Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সিন্ধুতাই সাপাকাল: হাজার শিশুর মা

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

– কামিনী রায়

কতই না সহজ সাবলীল, ভালোলাগার কিছু শব্দ যা আমরা ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পাতায় আর স্মৃতির কোঠায় লালন করে আসি। কিন্তু কখনো মন থেকে ধারণ করতে পারি না বা চাইলেও হয়ে ওঠে না বললেই চলে। স্বার্থ এবং আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা সবসময় আমাদের ঘিরে রেখেছে। অন্যের জন্য ভাবার অবকাশ আমাদের খুব বেশি নেই। কিন্তু তা সত্য জেনেও পৃথিবীতে কখনো কখনো খেয়ালের ভুলে অথবা সৃষ্টিকর্তার বদান্যতায় এমন কিছু মানুষের আগমন ঘটে, যারা চলমান সকল নিয়ম-নীতি ভুলে যেন নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে আমাদের ধ্যান-ধারণাকে। তেমনই এক মহিয়সী নারীকে নিয়ে আজকের লেখা, যিনি প্রবল দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে থেকেও শুধু নিজের কথা না ভেবে সমাজের অসংখ্য এতিমের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে হয়ে উঠেছেন সকলের ‘মাই’, নাম তার সিন্ধুতাই সাপাকাল। হাজার শিশুর ভালোবাসায় সিক্ত ভারতের পুনেতে বসবাসরত এই মহিয়সী নারী ‘অনাথদের মা’ নামেই অধিক পরিচিত।

দত্তক নেয়া বাচ্চাদের সাথে সিন্ধুতাই; Source: dailymotion.com

সিন্ধুতাইয়ের জীবনের শুরুটা খুব একটা সুখদায়ক ছিল না। ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর, ভারতের মহারাষ্ট্রের ওয়ারদার জেলার পিম্প্রি মেঘে নামক গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সিন্ধুতাই। ছোটবেলায় তাকে ডাকা হতো ছিন্ধি নামে, যার অর্থ হলো ছেঁড়া কাপড়। স্কুলে ভর্তি করা হলেও তার পরিবারের সামর্থ্য ছিল না তার জন্য পড়ার ব্যয় বহন করার‍। তাই সিন্ধুতাইয়ের বয়স যখন ১০ বছর, তখন পাশের নাবরগাও গ্রামের ৩০ বছর বয়সী শ্রীহরি সাপাকালের সাথে তার বিয়ে হয়। কিন্তু স্বামীর সংসারে এসেও ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি সিন্ধুতাইয়ের। বরং দিনের পর দিন স্বামীর অবহেলা ও অত্যাচার তার জীবনের সব সুখের চাওয়া ম্লান করতে থাকে। তবে অনেক কষ্ট সহ্য করেও ১০ বছর ধরে সংসার করে গেছেন সিন্ধুতাই। এরই মধ্যে তিনটি বাচ্চার জননীও হন তিনি।

সিন্ধুতাই সাপাকাল; Source: thebetterindia.com

এর মধ্যে সিন্ধুতাই তার গ্রামে এক অসাধারণ কাজ করে বসেছিলেন। ওয়ারদার জেলার বিভিন্ন গ্রামে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হতো গরুর গোবর। অনেকের এই গোবর বেচা অর্থই ছিল আয়ের মূল উৎস। কিন্তু গ্রামের এক প্রভাবশালী বন বিভাগের কর্মী গ্রামের সব গোবর সংগ্রহ করে বন বিভাগের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে দিচ্ছিল। আর গ্রামের মানুষকে নানা বাহানায় কম টাকা দিয়ে ঠকিয়ে আসছিল। সিন্ধুতাই ঘটনা বুঝতে পেরে এই কর্মীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তার প্রতিবাদে বনবিভাগ থেকে কর্মীরা পরিদর্শনে আসে এবং ঘটনার সত্যতা জানার পর সেই বনবিভাগ কর্মীর ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। এতে খুব ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে সেই ব্যবসায়ী। সে প্রতিশোধের আশায় সিন্ধুতাইয়ের স্বামীকে প্ররোচিত করতে থাকে। সিন্ধুতাইকে ত্যাগ করার জন্য তার স্বামীকে অনেকগুলো টাকাও দেয়।

সংগ্রামী নারী সিন্ধুতাই; Source: huffpostmaghreb.com

২০ বছর বয়সী সিন্ধুতাই তখন ৯ মাসের গর্ভবতী। পেটে তার চতুর্থ সন্তান মমতা। কিন্তু সেসবের পরোয়া না করেই সিন্ধুতাইয়ের স্বামী তাকে ঘর থেকে বের করে দেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবহীন ঐ গ্রামে কারো কাছে এতটুকু সাহায্য পেল না সিন্ধুতাই। পেটে বাচ্চা নিয়ে একা একা চলতে পারছিলেন না তিনি। শেষপর্যন্ত ঠাই নিলেন এক গোয়ালঘরে। হঠাৎ পেটে প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়, সাথে বের হতে থাকে রক্তও। রক্তে ভেসে যেতে থাকে পুরো গোয়ালঘর। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকেন সিন্ধুতাই। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো আর বাঁচানো যেত না মা-মেয়েকে। কিন্তু গোয়ালঘরের এক গাভী হয়তো বুঝতে পেরেছিল মায়ের মনের আকুতি। ‘হাম্বা হাম্বা’ রবে সারাক্ষণ জাগিয়ে রাখছিল সিন্ধুতাইকে। একসময় জন্ম নিল মমতা। পাশে পড়ে থাকা এক টুকরো পাথর দিয়ে ঘষে ঘষে নাড়ি কাটলেন সিন্ধুতাই। পরে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেলেন আশ্রয়ের আশায়। কিন্তু অর্থের অভাবে এবং লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েকে ঘরে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায় তারা।

হাজার এতিমের মা সিন্ধুতাই; Source: openthemagazine.com

আর কোনো উপায় না দেখে শেষে মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষা করতে নামলেন সিন্ধুতাই। খুব ভালো ধর্মীয় গান গাইতে পারতেন তিনি। সেই গান করে কিছু কিছু ভিক্ষা পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি অনুধাবন করলেন, গ্রামে-গঞ্জে অনেক এতিম ছেলে-মেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের জুটছে না দু’বেলা আহার, নেই থাকার জন্যে কোনো বাসস্থানও। সিন্ধুতাই তখন তাদেরকেও কিছু কিছু খাবার খাওয়াতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে তার কাছে এতিম সন্তানের ভিড় বাড়তে লাগলো। কিন্তু সিন্ধুতাইয়ের একার পক্ষে সবার জন্য খাবার যোগাড় করাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু এতগুলো কচি কচি দুধের বাচ্চারা না খেতে পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে, এ যেন আর তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। মনের দুঃখে একদিন আত্মহত্যার করার জন্যে মনঃস্থির করলেন।

প্রিয় বাচ্চাদের ভিড়ে সিন্ধুতাই; Source: fundyourownworth.com

আত্মহননের জন্য সিন্ধুতাই চলে যান কাছের রেলস্টেশনে। সেখানে গিয়ে দেখলেন এক বুড়ো ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছেন আর সাহায্য খুঁজছেন। কিন্তু আশেপাশে কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপই করছিল না। সিন্ধুতাইয়ের হাতে তখন ভিক্ষা করে পাওয়া একটি রুটির টুকরো ছিল। সিন্ধুতাই রুটিটা বৃদ্ধ লোককে দিয়ে উঠে বসালেন এবং পানি পান করালেন। বৃদ্ধের কাছে গিয়ে দেখলেন তার গায়ে অনেক জ্বর। তখন আত্মহত্যার কথা ভুলে গিয়ে বৃদ্ধের সেবায় লেগে পড়লেন। কিছুদিনের মধ্যেই সিন্ধুতাই সুস্থ করে তুললেন বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ সুস্থ হয়ে সিন্ধুতাইকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। এই ঘটনায় সিন্ধুতাই জীবনে অনেক পরিবর্তন এলো। সিন্ধুতাই যেন নিজেকে খুঁজে পেলেন নতুন করে। তিনি ফিরে আসলেন তার ফেলে রেখে যাওয়া এতিমদের কাছে। তাদের নিয়ে নতুন উদ্যমে শুরু করলেন ভিক্ষাবৃত্তি। গ্রামে গ্রামে গিয়ে এতিমদের জন্য টাকা তুলতে লাগলেন। কিন্তু ২০ বছর বয়সী একজন কিশোরীর জন্যে ব্যাপারটি মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। আর পুরুষ সমাজ থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতে তার নতুন বাসস্থান করলেন গোরস্থানে, যেখানে সাধারণত মানুষের কোনো যাতায়াত থাকে না।

অন্যের সাহায্যে নিবেদিতা সিন্ধুতাই; Source: aaradhyafoundations.com

ধীরে ধীরে সিন্ধুতাই এতিম ছেলে-মেয়েগুলোকে দত্তক নিতে শুরু করেন। সকল শিশুই সিন্ধুতাইকে মাই বলে ডাকতে শুরু করে। পক্ষপাতের ভয়ে নিজের মেয়ে মমতাকে পাঠিয়ে দেন পুনের একটি ট্রাস্টে। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে সিন্ধুতাইয়ের সংসার। তার সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব মিটিয়ে শিক্ষিত করে তোলার বিষয়েও সচেষ্ট হয়ে ওঠেন তিনি। বর্তমানে তার ছয়টি এতিমখানা, যার তিনটি ছেলেদের আর বাকি তিনটি মেয়েদের। এতিমখানার শিশুরা যেন পড়াশোনা করে সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেদিকে অসম্ভব মনোযোগী সিন্ধুতাই। হাজারের বেশি সন্তান আছে সিন্ধুতাইয়ের। ছেলের বউ, মেয়ের জামাই, নাতি-নাতনিদের নিয়ে এখন অনেক বড় সিন্ধুতাইয়ের সংসার।

বর্তমানে তার এতিমখানা থেকে বেরিয়ে অনেকে হয়েছেন ডাক্তার, অধ্যাপক এবং আইনজীবী। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে তার সন্তানদের ওঠা-বসা। তবে প্রতিষ্ঠিত হয়েও সন্তানেরা ভুলে যাননি তাদের মাইকে, তাদের আশ্রয়দাত্রীকে। এতিমখানার উন্নতিতে তারা সবসময় মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাদের অনেকের নিজেদের এতিমখানাও রয়েছে। মেয়ে মমতাও সোশ্যাল ওয়ার্কের উপর মাস্টার্স করে যোগ দিয়েছেন মায়ের সাথে। অনেক বছর পর তার স্বামী ফিরে আসেন সিন্ধুতাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে। সিন্ধুতাইয়ের মনে মানবতার আবাসভূমি। তাই ৮০ বছরের বৃদ্ধকেও আর ফেলতে পারেননি তিনি। তার অন্য সব সন্তানের মতোই আরেক বৃদ্ধ সন্তান হিসেবে ঠাই দিয়েছিলেন তার আশ্রয়ে। জীবনের শেষ মুহুর্তে এমন মহীয়সী নারীর সংস্পর্শ পাওয়াই ছিল তার জীবনের বড় প্রাপ্তি। সিন্ধুতাইয়ের জীবনকাহিনী নিয়ে ২০১০ সালে মুক্তি পায় মারাঠী চলচ্চিত্র ‘মি সিন্ধুতাই সাপাকাল’।

মি সিন্ধুতাই সাপাকাল ছবির পোস্টার; Source: hungama.com

তার এই অসামান্য কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। রাষ্ট্রের অনেক বড় বড় নেতা-নেত্রী, অভিনেতা-অভিনেত্রীর হাত থেকে তুলে নিয়েছেন এসব পুরস্কার। রাস্তায় নেমে যাওয়া এক নারী শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছা এবং অন্যের দুঃখ লাঘবের চেষ্টায় একের পর এক কাজ করে গেছেন। তার ছয়টি এতিমখানাকেই এমনভাবে তৈরি করে তুলেছেন যাতে করে তার অনুপস্থিতিতেও খুব ভালোভাবে চলে। কোনোকিছুই যেন সিন্ধুতাই-নির্ভর না হয়ে পড়ে সে ব্যাপারেও তিনি বেশ সচেষ্ট। খুব বেশি কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই সিন্ধুতাইয়ের। শুধু একটি মাত্র চাওয়া, এই পৃথিবীতে কোনো শিশু যদি মায়ের অভাব বোধ করে, যদি দু’বেলা দু’মুঠো আহার না জোটে, তবে তার পাশে সিন্ধুতাই আছেন সবসময়।

Related Articles