Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

৩০০০ নাইটস: কারাবন্দী ফিলিস্তিনি নারীর বিদ্রোহী হয়ে ওঠার গল্প

বৃষ্টিস্নাত রাতে পুলিশ জিপে চোখ বাঁধা, হাতে হ্যান্ডকাফ আর রক্তাক্ত মুখের বিক্ষিপ্ত কতগুলো ফ্রেম আলোছায়ার শেডে দেখিয়ে যাত্রারম্ভ শুরু হয় চলচ্চিত্র ৩০০০ নাইটস এর। পরিচালক মাই মাসরি একজন ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত জর্ডানী। মাসরির চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন আর শোষিতের করুণ হাহাকার। সে ধারাবাহিকতায় শোষণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা দেখা যায় এ চলচ্চিত্রেও। ব্যাকরণিক ভাষায় এমন ফিল্মকে মূলত সিনেমা অফ রেজিস্ট্যান্স বলে সম্বোধন করা হয়। সিনেমা ৩০০০ নাইটসের প্লট বিন্যস্ত হয়েছে নিপীড়নের শিকার ফিলিস্তিনি নারী লায়াল আসফুরের ইসরাইলী জেলে সন্তানপ্রসবের গল্প নিয়ে। মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার সদ্য বিবাহিতা নারীর জেল-জীবনের সংগ্রামী আখ্যান বলা যায়। যা মাসরি নির্মাণ করেছেন সত্য ঘটনা অবলম্বনে। এবং উৎসর্গও করেছেন বাস্তবের চরিত্রদেরকে।

প্রহসনমূলক বিচারে দীর্ঘ আট বছরের (প্রায় তিন হাজার দিন) সাজা ভোগ করতে হয় ফিলিস্তিনি লায়ালকে; Image Source: 3000 Nights Film

২০১৭ সালে অস্কারের ৮৯তম আসরে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে জর্ডানের অফিশিয়াল সাবমিশন ছিল ৩০০০ নাইটস। অবশ্য তার আগে এরাবিয়ান ছবিটির প্রিমিয়ার হয় ২০১৫ সালে টরোন্টো ফিল্ম ফেস্টিভালে। মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যা যে রাজনৈতিক সমস্যা দ্বারা প্রভাবিত সে দিকটিই উঠে আসে সিনেমায়। সেখানে ব্যক্তি-সমস্যা ছাপিয়ে জাতিগত সমস্যা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেলুলয়েডে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ওপর ইসরাইলের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং আদালতে অন্যায়ভাবে নিরীহ মানুষদের বিনা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টি খুব সাবলীলভাবে তুলে ধরা হয়। বাস্তবানুগ আবহ সৃষ্টিতে স্টুডিও সেট নয়, বরং জর্ডানের পরিত্যক্ত একটি জেলে শুটিংও সম্পন্ন করেন নির্মাতা। চমকপ্রদ আর্ট ডিরেকশনের কাজ রয়েছে ফিল্মে। জেলের অভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি বিষয়াদিকে ভারী যত্ন নিয়ে সাজানো হয়েছে। তৈজসপত্র, আসবাব এমনকি থালা বাসনেও যা লক্ষণীয়।

মিলিটারি কোর্টের নির্দেশ আসে, রাষ্ট্রদ্রোহী এক কিশোরকে সহায়তার জন্য ফিলিস্তিনি নারী লায়ালকে ৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। লায়াল ছাড়া অপরাপর পার্শ্বচরিত্রের মধ্যে জেলে সানা নামে একজন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীর দেখা মেলে যে কিনা পনের বছর ধরে বন্দি জীবনযাপন করছেন। আরেক বন্দি আসিম আলি আছেন যার বিদ্রোহী দুই ছেলে তাদের ঠিক পাশের পুরুষ কারাগারে বন্দি। কারাগারের বৈশিষ্ট্য চিত্রায়নে নির্মাতা দেখিয়েছেন যে, প্রকৃত অপরাধী এবং রাজনৈতিক বন্দিদের আলাদা আলাদা সেলে রাখা হয় বিধায় মহিলা কারাগারে ভিন্ন ভাষাভাষী (হিব্রু এবং আরবী) ধর্মীয় ও জাতিগত আদর্শের পার্থক্য দৃশ্যমান হলেও তারা পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জড়াতে পারে না। তবে কিছুক্ষেত্রে বিশেষভাবে কাউকে শায়েস্তা করতে চাইলে গার্ডরা আরবদের অত্যাচার করার জন্য হিব্রুদের উস্কে দেয়।

ফিলিস্তিনিদের (ছবিতে সম্মুখে বিদ্রোহী সানা) চিৎকারে বাতাস ভারী হয় কারা অভ্যন্তরে; Image Source: 3000 Nights Film

শুরুতে হামাসের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে লায়ালকে সাময়িকভাবে পাঠানো হয় ইসরাইলি অপরাধীদের সেলে। উক্ত সেলে মাদকাসক্ত শুলামিত ও জিভার অত্যাচার ও রুঢ় ব্যবহার সহ্য করতে হয় তাকে। একরকম জাতিগত বিদ্বেষী মনোভাব পরিলক্ষিত হয় শুলামিতের কথাবার্তা ও আচরণে। অন্যদিকে লায়াল চরিত্রে প্রথম থেকে নির্ভীক, সাহসী, অকুতোভয় নারীর প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন নির্মাতা মাসরি। তার সাহসিক ঔদ্ধত্য সহজে মেনে নিতে পারে না শাসকশ্রেণি তথা কারাপুলিশ সদস্যরা। এ থেকে অনুমেয়, জেলের অভ্যন্তরকেই প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের বর্তমান সংকটরূপে।

ফিলিস্তিনি লায়ালকে দেখামাত্র মাদকাসক্ত ইসরাইলী অপরাধী শুলামিতের ক্ষিপ্ত অগ্নিমূর্তি; Image Source: 3000 Nights Film

সদ্য বিবাহিতা লায়াল ও তার স্বামী ফরিদের পরিকল্পনা ছিল যুদ্ধ আক্রান্ত মাতৃভূমি ছেড়ে নিরাপদ ভবিষ্যতের সন্ধানে কানাডায় পাড়ি জমানোর। কিন্তু এর আগেই স্রেফ সন্দেহের বশে ইসরাইলি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে হয় স্ত্রীকে। অবশ্য আমরা তার কোনো ফ্ল্যাশব্যাক দেখি না। বরং জানতে পারি জেলে ফরিদ স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসার পরের কথোপকথন থেকে। ততদিনে জেল কর্তৃপক্ষ থেকে সন্তানসম্ভবা হবার খবর জানানো হয়। স্ত্রীর আট বছরের শাস্তির রায় শোনার পরেও ফরিদ স্বপ্ন দেখে বিদেশ বিভূঁইয়ের। কেননা, সে কানাডায় দেশান্তরী হবার সুবর্ণ সুযোগ হারাতে নারাজ।

You’re going to let me have the baby alone?
Do you really have a child in prison?
I’m having my baby, and that’s final
If you want to leave, go ahead

ফিলিস্তিনিদের বিদ্রোহী সত্তাকে নিবারণের জন্য নানা আয়োজন কারা পুলিশের; Image Source: 3000 Nights Film

ঘটনাপ্রবাহে ভুবন আলোকিত করে জন্ম হয় শিশুপুত্র নূরের। এতে ফিল্মের কাহিনিও নূরের আলোয় দেদীপ্যমান হয়। দ্বিতীয়ভাগে নির্মাতা মাসরি প্রায় প্রতি সিকুয়েন্সে ইসরাইল রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও স্বৈরাচারী মনোভাবের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সাজা ঘোষণায় সেল পরিবর্তন হয়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের সাথে থাকার সুযোগ হয় প্রটাগনিস্টের। সেখানে জাতিসত্তা অভিন্ন হওয়ায় বিভিন্ন বয়স আর চিন্তাধারার সবাই একত্রে মিলেমিশে থাকে। দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব জেলের ভেতরেও বিরাজমান দেখা যায়। ক্রমশই বিক্ষুব্ধ হতে থাকে বন্দিরা। একদিন তারা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে রীতিমত বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বন্দিদের এরূপ দৃঢ় ঐক্যে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। আন্দোলন ঠেকাতে সহিংস হয়ে উঠে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ। আর এভাবেই প্রতিবাদমুখর নারীদের দেশপ্রেম এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে চলচ্চিত্র ৩০০০ নাইটস চলচ্চিত্রের সীমানা পেরিয়ে হয়ে উঠে আরব বিশ্বের রাজনৈতিক প্যাম্ফলেট। যাতে কারাপ্রাচীর ভেদ করে দীপ্তকণ্ঠে ধ্বনিত হয়—

With our blood and souls,
we redeem you, Palestine.

কাকতালীয় এক ঘটনায় মাদকাসক্ত শুলামিত যেমন নিজের ভুল বুঝতে পেরে মানবিক হয়ে উঠে ফিলিস্তিনি শক্তির পক্ষে কাজ করে, বিপরীতে তেমনি রিহান নামের আরেক চরিত্র ব্যক্তি-সুবিধা আদায়ের জন্য কারা কর্তৃপক্ষের গুপ্তচর হয়ে স্বজাতির উপর নজরদারি করে। এই চরিত্রদ্বয়ের মাধ্যমে নির্মাতা স্বার্থান্বেষী মহল এবং বিবেকবান বন্ধুর কথাও আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ট্র্যাজেডি ধারার এ ছবিতে সামান্য হলেও হাস্যরসাত্মক কিছু সংলাপ ও আনন্দঘন মুহূর্ত আছে। বদলে যাওয়া শুলামিতের কণ্ঠে আরবি গান শুনে বড্ড বিরক্ত হয় হিব্রুভাষী জিভ। ক্ষোভ সংবরণ না করতে পেরে অবশেষে বলেই বসে— If I hear you singing those Arabic songs again, I will chop your tongue off.

তথ্য আদায়ে উপর্যুপরি পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় ফিলিস্তিনিদের ওপর; Image Source: 3000 Nights Film

যদিও এ চলচ্চিত্রের আবহসঙ্গীত কিছুটা সাদামাটা। ট্র্যাজেডি ফিল্মের যে চাহিদা সেই আবেদন যথাযথ পূরণ করতে পারেনি শারিফ সেহ্নাউই। ফলে দৃশ্যমান বর্বর নির্যাতন নিপীড়ন কাঙ্ক্ষিত অভিঘাত সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া মিলিটারি হসপিটালে কারাভোগী ফিলিস্তিনি ডাক্তার আয়মানের সাথে লায়ালের সম্পর্ক কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক লাগে না। বরং চলচ্চিত্রের স্পিরিটকে অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত করে। পক্ষান্তরে গিলস পোর্টের সিনেমাটোগ্রাফি বহুমুখী নান্দনিকতা প্রদর্শন করে। জেলের দেয়ালের পেছনে হাত রেখে মুক্ত পাখির ছায়ার অবয়ব তৈরি করা কিংবা বিক্ষোভকারীদের কাঁদুনে গ্যাসে নিভৃত করার দৃশ্যে নাটকীয়তা লক্ষ্য করা যায়। অনুরূপ ফ্রেমিং দ্বারা শেষ সিকুয়েন্সে খোলা আকাশে উড়তে যেয়ে ছাদের লোহার রডে আটকে পড়া পলিথিনে ভালো মেটাফরের সংযুক্তি ঘটে। পুরো সিনেমায় মিডশটের আধিক্য থাকায় গল্পের সাথে দর্শকের একাত্ম হওয়া সহজসাধ্য। যুগপৎ সাফল্য এসেছে মিচেল তায়ানের সম্পাদনার ব্যবচ্ছেদে। লায়ালের সন্তান জন্মদান দৃশ্যের নিষ্ঠুর অস্থিরতা বেড়েছে হাতকড়া পরা দেখানো কতগুলো ছন্দময় ফাস্টকাটে। আবার উক্ত দৃশ্যে রিদমিক মন্তাজের অনুপস্থিতি আক্ষেপও যুগিয়েছে।

সংগ্রামী মায়ের কোলে শিশুপুত্র নূর; Image Source: 3000 Nights Film

নারীবাদী দর্শনের ভিউপয়েন্ট থেকে এই ছবির কাহিনী ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। এককথায়— প্রহসনমূলক বিচার, অমানবিক সহিংস দমনমূলক আগ্রাসী আচরণ আর জাতিগত বৈষম্য চিত্রায়নে ৩০০০ নাইটস অনন্য চলচ্চিত্র। যা ফিকশন হলেও ডকুমেন্টারি নথির মতো করে দেখিয়েছে বক্তব্যের গভীরতা। সন্দেহাতীতাবেই রাজনীতি সচেতন চলচ্চিত্রপ্রেমীর জন্য দারুণ অর্থবহ হবে ফিল্মটি। কারণ চলচ্চিত্র যে নিছক বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং থার্ড সিনেমায় প্রতিবাদের শক্তিশালী ভাষা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, সেকথা বারবার স্মরণ করাবে জর্ডানের এ নির্মাণ।

Language: Bangla

Topic: This is a review of an Arabic/Hebrew drama film '3000 Nights' released in 2015.

Featured Image:  3000 Nights film.

Related Articles