Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একজন ‘হাতুড়ে’ ডাক্তারের ভুলভাল চিকিৎসা ও হিপনোসিস আবিষ্কারের ‘অবৈজ্ঞানিক’ গল্প!

১৮ শতকের মধ্যভাগে মানসিক সমস্যার সফল চিকিৎসা করিয়ে বেশ খ্যাতি লাভ করেন তিনি। তিনি একটি বিশেষ চিকিৎসাপদ্ধতিতে রোগীদের চিকিৎসা দিতেন যার নাম ‘এনিম্যাল ম্যাগনেটিজম’। চিকিৎসক তো নয়, তিনি যেন ছিলেন কোনো তান্ত্রিক। আর ম্যাগনেটিজম হচ্ছে তার তন্ত্রমন্ত্রের নাম, যার কাছে গেলে অসুখ বিসুখ রোগীর দেহ ছেড়ে পালাবার পথ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে! অথচ, এনিম্যাল ম্যাগনেটিজম বলতে আসলে কিছুই নেই! কিন্তু, তিনি এই অলীক বস্তুর নামেই নিজের চিকিৎসাপদ্ধতিকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন, সুস্থ করেছেন হাজারো রোগীকে। তার সম্মোহনী চিকিৎসাপদ্ধতির সংবেশনে মোহিত হয়েছেন কত শত মানুষ তার ইয়ত্তা নেই। তাই তো তারই নামের একটি অংশ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয় একটি বিশেষ চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে।

‘সম্মোহন’, ইংরেজি করলে হয় ‘হিপনোসিস’ কিংবা ‘মেজমারিজম’। এই মেজমারিজম শব্দটির একটি রূপ ‘মেজমারাইজ’ আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় ব্যবহার করা একটি বহুল প্রচলিত ক্রিয়া। নিজের কাজে কর্মে কতটা সম্মোহন সৃষ্টি করতে পারলে, একজন মানুষের নাম থেকে একটি ক্রিয়ার ব্যুৎপত্তি ঘটে ভাবতে পারছেন কী? যার কথা বলছি তার নাম মেজমার!

ফ্রাঞ্জ মেজমার (১৭৩৪-১৮১৫); source: mindmotivations.com

১৭৩৪ সালের ২৩ মে, দক্ষিণ জার্মানির ছোট্ট গ্রাম ইজনাং এ জন্মগ্রহণ করেন ফ্রাঞ্জ অ্যান্টন মেজমার। তিনি অ্যান্টন মেজমার এবং মারিয়া উরসুলার তিন সন্তানের কনিষ্ঠতম। অপরাপর বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মতো মেজমারের শৈশব পড়ালেখা করে কাটেনি, কেটেছে খেলাধুলা আর খুনসুটিতে। কন্সট্যান্স হ্রদের তীরে বালি দিয়ে ইচ্ছেমতো আকৃতি বানানো এবং বেলাশেষে হ্রদেই গোসল সেরে বাসায় ফেরা ছিল তার নিত্যকার রুটিন। আর বাসায় তো খেলার সঙ্গী একটি বিড়াল এবং কুকুর ছিলই। এসব থাকতে আর কী চাই জীবনে? ওহ, পড়ালেখাটাও তো চাই! এটা অনুধাবন করতে ৮ বছর লেগে গিয়েছিল মেজমারের। ‘গ্রিন মাউন্টেইন’ আশ্রমেই তার শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয়। তবে হাতেখড়ির অভিজ্ঞতা ছিল ভুলে যাবার মতোই।

একে তো দেরিতে পড়ালেখা শুরু করেছেন, তার উপর একাডেমিক পারফরম্যান্স ছিল ভীষণ বাজে। ফলে মেজমারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান তার বাবা। শেষতক সিদ্ধান্ত নেন, ছেলেকে চার্চের পাদ্রী বানাবেন। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘জেস্যুট কলেজ’ এবং ‘জ্যেসুট থিওলজিক্যাল স্কুল অব ডিলিঞ্জেন’ এ ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন মেজমার। তবে কলেজের গণ্ডি পার করবার আগেই তার মেধার বিচ্ছুরণ ঘটতে শুরু করে। তিনি নিজেও অনুধাবন করেন, শুধুমাত্র ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়নে তার মেধার যথার্থ ব্যবহার হবে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি দর্শন, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং যুক্তিশাস্ত্রের কোর্স বেছে নেন। সেখানে ‘ডক্টর অব ফিলোসফি’ অর্জন করে ১৭৫৯ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে চলে যান ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৭৬৫ সালে চিকিৎসকের লাইসেন্স পাবার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার দীর্ঘ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। তখন তার বয়স ৩১ বছর।

ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়; source: univie.ac.at

মেডিক্যাল ডিগ্রি লাভ করেই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলেন মেজমার। ১৭৬৮ সালের ১০ জানুয়ারি, ভিয়েনার এক ধনী ব্যবসায়ীর মেয়ে মারিয়া আনা ভন পসকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের উপহার স্বরূপ ভিয়েনায় একটি জাঁকালো বাড়িও পেয়ে যান। আর সে সুবাদে ভিয়েনাতেই সস্ত্রীক স্থায়ী হন। বাড়ির একটি কক্ষে নিজের চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণাগার খুলে বসেন তিনি। তাছাড়া, তিনি একজন চমৎকার পিয়ানোবাদক ছিলেন। সংস্কৃতিমনা হিসেবে এলাকায় দ্রুত তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। আর নাম হবে না কেন? সপ্তাহান্তে যে তার বাড়িতে বসতো আড়ম্বরপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে নাচ, গান, নাটকের পাশাপাশি থাকতো মেজমারের ‘মেজমারাইজিং’ পিয়ানোর সুর।

১৭৪০ সালে পত্রিকায় একটি চিত্তাকর্ষক সংবাদ দেখতে পান মেজমার। ম্যাক্সিমিলিয়ান হেল নামক কোনো এক জ্যোতির্বিদ কী এক ‘ম্যাগনেটিক থেরাপি’ ব্যবহার করে রোগ সারিয়ে দিচ্ছেন। খবরটা প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল মেজমারের। কিন্তু, চৌম্বকক্ষেত্র নিয়ে পড়াশোনা করে তিনি কৌতুহল বোধ করেন। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, ব্যাপারটা বাজিয়ে দেখবেন। যদি ম্যাগনেট থেরাপি আদতে কাজ করে থাকে, তাহলে কথিত ‘ম্যাগনেটিক ফ্লুইড’ বা চুম্বকীয় তরলের অস্তিত্ব সত্য। তাহলে এই থেরাপি কীভাবে কাজ করে? নিশ্চয়ই সে অদৃশ্য চৌম্বকীয় তরলের একটি কৃত্রিম প্রবাহ সৃষ্টি হয়! এখান থেকেই শুরু হলো সব অবিশ্বাস্য তত্ত্বে বিশ্বাস করার ধারা।

মেজমার একজন মৃগীরোগীর উপর পরীক্ষা চালালেন ম্যাগনেট থেরাপির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। তিনি রোগীকে এক গ্লাস আয়রন প্রিপারেশন (ফেরাস সালফেট, ফেরাস গ্লুকোনেট, ফেরাস ফিউমারেট এবং কার্বনিল আয়রনের মিশ্রণ) পান করতে দেন। এরপর তিনি রোগীর দেহের চারদিকে চৌম্বক সেঁটে দেন। কিছুক্ষণ পর রোগী বলতে লাগলেন, তিনি তার দেহের ভেতরে কোনো কিছুর প্রবাহ অনুভব করছেন এবং এই প্রবাহ তার রোগ ভালো করে দিচ্ছে! ব্যস, ম্যাগনেট থেরাপি প্রমাণিত!

ম্যাগনেট থেরাপি; source: medpedia.framar.bg

যেহেতু ম্যাগনেট থেরাপি প্রমাণিত হয়েই গেছে(!), তাহলে এবার এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করাই যায়। তবে কিছুদিন পরই তিনি ম্যাগনেট থেরাপিতে ম্যাগনেট অর্থাৎ, চুম্বকের ব্যবহারই বাদ দিয়ে দিলেন। তিনি আবিষ্কার করলেন যে তার হাত দুটোই উৎকৃষ্ট চুম্বকের ন্যায় আচরণ করে এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে একই ফলাফল দেয়! তিনি তাই চুম্বক এবং আয়রন দুটোই ত্যাগ করলেন। এর পরিবর্তে রোগীর দেহে হাত বুলিয়ে দেন এবং রোগীর সাথে গভীর মনোযোগে কথা বলেন। মেজমার এই পদ্ধতির নাম দেন এনিম্যাল ম্যাগনেটিজম। ১৭৭৫ সাল থেকেই তার এই পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। তিনি এর ব্যাখ্যা এভাবে দেন যে, তার দেহে চৌম্বকীয় তরলের প্রাচুর্য আছে যা তিনি অন্যের দেহে প্রদান করতে সক্ষম। তাছাড়া, প্রত্যেকের দেহেই চৌম্বকীয় তরল থাকে। তবে যাদের দেহে এর পরিমাণ কমে যায়, কিংবা এই তরল সঞ্চালন বাঁধাগ্রস্ত হয়, তাদেরই নানাবিধ মানসিক রোগ আক্রমণ করে!

রোগীদের চুম্বকায়িত করছেন মেজমার; source: invisiblemikey.wordpress.com

চুম্বকীয় তরল আর এনিম্যাল ম্যাগনেটিজম সবই ছিল ভুয়া। অবশ্য মেজমার তা জানতেন না। তিনি নিজেও জানতেন না যে ভুলভাল চিকিৎসার মধ্য দিয়ে তিনি চিকিৎসার এক অনন্য পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছেন! তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, কেতাদুরস্ত সুদর্শন পুরুষ। তার কথা বলার ভঙ্গি যেকোনো মানুষকেই অভিভূত করতো। সেক্ষেত্রে তার হাত থেকে কোনো অদৃশ্য তরল নির্গত হবার প্রয়োজন ছিল না, তার রোগীরা সুস্থ হতেন যে কারণে তা হচ্ছে ‘হিপনোসিস’ বা সম্মোহন। ১৮৪৩ সালে জেমস ব্রেইড এই হিপনোসিস ব্যাপারটা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু, ততদিনে বেচারা মেজমার বেঁচে থাকলে তো! তাকে তো তার সময়ের চিকিৎসক সমাজ ‘হাতুড়ে ডাক্তার’ উপাধি না দিয়ে ছাড়েনি! চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক বড় ট্র্যাজেডির নাম হয়ে আছেন মেজমার, যিনি কিনা একজন মেডিক্যাল কলেজ পড়ুয়া স্বীকৃত ডাক্তার ছিলেন, একটি মৌলিক এবং অনন্য চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কারও করেছেন, অথচ ইতিহাসে ‘হাতুড়ে ডাক্তার’ হিসেবে নাম লিখিয়েছেন নিজের কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাসের জন্য।

চিকিৎসক সমাজ দ্বারা একঘরে হলেও সাধারণের নিকট মেজমার ছিলেন শ্রেষ্ঠ ডাক্তার। মানসিক রোগীরা যেকোনো সমস্যার কথা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে যেতেন মেজমারের বাড়ির চৌকাঠে। অল্প সময়ে তিনি বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যান। নিজের বাড়িতেই গড়ে তোলেন বিশাল মানসিক চিকিৎসালয়। সেখানে তার ভ্রান্ত বিশ্বাস আর পাগলামি আকাশ ছুঁয়ে যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, তার দেহে চৌম্বকীয় তরল এত বেশি পরিমাণে আছে যে তিনি রাজা মাইডাসের মতো যা ছুঁয়ে দেন, তা-ই ম্যাগনেটিক ফ্লুইডে পরিপূর্ণ হয়ে যায়! তিনি তার বাগানের গাছ থেকে শুরু করে রোগীদের কক্ষের আসবাবপত্র, বিছানা, বালিশ এমনকি খাবার পাত্র, সবকিছুই চুম্বকায়িত করতে শুরু করেন, যাতে করে রোগীরা সর্বক্ষণ চুম্বকীয় তরলের সংস্পর্শে থাকে!

সম্মোহন করছেন মেজমার; source: dissertationreviews.org

অন্যদিকে, মেজমার এক বিশাল বড় বাথটাব তৈরি করেন, যার মধ্যে একসাথে ২০-২৫ জন রোগী গলা ডুবিয়ে বসে থাকতে পারবেন। সেই বাথটাব পূর্ণ থাকতো লৌহচূর্ণের সম্পৃক্ত দ্রবণে। আর পাশে একটি বড় পাত্র তার হাতের স্পর্শে চুম্বকায়িত তরলে পূর্ণ করা ছিল। সে পাত্র থেকে একাধিক টিউবের মাধ্যেম, তাদের মাথায় রড লাগিয়ে রোগীদের হাতে দেয়া হতো। রোগীরা সে রড ধরে বসে থাকতেন এবং পাত্রের চুম্বকীয় তরল তাদের দেহে প্রবেশ করে তাদেরকে সুস্থ করতো! মজার ব্যাপার হলো, তিনি পাগলামির পরিমাণ যত বাড়ান, তার জনপ্রিয়তাও বাড়লো সমানুপাতিক হারে! কেননা, হোক না তার কাজগুলো পাগলামি কিংবা ব্যাখ্যাগুলো অবৈজ্ঞানিক, কিন্তু সেগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে সম্মোহনী, যা মানসিক সমস্যার সমাধা করতে সফল হতো।

ভিয়েনাতে তার এই সাফল্য এবং সুখের পসরা চললো মাত্র দুই বছর। ১৭৭৭ সালের মধ্যে তার ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হতে শুরু করলো, তার এনিম্যাল ম্যাগনেটিজম কার্যকারীতা হারাতে শুরু করলো। তিনি সর্বদাই দাবি করতেন, তিনি কেবল ‘সাইকোম্যাটিক’ বা মানসিক সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। কিন্তু, এক অন্ধ রোগীর চিকিৎসায় সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে গেল। যদিও, অন্ধত্ব হচ্ছে একটি ‘সাইকোসোম্যাটিক’ বা শারীরবৃত্তীয় সমস্যা, তথাপি মেজমারের সমালোচকরা দ্রুতই রটিয়ে দিলেন যে মেজমার শারীরবৃত্তীয় চিকিৎসা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এই অপবাদের সমর্থক ছিলেন তার স্ত্রীও। মেজমার তাই ভিয়েনা এবং স্ত্রী, দুটোই ছেড়ে দিয়ে প্যারিসে পাড়ি জমালেন!

১৭৭৮ সালে প্যারিসে নিজের একটি চিকিৎসালয় খোলেন মেজমার। তার ক্যারিয়ারের পুনর্জীবন ঘটে এখানে। অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনি একদল অন্ধ সমর্থকগোষ্ঠী পেয়ে যান। এখানেও চিকিৎসক সমাজ তার বিরুদ্ধে চলে যায়। তাদের হাত থেকে বাঁচতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলেন মেজমার। ১৭৭৯ সালে তিনি তার আবিষ্কারের ২৭টি মৌলিক দিক নিয়ে ‘রিপোর্ট অন দ্য ডিসকভারি অব এনিম্যাল ম্যাগনেটিজম’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি তার অদ্ভুত চিকিৎসাপদ্ধতি এবং একইসাথে অদ্ভুত পোশাকের কারণ দর্শান। তার সাজসজ্জা ছিল এমনই যে, চিকিৎসা করার সময় তিনি ডাক্তার কম, জাদুকর বেশি দেখাতেন।

একসাথে অনেক রোগীর চিকিৎসা করাচ্ছেন মেজমার; source: asociatiaromanadehipnoza.ro

ষাটের দশকে ইংলিশ রক ব্যান্ড বিটলসের জনপ্রিয়তা বর্ণনায় ‘বিটলসম্যানিয়া’ নামক একটি শব্দ প্রচলিত হয়। এরূপ শব্দের প্রচলন কিন্তু প্রথম মেজমারের সময়েই হয়! তার রোগীর সংখ্যা একসময় এত বাড়তে লাগলো যে, পত্রিকাগুলো তার চিকিৎসালয়ের সামনে রোগীদের লম্বা লাইনকে ‘মেজমারোম্যানিয়া’ বলে আখ্যায়িত করে। ১৭৮০ সালের দিকে দেখা গেল যে দৈনিক ২ শতাধিক রোগীর চিকিৎসা করাচ্ছেন মেজমার। তবে এত রোগীর একসাথে চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক সময়ই নারীদের খিঁচুনি দেখা দিত। তাদেরকে বিশেষ যত্নের জন্য আইসিইউ এর আদলে মেজমারের ছিল ক্রাইসিস রুম। সেখানে নিয়েই দীর্ঘক্ষণ নিবিড় পরিচর্যা করতেন মেজমার। কিন্তু, তার সাফল্যের তরী এই ক্রাইসিস রুমে এসেই সঙ্কটাপন্ন হয়।

হঠাৎ করে পুরো প্যারিসময় গুজব রটে গেল যে মেজমার একাকী কক্ষে নারীদের সাথে যৌনাচার করছেন! এদিকে রাজা ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী ম্যারিও মেজমারের একজন গুণগ্রাহী ছিলেন। রাজা সন্দেহ করলেন, মেজমার তার স্ত্রীর উপরও জাদু করেছেন। এই সন্দেহ থেকে তিনি একটি তদন্ত কমিটি বসিয়ে দিলেন, যার প্রধান তদন্তকারী ছিলেন অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ে এবং বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদ্বয়। তদন্তের রিপোর্টে মেজমারের চিকিৎসাপদ্ধতিকে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বলে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় এবং ম্যাগনেটিক ফ্লুইড বলতে কোনো কিছু নেই বলে ঘোষণা করা হয়। এর ফলে প্যারিসেও মেজমারের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। ১৭৮৫ সালে তিনি হঠাৎ একদিন, সকলের অগোচরে প্যারিস থেকে অদৃশ্য হন। তার চলে যাবার পরদিন থেকেই প্যারিস জুড়ে মেজমারোম্যানিয়ার নামে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে অসংখ্য এনিম্যাল ম্যাগনেটিজম মানসিক চিকিৎসালয়!

রাজা ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী ম্যারি; source: history.com

প্যারিস ছাড়ার পর আর কোথাও স্থায়ী হননি মেজমার। ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন শহর ঘুরে ১৭৯৩ সালে ভিয়েনা ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভিয়েনা থেকে তাকে অপমানজনকভাবে বের করে দেয়া হয়। জীবনের শেষ অধ্যায়টা তিনি শুরুর মতো করে কাটান, বসবাস করেন কন্সট্যান্স হ্রদের তীরঘেঁষা শহর জার্মানির মির্‌সবার্গে। প্যারিস ঘটনার পর থেকেই আর কখনো চিকিৎসায় ফিরে যাননি। তবে যত অর্থ তিনি আয় করেছিলেন, তা দিয়ে অনায়াসে রাজকীয় পন্থায় জীবন কাটিয়ে দিতে সক্ষম হন। কন্সট্যান্স হ্রদের তীর যখন বয়োঃবৃদ্ধ মেজমার শৈশবের মতো ঘুরে বেড়াতেন, তখন মনে মনে ভাবতেন, চুম্বকীয় তরল হচ্ছে চিরন্তন সত্য যা একদিন প্রকাশিত হবে! এই ভাবনা নিয়েই ১৮১৫ সালের ৫ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন ফ্রাঞ্জ মেজমার। মৃত্যুর তিন দশক পর চিকিৎসাবিজ্ঞান এই ‘হাতুড়ে ডাক্তার’ এর সাফল্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।

ফিচার ছবি: mindmotivations.com

Related Articles