Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একটি গুমের ব্যবচ্ছেদ: বাবা হারানো এক কিশোরের উপাখ্যান

“কিছু কিছু সময় আসে, যখন বাবার অনুপস্থিতিকে আমার বুকের উপর বসে থাকা শিশুর মতো ভারী বলে মনে হয়” – হিশাম মাতারের ‘অ্যানাটমি অব এ ডিজ্যাপিয়ারেন্স’ উপন্যাসের শুরু হয়েছে এই বাক্যটি দিয়ে। উপন্যাসের কাহিনী যতই এগিয়ে যেতে থাকে, লেখকের বিষাদময় বর্ণনার মধ্য দিয়ে তার একাকীত্ব ততই স্পর্শ করতে থাকে পাঠককেও। নূরি নামের এক ১২ বছর বয়সী কিশোরের বাবা হারানোর বেদনাময় স্মৃতি হিশাম মাতার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন এই উপন্যাসে।

অবশ্য পারাটাই স্বাভাবিক। কারণ নূরির বাবার রহস্যজনকভাবে গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি নিছকই কাল্পনিক না। হিশাম মাতার নিজে যখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রেখেছিলেন, তখন তার নিজের বাবাও গুম হয়ে গিয়েছিলেন রহস্যজনকভাবে। উপন্যাসটি যদিও সম্পূর্ণ আত্মজীবনীমূলক না, কিন্তু এর কাহিনীর কাল্পনিক অংশগুলোর আড়ালে লেখকের নিজের বেদনাময় অনুভূতিগুলোই ফুটে উঠেছে।

ঔপন্যাসিক হিশাম মাতার; Image Source: Pearl Pirie/ Flickr

হিশাম মাতার একজন পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্ত লিবিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-আমেরিকান ঔপন্যাসিক। তার বাবা জাবাল্লা মাতার ছিলেন লিবিয়ান সেনাবাহিনীর একজন কর্ণেল। ১৯৬৯ সালে যখন রাজা ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করে গাদ্দাফী লিবিয়ার ক্ষমতা দখল করেন, জাবাল্লা মাতার তখন লন্ডনের লিবিয়ান দূতাবাসে ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি এজেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গাদ্দাফীর অভ্যুত্থানের পর অন্য অনেকের সাথে তাকেও লিবিয়ায় ফিরিয়ে এনে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি মুক্তি পান এবং জাতিসংঘে লিবিয়ার প্রতিনিধি দলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান।

জাবাল্লা মাতার যখন জাতিসংঘে কর্মরত, তখনই ১৯৭০ সালে নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন হিশাম মাতার। প্রথম কয়েক বছর গাদ্দাফীর সরকারের অধীনে চাকরি করলেও গাদ্দাফীর ক্রমেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নীতি জাবাল্লা মাতারের পছন্দ ছিল না। ফলে ১৯৭৩ সালে তিনি পদত্যাগ করেন এবং ব্যবসায়ী হিসেবে জীবন যাপন শুরু করেন।

কিন্তু তার পদত্যাগকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে লিবিয়ার সরকার। ১৯৭৯ সালে জাবাল্লা মাতার যখন বুঝতে পারেন অন্য অনেক সন্দেহভাজন সরকার বিরোধী কর্মীর মতো তাকেও গ্রেপ্তার কিংবা গুপ্তহত্যা করা হতে পারে, তখন তিনি সপরিবারে দেশ ত্যাগ করেন এবং মিসরে স্বেচ্ছা নির্বাসনে বসবাস করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি গাদ্দাফী বিরোধী প্রবাসী লিবিয়ানদের সংগঠন ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর দ্য স্যালভেশন অব লিবিয়া’র গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা হয়ে ওঠেন।

গুম হয়ে যাওয়া জাবাল্লা মাতার; Image Source: englishpen.org

আশির দশক জুড়ে গাদ্দাফীর সিকিউরিটি এজেন্টরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক রাজনৈতিক সমালোচক এবং ভিন্ন মতাবলম্বীকে অপহরণ করে, অনেককে হত্যা করে, অনেককে সেসব দেশের সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে আনে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে জাবাল্লা মাতার মিসর থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।

ধারণা করা হয়, মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে আটক করে লিবিয়ার কাছে হস্তান্তর করে। যদিও জাবাল্লা মাতারের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, কিন্তু একটি চিঠির সূত্র ধরে সন্দেহ করা হয় লিবিয়াতে তার স্থান হয়েছিল ত্রিপলীর কুখ্যাত আবু সেলিম কারাগারে, যেখানে তাকে টর্চার বরা হয় এবং শেষে হয়ত হত্যা করা হয়।

হিশাম মাতারের সাহিত্যকর্মের উপর তার বাবার এই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে বেড়ে উঠা হিশাম মাতার এ পর্যন্ত তিনটি উপন্যাস লিখেছেন এবং তার তিনটি উপন্যাসের কাহিনীই আবর্তিত হয়েছে প্রধান চরিত্রের বাবার নিখোঁজ হওয়াকে কেন্দ্র করে। তার ‘অ্যানাটমি অব এ ডিজ্যাপিয়ারেন্স’ উপন্যাসটিও এর ব্যতিক্রম না।

উপন্যাসটির মূল চরিত্র নূরি আল-আলফি পাশা, যে দীর্ঘদিন পর তার কৈশোরের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনা করে। এই নূরির মধ্যেই লেখকের নিজের এবং নূরির বাবা কামাল আল-আলফি পাশার মধ্যে জাবাল্লা মাতারের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়।

অ্যানাটমি অব এ ডিজ্যাপিয়ারেন্স উপন্যাসের প্রচ্ছদ; Image Source: Amazon

উপন্যাসে নূরির বাবা কামাল পাশা ছিলেন ‘একটি দেশের’ রাজতন্ত্রের অর্থমন্ত্রী। বিপ্লবীরা ক্ষমতা দখল করে রাজাকে প্রকাশ্য জনসভায় হত্যা করার পর যিনি প্রথমে সপরিবারে ফ্রান্সে এবং পরে মিসরে পালিয়ে যান। নূরির মা ছিল অসুস্থ, তাই ছোট থেকেই নূরি বড় হয়ে উঠেন নাঈমা নামে এক মিসরীয় পরিচারিকার হাতে। নূরির বয়স যখন ৮ বছর, তখন তার মা মারা গেলে নাঈমাই হয়ে উঠেন তার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু ঘটনা নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করে, যখন তাদের জীবনে প্রবেশ করে মোনা নামে নতুন এক সুন্দরী নারী, যার উপর একইসাথে প্রেমে পড়ে তার চেয়ে ১৪ বছরের ছোট কিশোর নূরি পাশা এবং ১৫ বছরের বড় প্রৌঢ় কামাল পাশা।

কামাল পাশার সাথে একসময় মোনার বিয়ে হয়। কিন্তু কিশোর নূরির ভালোবাসা তাতে ছেদ পড়ে না। তাদের এ জটিল সম্পর্ক শেষপর্যন্ত কোথায় যেত, বলা মুশকিল। কিন্তু এরমধ্যেই একদিন হঠাৎ করে গুম হয়ে যান কামাল পাশা। বাস্তবের মতোই উপন্যাসেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়, কামাল পাশাকে তার দেশের সরকারের এজেন্টরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। শুরু হয় মোনা এবং নূরির নতুন জীবন। তারা দুজনে মিলে খুঁজতে থাকেন কামাল পাশাকে। সময়ের সাথে সাথে উন্মোচিত হতে থাকে কামাল পাশার, তার স্ত্রীর, নূরির এবং নাঈমার জীবনের গোপন অধ্যায়গুলো।

অ্যানাটমি অফ এ ডিজ্যাপিয়ারেন্স উপন্যাসের বিকল্প প্রচ্ছদ; Image Source: Amazon

হিশাম মাতার নিজে লিবিয়ান হলেও এবং উপন্যাসের ঘটনার সাথে তার জীবনের কিছুটা মিল থাকলেও উপন্যাসে নূরির পরিবারকে লিবিয়ান হিসেবে দেখানো হয়নি। তাদের দেশটিকে সবসময় ‘একটি দেশ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যে দেশটির নাম একবারও উচ্চারণ করা হয়নি। তবে কিছু কিছু সূত্র থেকে দেশটিকে ইরাক বলে ধারণা করা যায়। সম্ভবত উপন্যাসটি যে হুবহু সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত না, সেটি বোঝানোর জন্যই লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে এই পার্থক্যটি তৈরি করেছেন।

হিশাম মাতারের কাব্যিক বর্ণনা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার চমৎকার শৈল্পিক উপস্থাপনা পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপন্যাসটির পাতায় আটকে রাখে। কিন্তু উপন্যাসের কাহিনীর সমাপ্তি নিয়ে পাঠকের মনে একটু অসন্তোষ থেকে যেতেই পারে। নূরির প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে যে টুইস্টটি উপন্যাসের শেষে দেওয়া হয়েছে, সেটি মনোযোগী পাঠক পঞ্চম অধ্যায়েই ধরে ফেলতে পারবেন, ফলে শেষের চমকটি আর সেই অর্থে চমক থাকবে না। এছাড়াও লেখক কিছুটা অস্পষ্টতাও রেখে দিয়েছেন, যার ফলে উপন্যাসটি পড়ার সময় অসাধারণ মনে হলেও শেষে পাঠকের মনে হয়ত কিছুটা অতৃপ্তি থেকে যেতে পারে।

হিশাম মাতার; Image Source: libyanexpress.com

হিশাম মাতারের তিনটি উপন্যাসের মধ্যে অ্যানাটমি অব এ ডিজ্যাপিয়ারেন্স তুলনামূলকভাবে একটু কম পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। গুডরিডস-এ প্রায় ২,৪০০ পাঠক বইটিকে ৩.৪৪ রেটিং দিয়েছেন। অন্যদিকে অ্যামাজনে ৩৯ জনের রিভিউতে এর গড় রেটিং এসেছে ৩.৬। তবে সমালোচকরা বইটির বেশ প্রশংসা করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, এটি একটি শিহরণ জাগানো উপন্যাস, যা অত্যন্ত চমৎকারভাবে লেখা এবং যার কাহিনী মনস্তাত্ত্বিকভাবে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, এটি হচ্ছে উপলব্ধি, কুশলী রূপক এবং খুঁটিনাটি বর্ণনার অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুক্তা দিয়ে খচিত একটি উপন্যাস।

অ্যানাটমি অব এ ডিজ্যাপিয়ারেন্স উপন্যাসটি ২০১১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় পেনঙ্গুইন বুকসের মালিকানাধীন ভাইকিং প্রেস থেকে। ২২৪ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি এ পর্যন্ত বিশ্বের ২৮টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট, দ্য টেলিগ্রাফসহ প্রথম সারির অনেক পত্রিকা বইটিকে বছরের অন্যতম সেরা উপন্যাস হিসেবে উল্লেখ করেছে। মানবিক সম্পর্কের উপন্যাস পড়তে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য উপন্যাসটি অবশ্যপাঠ্য।

This article is in Bangla language.

It's a review of the novel 'Anatomy of a disappearance' by Hisham Matar.

For references please check the hyperlinked texts inside.

Related Articles