Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

A Stranger in My Own Country: ‘৭১ নিয়ে এক পাকিস্তানি জেনারেলের স্বগতোক্তি

ইতিহাসের চর্চায় নিজেকে নির্মোহ রাখা খুব জরুরি। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বদা একাধিক পক্ষের লেখা বইসমূহকে গুরুত্ব দেয়া বাঞ্ছনীয়। বইটির শুরু এভাবে,

History, it is often said, ‘is written by victors’. In the case of East Pakistan, it has been written by the losers.

লেখক পাকিস্তানি বলে তার চিন্তা ভাবনা, কথা বলার ভঙ্গিমা ইত্যাদি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে লেখা। বইয়ের মুখবন্ধে জেনারেল ইয়াহিয়া খান, লে. জেনারেল নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, বিগ্রেডিয়ার সিদ্দিক সালিক প্রমুখকে পরাজিত শক্তির খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মেজর জেনারেল (অবঃ) খাদিম হোসেন রাজার মতে, তারা তাদের জাতিকে ভুল বার্তা দিয়েছেন। যুদ্ধের সে স্মৃতি থেকে বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে তিনি এখানে সব সত্য স্বীকার করেছেন। নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে, এ বইটি আসলে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে লেখকের ব্যক্তিগত চশমা দিয়ে অবলোকন করার চেষ্টা।

তিনি ১৯৭১ এর মার্চে রাও ফরমান আলির সমান র‍্যাংকে (তৎকালীন বিগ্রেডিয়ার) ডেপুটি মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন। অপারেশন সার্চলাইটের মাস্টারপ্ল্যানে রাও ফরমান আলীর সাথে তার ভূমিকা ছিল সমানে সমান। কিন্তু তাকে পরে পশ্চিমে বদলি করে ফেলা হয়, আর পরে টিক্কা খানকেও। টিক্কা খানের জায়গায় আসেন নিয়াজী ও খাদিম হোসেন রাজার স্থলাভিষিক্ত হন ফরমান আলী। উল্লেখ্য, যে লেখকের দায়িত্ব পালনকালে রাও ফরমান আলী সামরিক ও বেসামরিক সরকারের লিয়াজোঁ অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন।

 খাদিম হোসেন রাজার বই অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি; image source: goodreads

বইটিকে বর্ণনা করতে গেলে, একে ৩ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগ ‘৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে, পরের অংশ যুদ্ধকালীন, ও একদম শেষে লেখকের মূল্যায়ন। লেখকের নিজ উক্তি থেকেই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু কত বড় মাপের নেতা ছিলেন। ৬ দফা দাবিকে ১১ দফায় পরিণত করে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো হিসেবে তা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া, তৃণমূলে নিয়মিত যাতায়াত, এবং একইসাথে পাকিস্তানি মিলিটারি শাসকদের সাথে সাংবিধানিক সম্পর্ক চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। রাজা সাহেব ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন হবে। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থা, ও আমলারা ভুল তথ্য দিয়ে ইয়াহিয়া খানকে ভুল পথে চালিত করে। তাদের অনুমান ছিল, ওদিকে ভুট্টো আর এদিকে বঙ্গবন্ধু, কেউই কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন পাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা করে দেখিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুকে তার অধস্তনরা আওয়ামী লীগের অভাবনীয় জনসমর্থন দেখে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে গোয়েন্দা তথ্য ছিল খাদিম হোসেন রাজার কাছে। তার বক্তব্যমতে বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন স্বাধীনতার (তার ভাষায় বিচ্ছিন্নতা) ডাক দিতেন তাহলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক এনে পুরো জনসভা গুড়িয়ে দেয়ার মতো প্রস্তুতি ছিল তার। ইয়াহিয়া খানের গোয়েন্দারা, ও তার উপদেষ্টারা রাজা সাহেবের কথাকে অতটা আমলে নেননি। রাজা সাহেব তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বারবার পশ্চিম থেকে প্রেসিডেন্টের সরাসরি আগমনের ভিত্তিতে করণীয় ঠিক করতে বার্তা দিচ্ছিলেন। কিন্তু তার উক্তি থেকে এটা পরিষ্কার হয় যে, ইয়াহিয়া ভুল তথ্যকে বেশি প্রাধান্য দেন, ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান মিলিটারি কায়দায় সমাধানে উদ্যত ছিলেন।

Rao Farman Ali with Maj Gen Khadim Hussain Raja; Image: Dr. Ghulam Nabi Kazi/Flickr

পরে ২৫ মার্চ ভুট্টোকে সাথে আনতে আনতে জল অনেকদূর গড়িয়ে যায়। সকল পর্যায়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটে। বেশ সুনিপুণ পরিকল্পনা এঁটে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া, সারা অপারেশন সার্চলাইটের আপাত সাফল্য অর্জন হয়। বঙ্গবন্ধুকে (অপারেশন কোডনেম ময়না) আটক করে সাবজেলে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার (পরে স্বাধীন বাংলাদেশে লে. জেনারেল) বুদ্ধিদীপ্ত ভূমিকায় পাক বাহিনী বেশ মার খায়। তিনি চট্টগ্রামে কর্মচারীদের সামরিক রসদ খালাস বন্ধে সমর্থন দেন, ও দুজন পশ্চিমা ব্যক্তিসহ তার কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়াকে হত্যা করেন। কুমিল্লা থেকে আগমনের নির্দেশপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার ইকবাল শফিকে রাজা সাহেব প্রেরণ করেন। কিন্তু ততক্ষণে জিয়ার পরিকল্পনায় ব্রিজ ধ্বসিয়ে তাদের পথরুদ্ধ করা হয় ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।

রাজা সাহেব আরেকটি ভয় পেয়েছিলেন, যেটি বাস্তবায়ন হয়নি (হলে আরও ভালো হতো)। চট্টগ্রামে আনসার বাহিনীর সশস্ত্র ১ ব্যাটালিয়ন রিজার্ভ ফোর্স ছিল। তাদের কেউ বিদ্রোহ করতে উসকানি দেয়নি, যদিও সেখানে বেশিরভাগই বাঙালি ছিল। সেটি করলে হয়তো পরের দুদিনে জিয়াউর রহমান তার বাহিনী নিয়ে ভারতে এত দ্রুত পশ্চাদ্ধাবন করতেন না। উল্লেখ্য যে, ২৪ মার্চেও চট্টগ্রামের বর্ডার এলাকায় ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ইপিআর এ বিদ্রোহ হয়েছিল। বইয়ে সেটির কোনো উল্লেখ নেই। এছাড়া কুমিল্লায় মেজর খালেদ মোশাররফ জিয়ার মতোই সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। রক্তপাত ছাড়া তিনি তার পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসারকে গ্রেফতার করে ভারতে নিয়ে যান। বিজয়ের পরে সেই অফিসারকে পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।

একদম শেষ অধ্যায়ে তিনি তার মূল্যায়ন তুলে ধরেন। এটি নিয়ে ‘মুন্সিগঞ্জের খবর’ অনলাইন পত্রিকায় ২০১২ সালে প্রকাশিত তথ্যের আলোকে বলা যায়— মেজর জেনারেল খাদিমের ভাষ্য পাকিস্তানি বর্বরতার এক প্রামাণ্য দলিল। এক্ষেত্রে নিয়াজির নারী-লোলুপতা বিষয়ে খাদিমের উক্তিগুলো বইয়ে পাওয়া যাবে। খাদিম নিয়াজির দুটি উক্তি তুলে ধরেন, এবং এর সত্যতা হিসেবে উর্দুতে সেকথা লিখে ফুটনোটে ইংরেজি ভাষ্য দিয়েছেন। ১০ এপ্রিল মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা মেজর জেনারেল রহিম খানের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। সেদিন বিকেল চারটায় জিওসি ১৪ ডিভিশনের অপারেশন কক্ষে সামরিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা বৈঠক বসে। টিক্কা খান, নিয়াজিসহ অন্য সিনিয়র অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন, এবং সভার এক পর্যায়ে নিয়াজি মুখ খিস্তি ও গর্ব প্রকাশ করতে থাকেন। উর্দুতে বলেন, ‘ম্যায় ইয়ে হারামজাদে কৌমকি মাসাল বদল দু গা। ইয়ে মুঝে কিয়া সমঝতে হ্যায়’ (আমি এই জারজ জাতির চেহারা পাল্টে দেব। ওরা আমাকে কী মনে করেছে)। সেই ঘরে ছিল বাঙালি মেজর মুশতাক, যিনি খাদিম হোসেন রাজার অধীনে যশোরে পদায়িত ছিলেন। পরদিন জানা যায় এই বাঙালি অফিসার বাথরুমে পিস্তলের গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন।

পরদিন বিদায়ী সাক্ষাতের জন্য খাদিম হোসেন নিয়াজির দফতরে যান, এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে নবাগত জেনারেলকে অবহিত করবার জন্য একটি ম্যাপ ও রণকৌশল দেখাতে চান। নিয়াজি তার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘ইয়ার, লড়াই কি ফিকির নাহি কারো, উয়ো তো হাম কার লাই গে। আভি তো মুঝে বেঙ্গলি গার্ল-ফ্রেন্ডস কা ফোন নাম্বার দে দো।’ (আরে দোস্ত, যুদ্ধের প্রসঙ্গ বাদ দাও, সে তো আমি করে নেব। এখন আমাকে বাঙালি বান্ধবীদের ফোন নাম্বারগুলো দাও।)

লেখক স্পষ্টতই তার মূল্যায়নে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের সামরিক ও বেসামরিক উভয় পক্ষের ব্যর্থতাকে দুষেছেন। পাশাপাশি এক পাকিস্তানের প্রতি বাঙালি জাতির আনুগত্য নেই দেখে উষ্মা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। তার মতে পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি কেন্দ্রের কোন বৈষম্য ছিল না! তার ভাষায় বঙ্গবন্ধু ‘৭০ এর নির্বাচনের আগে দুর্যোগপূর্ণ ও ছোট একটি জনবহুল এলাকাকে মিথ্যা সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন। কী করলে পাকিস্তানের এ ভাঙন ঠেকানো যেত সেটা তুলে ধরাই ছিল তার প্রধান মূল্যায়ন। আর এ বইয়ের দ্বারা তিনি বিশ্বের কাছে তিনি তার সহকর্মীদের মুখোশ উন্মোচনের প্রয়াস চালিয়েছেন। 

বইয়ের নাম: A Stranger in My Own Country: East Pakistan 1969-71
লেখক: Khadim Hussain Raja
প্রথম প্রকাশ: ২০১২
গুডরিডস রেটিং: ৩.৭

Language: Bangla

Topic: This article is a review of the book 'A Stranger in My Own Country: East Pakistan, 1969-1971' by Khadim Hussain Raja.

Featured Image: Daily Star

Related Articles