Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আমরা হেঁটেছি যারা: প্রতীকী আত্মকথনে বাংলাদেশের অন্ধকার সময়ের এক অনবদ্য গল্প

মানুষকে দানবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, এটাই বড় কথা, সে বাঁচবে না মরবে সেটা বড় ব্যাপার নয়। সে যদি না দাঁড়ায়, সে যদি প্রতিবাদ না করে, তাহলে সে তার মনুষ্যত্বকেই অপমান করে। মানবতাকে পদদলিত করে।
– ইমতিয়ার শামীম 

তথাগত- যার নামের অর্থই নির্বাণপ্রাপ্ত এক ব্যক্তিকে বোঝায়, সেই তথাগত নামধারী এক যুবকের গল্প আমাদের শোনান লেখক ইমতিয়ার শামীম। তথাগত গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তার সেই মুক্তিযোদ্ধা বাবার কাছেই চাদা দাবি করে বসে রাতবাহিনী। রাতবাহিনীর হাত থেকে বাঁচাতে তৈরি করা হয় রক্ষকদল। কিন্তু এই রক্ষকদল বিনা খরচাপাতিতে কাউকে নিরাপত্তা দিতেও অক্ষম। তখন তথাগতের বাবা মশালবাহিনীতে যোগ দেয়া ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো রাস্তা দেখতে পান না।  

কিন্তু বাবার এহেন সিদ্ধান্তের ফলে রাতবাহিনী আর রক্ষকদলের রোষানলের পুরোটা এসে পড়ে তথাগত আর তার পরিবারের উপর। কেননা, তার বাবা ইতিমধ্যেই বাড়ি থেকে চলে গেছেন চাদার দাবী মেটানোর অক্ষমতায়। রাতবাহিনী ফিরে আসে আর তার বাবার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের বই পুড়িয়ে নিজেদের বিদ্রোহ প্রকাশ করে। এর পরপরই আসে রক্ষকদল। তারা নিজেদের রক্ষার কাজের প্রমাণ দেয় ঘরের হাঁস-মুরগি-বাছুরসহ সকল জিনিসপত্র বাগিয়ে নিয়ে। তথাগত তখনও হয়তো নিজের তরুণ বয়সের কোমলতাকে ত্যাগ করেনি। কিন্তু এক রাতের ঘটনার বিহ্বলতাই তাকে কেমন বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করে, এক নিমেষেই। 

অনেক অনেকদিন পরে, একদিন তথাগতের বাবা ফিরে আসেন মশালবাহিনী থেকে। দেয়ালে তার এখনও শেখ মুজিবেরই ছবি টাঙানো। কিন্তু তার আর ঘরে থাকা হয় না। হয় না সময় তথাগত আর ওর বোন মনীষাকে নিয়ে ভোরবেলা শিশির দেখতে যাওয়ার। জলপাইবাহিনী আসে, নিয়ে যায় তথাগতর বাবাকে। কেন যেন সবাই-ই টের পায়- এই যাওয়া হয়তো চিরতরের জন্য। তথাগত নিত্যদিনের জীবনে অভ্যস্ত হতে ফিরে যায় স্কুলের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে। কিন্তু সেখানে ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়ে গেছেন স্কুলের মৌলভি স্যার, ফতোয়া বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন তিনি।

কিন্তু এসবের কোনো কিছুই ভালো লাগে না তথাগতের। গ্রাম ছেড়ে চলে আসে শহরে। কিন্তু এ যেন ভিন্ন এক জগতে এসে প্রবেশ করে তথাগত। শহরে কিলবিল করে মানুষের ঝাঁক, আর সেসব ঝাঁকের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অসংখ্য বাহিনী। জলপাইবাহিনী, রগকাটা বাহিনী, ফতোয়া বাহিনী, পেঙ্গুইন বাহিনীসহ আরো কত কত বাহিনী। জলপাই বাহিনীর সামনে সলীল চৌধুরীর বিদ্রোহের গান গাওয়া নিষেধ; এদের সামনে মিছিল করা নিষেধ; অসাম্প্রদায়িক হতে চাওয়াটাও বারণ। 

Image Courtesy: Wazedur Rahman Wazed

জিরো পয়েন্টে এসে নূর হোসেনের প্রাণের বিনিময়ে গণতন্ত্র মুক্তি পায়। কিন্তু এই গণতন্ত্রের ভিড়েই গণতান্ত্রিক অধিকারের বুলি কপচিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে রগকাটা বাহিনী। খালকাটা দলের লোকেরা তখন মাথাচাড়া দিলে উঠলেও রগকাটাবাহিনীর কাছে ওদেরকে চুনোপুঁটিই মনে হয়। গণতন্ত্র আর বামপন্থী যেকোনো চিন্তাই টেনে নিয়ে আসে রগকাটা বাহিনীদের, চিন্তাকারীর হাত-পায়ের রগ কিংবা গলার রগ কাটতে। রগকাটা বাহিনীর পাশাপাশি নিজের ঈগল বাহিনী নিয়ে রঙের দুনিয়ায় টিকে থাকতে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দেন গোলাপি ম্যাডাম। তাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ বানায় পেঙ্গুইগল বাহিনী। এরকমই বাহিনী দিয়ে ভরে উঠতে শুরু করে শহর, নগর আর গ্রাম।

তথাগতের দম বন্ধ হয়ে আসে এতকিছুর ভিড়ে। হঠাৎ এক বৃষ্টিভেজা শীতল রাতে নিজের সৎ বোন মনীষাকে জড়িয়ে ধরার উষ্ণ শিহরণ খেলা করে তার ভেতরে। বাবার হাত ধরে ভোরবেলা শিশির মাখা ঘাসে হাঁটতে ইচ্ছে করে তার। মামুনের সঙ্গে রাতভর গল্প করতে ইচ্ছে করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন পরিচিত পাশ্চাত্য ঢঙের মারিয়ার সঙ্গে রিকশায় ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে। 

সর্বোপরি তথাগতের হাঁটতে ইচ্ছে করে। গ্রাম মাড়িয়ে, নগর পেড়িয়ে, শহর অতিক্রম করে তথাগত হেঁটে চলে। ইতিহাসের অলিগলি জুড়ে সে হেঁটে বেড়ায়। ইতিহাসের অন্ধকার গলির ল্যাম্পপোস্টগুলো ক্ষণিকের জন্য জ্বালিয়ে দেয় তথাগত। সেই আলোতে তথাগতের সঙ্গে নিজের ছায়া দেখে পাঠক।

মানুষ তো প্রত্যাশা নিয়ে সবকিছু করে না, করে নিজের মনুষ্যত্বকে শ্রদ্ধা করবার জন্য।
– ইমতিয়ার শামীম 

প্রচ্ছদপট থেকেই যাত্রা শুরু করে ইমতিয়ার শামীমের কালি-কলমে গড়া চরিত্র তথাগত। আর সেই তথাগতের সঙ্গে হেঁটে চলে পাঠকসমাজ এবং স্বয়ং বাংলাদেশ। আর তাই হয়তো বইয়ের নামটাও হয়েছে তেমনইভাবে আমরা হেঁটেছি যারা শিরোনামে। শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাসের মৃত্যুর আগে  কবিতার প্রথম বাক্যই ‘আমরা হেঁটেছি যারা’। পেন্ডুলাম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ইমতিয়ার শামীম রচিত এই উপন্যাসটি প্রকাশ পেয়েছে ২০২০ সালে অমর একুশে বইমেলায়। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। রঙিন আর সাদা-কালো দুনিয়ার মিশ্রিত প্রতীকী সেই প্রচ্ছদে ইমতিয়ার শামীমের গল্পের ভাব অনেকটাই ফুটে উঠেছে। 

Image Courtesy: Wazedur Rahman Wazed

উন্নতমানের পেপারব্যাক ফরম্যাটে করা বইটি অনেকটাই পকেটবুক আকৃতির। যে জন্য যেকোনো স্থানে যখন-তখন চাইলেই বসে পড়া যাবে। আর ছোট আকৃতির হওয়ায় সহজেই বহনযোগ্য। পেপারব্যাকের হিসেবে কাগজের মান ছিল বেশ ভালো। লেখার ফন্ট ছোট হওয়াতে শুরুতে খানিকটা বিরক্ত লাগলেও সয়ে যাওয়ার মতোই তা। তাই সর্বদিক বিচারে পেপারব্যাক হওয়া সত্ত্বেও বইয়ের আউটলুক যেমন ভালো, তেমনই পড়তে আরাম। 

নদীর একই পানিতে মানুষ দুইবার ডুব দিতে পারে না, সাঁতরাতে পারে না।
– ইমতিয়ার শামীম। 

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সূর্যের আলোয় স্বাধীনতা লাভ করলেও, শুরুর দশকের যাত্রাই ছিল অন্ধকার যুগে পদার্পণের মধ্য দিয়ে। সেই অন্ধকার যুগে একে একে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল অসংখ্য বাহিনী। সেসব বাহিনীর দাপটে সবাই-ই সব হারায়। কেবল বেঁচে থাকে অন্ধ, বোবা আর বধির হয়ে। হঠাৎ হঠাৎ সেই অন্ধকার দূরে ঠেলে গণতন্ত্রের আলো খানিকটা উঁকি দেয় বটে। কিন্তু ঘনকালো অন্ধকারকে হার মানাতে বারংবার ব্যর্থ হয় আলো। 

সত্তরের দশকটা বাংলাদেশের সার্বিক ইতিহাসে এক কালো বা অন্ধকার অধ্যায় বলেই ব্যাপক পরিচিত। কেননা, যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থার ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ সেই সময়ে অস্থির আর এক নোংরা রাজনীতির উত্থান হয়েছিল। নাগরিকদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আর স্বাধীনতার তকমা গায়ে লাগিয়েও পরাধীনতার শেকলে বন্দী জীবনযাপন প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হচ্ছিল সূর্যের ঝকমকে আলোর মতোই। 

কিন্তু এই ঝকমকে সূর্যের আলোর আড়ালে যে অন্ধকারের রাজত্ব ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল সেই গল্পও কেউ কখনো করে না। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সাধারণ জনগণ থেকে অসাধারণের খেতাবপ্রাপ্ত শিল্পীসমাজও এই সময়কে এড়িয়ে চলে। সেটা কি জাতির লজ্জাজনক অধ্যায়ের জন্য নাকি কেবলই পেছনে ফেলে এগিয়ে চলার প্রয়াস তা মোটেও স্পষ্ট করে না কেউই। 

Image Courtesy: Wazedur Rahman Wazed

দেশকে স্বাধীন করার পেছনে থাকা মানুষগুলোকে একে একে বরণ করে নিতে হয় নৃশংস মৃত্যু। হোক তা জেলের মধ্যে কিংবা প্রকাশ্যে সপরিবারে অথবা রাজনীতির ঘুঁটিতে পরিণত হয়ে। অবহেলিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু কেউই আগ বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে সাহস পায় না। সবকিছু ঘটে চোখের সামনেই, কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা ইতিমধ্যেই ভুলে গেছে সবাই। উটপাখির মতো মাটিতে গুঁজে চলার অভ্যাস গড়ে নেয় সকলে। যারা মাথা গোঁজারও জায়গা পায় না তারা সকলের মাঝে দিয়ে হেঁটে চলে অজানায়। 

মূল গাছ মরে গেলে ছায়াও মরে যায় একই সঙ্গে, তখন আর সেই ছায়া খুঁজে পাওয়া যায় না।
– ইমতিয়ার শামীম 

গল্পকার, প্রাবন্ধিক এবং ঔপন্যাসিক ইমতিয়ার শামীমের জন্ম ১৯৬৫ সালে সিরাজগঞ্জে। পৈতৃক নিবাসে থেকেই কলেজ জীবন শেষ করেন তিনি। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। কর্মজীবনে জড়িত আছেন সাংবাদিকতায়। বর্তমানে দৈনিক সমকাল পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। 

উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, প্রবন্ধ এবং শিশুতোষ সাহিত্য মিলিয়ে তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৪টি। ২০১২ সালে পান আখতারুজ্জামান কথাসাহিত্য পুরষ্কার তার রচিত মৃত্যুগন্ধী বিকেলে সুশীল সঙ্গীতানুষ্ঠান বইয়ের জন্যে। ২০১৪ সালে জীবনানন্দ সাহিত্য পুরষ্কার  পান সাহিত্যে অবদান রাখার সুবাদে। ২০১৬ সালে প্রথম আলোর বর্ষসেরা বই হিসেবে নির্বাচিত হয় তার রচিত গল্পগ্রন্থ শীতের জ্যোৎসাজ্বলা বৃষ্টিরাতে । আর সর্বশেষ ২৫ জানুয়ারি ২০২১ সালে কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য বহুল প্রতীক্ষিত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার অর্জন করলেন তিনি। 

Image Source: facebook.com/imtiar.shamim

মানুষ কেন যে এখনও এই কথাটা সরাসরি স্বীকার করে না সারাজীবন এই যে সে সংসার করে, সংসারের ঘানি টানে, প্রজননক্ষমতা জাহির করে, ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজনকে ঘিরে স্নেহমায়ার ভাবালু আচরণ তৈরি করে ভালোমানুষের সার্টিফিকেট নেয়ার চেষ্টা করে তা আসলে তার নিঃসঙ্গতা দূর করার প্রাণান্তকর চেষ্টা।
– ইমতিয়ার শামীম 

প্রতিটি লেখকেরই নিজস্বতা রয়েছে। রয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর লেখনশৈলীর মৌলিকত্ব। এসব দিক থেকে একদমই অনন্য ইমতিয়ার শামীম আর তার লেখকসত্তা। কথার জালে শব্দ বুনে বাক্যের মালা জপেন তিনি। তার অতি যত্নে গড়া বাক্যের বুননে সাহিত্যিক ভাবনা খেলা করে পাঠকের মনে। 

ভুলভ্রান্তির কথা বলতে গেলে তা কেবলই শব্দগত ভুল আর অপ্রাসঙ্গিক বিষয়েই সীমাবদ্ধ। কেননা, প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ভিত্তি এতটাই প্রাসঙ্গিকভাবে ফুটে উঠেছে গল্পে যে তা নিয়ে দ্বিতীয় উচ্চবাক্য করার কোনো সুযোগ রাখেননি লেখক। মূল কথা হচ্ছে, এমন লেখনশৈলীর কাছে আসলে অনেক ভুলত্রুটি নির্দ্বিধায় উবে যায়। পাঠকের বিভ্রান্তি বা বিরক্তি পরিণত হয় ভাষা প্রয়োগের জাদুময়তার এক অমোঘ লাগা ঘোরে।

লেখক কখন বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতের দিকে নিয়ে যান পাঠককে, তা পাঠকের কাছে মুশকিল আর তাজ্জব ঠেকে। আবার একইসঙ্গে, হুট করে কখন ভবিষ্যতে এসে দাঁড় করান; তা-ও অনুমান করার শক্তি পাঠকের থাকে না। লেখক ঠিক কোন কালে কিংবা কোন সময়বিন্দুতে দাঁড়িয়ে গল্পের শুরু করেছেন বা বলেছেন কিংবা শেষ করেছেন তা এক রহস্যই রয়ে যায় পাঠকের কাছে। কিন্তু গ্রন্থ শেষে পাঠকের এটাও মনে হয়- লেখক তো ঠিকই নিজস্ব ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন, হোক তা সময়ের তালে কিংবা লেখনীর ধারে। 

Image Courtesy: Wazedur Rahman Wazed

ইমতিয়ার শামীম রক্ষীবাহিনীর লোকেদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে হাঁটতে বলেন তথাগতকে। সেই হাঁটা চক্রাকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। শিশির ভেজা মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলে তথাগত। কখনো বাবার তর্জনী ধরে, কখনো মনীষার হাত ধরে। কখনো বা স্বয়ং ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে। তখন রাজাকার, মুজিব বাহিনী, রাত বাহিনী, লাল বাহিনী, গণ বাহিনী, জলপাই-রগকাটা-ঈগল-পেঙ্গুঈগল বাহিনীও চলতে থাকে তথাগতের সঙ্গে সমানতালে। ডান-বাম, ডান-বাম করতে করতে মার্চপাস্ট করে এগিয়ে চলে সকলে। তবুও থামে না তথাগতের হাঁটা। 

তথাগত হেঁটে চলে। একসময় ইমতিয়ার শামীমের পায়ে খিল ধরে। তথাগতকে হাঁটতে দিয়ে থেমে যান তিনি নিজে। তথাগতও থেমে যায় হয়তো একসময়। কিন্তু শিখিয়ে দিয়ে যায় পাঠকদের হাঁটা। পাঠক হাঁটতে থাকে। আমরা হাঁটতে থাকি। আমাদের হাঁটা নিয়ে জীবনানন্দের কবিতার পঙক্তি ধার করে কেউ লিখে ফেলে আস্ত এক উপন্যাস। সেই উপন্যাসের খোঁজ মেলে ইতিহাসের গলি-ঘুপচিতে। কেননা, অন্ধকার সময়ের গল্প অন্ধকারেই রয়ে যায়। আর আমরা আলোর পথিক! তথাগতের মতো হেঁটে চলি। তবুও আমরা হেঁটে চলি। 

আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষসন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপ দাঁড়ায়েছে চাঁদ – কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত- রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের’পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার;
পুরানো পেঁচার ঘ্রাণ;- অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ,- মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে – ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এইসব নিভৃত কুহক;

বইয়ের বাছাইকৃত কিছু উক্তি

মানুষ নির্বোধ ও জ্ঞানমূন্য অবস্থায় জন্ম নিলেও তাকে বহন করতে হয় তার পূর্বপুরুষের পরিচয়ের বোঝা, যাবতীয় সামাজিক ঋণ, লোকনিন্দা, পারিবারিক অবস্থানের সরল ও বক্ররেখা। কোন এক নিরীহ ভেড়া এসে নেকড়ের এই ঘাটের জল ঘোলা করে রেখে গেছে, – আমাকে তার দায় বইতে হবেই।
– ইমতিয়ার শামীম 

প্রকৃতির কাছ থেকে তুমি কত কিছু নিচ্ছ; প্রকৃতি কিন্তু চায় তার বিনিময়ে তুমি তাকে খানিকটা সময় দেবে, তার দিকে একটু সময় চেয়ে থাকবে, স্তব্ধতার ভাষায় কথা বলবে। নয়তো দেখবে তোমার সৃজনশীলতা ভোঁতা হয়ে গেছে, সঙ্গীতের সুর কর্কশ হয়ে গেছে, ভাষার চৈতন্য হারিয়ে গেছে। এমনকি তোমার শ্রবণের শক্তি উধাও হয়ে গেছে, বোধগম্যতার পরিধি সংকীর্ণ হয়ে গেছে, শ্রুতির মন্দ্রমুখরতা বিলোপ হয়ে গেছে।
– ইমতিয়ার শামীম 

দেখবে হৃদয় যেরকম সম্পর্ক দাবি করে সমাজ সেরকম সম্পর্ক না-ও চাইতে পারে। রাজনীতি যেরকম আচরণ প্রত্যাশা করে নৈতিকতার ধারণা সেরকম আচরণ অনুমোদন নাও করতে পারে। এ বড় জটিল কাজ দুয়ের মধ্যে মিলিয়ে চলা, হয় তোমাকে সমাজের সঙ্গে নিজের হৃদয় মিলিয়ে দিতে হবে, নয় আমৃত্যু তোমার হৃদয়বৃত্তির পক্ষে যেরকম সমাজ প্রত্যাশা কর, তার জন্যে সংগ্রাম করে যেতে হবে। এর মাঝামাঝি কোনো পথ নেই। এর মাঝামাঝি পথে থাকে পলাতকেরা। তারা বিদ্রোহ করে না, বিদ্রোহীদের পূজা করে। আবার অন্যায়কারীদের সামনেও নত হয়ে থাকে।
– ইমতিয়ার শামীম  

ধর্ষণগাথাই আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ গাঁথা। বলাৎকার করে নিজেদের রক্তকে প্রবাহমান রেখেছে এদেশে আর্যসকল, তাদের পথ ধরে ধর্মানুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে ধর্মপ্রচারকেরা, সেই দো-আশলা নারীই আবার অপছন্দনীয় হয়ে উঠেছে শাসক ইংরেজের বিদেশবিঁভূইয়ের নিরামিশী জীবনে, তারপর শুদ্ধাচারী মুসলমান বানানোর জন্যে আমাদের ধর্ষণ করে গেছে পাকিস্তানি হায়েনারা; আর বছরের পর বছর চোখের সামনে দেখতে দেখতে এখন সেই ধর্ষণ আমাদের এত বেশি মজ্জাগত হয়ে গেছে, এত বেশি অনুশীলন আর চর্চার বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে আমরা অনায়াসে ধর্ষণে মত্ত হতে পারি, ধর্ষণের শততম ঘটনা উদযাপন করতে পারি।
– ইমতিয়ার শামীম 

বই: ডানাকাটা হিমের ভেতর
লেখক: ইমতিয়ার শামীম
প্রকাশনী: পেন্ডুলাম পাবলিশার্স 
প্রচ্ছদশিল্পী: রাজিব দত্ত
মলাট মূল্য: ২৫০/-

This article is in the Bengali language. This is a review of a Bangladeshi novel named Amra Hetechi Jara by Imtiar Shamim. 

Necessary references have been hyperlinked inside the article. 

Feature Image: Wazedur Rahman Wazed

Related Articles