Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভ্লাদিমির কোমারভ: আকাশ থেকে পড়ে যাওয়া ইতিহাসের প্রথম এবং শেষ ব্যক্তি!

ভূপৃষ্ঠ ছেড়ে আকাশের দিকে উঠতে শুরু করার পর থেকেই নানা ধরনের টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দেয় সয়োজ-১ নামক মহাকাশযানটিতে। কোনোমতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ত্যাগ করতে পারলেও নির্ধারিত অক্ষে কিছুতেই পৌঁছুতে পারলো না সেটি। প্রাণপণ চেষ্টা করেও যানটি নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে না পেরে মহাকাশচারী ভ্লাদিমির কোমারভের মেজাজ তখন সপ্তাকাশে চড়েছে। নিরাপত্তার অভাব আছে জেনেও কেন এই মহাকাশযানটি আকাশে চড়ালো কর্তৃপক্ষ, সেজন্য তাদেরকে অবিরাম গালি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এদিকে একবার দুবার করে ১৮ বার পৃথিবীকে এলোমেলোভাবে প্রদক্ষিণ করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে গিয়ে। জীবনের আশা তার ক্ষীণ হয়ে উঠছিল ক্রমেই।

অকেজো নিরাপত্তা ব্যবস্থা, একাধিক টেকনিক্যাল সমস্যা আর পৃথিবীর সাথে ব্যাহত যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ১৮ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার পর ১৯ তম বারে ভাগ্য সহায় হলো। রেট্রোরকেটগুলো সচল করতে সক্ষম হলেন কোমারভ। সয়োজ-১ এর অন্যান্য অংশ ছেড়ে দিয়ে মডিউলটি তখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছে। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। যে কোণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার কথা, তার চেয়ে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছিল কোমারভের মডিউলটি। প্যারাস্যুটগুলো মেলতে শুরু করে কয়েক মূহুর্তেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

দিনটি ছিল এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখ। রাশিয়ার অরেনবার্গ শহরে তখন সকাল ৭টা। প্রতিদিনকার মতো গাছের পাতা চুইয়ে শিশিরবিন্দুগুলো মাটিতে পড়ছে তখনো। এই রুটিন ঘটনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম এবং শেষ মানুষ হিসেবে সরাসরি আকাশ থেকে মাটিতে পতিত হলেন দুর্ভাগা ভ্লাদিমির কোমারভ!

ভ্লাদিমির কোমারোভ (১৯২৭-১৯৬৭); image source: spacefacts.de

ভ্লাদিমির কোমারভের পরিণতি দুর্ভাগ্য যতটুকু ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনা। সে ইতিহাস জানার আগে কোমারভ সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক। ১৯২৭ সালের ১৬ মার্চ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোয় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। স্থানীয় মেলায় খেলনা বিমান কিনে সেটি দিয়ে খেলতে খেলতে স্বপ্ন বুনতেন আকাশে ওড়ার। স্থানীয় স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেই বাবার কাছে বায়না ধরেছিলেন তাকে বিমান চালনা শেখানোর জন্য! শৈশব থেকেই অ্যারোনটিক্সের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়, যা কৈশোরে গিয়ে সংকল্পে পরিণত হয়। শহরের বাইরে গিয়ে অ্যাভিয়েশন বিষয়ক ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে আনতেন, কিনে আনতেন বড় বড় বিমানের প্রোপেলার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের বড় বড় ছবি। উদ্দেশ্য ছিল নিজের মতো করে একটি বিমানের মডেল তৈরি করা!

১৫ বছর বয়সে মস্কো স্পেশাল এয়ারফোর্স স্কুলে ভর্তি হন কোমারভ। স্বপ্নের হাওয়াই জাহাজটিকে বাস্তব পৃথিবীতে ল্যান্ড করাতে আর কোনো বাঁধা থাকলো না তার। তিন বছর পর বিমানচালনাবিদ্যার স্নাতক সম্পন্ন করে মিলিটারি অ্যাভিয়েশন কলেজে ভর্তি হন। ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ বলে সম্মুখ যুদ্ধে যাবার অভিজ্ঞতা তার আর হয়ে ওঠেনি। অ্যাভিয়েশন কলেজে ৩ বছরের প্রশিক্ষণ শেষ করে লেফটেন্যান্ট পদ নিয়ে রাশিয়ান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন কোমারভ। স্থায়ী চাকরি পেয়েই বান্ধবী ভ্যালেন্টিনাকে বিয়ে করেন তিনি। ৫ বছর বিমান বাহিনীতে কাজ করার পর ‘সেন্ট্রাল সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ নামক মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলক পাইলট হিসেবে যোগ দেন।

ইউরি গ্যাগারিন; image source: front.bg

বিমানচালনা বিদ্যায় অসাধারণ একাডেমিক সাফল্যের জন্য তাকে তার সতীর্থরা ডাকতো ‘দ্য প্রফেসর’ নামে। এ ব্যাপারটি উর্ধ্বতনদের চোখে পড়লে তারা কোমারভকে একটু বাজিয়ে দেখার প্রয়াস চালান। প্রকৌশলী ক্যাপ্টেন পদের জন্য পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রায় ৩ হাজার প্রার্থীর সাথে কোমারভকেও পরীক্ষায় বসানো হয়। সেখান থেকে বাছাই করা হবে মাত্র ২০ জনকে। কিন্তু কোমারভের অত চিন্তা ছিল না। ১ জন বাছাই করলেও তিনি টিকে যেতেন। কারণ তিনিই প্রথম হলেন পরীক্ষায়। এরপর শুরু হয় মহাকাশচারী হবার জন্য ৬ মাসের কঠিন প্রশিক্ষণ। ইউরি গ্যাগারিন আর হেরমান টিটভের মতো বিখ্যাত সব রাশিয়ান নভোচারীদের সাথে নিজের প্রশিক্ষণ সারেন কোমারভ। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহাকাশচারী দলের অন্যতম সম্ভাবনাময় মহাকাশচারী মনে করা হতো তাকে।

স্পুটনিক-১; image source: msbfond.ru

এবার মূল ঘটনায় আসা যাক। ষাটের দশকটা মহাকাশ বিজয়ের জন্য একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, অন্যদিকে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণও ছিল। আত্মঅহংকার, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন দুই সুপারপাওয়ার আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয় এক অঘোষিত যুদ্ধ। স্নায়ুযুদ্ধের আবহে জমে উঠেছিল আকাশ জয়ের এ যুদ্ধটিও। স্পুটনিক স্যাটেলাইট আকাশে পাঠানোসহ আরো বেশ কিছু মহাকাশ অভিযানের মাধ্যমে আমেরিকাকে বারবার হারিয়ে দিচ্ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই জয়রথ ধরে রাখতেই কি না তাদের বেশ তাড়াহুড়ো ছিল, যার চূড়ান্ত বলি হয়েছিলেন ভ্লাদিমির কোমারভ।

১৯৬৭ সালের দিকে মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগীতায় কিছুটা সমতায় ফিরে আসে। দুই বিশ্বশক্তিই তাদের স্যাটেলাইট আকাশে পাঠিয়েছে ততদিনে। উভয় দেশই চেষ্টা করে চলেছে মহাকাশ স্টেশন স্থাপনের। একই বছর উভয় দেশই জাতিসংঘের মহাকাশ বিষয়ক চুক্তিপত্রেও স্বাক্ষর করে। তবে রাশিয়াকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মিশনে প্রথম প্রাণহানির সূচনা করে আমেরিকাই। অ্যাপোলো-১ এর একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে মৃত্যুবরণ করেন তিনজন নভোচারী। আমেরিকার এই হোঁচটের সুযোগ নিতে চেয়েছিল রাশিয়া। তারা চেয়েছিল অ্যাপোলোর আদলে একটি সফল মহাকাশ মিশন সম্পন্ন করে বিশ্বে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। তবে এটিও ছিল একটি গৌণ কারণ। মুখ্য কারণ ছিল বলসেভিক বিপ্লবের অর্ধশতবার্ষিকী উদযাপন। তাই তাড়াহুড়ো করা ছাড়া আদতে উপায়ও ছিল না তাদের!

সয়ুজ-১; image source: russianspaceweb.com

সয়োজ-১ ও সয়োজ-২ নামক দুটি মহাকাশযান এক সপ্তাহের ব্যবধানে মহাকাশে পাঠানোর পরিকল্পনা করে সোভিয়েত রাশিয়া। সয়োজ-১ পরিচালনা করবেন কোমারভ আর সয়োজ-২ এ করে যাবেন অন্য দুজন নভোচারী। মহাকাশে কিছু ইভিএ তথা ‘এক্সট্রা ভেহিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ’ সম্পন্ন করে তারা ফিরে আসবেন, এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল সয়োজ-১ এ। এর হ্যাচ এত ছোট ছিল যে তাতে দক্ষতার সাথে ইভিএ সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব। এই সমস্যা প্রধান প্রকৌশলী রিপোর্ট করলে একটি ৩ সদস্যের প্রকৌশলীর দল পাঠানো হয় এই মহাকাশযানটি পর্যবেক্ষণ করতে। তারা সয়োজ-১ পর্যবেক্ষণ করে ১০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেন যেখানে ২০৩টি ভুলের ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়! এই প্রতিবেদনটি আবার পুনরায় ৫০ জন প্রকৌশলীর দ্বারা যাচাই করানো হয়। তথাপি কেউ প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানানোর সাহস করলেন না! কারণ ব্রেজনেভের কঠোর নির্দেশ ছিল, বলসেভিক বিপ্লবের ৫০ বছর পূর্তিতে সয়োজ আকাশে উড়বেই!

যা-ই হোক, সয়োজ-১ এর সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন স্বয়ং কোমারভও। ইতিহাসের প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন ছিলেন কোমারভের বন্ধু। গ্যাগারিনের সাথেও এই মিশনের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন কোমারভ। ২০১১ সালে প্রকাশিত ইউরি গ্যাগারিনের জীবনী ‘স্টারম্যান: দ্য ট্রুথ বাহাইন্ড দ্য লেজেন্ড অব ইউরি গ্যাগারিন’ বইটিতে গ্যাগারিনকে বলা কোমারভের একটি উক্তি ছিল, “আমার মনে হয় আমি এ মিশন থেকে আর ফিরে আসবো না!” অনেকেই স্টারম্যানে উল্লেখিত এই উক্তিকে বানোয়াট বলতে চাইলেও কেজিবির প্রকাশিত কিছু গোপন নথি থেকে তার প্রমাণ মেলে।

ভস্মীভূত সয়োজ-১ এর মডিউলটি; image source: astronautix.com

দেখতে দেখতে অসংখ্য ত্রুটিযুক্ত সয়োজ মিশনের দিন চলে এলো। ১৯৬৭ সালের ২৩ এপ্রিল। সহযোগী নভোচারীদের অনেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানালেন কোমারভকে। হয়তো তারা ধরেই নিয়েছিলেন কোমারভ ফিরবেন না! সয়োজ-১ এ উঠে বসার আগে সবাই মিলে গান গেয়ে উৎসাহ দিল কোমারভকে। সয়োজ মহাকাশযানে উঠে বসলেন কোমারভ। দুই দেশের আত্মঅহংয়ের লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়ার মোহের কাছে নতি স্বীকার করে, জীবন হাতের মুঠোয় নিয়েই ভূপৃষ্ঠ ছেড়ে শূন্যে উড়ে গেলেন কোমারভ। আর অবশ্যম্ভাবীভাবে উড্ডয়নের কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। সয়োজ-১ যানটির সোলার প্যানেল অকেজো হয়ে পড়লো। নেভিগেশন ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিল, তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেল আর পৃথিবীতে কমান্ড স্টেশনের সাথে যোগাযোগ রহিত হলো। সয়োজ-১ এর এ অবস্থা দেখে সয়োজ-২ এর উড্ডয়ন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো।

মডিউলের সাথে পুড়ে ছাই কোমারভের দেহাবশেষ; image source: astronautix.com

মর্মান্তিক এ ঘটনার পরের অংশটুকু আপনাদের জানা। কয়েক হাজার ফুট উচ্চতা থেকে প্যারাস্যুট ছাড়া পড়তে থাকা মডিউলটিতে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণার ঘর্ষণে, এর প্রতি সেকেন্ডে বাড়তে থাকা গতির কারণে আগুন ধরে যায়। ওরেনবার্গের এক খোলা মাঠের ঘাসের উপর মডিউলটি প্রচণ্ড গতিতে যখন আছড়ে পড়ে, তখন সেটি আর শিশির বিন্দুটির মতো স্নিগ্ধ নেই। সেটি তখন ভস্মীভূত ছাই, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গলিত লোহা, আর আমৃত্যু বাঁচার চেষ্টা করে যাওয়া কোমারভের দেহাবশেষ। মস্কোতে জাতীয় শোক পালন আর বৃহৎ আকারে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান পালন করা হয়। বিমানবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি ‘অর্ডার অব লেনিন’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। মৃত্যুপরবর্তী তিনি দ্বিতীয়বার এ সম্মাননা লাভ করেন এবং তাকে ‘অর্ডার অব হিরো অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

ফিচার ছবি: gettyimages.co.uk

Related Articles