Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুভাষ চন্দ্র বসু: ভারতের স্বাধীনতার নেতা থেকে নেতাজী হয়ে উঠার উপাখ্যান

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বেড়ে ওঠা ভারতীয় তরুণদের দিনগুলো কাটতো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এক দোলাচলে। সেই সময় ভারতীয় সমাজে একদিকে যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার হতে থাকে, ঠিক অন্যদিকে পাশ্চাত্যের ছাঁচে গড়ে উঠতে থাকে ভারতীয় মন। কলকাতার বন্দরকে ঘিরে ওঠা সমৃদ্ধ শহরটিতে বাঙালি মধ্যবিত্ত মনেও তখন নাড়া দিয়েছে ইংরেজ শিক্ষা। বাঙালি বহিরাবরণ পরিহিত আধা ইংরেজ হয়ে যাচ্ছে না তো সবাই! রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সব সচেতন ব্যক্তি তখন বাঙালি সমাজকে আঁকড়ে ধরে থাকা কুসংস্কারকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দেশীয় সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার জন্য, বিশ্বের কাছে তা গ্রহণযোগ্য করার জন্য পশ্চিমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা কিংবা ইংরেজি ভাষা শিক্ষা দোষের কিছু নয়, এই ধারণা বাঙালি সমাজে বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথিকৃত জগদীশ চন্দ্র বসু সহ অনেক বাঙালির মনে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিলো। এমনই দ্বিধাবিভক্ত ভারতে জন্ম নিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সালটা তখন ১৮৯৭।1

পরিবারের সবার সাথে সুভাষ চন্দ্র বসু (সবার ডানে পেছনের সারিতে); Source: wikimedia commons

কর্মসূত্রে সুভাষের বাবা তখন কলকাতা ছেড়ে উড়িষ্যায়। বাবা-মায়ের চৌদ্দ সন্তানের নবম ছিলেন তিনি। বাবার কাছে ইংরেজি শিখে দুনিয়া জয়ের কথা আর গৃহিণী মায়ের কাছে ভারতের রূপকথার গল্পের মাধ্যমে পারিবারিক শিক্ষা শুরু। বাবা তার ইচ্ছানুযায়ী ভর্তি করে দিলেন র‍্যাভেন ‘শ কলেজে। সেখানে গিয়েই বাঙালি আর ইংরেজি-সংস্কৃতির চিরাচরিত দ্বন্দ্ব সুভাষকে একটু একটু করে আঘাত করলো। কিন্তু মাকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, তিনি আর যা-ই করেন পিতৃপুরুষের সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিতে পারবেন না। এই ধারণাই সারাজীবন তার মধ্যে বদ্ধমূল ছিলো। বিশ্বের যে প্রান্তেই গিয়েছেন, নিজেকে ভারতীয় কিংবা বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে এতটুকু দ্বিধা ছিলো না সুভাষ চন্দ্রের।

ছাত্র হিসেবেও দুর্দান্ত ছিলেন তিনি। র‍্যাভেন ‘শ স্কুলে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বেনী মাধব দাসের মতো কীর্তিমান শিক্ষককে। স্কুল জীবন থেকেই ভারতীয় চেতনা, মূল্যবোধের ভিত্তি গড়ে ওঠে সুভাষের। শুধু পাস করে ইংরেজের চাকরি করার বাইরেও যে জীবন আছে, তা উপলব্ধি করা শুরু হয়েছিল স্কুল থেকেই। ১৯১৩ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। ইংরেজ শাসনের সেই দিনগুলোতে প্রেসিডেন্সী কলেজ ছিলো ধনীর দুলালের বিদ্যাপীঠ। আর মধ্যবিত্ত সহপাঠীদের মধ্যে বেশিরভাগকেই দেখলেন তারা রাজনীতি কিংবা দেশের জন্য সচেতন নয়, বরং “পড়ালেখা শেষ করে চাকরিতে ঢুকে যেতে পারলেই বাঁচি“- এই ধারণা নিয়েই পড়তে এসেছে। প্রেসিডেন্সী কলেজের এমনই নিস্তরঙ্গ পরিবেশে ঝড় তুললেন সুভাষ। সাধারণ ছাত্রদেরকে ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতের অবস্থা যে দিনদিন ‘মরচে ধরা লোহা’র মতোই হয়ে যাচ্ছে, তা-ই বোঝাতে লাগলেন। কিন্তু তার মতো একই মন মানসিকতা নিয়ে বড় হয়েছে এমন সংখ্যা খুবই কম দেখে মর্মাহত কলেজের দিনগুলোতে মর্মাহত হয়েছিলেন।

একদিন প্রেসিডেন্সী কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ একদিন তার ক্লাস লেকচারে ভারতীয়দের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে বসলেন। ক্লাসে থাকা শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ভারতীয় হয়েও কেউই প্রতিবাদ না করায় একদিকে যেমন হতাশ, অন্যদিকে ক্ষুব্ধ হলেন সুভাষ। তার নেতৃত্বেই একদল ছাত্র প্রতিবাদ করলো অধ্যক্ষের এই মন্তব্যের। ইংরেজ অধ্যক্ষ ভারতীয় ছাত্রদের এই আচরণকে মোটেই ভালভাবে নিতে পারলেন না। বরং দৈহিক আক্রমণের অভিযোগ তুলে সুভাষ চন্দ্রকে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বহিষ্কার করে দিলেন। প্রতিবাদী সুভাষ এরপর ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্কটিশ চার্চ কলেজে। সেখান থেকে ১৯১৮ সালে বিএ পাশ করেন।2

তরুণ সুভাষ চন্দ্র বসু; Source: Der Tiger Indiens

১৯১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, কয়েক সপ্তাহ আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা শেষ হয়েছে। তখনই ভারত ছেড়ে সুভাষ পাড়ি জমালেন ইংল্যান্ডে। এপ্রিলের ১৩ তারিখ ভারতে ঘটে যায় ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এক হত্যাকাণ্ড, ব্রিটিশ সেনারা পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে চালায় সে হত্যাকাণ্ড। ক্ষোভে ফুঁসে উঠে সারা ভারত। রবীন্দ্রনাথ তার ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন। ভারতীয় সাধারণ জনগণের মতো তার মনেও চাপা ক্ষোভ দানা বাঁধে। কিন্তু তখন তার বিলেত যাওয়া ঠিকঠাক। তাই বিলেতে পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি জাতীয় আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির খুঁটিনাটি, দর্শন, ইতিহাস আর অর্থনীতির জ্ঞানকেও ঝালাই করে নিলেন। বিলেতে পা রেখেই বুঝতে পারলেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের হালচাল সম্পর্কে খুব কমই জানে সাধারণ ব্রিটিশরা।

বিলেতে বন্ধুদের সাথে সুভাষ চন্দ্র বসু; Source: Columbia University Press

সংবাদপত্রে ভারতের ব্যাপারে খুবই কম সংবাদ পাওয়া যেত, তাই দেশের অবস্থা নিয়ে যা জানবার তার শতভাগই আসতো আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিতদের সাথে বিনিময়কৃত চিঠি থেকে। ১৯২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি চিত্তরঞ্জন দাশকে লেখা চিঠিতে জানালেন তিনি আইসিএস অর্থাৎ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে চতুর্থ হয়েছেন, কিন্তু তিনি চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন না। দেশে ফিরে মানুষের জন্যই কাজ করতে চান। সেই চিঠিতেই কংগ্রেসের সাথে যোগ দেওয়ার চিন্তা চিত্তরঞ্জন দাশকে জানালেন তরুণ সুভাষ।3

বিলেতের প্রভাব

ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের জীবনধারা, চলাফেরা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেখে বেশ অবাক হয়েছিলেন সুভাষ। ভারতের মানুষ যা কল্পনা করতে পারে না, সেই অধিকার ব্রিটিশদের হাতের মুঠোয়। মূলত স্বাধীন দেশের মানুষের জীবন কতটা স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হতে পারে, প্রথমবারের মতো তিনি ইংল্যান্ডে এসে অনুভব করেছিলেন। এখানে না আসলে হয়তো ভারতকে পরাধীনতা নাগপাশ থেকে মুক্ত করার চিন্তা, সমস্যাগুলোকে গভীরভাবে ভেবে দেখার ফুসরত তার হতো না। এমনকি ভারতবাসীকে ব্রিটিশরা পরাধীনতার শৃংখলে বেঁধে রেখেছে বলে একদিকে যেমন ক্ষুব্ধ হতেন, অন্যদিকে মুগ্ধ হতেন কী সুনিপুণভাবে ভারতের মতো বিশাল সব সাম্রাজ্যেকে শাসন করে চলেছে। একটা সময় তিনি বুঝতে পারেন, ভারতের পরাধীনতার জন্য ভারতবাসীর রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতাও অনেকাংশে দায়ী। স্বাধীন দেশের সুবিধা সম্পর্কে এই মানুষগুলোকে বোঝাতে না পারলে যে তাদের মুক্তি অসম্ভব।

দেশে ফেরত এলেন পরিণত সুভাষ

দেশের মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে ভারতে ফিরে এলেন সুভাষ। ১৯২১ সালে যখন ফেরত এলেন, তার দেড় বছর আগে কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। এই আন্দোলনের খুঁটিনাটি নিয়ে গান্ধীর সাথে বিস্তর আলাপ আলোচনা করেও এ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি সুভাষ।

মহাত্মা গান্ধীর সাথে সুভাষ চন্দ্র বসু; Source: Gandhi Smarak Sangrahalaya Samiti

১৯২১ সালে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পরে সুভাষের প্রথম উল্লেখযোগ্য কর্মসূচী ছিলো প্রিন্স অফ ওয়েলসের ভারত সফর বয়কট করার আন্দোলন। দেশ জুড়ে হরতাল আর নানা কর্মসূচীতে সরকারের তখন নাভিশ্বাস। আন্দোলন ঠেকাতে কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা হলো। চিত্তরঞ্জন দাশ আর সুভাষও আটকা পড়লেন চৌদ্দ শিকের বেড়াজালে। ১৯২২ সালে যখন ভাইসরয় কংগ্রেসকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রস্তাব দিলেন, তখন কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়ে যাওয়ায় ভাইসরয় তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলেন। কংগ্রসে তখনো সুভাষের মতামত তেমন প্রভাবশালী হয়ে ওঠেনি।

এর পরপরই যখন চৌরি-চৌরার ঘটনায় গান্ধী তার অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন, তখন কংগ্রেস এবং গান্ধীর উপর হতাশ হয়ে পড়লেন সুভাষ। নবগঠিত স্বরাজ পার্টিতে সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। এরই মধ্যে ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু তাকে অত্যন্ত শোকাহত করে। তরুণ সুভাষ তার রাজনৈতিক জীবনের দীক্ষাগুরু হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশের পদাঙ্ক ধরেই হাঁটছিলেন। হঠাৎ করেই তার চলে যাওয়ায় জীবনে বেশ শূন্যতা অনুভব করতে থাকেন তিনি। ১৯২৭ সালে কংগ্রেসে আবার ফিরেন সুভাষ। ১৯২৮ সালের জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা বৈঠক আয়োজনের একটা বড় অংশের দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। বেশ সফলভাবে সেই দায়িত্ব পালন করে আলোচনায় উঠে আসেন সুভাষ। কলকাতা কংগ্রেসের কয়েক মাস পরেই তিনি ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রস’ এর সভাপতির দায়িত্ব পান। ভারতের বিশাল শ্রমিক শ্রেণীকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার চিন্তা করতে থাকেন তখন থেকেই। ১৯৩০ সাল নাগাদ কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতাদের মাঝে স্থান করে নিলেন সুভাষ।4

ভিয়েনায় বিদেশিনীর প্রেমে

১৯৩২ সাল অসহযোগ আন্দোলন আবারো জোরদার হয়েছে। আন্দোলনের একপর্যায়ে আবারো গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেন সুভাষ। আগে থেকেই অনুভব করছিলেন শরীরটা সুস্থ নেই, জেলে গিয়ে আরো বিপত্তি হলো। চিকিৎসার জন্য যেতে হলো অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে। সেখানেই তার সাথে পরিচয় এমিলি শেঙ্কলের। পরিচয় গড়ায় প্রমে, দুজনের মধ্যে বিনিময় হয় চিঠি।

এমিলিকে লেখা চিঠি; Source: NETAJI RESEARCH BUREAU

১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাদের বিয়ে হয়েছিল অস্ট্রিয়াতে। খুব গোপনে বিয়ের কাজটি করেন সুভাষ আর এমিলি। ১৯৪২ সালে তাদের কন্যাসন্তান অনিতা বসুর জন্ম হয়। ১৯৪২ সালে অনিতাকে দেখার জন্য একবার ভিয়েনায় গিয়েছিলেন সুভাষ। স্ত্রী আর সন্তানকে খুব কম সময়ই দিতে পেরেছেন এই বিপ্লবী নেতা।

স্ত্রী এমিলি শেঙ্কল ও কন্যা অনিতা বসু; Source: NETAJI RESEARCH BUREAU

জীবনে আসে নতুন মোড়

সুভাষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে ভিত্তালভাই প্যাটেলের সাথে পরিচয়ের পর। বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া ভারতকে স্বাধীন করা খুব কঠিন বলেই মনে করতেন। সুভাষ বসু আর ভিত্তালভাই প্যাটেল মিলে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন, যাতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছাড়া ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নেয়া অনেক কঠিন ব্যাপার। ইতোমধ্যে ভিত্তালভাই প্যাটেল গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে তিনি সুভাষ বসুর নামে তার সমস্ত সম্পদ উইল করে দিয়ে যান।

অন্যদিকে গান্ধী মনে করতেন, ভারতের জনগণ যেদিন জেগে উঠবে সেদিন ব্রিটিশদের ভারত ছেড়ে যাওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা খোলা থাকবে না। এই ব্যাপারেই গান্ধীর সাথে মত পার্থক্য ছিলো সুভাষ আর ভিত্তালভাই প্যাটেলের। আর গান্ধী যেখানে অহিংস আন্দোলনের রাস্তা বেছে নেয়ার কথা বলছিলেন, সেখানে সুভাষের দর্শন ছিলো, অস্ত্রের জবাব অস্ত্রেই দিতে হবে। ১৯৩৮ সালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রসের সভাপতিত্ব করেন সুভাষ চন্দ্র বসু। কংগ্রেসে তার মতাদর্শ ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করে।5

কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু; Source: www.oldindianphotos.in

এই কংগ্রেসে জওহরলাল নেহেরুকে সভাপতি করে ‘জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি’ গঠন করা হয়। পরের কংগ্রেসেও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এদিকে বিশ্ব রাজনীতির অবস্থাও বেশি ভালো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বযুদ্ধের চাপে পিষ্ট ব্রিটেনকে আরো চাপ দিয়ে ভারত স্বাধীন করার এই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে সব বৃথা। তবে সুভাষের গতিবিধি দেখে ব্রিটিশ সরকার তাকে আবারো জেলে বন্দী করে। ১৯৪০ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হলেও গৃহবন্দী করে রাখা হয় তাকে। ১৯৪১ সালে বাড়ি থেকে কলকাতার বাড়ি উধাও হয়ে গেলেন সুভাষ। ১৯৪২ সালে বার্লিন থেকে তার জোরালো কন্ঠ শোনা যায় আজাদ হিন্দ রেডিও স্টেশনে।6

হিটলারের সাথেও সাক্ষাত করেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু; Source: commons.wikimedia.org

কিন্তু ১৯৪৩ সালে হিটলারসহ জার্মানির উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাব্যক্তিদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলেন ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে তিনি তেমন সাহায্য পাচ্ছেন না। তিনি পাড়ি জমালেন জাপানে। ১৯৪২ সালেই গঠিত হয়েছিলো ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠনের প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হাতে ব্রিটিশ-ভারতীয় যুদ্ধবন্দীরা সংগঠিত হয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জাপানী বাহিনীর সাথে কাজ করবে। সুভাষ জাপানে পৌঁছে আজাদ হিন্দ ফৌজকে আরো গতিশীল করে তুলেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর লোকদের সাথে কথাবার্তাও শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি ভারতীয় নাগরিকদের মাঝেও এই বাহিনীর কাজকর্ম পৌঁছে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন।

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সুভাষ চন্দ্র বসু; Source: commons.wikimedia.org

জাপানে তার সাথে দেখা হয়েছিলো আরেক বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সাথে। তার অনুপ্রেরণা পেয়ে সুভাষ ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ নিয়ে দিনরাত কাজ করে যেতে লাগলেন। আজাদ হিন্দ ছাড়াও সাধারণ জনগণের মাঝে ধীরে ধীরে সুভাষচন্দ্র হয়ে উঠছিলেন ‘নেতাজী’। নেতাজী নামটি জার্মানিতেই থাকা ভারতীয়রাই প্রথম দিয়েছিলেন। কিন্তু এর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকে। সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয়দের মাঝে স্বাধীনতা আর জাতীয়তাবাদের প্রেরণা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করলেন নেতাজী। পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সাথে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ তথা মিত্র বাহিনীর উপর গেরিলার আক্রমণের মাধ্যমে খন্ডযুদ্ধ চালিয়ে যেতে থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজ। তবে ব্রিটিশ শক্তির সামনে সুবিধা করে উঠতে পারেনি জাপান। তাই জাপানের পরাজয়ের সাথে সাথে আজাদ হিন্দ ফৌজেরও পতন ঘটে।

নেতাজীর মৃত্যু রহস্য

১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছিলো জাপানের সংবাদপত্রগুলোতে। কিন্তু ভারতে তুমুল জনপ্রিয় এই নেতার মৃত্যু সংবাদ অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। কংগ্রেসে থাকা তার কর্মী সমর্থকদের অনেকের ধারণা ছিলো, তিনি আত্মগোপনে আছেন। নেতাজী হয়তো আবারো সংগঠিত হয়ে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ নিয়ে ভারতের স্বাধীনতার ডাক দেবেন।7

জাপানের সংবাদপত্রে নেতাজীর মৃত্যু সংবাদ; Source: commons.wikimedia.org

তবে কালের গভীরে হারিয়ে যাওয়া এই নেতা আর ফিরে আসেননি। তার মৃত্যু রহস্যের জট খুলতে গঠিত হয়েছিলো শাহনওয়াজ কমিশন, খোসলা কমিশন এবং মুখোপাধ্যায় কমিশন। কিন্তু কেউই সঠিক কূল কিনারা করে উঠতে পারেনি। তবে জাপানের সাথে যোগ দেওয়ায় কংগ্রসের অনেক নেতাই তার উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তবে অনেকে আবার আশায় বুক বেঁধেছিলেন সুভাষ হয়তো তার নেতৃত্বের ঝলকানিতে অন্ধকার ভারতে আলো নিয়েই ফিরবেন। কিন্তু সুভাষের আর ঘরে ফেরা হয়নি, ‘নেতাজী’ হয়েই চিরকাল বেঁচে রইলেন ভারতের সাধারণ মানুষের অন্তরের মণিকোঠায়। কিন্তু তার দেখানো সংগ্রামী পথে হেঁটেই ভারত ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। যুগে যুগে বিপ্লবীদের প্রেরণা হয়ে তাই আজও বেঁচে আছেন ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু’।

তথ্যসূত্র

  1. MOOKERJE, Dr. GIRIJA K (2016). SUBHASH CHANDRA BOSE, page: 1-5
  2. MOOKERJE, Dr. GIRIJA K (2016). SUBHASH CHANDRA BOSE, page:9-18
  3. MOOKERJE, Dr. GIRIJA K (2016). SUBHASH CHANDRA BOSE, page:27-31
  4. MOOKERJE, Dr. GIRIJA K (2016). SUBHASH CHANDRA BOSE, page:111-115
  5. Bose, Sugata(2011). His Majesty’s Opponent, page: 45-48
  6. Bose, Sugata(2011). His Majesty’s Opponent, page:85-90
  7. Bose, Sugata(2011). His Majesty’s Opponent, page: 7-9

ফিচার ইমেজ: assets.change.org

Related Articles