মশক্তি আর হার না মানা মনোবল নিয়ে নারী-পুরুষ লিঙ্গ ভেদাভেদের উর্ধ্বে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। তার নাম সোনিয়া বশির কবির।
বর্তমানে যে ক'জন বাংলাদেশি ব্যক্তিত্ব বিশ্ব দরবারে নিজেদেরকে বিশেষভাবে চেনাতে পেরেছেন, সোনিয়া বশির কবির তাদেরই একজন। তার অনন্যতা এই যে, তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের বাইরে থেকে নয়, বরং দেশের এই ট্রাফিক জ্যাম আর হৈ-হট্টগোলের মাঝে কাজ করেই। তাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়াই যায়, বিশেষত তার কর্মজীবনের বিস্তৃতি জানার পর। সোনিয়া বশিরের কর্মজীবন এতটা ব্যাপক এবং বিস্তৃত যে তা অবিশ্বাস্য ঠেকে। কেন অবিশ্বাস্য ঠেকবে, তা তার কর্মজীবন আর অভিজ্ঞতার উপর চোখ বোলালেই বুঝতে পারবেন। চলুন, সংক্ষেপে তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বিভিন্ন অধ্যায় দেখার চেষ্টা করি।
- ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘সান মাইক্রোসিস্টেমস’ এর অর্থ নিয়ন্ত্রক (ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার) হিসেবে কাজ করেন।
- ২০০৭ সালের শেষ দিকে প্রধান অপারেটিং অফিসার হিসেবে যোগ দেন ঢাকা কেন্দ্রিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘আমরা টেকনোলজিস লিমিটিড’ এ। সেখানে কাজ করেছে আড়াই বছর।
- ২০০৯-১২ সাল পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড’ তথা বিসিবির নারী উইংয়ে কাজ করেছেন।
- ২০১০ সালে যোগ দেন মাইক্রোসফটের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উদীয়মান বাজারের ব্যবসায়িক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিচালক হিসেবে। এখানে কাজ করেন দেড় বছর।
- ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩ বছর কাজ করেছেন ডেল কম্পিউটার্স বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে।
- ‘আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা’র বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য ছিলেন ২০০৭-১৫ পর্যন্ত টানা ৮ বছর।
- তিনি টাই (TiE) ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট।
- ‘বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট। ২০১৩ সাল থেকে তিনি এ দায়িত্ব পালন করছেন।
- তিনি বাংলাদেশি কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ‘সিনটেক কনসাল্টিং লিমিটেড’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ২০০৬ সাল থেকে বর্তমান অবধি তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
- তিনি ‘ডি মানি বাংলাদেশ’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৬ থেকে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
- ২০১৪ সাল থেকে টেকজায়ান্ট ‘মাইক্রোসফট বাংলাদেশ’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি (ম্যানেজিং ডিরেক্টর) হিসেবে নিযুক্ত আছেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এবং লাওসের মাইক্রোসফটের এমডির দায়িত্বও তার বিশ্বস্ত কাঁধে তুলে দেয় মাইক্রোসফট।
- তিনি ২০১৬ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য জাতিসংঘের ‘টেকনোলজি ব্যাংক’ প্রোগ্রামে ভাইস চেয়ারপারসন হিসেবে কর্মরত আছেন।
- সর্বশেষ ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে জাতিসংঘের ‘মহাত্মা গান্ধী ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন ফর পিস অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি’ বা এমজিআইইপির (MGIEP) গভার্নিং কাউন্সিলর হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন।
- এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন সোনিয়া বশির কবির। তিনি ‘দ্য ফাউন্ডার ইনস্টিটিউট’ এর মেন্টর হিসেবে কাজ করেছেন কিছুকাল। বর্তমানে যুক্ত আছেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘নর্থ সাউথ’ এর বাণিজ্য বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য। একই রকম পদে কাজ করছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়েও। এছাড়াও তরু, জাগো ফাউন্ডেশন আর ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারেও’ কাজ করেছেন সোনিয়া বশির।
সোনিয়া বশিরের জন্ম রাজধানী ঢাকায়। তার পরিবার আর্থিকভাবে যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিল। তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এ কথাও বলেছেন যে, জীবনের কোনো ক্ষেত্রে অন্তত আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয়নি তাকে। এজন্য তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। তবে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তো অনেকেই হন, কিন্তু সবাই সোনিয়া বশির তো হতে পারেন না!
শৈশব থেকেই সোনিয়া ছিলেন পড়ালেখা, খেলাধুলা সবক্ষেত্রেই দুরন্ত এবং প্রাণবন্ত। দুই ভাইয়ের সাথে খেলাধুলা আর হৈ হুল্লোড় করেই শৈশব কেটেছে তার। তার বাবা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করতেন। রোজ যখন সকালবেলা বাবাকে স্যুট-টাই পরে অফিসের পথে পা বাড়াতে দেখতেন, তখন মনে মনে নিজেকে কল্পনা করতেন সেসব পোশাকে। তার স্বপ্নের হাওয়াই জাহাজটা কত দিকে ডানা মেলতো তার ঠিক নেই। তবে হাওয়াই জাহাজটার গতি কিছুটা থমকে যেত যখন তার মা বলতেন স্যুট-টাই তো পুরুষের পোশাক।
কিন্তু তাতে কী? সোনিয়া ছিলেন তার বাবার মেয়ে। জীবনে চলার পথে তিনি বাবাকেই তার আদর্শ মানেন। তার স্বপ্নের হাওয়াই জাহাজটাকে মাটিতে নামতে দেননি তার বাবা। বাবার কারণে তিনি কখনো বুঝতেই পারেননি যে, তিনি আর দশটা মেয়ের মতো, যাদের জীবনে চলার পথে আসে নানাবিধ সামাজিক ও পারিবারিক বাধা। শিশুকাল থেকেই সোনিয়া পড়ালেখায় যতটা ভালো ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো ছিলেন খেলাধুলায়। দুই ভাইয়ের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবরকমের খেলায় অংশ নিতেন তিনি।
তার বিকালগুলো কাটতো আবাহনীর মাঠে কখনো ক্রিকেট, কখনো ভলিভল, কখনোবা ফুটবল খেলে। একটি নারী ক্রীড়াচক্রের সদস্য হয়ে অসম্ভব উন্নতি করেছিলেন খেলাধুলায়। ফলশ্রুতিতে দেশের প্রথম নারী জাতীয় ক্রিকেটদলে সুযোগও পান সোনিয়া। সে সময় তিনি কেবল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তিনি জাতীয় নারী ভলিভল দলেও জায়গা করে নেন দক্ষতা গুণে।
তবে খেলাধুলা তার পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। ভিকারুন্নিসা নুন কলেজ থেকে সাফল্যের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। মূলত খেলাধুলার জীবনই তাকে ভবিষ্যৎ জীবনে বড় কিছুর দিকে সাহসের সাথে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, যেহেতু খেলার মাঠে নারী হওয়াটা তাকে সাফল্য থেকে আটকাতে পারেনি, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই নারী হওয়াটা বাধা হবে না।
উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন সোনিয়া বশির। তারপরই স্বামীর সাথে পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে, যিনি কি না একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। জীবনের পরবর্তী ২০ বছর বিশ্বের ‘টেকনোলোজি ক্যাপিটাল’ হিসেবে পরিচিত ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে কাটে তার। আর এই ২০ বছর তার জীবনের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সিলিকন ভ্যালিতে প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের সাথে ধাতস্থ হতে হতেই শিক্ষাজীবনের পূর্ণতা দেন। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করে সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ সম্পন্ন করেন।
পড়ালেখা শেষ করার পরই শুরু হয় তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। সিলিকন ভ্যালিতে থেকে গেলে তিনি হয়তো আরো অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পেতেন। তার ক্যারিয়ার হয়তো আরো প্রশস্ত হতে পারতো। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে এলেন। এর পেছনে তার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ, বাবা এবং শ্বশুরের প্রতি দায়িত্ববোধ।
দ্বিতীয়ত, দেশকে নিয়ে কিছু করতে চাওয়ার অফুরন্ত বাসনা। এখনো যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ক্যারিয়ারে এত কিছু অর্জনের পরও তিনি নিজেকে সফল ভাবেন কি না, তিনি নিঃসঙ্কোচে বলে দেন ‘না’। দু'চোখে তিনি অসীম স্বপ্নের জাল বুনন করেন দেশকে প্রযুক্তিতে এগিয়ে নেবার, ধনী-গরীব সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার। যখন এ কাজে সফল হবেন, তখনই কেবল নিজেকে সফল মনে করবেন তিনি।
সোনিয়া তার সাফল্যমণ্ডিত কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা জিতেছেন। তার সাফল্যের মুকুটে সবচেয়ে সম্মানজনক পালকটি আসে ২০১৬ সালে। সে বছর মাইক্রোসফটের ‘ফাউন্ডার্স অ্যাওয়ার্ড’ জেতেন সোনিয়া। তাছাড়া, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অবদান রাখার জন্য ‘এসডিজি ২০১৭ পায়োনিয়ার্স’ পুরস্কার জেতেন তিনি। নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস গ্লোবাল কমপ্যাক্ট লিডারস সামিট’ অনুষ্ঠানে তাকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়। ২০১৫ সালে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বাংলাদেশে ‘অনন্যা টপ ১০’ পুরস্কারও জেতেন তিনি।
জীবনের এ পর্যায়ে এসে সোনিয়া বশির কবিরের নতুন করে নিজেকে চেনানোর আর কিছুই নেই। যেখানেই তিনি গিয়েছেন, সফল হয়েছেন। তার সাফল্যের তুলনা তিনি নিজেই। সাফল্যের পথে নারী হওয়াটা কোনো বাধা নয়, এ সত্য তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশের নারী সমাজ তো বটেই, তরুণ প্রজন্মের নিকটই তিনি অনুকরণীয়, অনুসরণীয়।
This article is written in Bangla language. It's written about the famous technology person and Managing Director of Microsoft Bangladesh Sonia Bashir Kabir.
Necessary references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: techzoom.tv