Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডরোথি স্ট্র্যাটেন হত্যাকান্ড: ভালোবাসা যখন পরিণত হয় জিঘাংসায়

১৯৮০ সালের কথা, হলিউডের মডেল ও অভিনেত্রী ডরোথি স্ট্র্যাটেন খ্যাতির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করেছেন কেবল। আশির দশকের রূপালী পর্দায় সৌন্দর্যের দেবী হিসেবে তার ভবিষ্যৎ দেখতে শুরু করেছিলেন অনেকেই। কেউ কেউ তো মেরিলিন মনরোর সাথে তার তুলনাও করতে শুরু করেছিলেন। এসময় একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আবিষ্কৃত হয় শটগানের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত ডরোথির লাশ। তার পাশেই পড়ে ছিল সাবেক প্রেমিক পল স্নাইডারের নিথর দেহ। ডরোথিকে হত্যা করার পর আত্মহত্যা করেছিলেন স্নাইডার।

ঘটনাটি সেসময় পত্রপত্রিকায় ব্যাপক সাড়া ফেলে। মানুষ অবাক হয়ে দেখেছিল, ঈর্ষার পরিণতি কতটা মর্মান্তিক হতে পারে। বস্তুত ভালোবাসা হয়তো মানুষের হৃদয়ে জন্ম নেয়া সবচেয়ে পবিত্র অনুভূতিগুলোর একটি। কিন্তু এই সুন্দরতম অনুভূতিটির হাত ধরে ঈর্ষা, ঘৃণার মতো অসুন্দর অনুভূতিগুলো যে কখন আমাদের মনে জায়গা করে নেয়, তা আমরা টেরই পাই না।

প্রিয়জনের সাথে অন্য কারো সম্পর্ক নিয়ে ঈর্ষান্বিত হওয়ার স্বভাব আমাদের মধ্যে আদ্যিকাল থেকেই চলে আসছে। বলা চলে, এটি মানুষের সহজাত অনুভূতিগুলোর একটি। তবে এই ঘৃণা কিংবা ঈর্ষার সহজাত অনুভূতি কখনো ধারণ করতে পারে অচিন্ত্যনীয় ভয়ংকর রূপ। এটি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে পরিণত হতে পারে জিঘাংসায়; এমনকি প্রিয়জনকে পরিণত করতে পারে নৃশংস ঘাতকে। এর জলজ্ব্যান্ত উদাহরণই বাস্তবায়িত হয়েছিল ডরোথির জীবনে।

ডরোথি স্ট্র্যাটেন; ছবিসূত্র: ofpof.com

ডরোথির জন্ম ১৯৬০ সালে, কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের ভ্যানকুভার শহরে। হাই স্কুলে পড়ার সময় তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতেন ‘ডেইরী কুইন’ নামের একটি ফাস্টফুডের রেস্তোরায়। সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় ছাব্বিশ বছর বয়েসী পল স্নাইডারের। পরিচয়ের পর থেকে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে তাদের। একসময় তা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। নিজের রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে ডরোথি ততোটা উচ্ছ্বাসিত ছিলেন না কখনোই। কিন্তু স্নাইডার প্রথম দর্শনেই বুঝে ফেলেছিলেন ডরোথির আকর্ষণীয় দেহবল্লরীর কদর।

স্নাইডার তখন নাইট ক্লাবের প্রমোটার হিসেবে কাজ করতেন। তাই এসব অঞ্চলে তার জানাশোনা ছিল ভালোই। তিনি ডরোথিকে তার দৈহিক সৌন্দর্যের মূল্য বোঝাতে সক্ষম হন এবং তাকে রাজি করান মডেল হতে। একজন পেশাদার ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ডরোথির কিছু আবেদনময়ী নগ্ন ছবি তুলেন তিনি এবং ছবিগুলো পাঠিয়ে দেন প্লে-বয় ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা হিউ হেফনারের কাছে।

প্লে-বয় তখন আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত ম্যাগাজিন। আবেদনময়ী সব নারীদের রূপসুধা পান করার জন্য তরুন সমাজ মুখিয়ে থাকে প্লে-বয়ের দিকে। হিউ হেফনারের কাছ থেকে উত্তর পেতে দেরী হলো না তাদের। আর সাথে সাথে ঘুরতে শুরু করলো ডরোথির ভাগ্যের চাকা। প্রথমবারের মতো বিমানে উঠলেন তিনি, স্নাইডারকে সাথে নিয়ে পাড়ি জমালেন অ্যামেরিকার লস এঞ্জেলসে। হেফনারের বিখ্যাত প্লে-বয় ম্যানসনে নতুন ঠিকানা হলো তার।

ডরোথি ও হিউ হেফনার; ছবিসূত্র: radaronline.com

১৯৭৯ সালের আগস্ট মাসে ডরোথি প্লে-বয়ের ‘প্লে-মেট অফ দ্য মান্থ’ নির্বাচিত হন, এর ফলে বিনোদন জগতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। তার পরিষ্কার ত্বক, আবেদনময়ী, নিখুঁত দৈহিক গড়নের সাথে নিষ্পাপ চাহনীর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে প্লে-বয় ভক্তকূল। হিউ হেফনারও বাজির ঘোঁড়া হিসেবে দেখছিলেন ডরোথিকে। তখন পর্যন্ত হলিউডে প্লে-বয়ের নিজস্ব কোনো বড় তারকা ছিলো না। তারা ডরোথিকে নিয়ে সে অভাব পূরণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।

প্লে-বয় মিশন শুরু করার পর ডরোথির ব্যক্তিগত জীবনেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। ছোট শহরের আলাভোলা তরুণী মেয়েটি এই নতুন জগতের অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। তার ওপর প্রতিনিয়ত বাড়ছিলো তার ভক্ত ও প্রণয়াকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা, যাদের অনেকেই ছিলেন বেশ নামীদামী ব্যক্তিত্ব। প্লে-বয় ম্যানসনের এ দিনগুলো নিয়ে ডরোথি তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন,

“প্রায় সময়ই আমি চোখে জল নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। একদম হঠাত করেই আমার জীবনে প্রচুর পুরুষের আনাগোনা শুরু হয়। আর এদের অনেকেই আমাকে চাইতে শুরু করে। যদিও কেউই কোনরকম চাপ প্রয়োগ করতো না। কিন্তু স্রেফ কথার জোরও কম নয়, বিশেষ করে ছোট শহর থেকে উঠে আসা এই মেয়েটির কাছে।”

আর অন্যদিকে ছিলো ডরোথির সেই প্রেমিক, পল স্নাইডার। ছোট শহরের অন্ধকার পাড়া থেকে উঠে আসা এক উচ্চাভিলাসী তরুণ, তার অতীত খুব একটা সুবিধের ছিলো না। অর্থ আর নারীসঙ্গের লোভে তরুণ বয়সেই সমাজের অন্ধকার পথে পা বাড়ান তিনি। নাইট ক্লাব প্রমোটার থেকে শুরু করে পতিতাবৃত্তিতে মধ্যস্থতা করার কাজও করছিলেন অনেকদিন। এর আগে একজন ষ্ট্রিপারকে প্লে-বয় মডেল করার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয় নি। এই পল স্নাইডারও ডরোথিকে দেখেই বুঝেছিলেন, ডরোথিই হতে পারে তার তুরুপের তাস ।

ডরোথি স্ট্র্যাটেন ও পল স্নাইডার; ছবিসূত্র: nydailynews.com

তবে ডরোথিকে সফলতার রাস্তা হিসেবে দেখলেও, তাকে দিয়ে কখনো পতিতাবৃত্তি করাতে চায়নি স্নাইডার। বরং তার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো, তাকে ভালোবেসেছিলো।  কিন্তু এ পর্যায়ে এসে স্নাইডার টের পাচ্ছিলো যে, ডরোথি তার হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই সে প্রতিনিয়ত বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলো। হিউ হেফনার সহ অন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা ডরোথিকে বিয়েতে এগোতে নিষেধ করলেন। তারা বলেছিলেন, এটি তার ক্যারিয়ারের জন্য খারাপ হতে পারে, তাছাড়া স্নাইডার তার জন্য আদর্শ কেউও নয়।

কিন্তু ডরোথি বিয়েতে সায় দেন। তিনি বলেন, “পল সবসময় আমার খেয়াল রেখেছে। আমার প্রয়োজনে আমি সবসময়ই তাকে পাশে পেয়েছি। পল ছাড়া অন্য কারো সাথে আমি নিজেকে ভাবতেই পারি না।” অবশেষে ১ আগস্ট, ১৯৭৯ সালে তারা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। পল ও ডরোথি একসাথে একটি বাড়ীতে উঠে আসেন। আর বুনতে শুরু করেন আগামী দিনের স্বপ্নের জাল। ডরোথির স্বপ্নগুলো, পলের নিজেরও স্বপ্ন ছিল। কারণ ডরোথিই ছিল তার স্বপ্ন পূরণের মাধ্যম, যেমনটি সে ডরোথিকে বলতো, “We’re on a rocket ship to the moon”।

এদিকে ডরোথির সময়ও তখন পয়মন্ত হয়ে উঠেছে। ১৯৮০ সালেই তিনি ‘প্লে-মেট অফ দ্য ইয়ার’ হওয়ার পর তার জীবন নতুন মোড় নেয়। বলা যায় রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান তিনি। করে। বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে, সিরিয়ালেও ছোটখাটো অভিনয় শুরু করেছিলেন। হলিউডের নামীদামী সব পরিচালকের সাথে তার পরিচয় হতে শুরু করে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ব্রেক আসে হলিউডের উঠতি পরিচালক পিটার বোগদানোভিচের হাত ধরে।

পিটার ততোদিনে ‘পেপার মুন’, ‘দ্য লাস্ট পিকচার শো’ এর মতো জনপ্রিয় সিনেমা তৈরি করে  হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। তিনি ডরোথিকে দেখেই তার পরের সিনেমার অভিনেত্রী হিসেবে তাকে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ডরোথির কাছে এটা ছিল স্বপ্নের মতো, নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে যান তিনি। শুরু হয় পিটার পরিচালিত কমেডি ঘরানার ‘দে অল লাফড’ সিনেমার শ্যুটিং। এতে ডরোথির সাথে অড্রে হেপবার্ণও অভিনয় করেছিলেন।

দে অল লাফড সিনেমার কভার; ছবিসূত্র: cloudfront.net

কিন্তু এ সময়গুলোতে, পল স্নাইডারের মনে হতে থাকে, ডরোথির উপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে। পল ডরোথির আর্থিক ও পেশাগত কাজে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করেন তিনি। এসব বিষয় নিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হতে শুরু করে পল ও ডরোথির মাঝে।  তাছাড়া চাকরিবাকরী বিহিন, ব্যর্থ পল স্নাইডারের মনে হচ্ছিল দিন দিন তিনি বেমানান হয়ে আসছেন গ্ল্যামারাস ডরোথির পাশে। হীনমন্যতা ঘিরে ধরে তাকে। আর এর ফলে সে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় ডরোথির উপর।

ডরোথির ম্যানেজার, আইনজীবিদের কল্যাণে তার টাকা পয়সার উপরও অধিকার কমে যেতে থাকে স্নাইডারের। এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রায়ই তাদের মাঝে ঝামেলা হতো। এমনকি এসব ঝামেলা থামানোর জন্য ডরোথি হলিউড ছেড়ে দিয়ে স্নাইডারের সাথে কানাডায় স্থায়ী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্নাইডার তাতে রাজি হয়নি। তাদের মধ্যকার ঝামেলারও কোনো সমাধান হয়নি।

এদিকে নিউইয়র্কে শ্যুটিং চলাকালে ডরোথির সাথে পরিচালক পিটার বোগদানোভিচের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ডরোথি পিটারের সাথে তার হোটেল স্যুটে উঠে আসেন। এরপর ক্যালিফোর্নিয়া ফেরার পর উঠে যান পিটারের সাথে তার বাসায়। পল স্নাইডারকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার কাছ থেকে আলাদা হয়ে এসেছিলেন তিনি।

ডরোথি ও পিটার বোগদানোভিচ; ছবিসূত্র: David McGough, gettyimages

এ পর্যায়ে স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি এসে পল সব হারিয়ে ফেললেন। ডরোথিই ছিল তার সব উচ্চাশার ভিত। এত কাছে এসে তা হারিয়ে অকূল পাথারে পড়লেন পল। ডরোথিকে ফিরে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন তিনি। জানা যায়, ডরোথির গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভও নিয়োগ দিয়েছিলেন।

ডরোথিও পলের উপর মায়া সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। বস্তুত তার এ যাত্রা তো পলের হাত ধরেই শুরু। তিনি চেয়েছিলেন তাকে কিছু অর্থ দেয়ার মাধ্যমে পলের সাথে সমঝোতায় আসতে। কিন্তু কে জানতো যে, পলের মাথায় ছিলো অন্য পরিকল্পনা। ১৯৮০ সালের ১৪ই আগস্ট  কিছু অর্থ-কড়ি সঙ্গে নিয়ে ডরোথি যান স্নাইডারের বাসায়। এরপর একান্তে আলোচনা করতে শুরু করেন তারা। দুপুর থেকে বিকাল গড়িয়ে যায়, বিকাল থেকে রাত, তাদের কোনো সাড়া শব্দ নেই।

এ বাড়ীতেই মৃত পাওয়া গিয়েছিলো তাদের। বাড়ির সামনে ডরোথির গাড়ি; ছবিসূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট

অবশেষে তার বন্ধুরা দরজা ভেঙ্গে আবিষ্কার করে রক্তে ভেসে যাচ্ছে রুম। আর এক পাশে পড়ে আছে পল ও ডরোথির নগ্ন লাশ। ধারণা করা হয়, ডরোথিকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পর নিজের মাথায় গুলি চালিয়েছিলেন স্নাইডার। স্নাইডার কি ডরোথিকে আদৌ ভালোবাসতেন, সেই ভালোবাসা প্রসূত ঈর্ষা থেকে এ হত্যাকাণ্ড? নাকি ডরোথি ছিলেন কেবল তার স্বপ্নপূরণের উপকরণ, তা ব্যর্থ হওয়ায় এটি ঘটিয়েছেন তিনি? এ প্রশ্নগুলো এই পর্যায়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।

তবে এগুলোর উত্তর যা-ই হোক, বাস্তবতা হলো পল স্নাইডারের জিঘাংসার বলি হয়ে ডরোথি স্ট্র্যাটেন চলে গেছেন না ফেরার দেশে। চলে গেছেন মাত্র বিশ বছর বয়সে; নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত করার আগেই। চলে গেছেন অনেকের অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে। ডরোথির মৃত্যুর পর এ দু’বছরের স্বল্প সময়টা স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল অনেকের কাছে। সন্দেহ হয়েছিলো, ডরোথি স্ট্র্যাটেন নামে কি আদৌ কেউ ছিলেন, নাকি ডরোথি কেবল মিষ্টি একটি সুখস্বপ্নের নাম?

তথ্যসূত্রঃ ভালোবাসা কারে কয়, অভিজিৎ রায় (পৃষ্ঠাঃ ১১৬-১১৯)

ফিচার ইমেজ- washingtonpost.com

Related Articles