Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একজন অরুন্ধতি রায়

যদি আপনি ধার্মিক হয়ে থাকেন, তাহলে মনে রাখুন, এই বোমা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের চ্যালেঞ্জ। যেন খুব সহজ ভাষায় বলা যায়, তুমি যা কিছু সৃষ্টি করেছো, সে সব কিছু ধ্বংসের ক্ষমতা আমাদের আছে। আর যদি আপনি ধার্মিক না হন, তাহলে এভাবে ভাবুন, আমাদের ৪৬০ কোটি বছরের পুরোনো এই পৃথিবী এক বিকেলেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

এই কথাগুলো পড়েই পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কতটা সূক্ষ্ণতা অবলম্বন করে বক্তা কথাগুলো বলেছেন। একইসাথে দুটো আলাদা মানসিকতার মানুষদের কথা মাথায় রেখে তাদের একই ধারায় চিন্তা করতে বাধ্য করার মতো সুষ্ঠু কূটনৈতিকতা অবলম্বন করে কথাগুলো বলা। এই লাইনগুলো লিখেছিলেন অরুন্ধতি রায়। ১৯৯৮ সালে তিনি ভারত সরকারের নিউক্লিয়ার পলিসির একটি সমালোচনা লিখেন ‘দ্য এন্ড অব ইমাজিনেশন’ নামে। সেখানেই উক্ত কথাগুলো উল্লেখ করেন তিনি।

অরুন্ধতি রায়; Image Source: nytimes.com

অরুন্ধতি রায় একজন প্রখ্যাত ভারতীয় ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক এবং মানবাধিকার ও পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলনে জড়িত রাজনৈতিক কর্মী। ১৯৯৭ সালে নিজের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ এর জন্যে ম্যান বুকার পুরষ্কার পান অরুন্ধতি। ভারতে বসবাসরত কোনো ভারতীয় নাগরিক কর্তৃক রচিত সবচেয়ে অধিক বিক্রিত বই হয় এটি সেই সময়। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষহীন এবং নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে সর্বদা উচ্চকন্ঠ, মানুষ এবং সমাজ সম্পর্কিত গভীরতর বোধসম্পন্ন এক মহিয়সী বুদ্ধিজীবি এ নারী। নামটি হয়তো অনেকেরই জানা, চলুন কিছু জানা যাক তার কর্ম ও ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে।

অরুন্ধতির জন্ম ১৯৬১ সালের ২৪ নভেম্বর, ভারতের মেঘালয়ের শিলং-এ। বাবা রাজীব রায় ছিলেন কলকাতার একজন বাঙালি হিন্দু। পেশায় তিনি ছিলেন চা-বাগান প্রকল্পের ম্যানেজার। আর মা মেরী রায় ছিলেন কেরালার খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে, পেশায় নারী অধিকার রক্ষা কর্মী। অরুন্ধতির বয়স যখন ২ বছর, তখন তার বাবা-মা’র বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর মায়ের সাথে কেরালায় চলে আসেন শিশু অরুন্ধতি। মাঝে কিছুদিন উটি-তে নানার বাড়িতেও কাটান তিনি। ৫ বছর বয়সে পুনরায় ফিরে আসেন কেরালায়। সেখানে তার মা একটি স্কুল চালু করেন। অরুন্ধতির ছোটবেলা কেটেছে এই প্রাকৃতিক রুপ-সৌন্দর্যে ঘেরা কেরালাতেই।

কোট্টায়ামের ‘করপাস ক্রিস্টি’ স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা নেন অরুন্ধতি। এরপর তামিলনাড়ুর নীলগিরিতে লাভডেল লরেন্স স্কুলে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে দিল্লীর স্কুল অব প্ল্যানিং এন্ড আর্কিটেকচার থেকে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। এখানে তিনি আর্কিটেক্ট জেরার্ড দা কানহা’র সাথে মিলিত হন এবং পরবর্তীতে তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। দিল্লী এবং গোয়ায় বেশ কিছুদিন একসাথে বসবাসের পর তাদের বিচ্ছেদ হয়।

দিল্লীতে ফিরে ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট আরবান অ্যাফেয়ার্স’-এ কর্মজীবন শুরু করেন অরুন্ধতি। ১৯৮৪ সালে চিত্রনির্মাতা প্রদীপ কৃষাণের সাথে পরিচয় হয় তার। নিজের নির্মিত একটি চলচ্চিত্রে অরুন্ধতিকে একটি রোল দেন তিনি। ‘ম্যাসেই সাহিব’ নামক চলচ্চিত্রটি বেশ কিছু পুরষ্কারপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে তারা দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মিলিত প্রচেষ্টায় এই দম্পতি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে একটি টিভি সিরিজ এবং ‘ইন হুয়িচ অ্যানি গিভস ইট দোজ ওয়ানস’ (১৯৮৯) ও ‘ইলেকট্রিক মুন’ (১৯৯২) নামে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। প্রথমটির জন্যে সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার পান অরুন্ধতি।

সিনেমার পর্দায় অরুন্ধতি; Image Source: pinterest.com

একসময় সিনেমার দুনিয়ায় মন উঠে যায় তার। এরপরে অ্যারোবিক ক্লাস চালানোসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। এর মাঝে তার লেখাও চলতে থাকে। একসময় প্রদীপের সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ’৯৭ সালে প্রকাশিত অরুন্ধতির প্রথম উপন্যাস, সেমি-অটোবায়োগ্রাফিক্যাল ধাঁচের ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ তাকে তুমুল জনপ্রিয়তা এবং আর্থিক সচ্ছ্বলতা এনে দেয়। আয়মানামে বাসকালীন সময়ের নিজের বাল্যকালের অনেক স্মৃতির প্রতিচ্ছবি আছে তার এই উপন্যাসে। টাইম, গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, টরেন্টো স্টার প্রভৃতি নামকরা ম্যাগাজিন কর্তৃক ভূয়সী প্রশংসিত হয় বইটি। অবশ্য তার নিজ বাসভূমি কেরালার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ই. কে. নয়নজার বইটিতে অনবদমিত যৌনতার ব্যবহারের সমালোচনা করে অরুন্ধতির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনেন।

অরুন্ধতির প্রথম উপন্যাস; Image Source: twitter.com

প্রথম উপন্যাসের অভূতপূর্ব সাফল্যের পরে অরুন্ধতি রায় ‘The Banyan Tree’ নামে একটি টিভি সিরিয়াল এবং ‘DAM/AGE: A Film with Arundhati Roy’  নামে একটি ডকুমেন্টরি তৈরি করেন। প্রথম উপন্যাসের প্রকাশের পর তার বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অতিবাহিত করেন। এই দীর্ঘ সময় তিনি সামাজিক বিষয়াবলির উপর অনেক প্রবন্ধ লিখেন। সবসময় নগ্ন সত্যের পক্ষে কথা বলে বিতর্কিতও কম হননি অরুন্ধতি।

২০০৮ সালে তিনি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে কাশ্মীরের স্বাধীনতার স্বপক্ষে তার মতামত ব্যক্ত করেন। ১৮ আগস্ট, ২০০৮ কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে প্রায় ৫ লক্ষ কাশ্মীরি জনতার একটি র‍্যালী অনুষ্ঠিত হয়। অরুন্ধতির ভাষ্যমতে, তাদের এই র‍্যালী ছিল ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আকাঙ্খার নিদর্শন। তার মতে কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় কাশ্মীরি জনগণকে স্বাধিকার প্রদান করা। তার এই মতামতের জন্য তিনি কংগ্রেস ও বিজেপি’র তীব্র তোপের মুখে পড়েন। কংগ্রেস নেতা সত্য প্রকাশ মালবিয়া অরুন্ধতিকে তার দেয়া ‘ঐতিহাসিক সত্যের বিপরীত’ এই ‘দায়িত্বহীন’ উক্তি অপসারণ করে নিতে বলেন।

সবসময় নগ্ন সত্যের পক্ষে কথা বলে বিতর্কিতও কম হননি অরুন্ধতি; Image Source: Channel 4

নর্মদা ড্যাম প্রজেক্টের বিরুদ্ধে তীব্রকন্ঠ ছিলেন অরুন্ধতি। তিনি বলেছিলেন, এই প্রজেক্ট প্রায় আধা মিলিয়ন মানুষকে গৃহহীন করে ছাড়বে এবং তাও কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়া। নিজের বুকার প্রাইজ থেকে পাওয়া অর্থ ও বই এর স্বত্ত্ব হতে পাওয়া অর্থ তিনি দান করেন ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে’। তার এই আন্দোলনও কংগ্রেস ও বিজেপি নেতাদের সমালোচনার শিকার হয়। পরিবেশ ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহও অরুন্ধতির এই আন্দোলনকে তীব্র সমালোচনা করেন। তার মতে, মিস রায়ের এই পক্ষ সমর্থন অতিরঞ্জিত ও আত্মকেন্দ্রিক এবং তিনি পরিবেশগত বিশ্লেষণের নাম খারাপ করে দিয়েছেন। প্রত্যুত্তরে অরুন্ধতি সোজা সাপ্টা বলে দেন,

আমি বিকারগ্রস্ত। আমি ছাদে উঠে চেঁচিয়ে যাচ্ছি, আর উনি আর উনার ফিটফাট শাবকেরা আমায় বলছেন, ‘হিসসস…প্রতিবেশীরা জেগে যাবে!’ আমি প্রতিবেশীদের জাগাতেই চাই। এটাই আমার উদ্দেশ্য। আমি চাই সবার চোখ খুলুক।

রাজস্থানের পোখরানে ভারত সরকারের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করে অরুন্ধতি লিখেন ‘দ্য এন্ড অব ইমাজিনেশন’। ২০১৩ সালে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়াকে তিনি একটি ‘ট্র্যাজেডি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। পরবর্তী সময়ে ভারতে বর্ধিঞ্চু অসহিঞ্চুতা ও সংখ্যালঘু নিপীড়নের প্রতিবাদস্বরুপ সুশীল সমাজের যে অংশটি নিজ নিজ জাতীয় পুরষ্কার ফেরত দেন, তাদের মধ্যে অরুন্ধতিও ছিলেন। তিনি বলেন,

মানুষকে বিনা বিচারে মেরে ফেলা, পুড়িয়ে ফেলা, গণহত্যা এসব ঘটনার জন্য ব্যবহৃত অসহিঞ্চুতা শব্দটি যথেষ্ট নয়।

নকশাল ও মাওবাদী বিদ্রোহীদের উপর সরকারের সশস্ত্র আক্রমণেরও তিনি সমালোচনা করেন। তিনি একে ভারতের সবচেয়ে গরীব মানুষদের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন।

সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় প্রতিবাদমুখর অরুন্ধতি; Image Source: archive.indianexpress.com

২০০১ সালে ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতি আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা এবং বুশ-ব্লেয়ার জোটের সুতীব্র নিন্দা করেছিলেন। তাদের নিজেদেরকে শান্তিপ্রিয় উল্লেখ করার বিপরীতে তিনি বলেন,

তো এখন আমরা জানি, শুয়োর মানে ঘোড়া, নারী মানে পুরুষ আর যুদ্ধ মানে শান্তি!

২০০৬ এর আগস্টে ‘দ্য গার্ডিয়ানে’ নোয়াম চমস্কি, হাওয়ার্ড জিনসহ প্রায় ১০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে অরুন্ধতি রায়ও একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর প্রদান করেন। এই চিঠিতে ২০০৬ এর লেবানন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইজরায়েলকে যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হয়।

লিখনশৈলি ও সমাজসেবার জন্য এখন অবধি অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন অরুন্ধতি। অহিংসার পক্ষে সামাজিক আন্দোলনকর্মের স্বীকৃতিস্বরুপ ২০০৪ সালে ‘সিডনী পীস প্রাইজ’ লাভ করেন তিনি। ২০০৬ সালে তার প্রবন্ধসমগ্র ‘দি অ্যালজেবরা অব ইনফাইনাইট জাস্টিস’ এর জন্যে অরুন্ধতি ‘সাহিত্য একাডেমি’ পুরষ্কার লাভ করেন, যদিও তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। ভিন্নধর্মী লেখার জন্য ২০১১ সালে ‘নরম্যান মেইলার প্রাইজ’ লাভ করেন অরুন্ধতি। ২০১৪ সালে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকাতেও উঠে আসে তার নাম। প্রথম উপন্যাস প্রকাশের দীর্ঘ ২০ বছর পর ২০১৭ সালে এসে অরুন্ধতি তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ প্রকাশ করেন। সেবছরই বইটি ছিল ম্যান বুকার পুরষ্কারের মনোনয়নের তালিকায়। 

দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস; Image Source: Verve Magazine

জাতীয় হোক বা আন্তর্জাতিক, যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে সেখানেই সচকিত হয়েছেন অরুন্ধতি, হয়ে চলছেন অবিরত। তার মতো একজনের প্রচেষ্টায় হয়তো পৃথিবীজুড়ে চলমান সার্বিক মানবাধিকার লঙ্ঘনে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে না, কিন্তু তার মতো অনেকে এখনও আছেন বলেই হয়তো মানুষ এখনও সাহস করে বাঁচার, স্বপ্ন দেখে সাম্যের, সৌহার্দ্যের। একজন অরুন্ধতি রায় আমাদের সেই অনুপ্রেরণাই দান করে যান।

This article is in Bangla language. It's an article about a famous Indian writer named Arundhati Roy.

Featured Image © Shyama (Art Director: Zak Bickel)

Source of Information

1. weroy.org/arundhati.shtml

2. theguardian.com/books/2016/oct/03/arundhati-roy-announces-second-novel-after-20-year-gap

Related Articles