Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর: চন্দ্রশেখর সীমা, তারকাদের পরিণতি এবং সিঙ্গুলারিটি কথন

চমৎকার মৌলিক গবেষণা সহ স্নাতকোত্তর পাস করার দু বছরের মাথায়, ১৯১০ সালে ভারতের শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা আইএসিএসে নিজের বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন শুরু করেন চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণ। শিক্ষাজীবনে তার অসাধারণ সাফল্যের জন্য তার বড় ভাই, ভারতীয় রেলওয়ের অডিটর জেনারেল চন্দ্রশেখর সুব্রহ্মণ্যন আইয়্যার সেদিন তাকে বলেছিলেন, তিনি যেন অনেক বড় বিজ্ঞানী হন।

সে বছরই ১৯ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের লাহোরে তার ঘরে জন্ম নিয়েছিল একটি শিশু। কোনো এক অজানা কারণে, সি ভি রমণ ভ্রাতুষ্পুত্রকে দেখতে গিয়ে বলেছিলেন এ ছেলে একদিন আমার চেয়ে বড় বিজ্ঞানী হবে! সৃষ্টিকর্তা দুই ভাইয়ের কথাই রেখেছিলেন। বড় ভাইয়ের প্রার্থনা পূরণ হলো রমণের নোবেল পুরস্কার পাবার মাধ্যমে। আর রমণের ভবিষ্যদ্বাণীও মিলে গিয়েছিল তার ভ্রাতুষ্পুত্র চন্দ্রশেখরের নোবেল পুরস্কার পাবার মাধ্যমে। উভয়েই নামকরা বিজ্ঞানী হয়েছিলেন, কে বড় সেটা ধার্তব্য নয়।

সি ভি রমণ; Image source: thefamouspeople.com

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর জন্মেছিলেন ধনাঢ্য এবং উচ্চশিক্ষিত পরিবারে। তাই শৈশবে লেখাপড়ার জন্য অর্থাভাবে পড়তে হয়নি কখনো। শুরুটা কাকার চেয়ে একটু ধীরগতির হলেও তিনি রমণের পদাঙ্কই অনুসরণ করে চলেন। ১২ বছর বয়সে হিন্দু স্কুলে ভর্তি হবার সময় বিস্তর সাহিত্য আর দর্শন পড়া হয়ে গেছে তার। স্কুলে ভর্তি হয়ে শুধুই গণিত আর বিজ্ঞান নিয়ে মেতে থাকতেন। এরপর ১৪ বছর বয়সে কাকার মতোই মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পড়ার জন্য ভর্তি হয়ে যান। উল্লেখ্য, রমণ ১৪ বছর বয়সে স্নাতক পাস করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন!

যা-ই হোক, ৪ বছর পর তিনি সাফল্যের সহিত স্নাতক সম্পন্ন করেন। আর স্নাতক কোর্সের শেষ বছর রচনা করেন জীবনের প্রথম গবেষণাপত্র ‘কম্পটন স্ক্যাটারিং অ্যান্ড নিউ স্ট্যাটিস্টিকস’। চন্দ্রশেখরের গবেষণাপত্রটি তার শিক্ষকদের এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, তারা চন্দ্রশেখরের জন্য ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন। তাদের ধারণা ছিল, ক্যামব্রিজে পড়ালেখা করলে বড় বিজ্ঞানী হয়ে উঠবেন চন্দ্রশেখর। কিন্তু চন্দ্রশেখর এত ধৈর্য ধরবেন কেন?

পড়ালেখা শেষ করতে তো অনেকদিন লাগে। অথচ তিনি তো ততদিনে বিজ্ঞানী হয়েই গেছেন! হ্যাঁ, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং ক্যামব্রিজে যাওয়ার পথের ভ্রমণটাই তার জীবন পাল্টে দেয়। ভারত থেকে জাহাজে করে ব্রিটেন পর্যন্ত দীর্ঘ ভ্রমণে তিনি অলস সময় না কাটিয়ে এক বিস্ময়কর কাজ করে ফেলেন। তিনি জানতেন যে, ট্রিনিটি কলেজে তার সুপারভাইজার হবেন পদার্থবিজ্ঞানী রালফ ফাউলার। তাই জাহাজে বসে ফাউলারের বৈজ্ঞানিক কাজগুলো পড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

শ্বেত বামন তারকা; Image source: xataka.com

ফাউলার এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের শ্বেত বামন তারকায় ডিজেনারেট ইলেকট্রন গ্যাস নিয়ে লেখাগুলো পড়তে গিয়ে একটি যুগান্তকারী বিষয় অনুধাবন করেন চন্দ্রশেখর। তিনি দেখলেন যে, সবাই এ ব্যাপারটিকে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। ডিজেনারেট ইলেকট্রনের ধর্ম পর্যবেক্ষণ করার পদ্ধতিকে হালনাগাদ করে তিনি ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানকে সরিয়ে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা ব্যবহার করেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই জাহাজে বসে জীবনের সেরা কাজটি করে ফেলেন চন্দ্রশেখর, যার সূত্র ধরেই তিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন।

যা-ই হোক, ক্যামব্রিজে এক বছর থাকার পর তিনি চলে গেলেন জার্মানির গোটিঙ্গেনে। সেখানে নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স বোর্নের সাথে এক বছর কাজ করে ডেনমার্ক হয়ে ফিরে যান ক্যামব্রিজে। ২২ বছর বয়সে তিনি ক্যামব্রিজ থেকে পি.এইচডি সম্পন্ন করেন। আবার জাহাজে ফেরা যাক। জাহাজে বসেই তিনি অঙ্ক কষে এমন একটি সংখ্যা নির্ণয় করলেন, যা নভো-জ্যোতির্বিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গতিপথই পাল্টে দিয়েছিল। তার সম্মানে সে সংখ্যাটি ‘চন্দ্রশেখর সীমা’ বলে পরিচিত।

সংখ্যাটি হচ্ছে ১.৪। ১৯৩০ সালের জাহাজ ভ্রমণের এই কাজ তিনি পরবর্তী এক বছরে পরিমার্জন করে পরের বছর ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’এ প্রকাশ করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি সংখ্যাটি ১.৭ নির্ণয় করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে পরিমার্জন করে ১.৪ নির্ণয় করেন। কী এই সংখ্যা এবং কী এর মাহাত্ম্য? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের জানতে হবে তারকাদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে।

তারকা টিকে থাকে এর বহির্মুখী এবং অন্তর্মুখী বলের সাম্যাবস্থার জন্য; Image source: gifer.com

উপরের ছবিটি লক্ষ করুন। লাল রঙের তীর চিহ্নগুলো বহির্মুখী এবং কালো রঙেরগুলো অন্তর্মুখী চাপ নির্দেশ করে। একটি তারকা কোটি কোটি বছর টিকে থাকে এই দুই চাপের সাম্যাবস্থার কারণেই। তারকার কেন্দ্রে ক্রমাগত যে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চলতে থাকে, তা থেকে সৃষ্ট বহির্মুখী চাপ এবং কেন্দ্রমুখী মহাকর্ষ বল সাম্যাবস্থায় থাকে বলেই তারকা টিকে থাকে।

কিন্তু একটি তারকা যখন এর জ্বালানীর প্রায় সবটাই পুড়িয়ে ফেলে, তখন এর নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া আর আগের মতো বহির্মুখী চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। ফলে সাম্যাবস্থা বিঘ্নিত হয় এবং কেন্দ্রমুখী মহাকর্ষের দরুন তারকাটি ক্রমাগত সঙ্কুচিত হতে থাকে। এর সংকোচন আবার নির্ভর করে এর ভরের উপর। তারকার ভর যত বেশি হবে, কেন্দ্রমুখী মহাকর্ষ বল তত বেশি হবে এবং তারকাটি তত বেশি সঙ্কুচিত হবে।

চন্দ্রশেখর সীমা; Image source: de.wikipedia.org

আমরা জানি যে, আর কয়েকশ কোটি বছর পর সূর্য একটি শ্বেত বামনে পরিণত হবে। গত শতাব্দীর ‘৩০ এর দশকে জ্যোতির্বিদরা বিশ্বাস করতেন যে, কেবল সূর্য নয়, মহাবিশ্বের কোটি কোটি তারকার পরিণতিই শ্বেত বামনে রূপান্তরিত হওয়া। কিন্তু চন্দ্রশেখর এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেন। তিনি দেখান যে, একটি শ্বেত বামনের অস্তিত্ব তখনই সম্ভব, যখন এর ভর ১.৪ সৌরভরের সমান বা তার চেয়ে কম হবে।

সোজা কথা, যদি কোনো তারকার জ্বালানী নিঃশেষ হবার পরের ভর সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ বা সমান হয়, তাহলে সেটি শ্বেত বামনে পরিণত হবে। অন্যথায় এর পরিণতি হবে ভিন্ন। জ্বালানি নিঃশেষ হবার পর কোনো তারকার ভর চন্দ্রশেখর সীমার বেশি হলে এর পরিণতি দু’রকম হতে পারে।

১. তারকাটি একটি নিউট্রন তারকায় পরিণত হতে পারে, যার ঘনত্ব অস্বাভাবিকভাবে বেশি হবে। সাধারণ নিউট্রন তারকার ঘনত্ব প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ৫০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন হয়।

২. তারকাটি একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে। যার কেন্দ্রে থাকবে মহাকর্ষী সিঙ্গুলারিটি, এর ঘনত্ব হবে অসীম।

সিঙ্গুলারিটি হচ্ছে এমন একটি বিন্দু যার আয়তন শূন্য, ভর এবং ঘনত্ব অসীম! এই বিন্দুতে সময় এবং স্থান অসীমভাবে বেঁকে যায় এবং পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো সেখানে অচল। সাধারণত কোনো তারকার সমগ্র ভর প্রবল মহাকর্ষের টানে সঙ্কুচিত হয়ে আয়তন প্রায় শূন্য হয়ে গেলে সিঙ্গুলারিটির সৃষ্টি হয়। চন্দ্রশেখর যদিও তারকার পরিণতি হিসেবে নিউট্রন তারা কিংবা কৃষ্ণগহ্বর, কোনোটির কথাই বলেননি। তথাপি তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে, চন্দ্রশেখর সীমার অধিক ভর সম্পন্ন একটি ক্রমাগত ধ্বসে পড়তে থাকা তারকার সিঙ্গুলারিটি সৃষ্টি ঠেকানোর মতো কোনো বল তখনো আবিষ্কার হয়নি। বলা বাহুল্য, সেই বল আজও আবিষ্কৃত হয়নি এবং তার সিদ্ধান্তই সঠিক। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, প্রতিটি কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রই হচ্ছে একেকটি সিঙ্গুলারিটি।

সিঙ্গুলারিটি; Image source: celebrationscakedecorating.com

চন্দ্রশেখরের এই বিস্ময়কর আবিষ্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেসময়কার প্রতিষ্ঠিত সকল জ্যোতির্বিদ। তখনকার জ্যোতির্বিদদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী স্যার আর্থার এডিংটন তো সরাসরি বলেই দিয়েছিলেন যে, সিঙ্গুলারিটি তথা অসীম ঘনত্বের কোনো বিন্দুর অস্তিত্ব অসম্ভব। তার বিশ্বাস ছিল, এমন কোনো অনাবিষ্কৃত বল বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রয়েছে, যা আসলে সিঙ্গুলারিটির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মজার ব্যাপার হলো, চন্দ্রশেখরের গাণিতিক হিসাব নিকাশের সাথে কেউই অমত প্রকাশ করতে পারছিলেন না। কিন্তু শূন্য আয়তনে অসীম ভরের ব্যাপারটাই কেউ মেনে নিতে পারছিলেন না।

ক্যামব্রিজে একসময় তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিলেন না। কিন্তু চন্দ্রশেখর বিশ্বাস করতেন, তিনি সঠিক। তাই ভগ্নহৃদয়ে ক্যামব্রিজ ছেড়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমান। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পরবর্তী জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। চন্দ্রশেখর সীমার পর আর কোনো বড় সাফল্য না পেলেও বামন তারকা বিষয়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা তিনি প্রকাশ করেছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

ধীরে ধীরে দুয়ে দুয়ে চার মিলতে লাগলো এবং জ্যোতির্বিদরা অনুধাবন করতে লাগলেন যে, এডিংটন ভুল আর চন্দ্রশেখরই সঠিক। তবে প্রক্রিয়াটি এত শ্লথ ছিল যে এমন যুগান্তকারী আবিষ্কারের স্বীকৃতি পেতে চন্দ্রশেখরকে অপেক্ষা করতে হয় ৩০টি বছর! ১৯৮৩ সালে উইলিয়াম ফাউলারের সাথে চন্দ্রশেখরকেও পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর (১৯১০-১৯৯৫ সাল); Image source: photoarchive.lib.uchicago.edu

ব্যক্তিগত জীবনে চন্দ্রশেখর ছিলেন অত্যন্ত ডানপিটে স্বভাবের। যা তিনি বিশ্বাস করতেন, তা অন্যদের বিশ্বাস করানোর আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হতেন না। স্নাতক পাস করার পরই লালিথা নামক এক রমণীকে বিয়ে করেন। তাদের কোনো সন্তান হয়নি। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও রয়্যাল মেডেল, কুপলি মেডেল, পদ্মবিভূষণ, হেইনম্যান প্রাইজসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন চন্দ্রশেখর।

৭০ বছর বয়সে অধ্যাপনা থেকে অবসর নিলেও আমৃত্যু কলম চালিয়ে গেছেন। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে প্রকাশ করেছেন ‘নিউটন’স প্রিন্সিপিয়া ফর দ্য কমন রিডার’ নামক বইটি, যা পাঠকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯৫ সালে ২১ আগস্ট শিকাগোয় মৃত্যুবরণ করেন সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর। তার সম্মানে নতুন নতুন কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কারের জন্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকা নাসার একটি এক্সরে অবজারভেটরির নামকরণ করা হয়েছে ‘চন্দ্র এক্সরে অবজারভেটরি’।

ফিচার ছবি: indianexpress.com

Related Articles