Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

২০০১: আ স্পেস অডিসি – ধ্রুপদী সিনেমার আখ্যান

বিশ্ব-সিনেমার বয়স কম-বেশি ১২০ বছর হবে। সেই হিসেবে, স্ট্যানলি কুব্রিকের ২০০১: আ স্পেস অডিসি মাঝবয়েসী একটি সিনেমা; আমাদের চাঁদের যাওয়ার আগের বছর, অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায়। এ বছর সিনেমাজগতে ঘটা করে পালন করা হলো তার পঞ্চাশ বছরপূর্তি।

বিশ্ব-সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম দুর্বোধ্য সিনেমা, আমদর্শক হতে শুরু করে সমালোচক সবার কাছেই এর শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য। কুব্রিকের এই নির্মাণ তাকে সেলুলয়েডের ঈশ্বরে পরিণত করে।

২০০১: আ স্পেস ওডিসি; Credit: A Stanley Kubrick Production

২০০১: আ স্পেস অডিসির পূর্বে কুব্রিক তৈরি করেছেন পারমাণবিক যুদ্ধ নিয়ে দুর্দান্ত এক স্যাটায়ার ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ অর হাউ আই লার্নড টু স্টপ ওরিং এন্ড লাভ দি বোম্ব, বাবা-মেয়ের নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প নিয়ে ললিতা। এবার তিনি তার বৃত্ত ভাঙতে চাইলেন। নিজের সক্ষমতা প্রমাণে বিস্তৃত করলেন তার ক্যানভাস, দর্শকের অবচেতনে প্রবেশ করলেন এবং তৈরি করলেন সময়ের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে থাকা মডার্ন মিথ

কুব্রিক স্পেস অডিসির অনুপ্রেরণা পান আর্থার সি ক্লার্কের একটি ছোটগল্প হতে, নাম দ্য সেন্টিনেল। সে গল্পে মানুষ চাঁদের বুকে এক মহাজাগতিক বস্তু আবিষ্কার করে, বহুকাল ধরে সে বস্তু মহাকাশব্যাপী একটি সিগনাল ছড়িয়ে দিচ্ছে। গল্প অনুযায়ী, বস্তুটি চাঁদে স্থাপন করেছে এলিয়েনরা এবং যুগের পর যুগ ধরে মানুষের অবস্থান সম্পর্কে সেটি অন্যান্য মহাজাগতিক প্রাণীদের জানান দিয়ে আসছে।

এই প্লটের ওপর ভিত্তি করে কুব্রিক মানব ইতিহাসের আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের দিকে নজর দিলেন। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, মহাজগতে আমাদের অস্তিত্ব এবং অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতব্যাপী মানবজাতির বিবর্তনকে মাথায় রেখে নতুন দাবার বোর্ড সাজালেন। স্ক্রিনপ্লে লিখতে সাহায্য নিলেন আর্থার সি ক্লার্কের। সমান্তরালে লেখা হলো একই নামে একটি উপন্যাস।

চারটি অংশে বিভক্ত সিনেমার প্লট, চারটি অংশেরই প্রোটাগনিস্ট ভিন্ন। প্রথম অংশের শিরোনাম দ্য ডন অফ ম্যান। সেখানে আমরা মানুষ এবং বানরের মাঝে যে প্রজাতিকে দেখি, তা মূলত মানুষেরই আদি রূপ। পরিচালক এখানে থিওরি অফ ন্যাচারাল সিলেকশন-এর সাহায্য নিয়েছেন। দেখা যায়, আদি মানুষেরা খাবারের জন্য শুঁড়ওয়ালা স্তন্যপায়ী প্রাণী টেপিরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। পানিকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তার করতে বিবাদে জড়ায় তাদের দুটি গোত্র। তখন দৃশ্যপটে হাজির হয় সিনেমার সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দীপক চরিত্র মনোলিথ।

মনোলিথকে কেন্দ্র করে আদি মানবেরা; Credit: A Stanley Kubrick Production

মনোলিথ অর্থ বিশালাকৃতির পাথর; পিলার বা মনুমেন্ট যেমন হয়। মনোলিথের সংস্পর্শে ঘটনাপ্রবাহ বদলে যায়। আদিমানুষেরা মৃত প্রাণীর হাড়কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শেখে। যে দলটি তাদের বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হয়েছিলো, অন্যদলের দলপতিকে হত্যা করে তারা আবার তা দখল করে।

বিশ্বসিনেমার ইতিহাসের একটি খুবই বিখ্যাত ম্যাচ কাট দেখা যায় তারপর। আদি মানুষেরা তাদের অস্ত্র আবিষ্কারে বেশ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। টেপির মেরে তারা প্রথম মাংসের স্বাদ পায়। দেখা যায়, আদি মানবদের দলনেতা তাদের সেই অস্ত্র অর্থাৎ হাড় আকাশে ছুঁড়ে মারে। কুব্রিক এবং রে লাভজয়ের মুন্সিয়ানায় সেই হাড় পরিণত হয় অতিকায় এক স্পেস শিপে।

দুর্দান্ত একটি পোস্টার; Credit: A Stanley Kubrick Production

আর দশটি পশুর সারিতে বসবাসকারী আদি মানুষেরা চোখের পলকে এগিয়ে গেলো লক্ষ বছর। প্রযুক্তির অগ্রগতি মানবসভ্যতার অগ্রগতির সাথে সমান্তরালে হয়নি, বরং, প্রযুক্তির ওপর ভর করেই মানব সমাজ উন্নতির শেখরে উঠেছে- পরিচালকের ভাষ্য তেমনই।

দ্বিতীয় অংশের কোনো শিরোনাম নেই। আমেরিকান মহাকাশ বিজ্ঞানী ডক্টর হেউড ফ্লয়েড চাঁদে যাচ্ছেন। যাত্রার অনুসঙ্গ এবং আচার দেখে মনে হয়, চাঁদে যাওয়া মানুষের জন্য তখন ডাল-ভাত হয়ে গেছে। অথচ, বাস্তবে চাঁদে যেতে মানুষের তখনও এক বছর বাকি! ডক্টর ফ্লয়েড চাঁদে যাচ্ছেন চাঁদের অভ্যন্তরে থাকা আজব একটি বস্তু পরীক্ষা করতে।

চাঁদে মনোলিথ; Credit: A Stanley Kubrick Production

ফ্লয়েড এবং তার সহযোগীরা সেখানে আবিষ্কার করেন সেই মনোলিথ, লক্ষ বছর আগে যা আদি মানুষদের সাহায্য করেছিলো। মানুষের স্পর্শ পাওয়ার সাথে সাথে মনোলিথটি ট্রিপওয়ারের মতো কাজ করতে আরম্ভ করে, অর্থাৎ বিকট আওয়াজ করতে থাকে। অতএব, খানিক সামাঞ্জস্য তৈরি হয় দ্য সেন্টিনেল গল্পটির সাথে।

আঠারো মাস বাদে জুপিটার মিশান নিয়ে তৃতীয় অংশ। যদিও এ অভিযানের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করা হয়নি সিনেমার কোথাও। মহাকাশচারীদের একটি দল এবং অত্যন্ত আধুনিক ও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একটি কম্পিউটার হ্যাল ৯০০০ এ অংশের প্রোটাগোনিস্ট। ডেভ বোম্যান এবং ফ্র্যাঙ্ক পোল বাদে অন্য সকল নভোচারী ক্যাপসুলের ভেতর ঘুমিয়ে আছেন। ঘটনার একপর্যায়ে ফ্র্যাঙ্ক আর ডেভের মনে হয়, হ্যালকে তারা বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু হ্যাল তা বুঝতে পারে এবং বিদ্রোহ করে। গল্প এগিয়ে যায়।

সিনেমার সবচেয়ে নাটকীয় এবং দুর্বোধ্য তার শেষ অংশটি, শিরোনাম জুপিটার অ্যান্ড বিয়ন্ড দ্য ইনফিনিটি। মনোলিথ আবার দৃশ্যপটে হাজির হয়। হ্যালের বিদ্রোহের পর ডেভ একটি পড নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মনোলিথকে অনুসরণ করতে। ওয়ার্মহোল কিংবা স্থান-কালের স্বাভাবিক ন্যায্যতাকে খারিজ করে মাল্টিডিমেনশনাল যাত্রার অভিজ্ঞতা হয় তার। এ অভিজ্ঞতা নভোচারীর ব্যক্তিগত মনে করিয়ে দিতে পরিচালক বেশ কিছু ক্লোজ শট নেন।

অসীমের উদ্দেশ্যে যাত্রায় ডেভ; Credit: A Stanley Kubrick Production

অপার্থিব সে যাত্রার শেষে ডেভ নিজেকে আবিষ্কার করেন একটি ঘরে। বারোক ফার্নিচারে সজ্জিত ঘরটির মেঝে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। সে ঘরে ডেভ নিজের বৃদ্ধ অবস্থাকে দেখতে পান। সেই বৃদ্ধ আবার দেখেন তার চেয়েও বৃদ্ধ ডেভ বিছানায় মৃত্যুর ক্ষণ গুণছেন। মৃত্যুর পূর্বে অতিবৃদ্ধ ডেভ ইশারা করেন মনোলিথের দিকে। সেই মনোলিথের চোখে যখন আমরা বৃদ্ধকে দেখি, দেখা যায়, বৃদ্ধটি পরিণত হয়েছেন একটি শিশুতে এবং তাকে ঘিরে রয়েছে আলোর বলয়।

শেষ দৃশ্যে সেই শিশুটি মহাকালের যাত্রায় প্রদক্ষিণ করতে থাকে পৃথিবীকে, যেন পৃথিবীর বুকে তার আগমন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

অনন্ত নক্ষত্রবীথির সন্তান; Credit: A Stanley Kubrick Production

সিনেমাটিকে বিশ্লেষণ করতে বেশ কিছু প্যাটার্ন লক্ষ্য করবো আমরা। সিনেমার শুরু হয়েছিলো দ্য ডন অফ ম্যান শিরোনামে, অর্থাৎ মানবজাতির জন্মলগ্ন। আমরা ঘুরে ফিরে দেখতে পাই, জন্মের বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ববহ করতে চেয়েছেন কুব্রিক। ফ্লয়েড চাঁদে যাওয়ার আগে তার মেয়েকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। ফ্র্যাঙ্ককে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে পৃথিবী থেকে ভিডিও বার্তা পাঠান তার বাবা-মা। ডেভ যখন হ্যালকে বন্ধ করে দিচ্ছিলেন, হ্যাল তখন তাকে তৈরির স্থান এবং সময় বলে যাচ্ছিলো। এবং শেষে ডেভ বোম্যানের নতুন জন্ম হয়, তিনি পরিণত হন স্টারবেবিতে।

সিনেমার শুরু এবং শেষ দৃশ্যপটের ঐকতান যেন মহাবিবর্তনের সুরে বাজে। যে মানুষের শুরু হয়েছিলো বানর হতে, ডেভ বোম্যানের স্টারবেবি হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসা তার পূর্ণতা দেয়। নতুন বিপ্লব সৃষ্টি করে নতুন প্রজন্মের মানুষ। এর প্রতিটি পদক্ষেপেই মানুষকে সাহায্য করে মনোলিথ।

বিছানায় অতিবৃদ্ধ ডেভ মনোলিথের দিকে ইশারা করে আছেন; Credit: A Stanley Kubrick Production

এখন মনোলিথকে বোঝার চেষ্টা করা যাক। মনোলিথ ১×৪×৯ অর্থাৎ ১^২ × ২^২ × ৩^২ পরিমাপের একটি কালো পাথর। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন উন্নত কোনো এলিয়েনদের তৈরি এই মনোলিথ। অ্যালিয়েনরা মানুষকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং তাদের অগ্রযাত্রাকে নিজেদের তরিকায় প্রভাবিত করতে মনোলিথকে ব্যবহার করেছিলো। মনোলিথকে আমরা ধরতে পারি ক্ষমতাশালী কোনো একক সত্ত্বা হিসেবে। মনোথিস্টিক বা একেশ্ববাদী ধর্মে সৃষ্টিকর্তার যে সর্বময় ক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়া হয়, আমরা মনোলিথকে তার প্রতিনিধি হিসেবেও ধরতে পারি।

সেট নির্মাণের বিষয়ে মৌন থাকলে কুব্রিকের উপর খুব অবিচার করা হবে। অনেকে বলেছিলেন, কুব্রিক সিনেমার নামে সেট তৈরি শিখিয়ে দিয়েছেন। কুব্রিক ফ্রন্ট প্রজেকশনের মাধ্যমে মহাকাশে ভাসতে থাকা স্পেসশিপের দৃশ্যগুলো করেছিলেন। আর সে দৃশ্যগুলোর সাথে তিনি মিউজিকের দুর্দান্ত উপস্থাপন করেছেন। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক ছিলো কুব্রিকের। কলেজ জীবনে একটি ব্যান্ডের ড্রামার ছিলেন। তার সেই শিল্পীরুচির প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই পুরো সিনেমাজুড়ে। প্রতিটি দৃশ্যে অন্তঃপ্রাণ হলো মিউজিক। মিনিমাল ডায়ালগের সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর দারুন আবহ তৈরি করে দেয়।

দৃষ্টিনন্দন আরেকটি পোস্টার; Credit: A Stanley Kubrick Production

সেট, মিউজিকের এই বিরাট আয়োজন কোনোটিই কিন্তু মনোযোগকে সরিয়ে দেয়নি মূল উপজীব্য হতে। বরং দর্শকের ক্ষুধা আরো বাড়িয়ে তুলেছে আগামীর প্রতি। অনেকের সমালোচনা, এতসব করতে গিয়ে কুব্রিক চরিত্রগুলোর প্রতি তেমন মনোযোগী হতে পারেননি। ফ্র্যাঙ্ক, ডেভ কিংবা ফ্লয়েড- কারো ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানতে পারিনি।

কুব্রিক এখানে একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন। প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির সাথে সাথে মানুষের অান্তঃসম্পর্কের চিড় আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি, এবং যতই দিন যাচ্ছে, ততই তা প্রটক হচ্ছে। কুব্রিক তা বুঝে নিয়েছিলেন তার সময়েই। তাই তিনি চরিত্রদের কথোপকথনে উষ্ণতার জায়গা রাখেননি, ব্যক্তিগত জীবনকে তিনি পর্দার আড়ালেই রেখে দিয়েছেন।

পোস্টারে স্টারবেবি; Credit: A Stanley Kubrick Production

শেষ দৃশ্যে আলোর বৃত্তে অন্তরীত হওয়া মহাজাগতিক শিশুটির মাধ্যমে কুব্রিক আরো একটি দারুন বার্তা দিয়ে গেছেন। সেই শিশুটি মানুষের পরবর্তী প্রজন্ম। অর্থাৎ, বর্তমান পৃথিবীর আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিসম্পন্ন, আধুনিক। কিন্তু তার মহাকাশের পথে বেরিয়ে পড়তে কোনো স্পেসশিপ বা পডের দরকার হয় না। প্রযুক্তির ব্যবহার যেন তার কাছে আধিক্য। সুতরাং, আমরা প্রযুক্তির উন্নতির পথে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারবো কেবলমাত্র প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত করে।

প্রিয় পাঠক, এতসব সিনেমা থিওরির বকবকানিতে যদি মাথাটা ভারি হয়ে আসে, তবে আর্থার সি ক্লার্কের একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করি। সিনেমার দুর্বোধ্যতা নিয়ে ক্লার্ক বলেছিলেন,

যদি কেউ সিনেমাটি পুরোপুরি বুঝতে পারে, তবে আমরা ব্যর্থ। আমরা যতটা না উত্তর দিয়েছি, তার চেয়ে বেশি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চেয়েছি।

ফিচার ছবি: A Stanley Kubrick Production

Related Articles