Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রানী রাসমণি: এক প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা যিনি কখনো হারতে শেখেননি

তখন কলকাতাকে ঘিরে ছিল অনেকগুলো গাঙ্গেয় অববাহিকা, হ্রদ, উপহ্রদসহ অনেক জলাশয়। কলকাতাবাসীদের বিশাল একটা অংশের জীবিকার উৎস ছিল মাছ ধরা। ভারতীয় উপমহাদেশে তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব। কোম্পানির চোখের সামনে দেশীয়দের ‘মৎস্য মারিবো খাইবো সুখে’– ব্যাপারটি সহ্য হচ্ছিল না। তাই মাছ ধরার উপর কর আরোপ করা হলো। যথারীতি যেসব জেলেরা কর দিতে অসম্মতি জানায় তাদেরকে পেয়াদা পাঠিয়ে নির্যাতন করতো। অসহায় জেলেদের জীবিকার অবলম্বন জালটাও ছিঁড়ে ফেলা হতো। বসে বসে মার না খেয়ে জেলেরা গেলেন রানীর কাছে। রানী তাদের সান্ত্বনা দিলেন এবং ব্যাপারটা দেখছেন বলে আশ্বস্ত করলেন।

রানী জানতেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করে জেতা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এগোতে হবে ভিন্ন রাস্তায়। অবলম্বন করতে হবে ভিন্ন কৌশল। সেটা হলো ব্যবসায়িক চাল কিংবা বুদ্ধির মারপ্যাঁচ। রানী কোম্পানির কাছ থেকে গঙ্গা থেকে ঘুসুড়ি হয়ে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার এলাকা ১০ হাজার রুপির বিনিময়ে ইজারা নেন। যেইমাত্র ইজারার দলিলাদি এবং কাগজপত্র রানীর হাতে এসে পৌঁছালো, সেইমাত্র তিনি জেলেদের এক অভিনব হুকুম দিলেন। রানীর হুকুমে রাতারাতি লোহার মোটা মোটা শিকল দিয়ে ইজারা নেওয়া অংশটুকু ঘিরে ফেলা হলো। জেলেদের শুধুমাত্র ঘেরাওকৃত স্থানে মাছ ধরতে বলা হলো। ফলে পুরো এলাকার ঘাটগুলোতে সব ধরনের নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো। কোম্পানির বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজগুলো আটকে গেল।

কলকাতার এক রানী কিনা ব্রিটিশরাজের সাথে টক্কর দিচ্ছে! এ খবর বারুদের বেগে ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে। এহেন কাণ্ড এর আগে কলকাতাবাসী দেখেনি কখনো। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও ছুটে এলেন অভিনব সেই দৃশ্য অবলোকন করার জন্য। কিছু জেলে নৌকা মাছ ধরছিল আর কিছু নৌকা সেই বেষ্টনী পাহারা দিচ্ছিল। প্রতিশোধপ্রবণ ক্ষিপ্ত সেই জেলেরা আবার লোহার শিকলের সাথে নিজেদের দড়িও জুড়ে দিয়েছিল।

যথারীতি রানীকে সর্বোচ্চ আদালতে তলব করা হলো এবং সেইসাথে লোহার শিকলের বাঁধ অবিলম্বে খুলে দিতে আদেশ করা হলো। কিন্তু রানী তা করতে অসম্মতি জানালেন। কারণ হিসেবে বললেন, তিনি ব্রিটিশরাজ থেকে ঐ এলাকাটুকু ইজারা নিয়েছেন। নিজের ব্যবসায়িক ও প্রজা স্বার্থে তিনি যা ইচ্ছা তা করতে পারেন। তাছাড়া কোম্পানির জাহাজ চলাচলের কারণে জেলেদের জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাছেরা এই এলাকায় আসে না। এতে প্রজার ক্ষতি এবং রানীর ব্যবসায়িক ক্ষতি। তাছাড়া এমন কাজ তিনি ইচ্ছা করে করেননি বরং কোম্পানি তাকে বাধ্য করেছে। এই বাঁধ তিনি তখনই উঠাবেন যখন তার প্রজাদের উপর আরোপ করা কর উঠিয়ে নেওয়া হবে।

রানীর বুদ্ধিমত্তা এবং যুক্তির কাছে কোম্পানি মাথানত করলো। জেলেদের উপর সকলপ্রকার কর উঠিয়ে নেওয়া হলো এবং রানীকে ইজারা বাবদ ১০ হাজার রুপি ফেরত দেওয়া হলো। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কলকাতা, বিহার এবং আরো কিছু অঞ্চলে গঙ্গায় মাছ ধরার উপর কোনো পানিদারি কর নেই। রানীর সাহসিকতার নিদর্শনস্বরূপ উত্তর কলকাতার নিমতলা ঘাটের আদি ভূতনাথ মন্দিরের কাছাকাছি এখনো সেই বিশাল লোহার পিলার ও কিছু লোহার শিকল আছে।

রানী রাসমণি; Source: kamat.com

দুর্গা পূজায় ঢাকঢোল বাজিয়ে, কীর্তন গেয়ে মিছিল বের করা হিন্দু সম্প্রদায়ের বহুকালের প্রথা। একবার রানীর বাড়ি থেকে গঙ্গা পর্যন্ত এমন একটি পূজার মিছিল বের হয়। পথিমধ্যে কোম্পানির সৈন্যরা বাধা দেয়। কারণ ঢাক ও কীর্তনের উচ্চশব্দে বাবুদের পাড়ার শান্তি বিনষ্ট হচ্ছিল। এ খবর রানীর কানে গেলে, প্রতিবাদ হিসেবে রানী তার পুরোহিতদের আরো বড়সড় মিছিল বের করার নির্দেশ দেন। এহেন ঘটনার পর কোম্পানির প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রানীর বাড়িতে নোটিস নিয়ে এলে, রানী তাদের চোখের সামনেই সেই নোটিস ছিঁড়ে ফেলেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অবমাননা করার জন্য রানীকে ৫০ রুপি জরিমানা করা হয় এবং রানী সাথে সাথে সেটা দিয়েও দেন। কিন্তু ঝামেলা সেখানেই শেষ হয়নি।

এত সহজে রানী ব্রিটিশরাজকে ছেড়ে দেবেন, তা হয় না। এবারও রানী অভিনব পন্থা অবলম্বন করলেন। তার প্রাসাদ থেকে নিউমার্কেট হয়ে বাবু বাজার পর্যন্ত সবগুলো রাস্তা কাঠের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। শহরের উত্তর এবং দক্ষিণকে সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ তিনটি রাস্তাই ঘেরাও করা এলাকার মধ্যে পড়ে গেল। ফলে শহরের যান চলাচল ভয়াবহভাবে বিঘ্নিত হলো। যথারীতি এবারও কোম্পানি রানীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল।

রানী তার জবানবন্দীতে বলেন, তার প্রাসাদ থেকে নিউমার্কেট হয়ে বাবুঘাট পর্যন্ত ঘেরাওকৃত এলাকা তার পারিবারিক সম্পত্তি। তিনি নিজ এলাকার মধ্যে থেকে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করেছেন। বরং সরকার দোষী। কারণ সরকার তার এবং তার প্রজাদের নাগরিক অধিকার তো খর্ব করেছেই উলটো জরিমানাও করেছে। এবারও ব্রিটিশরাজকে রানীর বুদ্ধিমত্তা এবং যুক্তির কাছে হার মানতে হলো। আদালত কোম্পানিকে সেই জরিমানার অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য করে এবং রানীকে তার ধর্মীয় আচার পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে বলে আশ্বাস দেয়।

শিল্পীর তুলিতে লোকমাতা রানী রাসমণি; Source: feminismindia.com

লোকমাতা রানী রাসমণি। অনেক কিংবদন্তি রয়েছে তাকে ঘিরে। এমন এক সময়ে রানী রাসমণি জন্মান যখন মেয়েদের মানুষ বলে গণ্য করা হতো না। এমন এক সমাজে তিনি জন্মান যেখানে নারীকে দেবী হিসেবে পূজো করা হতো, পাশাপাশি সতীদাহও করা হতো। তেমনই এক সময়ে, ১৭৯৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে হালিশহরের কাছাকাছি কোনা নামক এক গ্রামে এক দরিদ্র শুদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রানী রাসমণি। মা রামপ্রিয়া দাস এবং বাবা হরেকৃষ্ণ দাস ছিলেন গরীব কৃষক দম্পতি।

আর দশটা কৃষিজীবী পরিবারের মেয়ের মতোই রাসমণির দিন কেটেছিল ঘর গেরস্থালির কাজ করে আর বাবার জন্য মাঠে খাবার নিয়ে গিয়ে। হরেকৃষ্ণ দাস গরীব হলেও লেখাপড়া জানতেন এবং মনমানসিকতার দিক থেকেও আর দশটা মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত ছিলেন। বাবার হাতেই রাসমণির প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়, বাবা তাকে অনেক গল্প শোনাতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গ্রামের লোকেরা হরেকৃষ্ণ দাসের বাড়িতে জমায়েত হতো মহাভারত, গীতা, পুরান পাঠ শোনার জন্য। ছোট্ট রাসমণি হারিয়ে যেতেন সেসব গল্পের মাঝে। এভাবে ধীরে ধীরে তার অন্তরে ধর্মের প্রতি ভালবাসার বীজ রোপিত হয়।

১৮০৪ সাল। কলকাতার জানবাজারের অভিজাত জমিদার পুত্র বাবু রাজচন্দ্র দাস স্ত্রী বিয়োগের শোক কাটাতে গঙ্গায় বজরা ভাসিয়েছেন। তখন জমিদারপুত্রের বয়স মাত্র ২১ বছর। ঘাটের দিকে চোখ ফেরাতে হঠাৎ অপরূপ রূপবতী ১১ বছর বয়সী রাসমণিকে দেখলেন। তার সৌন্দর্যে রাজচন্দ্র মুগ্ধ হলেও, পর পর দুই স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাননি। কিন্তু জমিদার পুত্র বলে কথা, পরিবারের সদস্যরা তাকে আবার বিয়ে করাতে উঠে পড়ে লাগে গেল। কিন্তু রাসমণি যে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে এবং সবচেয়ে বড় কথা, জাতে শুদ্র। প্রগতিশীল রাজচন্দ্র জাত, শ্রেণীভেদ এবং তৎকালীন সমাজের অন্যতম বিষফোঁড়া যৌতুক- সবকিছুকে গুঁড়িয়ে দিয়ে রাসমণিকে বিয়ে করে জানবাজারের প্রাসাদে স্থান দেন। গ্রাম্য কিশোরী রাসমণি খুব সহজেই শহরের অভিজাত পরিবারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেন।

কলকাতার জানবাজারে রানী রাসমণি প্যালেস; ছবি: পি কে নিয়োগি/উইকিমিডিয়া কমন্স

রাজচন্দ্রের পিতা প্রীতরাম ছিলেন ব্রিটিশদের বিভিন্ন পণ্য সরবরাহকারী। সেই সূত্রে ব্রিটিশ অভিজাত কর্মকর্তাদের সাথে ছিল তার ওঠাবসা। ১৮১৭ সালে প্রীতরামের মৃত্যু হলে রাজচন্দ্র তৎকালীন ৬ লক্ষ ৫০ হাজার রুপি নগদ অর্থ এবং বিশাল সম্পত্তির মালিক হন। কিন্তু রাজচন্দ্র বাবা প্রীতরামের মতো শুধুমাত্র বৈষয়িক এবং হিসেবী জমিদার ছিলেন না, সামাজিক নানা দাতব্য কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। আর পর্দার অন্তরাল থেকে সাহস যোগাতেন রাসমণি। ধীরে ধীরে তিনি জানবাজারের জমিদার প্রাসাদের রানী হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, সেই সমাজে অভিজাত নারীদের পর পুরুষের সামনে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রানী প্রায়ই পর্দার অবগুন্ঠন ভেদ করে বের হয়ে আসতেন এবং স্বামীর সাথে সাথে নিজের মূল্যবান মতামতও ব্যক্ত করতেন।

রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ করেছেন। তাকে সর্বাত্মক সহায়তা করেন রাজা রাজচন্দ্র এবং রানী রাসমণি। রাসমণি ছোটবেলা থেকে মেয়েদের দুঃখ দুর্দশা দেখে বড় হয়েছেন। তিনি মনে প্রাণে চাইতেন নারীরা দাসত্ব এবং ধর্মের নামে এঁটে দেয়া দুর্দশা থেকে মুক্তি পাক। এছাড়া রাজচন্দ্র অনেক মানবসেবামূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। কলকাতায় দুটি স্নান ঘাট, নিমতলায় একটি বৃদ্ধাশ্রম এবং বন্যাপীড়িতদের জন্য খাদ্য ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৮২৩ সালের বন্যায় জানবাজারের প্রাসাদ থেকে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। রানী রাসমণি তার স্বামীকে সরকারি অনুমোদন নিয়ে বাবু রোড (বর্তমান রানী রাসমণি রোড) এবং বাবু ঘাট তৈরির অনুরোধ করেন।

রানী রাসমণী প্যালেস; ফটোগ্রাফ: কনদ স্যানাল

১৮২৯ সালে কলকাতার সর্বপ্রথম ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় রাজচন্দ্রের হাত ধরে। এছাড়া হিন্দু কলেজের ছাত্রদের অবৈতনিক পড়াশোনার দায়িত্ব নেন তিনি। কলকাতায় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে তারা ১০ হাজার রুপি অনুদান দেন। এভাবে সমাজসংস্কার এবং দাতব্য কাজের মধ্য দিয়ে এই প্রগতিশীল দম্পতির জীবন কাটছিল। এদিকে তাদের সংসারে চার কন্যা পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী এবং জগদম্বার জন্ম হয়। কিন্তু ৪৯ বছর বয়সে রাজচন্দ্রের আকস্মিক মৃত্যুতে রানী দিশেহারা হয়ে পড়েন।

মাথুরামোহন দাসের বাড়িতে পূজার ধুম; Source: কনদ স্যানালের তোলা theindianquest.com থেকে প্রাপ্ত

একদিকে ভালোবাসার মানুষটার ছায়া হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত রানী, অন্যদিকে জমিদারী কেড়ে নেবার পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র। কোম্পানি এবং রানীর পরিবারের বেশ কিছু সদস্য ভেবেছিল একা বিধবা নারী আর কী-ই বা করতে পারবে। যখনই তারা রানীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কীভাবে এই বিশাল সাম্রাজ্য হাতিয়ে নেওয়া যায় সেই পাঁয়তারা করছিল, তখন রানী শোক ভুলে জমিদারীর হিসেবের খাতা হাতে নিয়েছেন। সাথে পেয়েছেন তার পরবর্তী জীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী জামাতা মাথুরমোহন বিশ্বাসকে। মাথুরমোহন ছিলেন রানীর তৃতীয় ও চতুর্থ কন্যার স্বামী। এখানে একটু খোলাসা করেই বলতে হয়। মাথুরমোহনের সাথে করুণাময়ীর বিয়ে হয়। বিয়ের ২ বছরের মাথায় করুণাময়ী মৃত্যুবরণ করেন। মাথুরমোহন শুধুমাত্র জামাতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন রানীর পুত্রসম। আর মাথুরমোহন রানীকে মা বলেই ডাকতেন। তাই রানী তার সর্বকনিষ্ঠ কন্যা জগদম্বাকে মাথুরানাথ বা মাথুর বাবুর সাথে বিয়ে দেন।

উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিশাল জমিদারীর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবার পর ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে একজন স্বভাব নেত্রী এবং বিচক্ষণ ব্যবসায়ী হিসেবে তুলে ধরেন। এবার চলুন, তার কয়েকটি গল্প শোনাবো আপনাদের।

রানী রাসমণির একটি প্রতিকৃতি; Source: peoplesreporter.com

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন রাজচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিদেশ যাত্রার উদ্দেশ্যে দ্বারকানাথ ২ লক্ষ রুপি ধার নিয়েছিলেন রাজচন্দ্র থেকে। রাজচন্দ্রের মৃত্যুর পর দ্বারকানাথ সদ্য বিধবা রানীর কাছে তাদের জমিদারীর ম্যানেজার হতে চান বলে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এদিকে রানী চান দ্বারকানাথের কাছে তাদের ২ লক্ষ রুপি ফেরত পেতে। কিন্তু স্বামীর এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু এমন একটা আবদার করলেন আবার তার কাছে টাকাও পাওনা। এখন তিনি কী করবেন? কীভাবে টাকাটা চাইবেন আর কীভাবেই বা বলবেন যে, জামিদারীর ম্যানেজারের দায়িত্ব তিনি জামাতাকে দিতে চান?

রানী দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছে বিনয়ের সহিত পাওনা টাকাটা চান। দ্বারকানাথ বলেন, তার কাছে নগদ অর্থ নেই। তাই রানী তাকে ২ লক্ষ রুপির সমমূল্যের জমি লিখে দিতে বলেন। জমির দলিলাদি গ্রহণের পর রানী জানান, তার জামাতাও ম্যানেজার হতে চায়, ঘরের আপন লোককে কীভাবে তিনি আশাহত করবেন? দ্বারকানাথ যেন কিছু মনে না করেন। এভাবে পাওনা টাকা আদায় করে তিনি তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি এবং এত সুন্দরভাবে সম্পর্ক নষ্ট না করে বিনয়েরও পরিচয় দেন।

মন্দিরে রানীর প্রতিকৃতি; Source: youtube.com

মানবতাবাদী রানী কখনোই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতেন না। হোক সে চোর, ডাকাত কিংবা সাধু। ১৮৫১ সালের ঘটনা। তীর্থযাত্রা শেষে রানী রাসমণি ত্রিবেণী, নবদ্বীপ হয়ে গঙ্গাসাগর যাচ্ছিলেন। চন্দননগরের কাছাকছি তাদের বজরায় এক দল ডাকাত হামলা করল। রানীর দেহরক্ষীদের সাথে কয়েক দফা গোলাগুলিও হলো। গোলাগুলিতে ডাকাতদলের একজন আহত হলো। করুণাময়ী রানী তৎক্ষণাৎ গোলাগুলি বন্ধ করতে বললেন এবং তারা কী চায় তা জানতে চাইলেন। ডাকাত দলের সর্দার ১২ হাজার রুপি দাবী করলে রানী তাতেই রাজী হন। বিনিময়ে তাদের পথে ছেড়ে দিতে বলেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন তাদের পাওনা আদায় করার। পরদিন রানী তার লোক মারফত প্রতিশ্রুতির টাকা পাঠিয়ে দেন ডাকাত দলের সর্দারের কাছে।

১৮৫৯ সালের কথা। নীল চাষিদের জোরপূর্বক নীল চাষ করাচ্ছিল নীলকরেরা। সারা বাংলায় তখন নীলকরদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষের হাহাকার। রানী জানতে পারলেন তার মাকিমপুর পরগণার চাষিদের উপরও এমন নির্যাতন চালাচ্ছে ইংরেজ নীলকর ডোনাল্ড। রানী বুঝলেন, প্রজাদের বাঁচাতে এখন তার লড়াইয়ে নামতে হবে। বুদ্ধি কিংবা যুক্তিতে নয় শক্তি প্রয়োগ করে লড়াই করতে হবে। ৫০ জনের একটি নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী পাঠালেন রানী, ডোনাল্ডের সৈন্যদের শায়েস্তা করতে। লাঠিয়ালরা মাকিমপুর পরগণায় পৌঁছানোর পর তারা সংখ্যায় আর ২৫ জন রইলেন না। হয়ে গেলেন শ’খানেক। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন নির্যাতিত কৃষক জনতা। সবাই মিলে ডোনাল্ড এবং তার পেয়াদাদের পরগণা ছাড়া করেন তারা। এভাবে সারা দেশজুড়ে শুরু হয় নীল বিদ্রোহ।

রানী রাসমণি সমাজ সংস্কারক হিসেবেও অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তখনকার যুগে বয়সের অনেক বেশি পার্থক্য রেখে বিয়ে দেওয়া হতো। দেখা যেতো, ৮-৯ বছর বয়সী শিশুর সাথে সাথে মাঝবয়সী বিপত্নীক পুরুষ অথবা বৃদ্ধের বিয়ে দেওয়া হতো। ফলে অকাল বৈধব্য বরণ করতে হতো সেসব অভাগিনী মেয়েদের। রানী সিদ্ধান্ত নিলেন, এধরনের কুপ্রথা সমাজ থেকে দূর করবেন। সামাজিক প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে রানী তার জ্যেষ্ঠ কন্যা পদ্মমণিকে তার চেয়ে ২ বছরের বড় এক কিশোরের সাথে বিয়ে দেন। এছাড়া রাজা রামমোহন রায়ের সাথে সতীদাহ প্রথা রদে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বিধবা বিবাহ প্রচলনে আর্থিক সাহায্যও প্রদান করেছিলেন তিনি।

রানী সাধারণ তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরি পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি করেন। এছাড়া গঙ্গা স্নানের সুবিধার্থে আহিরিটোলা ঘাট, বাবু ঘাট (স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাসের স্মরণার্থে), নিমতলা ঘাট নির্মাণ করেন। শবদাহ করার জন্য নিমতলা ঘাটে একটি বড় ছাউনি তৈরি করে দেন। ভারতের ইমপেরিয়াল লাইব্রেরিতে তার দেওয়া অনুদান চিরস্মরণীয়।

বর্তমান বাবু ঘাট; ছবি: বিশ্বরুপ গাঙ্গুলী

রানী রাসমণি সবচেয়ে বড় যে সমাজ সংস্কারটি করেছেন তা হিন্দুদের মধ্যে বিদ্যমান ধর্মীয় বৈষম্য দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার একমাত্র প্রতীক হলো কলকাতা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণেশ্বরের জাঁকজমকপূর্ণ কালী মন্দির। রানী রাসমণি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেন। তখনকার দিনে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা উপাসনালয় স্থাপনের নিয়ম ছিল না। সেখানে একজন নিম্নবর্ণের নারী, তিনি যতই ধর্মপ্রাণ হোন না কেন, তার মন্দির নির্মাণ হিন্দু সমাজে রীতিমতো আন্দোলন বটে। কিংবা বলা যায়, উঁচু শ্রেণীর মানুষ অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের একধরনের যুদ্ধও বলা যায়। এই কালী মন্দির তৈরির পেছনে একটি গল্প আছে।

রানী বেনারসের এক তীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন। কয়েকজন নিকটাত্মীয় এবং চলার পথের রসদ সহ সকল প্রস্তুতি শেষ। যাত্রার আগের রাতে মা কালিকে স্বপ্নে দেখলেন রানী। বেনারস না গিয়ে এখানেই কালী মন্দির স্থাপনের নির্দেশ দিলেন। রানী তার স্বপ্নের কথা সকলকে জানালেন এবং বিশ্বস্ত লোকদের মন্দির স্থাপনের জমি খুঁজতে বললেন। বিশেষত মাথুর বাবুকে। অবশেষে, অনেক খোঁজাখুঁজির পর ১৮৪৭ সালে দক্ষিণেশ্বরে জেমস হেস্টির ২০ একরের জমিটি পাওয়া যায়। রানী তা আনুমানিক ৪২ হাজার ৫০০ রুপি অথবা ৫০ হাজার রুপি দিয়ে কেনেন। জমিটির ইতিহাস অসাম্প্রদায়িকতার এক অনন্য নিদর্শন। জমিটির এক অংশ পূর্বে এক ইউরোপিয়ানের খ্রিস্ট ধর্মালম্বীর ছিল, আরেক অংশে ছিল মুসলিম গোরস্থান। এখন বর্তমানে কালী মন্দির।

দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির; Source: indiatoursntravel.com

৮ বছর ধরে নির্মাণকাজ চলে মন্দিরটির। মূল মন্দরটি মা কালীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। উত্তরে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ মন্দির আর দক্ষিণে নাটমন্দির এবং ১২টি ছোট মন্দিরের সমন্বয়ে দ্বাদশ শিবমন্দির। পুরো মন্দির কমপ্লেক্সটি তৈরি করতে তখনকার দিনে প্রায় ৯ লক্ষ ২৫ হাজার রুপি খরচ হয়েছিল। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে মন্দির কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শেষ হয়। মন্দির নির্মাণ শেষ কিন্তু পুরোহিত হবেন কে? একজন শূদ্র নারীর মন্দিরে কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিত হতে রাজি হবেন না। রানী রাসমণি দমে যাবার পাত্রী নন। তিনি তৎকালীন নামজাদা অনেক পণ্ডিতকে চিঠি লিখলেন। প্রায় সবার কাছ থেকে যখন হতাশাজনক উত্তর পাচ্ছিলেন তখন রামকুমার চট্টোপাধ্যায় নামক এক ব্রাহ্মণ রানীকে আশার আলো দেখালেন। রামকুমার বলেন, রানীর মন্দিরে উপাসনা করা তখনই সম্ভব যখন তিনি মন্দিরটি কোনো ব্রাহ্মণকে উপহার হিসেবে দেবেন এবং মন্দির পরিচালনার জন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ ধার্য করে তা পুরোহিতের হাতে তুলে দেবেন।

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস; ছবি: অবিনাশ চন্দ্র

রানী আর দেরি করলেন না। মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিলেন। আর দিনাজপুরের জমিদারি থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ধার্য করে দিলেন। রামকুমার তার ছোট ভাই গদাধর বা গদাইকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরে এসে উপস্থিত হলেন। রামকুমার প্রধান পুরোহিত আর গদাধরকে মা কালীর সাজসজ্জা ও মন্দির সংক্রান্ত ছোটখাটো কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রানী রাসমণি খেয়াল করলেন, গদাই ছেলেটি থাকে অন্য এক জগতে, ভব জগতের সাথে তার সম্পর্ক খুব কম। সবসময় মা কালীর চিন্তায় ডুবে থাকে, লোকে তাকে পাগল বলে। কিন্তু রাসমণির ধার্মিক হৃদয় বুঝতে পেরেছিল, গদাই সাধারণ কোনো ছেলে নয়।

ছবিটি বরানগর মঠে ১৮৮৭ সালের ৩০ জানুয়ারিতে তোলা হয়। রামকৃষ্ণের অন্যান্য অনুসারীদের সাথে দাঁড়ানো বাম থেকে তৃতীয় স্বামী বিবেকানন্দ; ছবি: কে তুলেছেন তা জানা যায়নি, wikipedia.org থেকে প্রাপ্ত

রামকুমারের মৃত্যুর পর মাতৃভক্ত গদাইকে রানী মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব দেন এবং তাকে নিজের ইচ্ছামতো মা কালীর সেবা ও প্রার্থনা করার অনুমতি দেন। গদাধর জীবনের ৩০ বছর কাটান এই মন্দিরে, হয়ে উঠেন হিন্দু ধর্মের অন্যতম ধর্মাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। শ্রীরামকৃষ্ণ হাত ধরে স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাস লাভ করেন। বলা হয়ে থাকে, নিম্নবর্ণের শূদ্র সেই রানী যদি দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির তৈরি না করতেন, তাহলে গদাই কখনো শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস হতে পারতেন না, আর স্বামী বিবেকানন্দকেও হিন্দু ধর্ম পেত না। মোদ্দাকথা, ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণ সম্ভবই হতো না। গদাই অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তি কাহিনী নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী এবং গল্প প্রচলিত আছে। এর মধ্যে রানী রাসমণিকে একটি কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত।

Source: Businesseconomics.in

একদিন রানী গঙ্গাস্নান সেরে কালী মন্দিরে গেলেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে একটি ভক্তির গান ধরতে অনুরোধ করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ গান ধরলেন। তিনি নিজেই গানের মাঝে ডুবে গেলেন কিন্তু টের পেলেন রানী কোন প্রার্থনায় মনোযোগ দিতে পারছেন না। তখন তিনি রানীর মাথায় ঝাঁকি দিয়ে প্রার্থনায় মনে দিতে বললেন। রানী তখন একটি বৈষয়িক মামলা নিয়ে ভাবছিলেন তাই প্রার্থনায় মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। পরে উপস্থিত রানীভক্তরা শ্রীরামকৃষ্ণের এমন ব্যবহারের কঠোর সমালোচনা করেন। কিন্তু রানী বলেন, মা কালী গদাধরকে দিয়ে তাকে সাবধান করেছেন। এরপর রানী ধীরে ধীরে বিষয় সম্পত্তি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে সব দায় দায়িত্ব মাথুর বাবুর হাতে তুলে দেন।

শিল্পীর তুলিতে রানীকে মাথা ঝাঁকানোর ঘটনা; Source: ramakrishnamrta.blogspot.com

মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রানী সবসময় মায়ের পূজা এবং ভজন সাধন করে দিন কাটাতেন। ১৮৬১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৬৮ বছর বয়সে রানী রাসমণি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৯৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রানীর জন্মের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কলকাতার এসপ্ল্যানেডের কাছাকাছি কার্জন পার্কে রানীর একটি মার্বেল প্রতিকৃতি স্থাপিত হয়। বর্তমানে জানবাজারের সেই জমিদার বাড়ি রানী রাসমণি প্যালেস নামে পরিচিত।

ফিচার ইমেজ- feminisminindia.com

Related Articles