Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বারবার প্রত্যাখাত জ্যাক মা’র বিলিয়নিয়ার হবার গল্প

জ্যাক মা, নামটা শুনলেই ছোট চেহারার চীনা লোকটার ছবি চোখে ভেসে উঠে, প্রায় দু’শ ত্রিশ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের কোম্পানি আলিবাবা’র প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ভেসে উঠে বিশ্বের প্রথম সারির বিলিয়ন ডলারের অধিপতি একজন সাধারণ কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের মুখশ্রী। ফোর্বসের ‘রিয়াল টাইম নেট ওর্থ’ এর হিসেব অনুযায়ী যার বর্তমান সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় চৌত্রিশ বিলিয়ন ডলার। পুরো পৃথিবীর ছোট-বড় ব্যবসায়ী আর উদ্যোক্তাদের কাছে যিনি একজন আদর্শ এবং অনুপ্রেরণার নাম।

জ্যাক মা; ছবিসূত্র: উইকিমিডিয়া কমনস

কিন্তু হোঁচট খাওয়া, বারবার ব্যর্থ হওয়া, বিভিন্ন বাধার মধ্য দিয়ে সামনে আগানো জ্যাক মাকে আমরা কতটুকু চিনি? যে মানুষটি আগামী বিশ বছরের মধ্যে পুরো পৃথিবীতে একশত মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনা করছে, সে মানুষটিই যে একসময় মাত্র একটি ছোট চাকরির জন্য ছোট-বড় বহু কোম্পানির দ্বারে দ্বারে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছেন, সে কথা কি আমাদের সবার জানা?

শিক্ষা পর্ব

১৯৬৪ সালে জন্ম নেওয়া জ্যাক ছোটবেলা থেকেই শেখার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিল। তা বোঝা যায় তার ইংরেজি ভাষাভাষীদের সাথে কথা বলার মাধ্যমে নিজের ইংরেজি বলার দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টার গল্প শুনলেই। তরুণ জ্যাক বাড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে প্রত্যেকদিন স্থানীয় হাংযু নামক হোটেলে আসতেন বিদেশিদের সাথে কথা বলার জন্য। দীর্ঘ সময় কথোপকথন  চালিয়ে যাবার জন্য তিনি বিনে পয়সায় তাদের শহর ঘুরিয়ে দেখাতেন। একনাগাড়ে পুরো নয় বছর তিনি এই কাজ করে গিয়েছেন। আর এর মাধ্যমে তিনি কিছু বিদেশি বন্ধুও জুটিয়ে ফেলেন, যাদের সাথে নিয়মিত চিঠি চালাচালি হতো। তার আসল নাম কিন্তু ‘মা ইউন (Ma Yun)’। এ নামের উচ্চারণ কষ্ট সাধ্য হওয়ায়, সেই বন্ধুরাই প্রথম তাকে জ্যাক নামে ডাকা শুরু করে।

বিদেশী পর্যটকদের সাথে ছোট জ্যাক; ছবিসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার

ব্যর্থতা, ব্যর্থতা এবং ব্যর্থতা

জ্যাকের ব্যর্থতার গল্পের শুরু কলেজে ভর্তি হবার সময় থেকেই। চীনে জাতীয় কলেজে ভর্তির জন্য বছরে একবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু জ্যাকের সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পুরো তিন বছর লেগেছিল। হার্ভাডে ভর্তির জন্য তিনি মোট দশবার আবেদন করেন, কিন্তু দশবারই প্রত্যাখ্যাত হন। চাকরির বাজারেও বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে তাকে। ছোট-বড় প্রায় ত্রিশটি কোম্পানিতে আবেদন করেও কোনো চাকরি পাননি। আমেরিকান টিভি-হোস্ট চার্লি রোজের কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জ্যাক বলেন, “আমি পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করেছিলাম, কিন্তু সেখান থেকেও নাকচ করে দেওয়া হয়। এমনকি আমার শহরে কেএফসি আসার পর সেখানেও আমি আবেদন জানাই। সেখানে চব্বিশ জন আবেদনকারীর মধ্যে আমি ছাড়া অন্য তেইশ জনই চাকরি পায়।” এমনকি আলিবাবার সফলতার আগে তিনি দুটি উদ্যোগে বেশ খারাপভাবে ব্যর্থ হন। যদিও তিনি হাংযু ডিয়ানযি ইউনিভার্সিটিতে প্রায় ছয় বছরের মতো ইংরেজি এবং ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড, এই বিভাগ দুটিতে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু সেখানেও এর বেশি কাজ করার ব্যাপারে তিনি মানসিক শান্তি পাচ্ছিলেন না।

টিভি-হোস্ট চার্লি রোজের সাথে জ্যাক; ছবিসূত্র: Quartz Media

সমস্যা, সমাধান, সুযোগ এবং নতুনভাবে শুরু করার গল্প

ই-কমার্সের বিশাল সাম্রাজ্যে জায়ান্টদের মধ্যে অন্যতম ই-কমার্স ওয়েবসাইট আলিবাবা শুরু করার বছর পাঁচেক আগেও জ্যাক মা ইন্টারনেট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। ১৯৯৪ সালে তিনি প্রথম ইন্টারনেট নামক মাধ্যমের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে এক বন্ধুর সহযোগিতায় ইন্টারনেটের প্রথম পাঠ নেন। সেসময় তিনি ইন্টারনেটে ‘বিয়ার’ লিখে সার্চ দিয়ে যে সমস্ত তথ্য পান, তার মধ্যে বিভিন্ন দেশের ওয়েবসাইটের অবদান থাকলেও নিজ দেশ থেকে কোনো অবদান তার চোখে পড়েনি। এমনকি তার নিজের দেশের তথ্য ইন্টারনেটে সার্চ দিয়েও না পেয়ে বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হন জ্যাক। পরে নিজেই এক বন্ধুর সহযোগিতায় একটি সাধারণ ওয়েবসাইট তৈরি করেন। ওয়েবসাইটটি প্রকাশ করার মাত্র ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যে তিনি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পান। এটিই মূলত ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা করার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে তার জন্য।

জ্যাক মা এবং তার বন্ধুরা; ছবিসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার

সে বছরই জ্যাক তার স্ত্রী জ্যাং ইং এর সহযোগিতায় বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে প্রায় বিশ হাজার ইউএস ডলার সংগ্রহ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের একজন বন্ধুর সহযোগিতায় ‘China Yellow Pages‘ নামের একটি কোম্পানি তৈরি করেন। তাদের মূলত কাজ ছিল চীনের বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করে দেয়া, যদিও জ্যাক প্রোগ্রামিং এর কিছুই জানতেন না। মাত্র তিন বছরের মধ্যে সেই কোম্পানি প্রায় আট লক্ষ ইউএস ডলারের মতো মুনাফা লাভ করে। এই পরিমাণটা সেই সময়ের তুলনায় অনেক বিশাল ছিল।

ব্যবসায় মাথা খাটানোর পাশাপাশি জ্যাক নিয়মিত মার্শাল আর্ট ‘তাই চি’ও প্রেকটিস করে থাকেন; ছবিসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার

সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে জ্যাক জানান, “ওয়েবের সাথে সংযুক্তির পর দিনদিন চারপাশ বদলাতে থাকে। কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ অনেক ধীর গতির হওয়ায় একটি ওয়েব পেজ লোড হতেই অধিকাংশ সময় ঘণ্টা তিনেকের মতো প্রয়োজন হতো। ঐ সময়টা অতিবাহিত করার জন্য আমি আমার বন্ধুদেরকে বাড়িতে দাওয়াত দিতাম। টিভি দেখে, তাস খেলে, মাতাল হওয়ার মাধ্যমে সময়টা বেশ কেটে যেত।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ট্রাম্প টাওয়ারে জ্যাক মা; ছবিসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট

১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত জ্যাক Ministry of Foreign Trade and Economic Cooperation-এর টেকনোলজি কোম্পানি China International Electronic Commerce Center-এর প্রধান হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকে ১৯৯৯ সালে স্থায়ী ঠিকানা হাংযুতে ফিরে আসেন এবং নিজের আঠারো জন বন্ধুকে সাথে নিয়ে পাঁচ লক্ষ ইয়ুন মূলধনের নতুন একটি চীন ভিত্তিক স্টার্টআপ শুরু করেন। বিজনেস-টু-বিজনেস ওয়েব মার্কেটপ্লেস হিসেবে তখনকার সময়ে পরিচিত ই-কমার্স সাইটটিই হলো ‘আলিবাবা’। এটি ১৯৯৯ সালের অক্টোবর এবং ২০০০ সালের জানুয়ারিতে পর পর দু’বার ২৫ মিলিয়ন ডলারের বিদেশী উদ্যোগের মূলধন বিনিয়োগ হিসেবে লাভ করে। আস্তে আস্তে জ্যাক তার কোম্পানিকে গ্লোবাল ই-কমার্স সিস্টেমের আওতায় উন্নীত করার চেষ্টা করেন। সে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে Taobao Marketplace, Alipay, Ali Mama এবং Lynx নামের চারটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এর মধ্যে টাওবাও মার্কেটপ্লেস বেশ দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। সে সময় বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তর ই-কমার্স কোম্পানি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করা ebay থেকে আলিবাবাকে কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু জ্যাক মা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইয়াহুর সহ-প্রতিষ্ঠাতা Jerry Yang থেকে পাওয়া এক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে থাকেন। তার সঠিক সিদ্ধান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ এবং হাল ছেড়ে না দেয়ার ফলাফল হিসেবে আলিবাবা বর্তমানে  বিজনেস-টু-বিজনেস, বিজনেস-টু-কাস্টমার এবং কাস্টমার-টু-কাস্টমার সার্ভিস দেয়া কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।

অনুপ্রেরণায় জ্যাক মা

হতাশা ব্যাপারটা খুব সহজেই মানুষকে আঁকড়ে ধরে। একজনকে মানসিক ভাবে নিঃস্ব করার জন্য এর বিকল্প নেই বললেই চলে। আর আমরাও বিভিন্ন ব্যর্থতা, আর্থিক বা অন্য কোনো অসচ্ছলতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে খুব সহজেই হতাশ হয়ে পড়ি। নিজের ভালো লাগার কাজগুলো থেকে দূরে চলে যাই। বড় বড় স্বপ্নে বিভোর হয়ে থেকে ছোট ছোট সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে ভুলে যাই। কয়েকবার চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দেই। আর এই জায়গাতেই জ্যাক মা সবার চেয়ে আলাদা। তার সফলতার পেছনে অনেকগুলো ব্যর্থতার গল্প আছে, তা আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি। তিনি বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও হাল ছেড়ে দেননি, বরং শেখার এবং ছোট ছোট সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে বড় কিছু তৈরি করার দিকগুলোতে বেশ সময় দিয়েছেন।

ছবিসূত্র: insbright.com

জ্যাক মার মতে, “আপনি যদি হাল ছেড়ে না দেন, তাহলে সামনে জয়ী হওয়ার আরো সুযোগ পাবেন।” তিনি আরো বলেন, “যদি আপনি চেষ্টাই না করেন, তাহলে কীভাবে বুঝবেন কোনো সুযোগ আছে কি নেই?” অর্থাৎ তিনি হাল ছেড়ে না দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলেছেন। এক জায়গায় ব্যর্থ হলেও, আরেক জায়গায় চেষ্টা করার কথা বলেছেন। তিনি বারবার ধৈর্য ধারণ করার কথা বলেছেন। নিজের পছন্দের কাজের প্রতি আসক্ত হবার কথা বলেছেন। ছোট ছোট কাজ দ্বারা এগিয়ে যাবার মাধ্যমে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতে উৎসাহী করেছেন।

জ্যাকের ‘চেষ্টা চালিয়ে যাও, হাল ছেড়ো না’ ফর্মুলা; ছবিসূত্র: ইউর স্টোরি ডট কম

জ্যাক মা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ না হয়েও দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করা যায়। এ ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “I’m not a tech guy. I’m looking at the technology with the eyes of my customers, normal people’s eyes“। পণ্যের উপর নির্ভরশীল ব্যবসাগুলোতে তার সফলতার মূল কারণ তার দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বারবার প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর লক্ষ্য না রেখে গ্রাহকদের চাহিদার উপর লক্ষ্য রেখে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেন। ব্যবসায় গ্রাহকদের গুরুত্ব বোঝাতে তিনি বলেন, “Customer number one, employee number two, shareholder number three. If the customer is happy, the business is happy, and the shareholders are happy“।

সুখী এবং হাস্যোজ্জ্বল জ্যাক; ছবিসূত্র: পোস্টকর্ন

সর্বোপরি, সবার মতো তিনিও সুখে থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, “I try to make myself happy, no, because I know that if I’m not happy, my colleagues are not happy and my shareholders are not happy and my customers are not happy“। এ কথাটি থেকেই তার ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ দৃঢ়ভাবে ফুটে উঠেছে!

ফিচার ছবিসূত্র: Forbes

Related Articles