Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তেজস্ক্রিয় রসায়নের প্রাণপুরুষ হেভেসি ও তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ

আইসোটোপকে বিভিন্ন রাসায়নিক এবং জৈবিক প্রক্রিয়ায় ‘ট্রেসার’ বা অনুসন্ধানকারী/চিহ্নিতকারী হিসেবে ব্যবহারের অগ্রদূত তিনি। জীব ও উদ্ভিদ পুষ্টি হিসেবে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য গ্রহণ করার পর সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করে, তা গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচন করেন তিনি। সহকারীদের সহায়তায়, পর্যায় সারণীর ৭২ তম মৌল হাফনিয়াম আবিষ্কার করেন তিনি। নিজের অবদানের জন্য তিনি জিতেছেন নোবেল পুরস্কারও। রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের নানান শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। তিনি হাঙ্গেরিয়ান তেজস্ক্রিয় রসায়নবিদ জর্জ হেভেসি।

জর্জ ডি হেভেসি (১৮৮৫-১৯৬৬); image source: biografiasyvidas.com

হেভেসির শুরুটা হয়েছিল দুর্দান্ত। বুদাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গলিত সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড এবং সোডিয়াম ধাতুর মধ্যকার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট সম্পন্ন করেন। পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রির জন্য গিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে। আর সেখানে ভাগ্যক্রমে অধ্যাপক হিসেবে পেয়ে যান আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীকে। আইনস্টাইনের সান্নিধ্য তার জীবনে জন্য বড় অনুপ্রেরণা হয়ে আসে। ফ্রিটজ হেবারের বিশ্বখ্যাত অ্যামোনিয়া সংশ্লেষণ আবিষ্কার তিনি একজন সহযোগী হিসেবে প্রত্যক্ষ্য করেন, যা তার রাসায়নিক জ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধ করে। তবে তার জন্য বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যের এখানেই শেষ নয়। পোস্ট ডক্টরেট সম্পন্ন করে হেভেসি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে। সেখানে গিয়ে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে নীলস বোর আর হেনরি মোসলের মতো পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে। অবশ্য তার বিজ্ঞানী ক্যারিয়ারের প্রকৃত সূচনা হয় রাদারফোর্ড ল্যাবরেটরিতে। এখানে তিনি পানির অণুর তেজস্ক্রিয়তা, দ্রবণে তেজস্ক্রিয় আয়নের যোজনী এবং রেডিয়াম ডি-ইমানেশন পৃথকীকরণ নিয়ে গবেষণা করেন। খুব বেশি সাফল্য যে পেয়েছিলেন, তা নয়। কিন্তু কর্মজীবনের পরবর্তী সাফল্যের ভিত্তি এখানেই স্থাপিত হয়।

তার জীবনের প্রথম সফল পরীক্ষাটি কিন্তু বেশ মজার। ম্যানচেস্টারে যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, সেখানকার বাড়িওয়ালাকে একদিন তিনি খাবারের ব্যাপারে অভিযোগ করেন। তার অভিযোগ ছিল বাড়িওয়ালা তার খাবারে আগের বেলার খাবারের উচ্ছিষ্ট মিশিয়ে দিচ্ছেন। এমন অভিযোগে আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা হলো বাড়িওয়ালার। হেভেসি তাই কথা না বাড়িয়ে কাজে নেমে পড়লেন। সেদিন দুপুরে খাবার পর তিনি অবশিষ্ট খাবারে কিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছিটিয়ে দিয়ে কাজে চলে গেলেন। রাতে ফেরার সময় ল্যাবরেটরি থেকে সাথে নিয়ে এলেন ইলেকট্রোস্কোপ যন্ত্রটি। হাত মুখ ধুয়ে যখন খাবার টেবিলে এলেন, সাথে নিয়ে এলেন ইলেকট্রোস্কোপ যন্ত্রটি। বাড়িওয়ালার সামনেই সেটি দিয়ে খাবার পরীক্ষা করে দেখান যে, দুপুরের ছিটিয়ে দেয়া তেজস্ক্রিয় পদার্থ সেখানে উপস্থিত! আর ধরা পড়ে গিয়ে বাড়িওয়ালা মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজতে লাগলেন।

বুদাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়; image source: dailynewshungary.com

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বুদাপেস্ট ছেড়ে ভিয়েনা চলে যান হেভেসি। সেখানে একটি কপারের ফ্যাক্টরিতে যুদ্ধের পুরো সময়টা জুড়েই টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। যুদ্ধ শেষ হলেই নিজ শহরে ফিরে পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যাপনা শুরু করেন। এখানে অধ্যাপনা করার সময়ও বিশ্বের অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় আর ল্যাবরেটরিতে গবেষণার আমন্ত্রণে বারবার ছুটে গিয়েছেন তিনি। গবেষণার ব্যাপারে তার কাছে কেউ কখনো ‘না’ শব্দটি শোনেনি। বন্ধু নীলস বোরের সাথে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন এক বছরেরও অধিক সময়। অথচ এসব কাজে তার না কোনো অর্থ আয় হতো, না সাফল্যের জন্য পেতেন কোনো কৃতিত্ব। কেবলই জ্ঞানার্জনের ইচ্ছা এবং গবেষণার জন্য অফুরান প্রাণশক্তি থেকে তিনি করে গেছেন এসব।

হেভেসিই প্রথমবারের মতো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়া জানার প্রয়াস চালিয়েছেন। তিনি একটি ছোট উদ্ভিদের মূল তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ধারণকারী একটি দ্রবণে ডুবিয়ে রাখেন কিছুক্ষণ। পরে সেই উদ্ভিদের বিভিন্ন অঙ্গের ছাইভস্ম পরীক্ষা করে সহজেই নির্ণয় করে ফেলেন উদ্ভিদের কোনো অংশ কতটা তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহার করে। এই পরীক্ষাটি করতে তিনি ২১২-লেড ব্যবহার করেন, যা সেসময় থোরিয়াম-বি নামে পরিচিত ছিল। হেভেসি তার এই পরীক্ষাটি ১৯২৩ সালে প্রকাশ করেন, যা বিজ্ঞানীমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তার এই আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায়ই তেজস্ক্রিয় রসায়ন আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে।

তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ যেভাবে তৈরি হয়; image source: sites.google.com

১৯২২ সালের দিকে হেভেসি এবং তার সহযোগী ডির্ক কোস্টার একটি নতুন মৌলের সন্ধান শুরু করলেন। বোরের পরমাণু মডেলের গণনানুযায়ী ৭২টি প্রোটন বিশিষ্ট একটি মৌলের অস্তিত্ব আছে যার রাসায়নিক ধর্ম অনেকটা জিরকোনিয়ামের কাছাকাছি। হেভেসি ও কোস্টার তাই জিরকোনিয়ামের খনিজের মধ্যে নতুন সেই মৌলের সন্ধান শুরু করেন। এ কাজে তারা এক্সরে ইমিশন যন্ত্র ব্যবহার করেন। খনিজ হতে সকল দ্রবণীয় জিরকোনিয়াম আলাদা করে ফেলতেই এক্সরে বর্ণালীতে নতুন রেখার দেখা পাওয়া যায়। এরপর ‘ফ্র্যাকশনাল ক্রিস্টালাইজেশন’ পদ্ধতির ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন মৌলের বিশুদ্ধ ফ্লুরাইড লবণ পৃথক করা হয়। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আবিষ্কার করেন বলে হেভেসি এই মৌলের নাম দেন ‘হাফনিয়াম’, যা হচ্ছে কোপেনহেগেনের ল্যাটিন নাম। তার এই আবিষ্কারটিও ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়।

“হেভেসি এবং কোস্টার হাফনিয়াম নামক একটি নতুন মৌল আবিষ্কার করেছেন”, ৭২টি প্রোটন বিশিষ্ট মৌলের ঘটনা কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। ১৯১২ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী আরবেইনও একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে তিনি গ্যাডোলিনের খনিজ থেকে ৭২ প্রোটন বিশিষ্ট একটি বিরল মৃত্তিকা মৌল ‘সেল্টিয়াম’ এর পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্তু বোরের পারমাণবিক মডেল অনুযায়ী ৭২ প্রোটন বিশিষ্ট মৌলটি রূপান্তরিত মৌল হবার কথা। সেক্ষেত্রে ১৯২৩ সালে হেভেসির আবিষ্কার ছিল অধিক যুক্তিসঙ্গত এবং উন্নত, যেখানে হাফনিয়াম ছিল একটি রূপান্তরিত মৌল। কিন্তু তারপরও হেভেসির আবিষ্কারকে অনেকদিন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত আরবেইনের সেল্টিয়ামই পর্যায় সারণির ৭২ তম স্থানটি দখল করে রেখেছিল।

জিরকোনিয়াম থেকে যে পদ্ধতিতে হাফনিয়াম পৃথক করেছেন হেভেসি, তার ডায়াগ্রাম; image source: researchgate.net

তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে রাসায়নিক প্রক্রিয়া নির্ণয়ের পন্থা আবিষ্কার করার পর হেভেসির মাথায় নতুন পদ্ধতির বুদ্ধি খেলে যায়। হ্যারল্ড উরের ‘হেভি ওয়াটার’ বা ভারী পানির আবিষ্কার তাকে জৈবিক প্রক্রিয়ায় ভারী পানি ব্যবহারে অনুপ্রাণিত করে। ভারী পানি হচ্ছে হাইড্রোজেনের ভারী আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম দ্বারা তৈরি করা পানি। হেভেসি উরের কাছ থেকে কয়েক লিটার ভারী পানি চেয়ে আনেন। এই ভারী পানিকে তিনি অতেজস্ক্রিয় ট্রেসার হিসেবে ব্যবহার করেন মানুষের দেহে। এর মাধ্যমে তিনি একটি পানির অণু মানুষের দেহে গড়ে কত সময় ব্যয় করে এবং পূর্বে অবস্থিত পানির সাথে কতটা মিশ্রিত হয় তা নির্ণয় করেন। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত এ গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিটি পানির অণু মানবদেহে গড়ে ১১.৫-১৪.৫ দিন পর্যন্ত অবস্থান করে। আবার, কোনো নির্দিষ্টি দিনে একজন মানুষের দেহে বিদ্যমান পানির প্রতিটি অণুই ৮১০ দিনের মধ্যে দেহত্যাগ করে এবং নতুন অণু সেই স্থান দখল করে।

ভারী পানি; image source: pinterest.com

‘দ্য রেসিডেন্স টাইম অব ওয়াটার ইন দ্য হিউম্যান বডি’ শিরোনামে এই গবেষণাটি প্রকাশের পরই হেভেসি ফসফরাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। মানবদেহের বিপাকীয় ক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই মৌলকে তিনি একটি জৈবিক ট্রেসার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দুই বছরের গবেষণায় হেভেসি এবং তার সহকারীরা একটি চমৎকার আবিষ্কার করে ফেলেন। তারা দেখান যে, প্রতিনিয়ত খাদ্যের সাথে গ্রহণ করা ফসফরাসের অধিকাংশই শেষপর্যন্ত দেহের অস্থিসমূহে গিয়ে জমা হয়। আর অস্থিতে আগে থেকেই বিদ্যমান ফসফরাসের মজুদ নতুনদের জন্য স্থান ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো অঙ্গের চাহিদা মেটাতে বেরিয়ে পড়ে। আর একান্তই যদি অন্য কোনো অঙ্গে কোনোরূপ চাহিদা না থাকে, তাহলে তা দেহকে পায়ুপথে নিষ্কাশিত হয়।

রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আইসোটোপকে ট্রেসার হিসেবে ব্যবহার বিষয়ক কাজের জন্য ১৯৪৩ সালে এককভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন হেভেসি। সে বছরই নাৎসিদের হাতে চুরি যাওয়ার ভয়ে জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স ভন লাউ এবং জেমস ফ্রাংক তাদের নোবেল পুরস্কারের স্বর্ণের মেডেলগুলো গচ্ছিত রাখেন হেভেসির কাছে। তিনি নিজেও নাৎসিদের থেকে বাঁচতে পালিয়ে গিয়েছিলেন সুইডেনে। তবে যাবার আগে কোপেনেহেগেনে নিজের ল্যাবরেটরিতে দুটি পৃথক জারে অ্যাকোয়া রিজিয়ার মধ্যে উভয় বিজ্ঞানীর স্বর্ণের মেডেলগুলো দ্রবীভূত করে রেখে যান। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে সেগুলো থেকে স্বর্ণ পুনরুদ্ধার করেন। নোবেল কর্তৃপক্ষ তার এই বুদ্ধির জন্য প্রশংসা করে এবং সেগুলো থেকে মেডেল পুনরায় প্রস্তুত করে দেয়।

image source: cultura.hu

অসামান্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানী জর্জ চার্লস ডি হেভেসি ১৮৮৫ সালের ১ আগস্ট বুদাপেস্টে জন্মগ্রহণ করেন। তার গোঁড়া ক্যাথলিক পিতামাতা উভয়েই ছিলেন সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারের সন্তান যারা পরবর্তীতে ধর্মান্তরিত হন। বাসায় প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে স্থানীয় স্কুলে শেষ করেন মাধ্যমিকের অধ্যায়। এরপর খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও ফিরে আসেন। এক বছর পড়ালেখা করেন ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও। শেষে ভর্তি হন বুদাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩৯ সালে তিনি পিয়া রিসকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির ঘরে ৩ সন্তানের জন্ম হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পালিয়ে সুইডেন চলে আসার পর আর নিজ দেশে ফিরে যাননি হেভেসি। সুইডিশ নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই অধ্যাপনা করতে থাকেন। তবে জীবনের অন্তিম সময়ে মাতৃভূমির টানে আবার ফিরে গিয়েছিলেন বুদাপেস্টে। কিছুদিনের জন্য অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়েছিলে ফ্রেইবার্গেও। ১৯৬৬ সালের ৫ জুলাই সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও ডেনিশ একাডেমি পুরস্কার, ক্যানিজারো পুরস্কার, কুপলি মেডেল, ফ্যারাডে মেডেল সহ অসংখ্য সম্মানজনক পুরস্কারজয়ী এই বিজ্ঞানীকে ফ্রেইবার্গের লিটেনউইলার সেমেটারিতে সমাহিত করা হয়।

ফিচার ছবি: cultura.hu

Related Articles