'সত্যজিৎ রায়'; নামের মাঝেই রয়েছে এক অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা। 'পথের পাঁচালী' আর 'অপরাজিত'-এর পর তিনি আর কোনো সিকুয়েলের কথা তখনও ভাবেননি। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় তার ‘পরশ পাথর’ আর ‘জলসাঘর’ সিনেমা দুটো। এর মাঝেই তিনি ‘অপুর সংসার’ সিনেমাটিরও পরিকল্পনা তৈরি করেন।
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাতে নিয়মিত অভিনেতা হিসেবে আগমনের আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতেন। সৌমিত্রের একজন বন্ধুর বন্ধু ছিলেন নিত্যানন্দ দত্ত, যিনি ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সহকারী। 'অপরাজিত' সিনেমার কাস্টিং খোঁজা হচ্ছিল তখন। সেই নিত্যানন্দ দত্তই কফি হাউজ থেকে সৌমিত্রকে নিয়ে গেলেন লেক এভিনিউতে। সৌমিত্রকে দেখেই সত্যজিৎ রায় বলে উঠেছিলেন, "ওহো! আপনি যে বড় লম্বা হয়ে গেলেন!"
সত্যজিৎ রায়ের কাস্টিং সম্পর্কে নিজস্ব একটা ভাবনা ছিল। তিনি স্ক্রিপ্ট তৈরির সময়ই চরিত্রের একটা ধারণা গড়ে তুলতেন আর সেই অনুযায়ী কাস্টিং ঠিক করতেন। নতুনদের নিয়ে কাজ করবার ব্যাপারে তিনি সবসময়ই এগিয়ে ছিলেন।
'অপরাজিত'-এর কিশোর অপুর জন্য সৌমিত্র লম্বা হয়ে যাওয়ায় সে যাত্রায় আর অপু হওয়া হলো না সৌমিত্রের। এরপর সত্যজিৎ রায় শুটিং দেখার জন্য ‘পরশ পাথর’ এবং 'জলসা ঘর'-এর সেটে ডাকেন সৌমিত্রকে। 'জলসা ঘর'-এর সেটে শুটিং দেখতে দেখতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাজের সময় হয়ে গেলে সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে যান তিনি। এসময় তিনি সৌমিত্রকে বললেন, “এসো, ছবি বিশ্বাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।” ছবি বিশ্বাসের সাথে পরিচয় করানোর সময় সত্যজিৎ রায় বলেন, “ছবি দা, এই হচ্ছে আমার অপুর সংসারের অপু!” এভাবেই সৌমিত্র জানতে পারেন তাকে সত্যজিৎ রায় অপুর চরিত্রে বেছে নিয়েছেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের মেয়ে শর্মিলা ঠাকুর কেবল স্কুলে পড়তেন। যখন অপুর সংসারের জন্য অভিনেত্রী খোঁজা হচ্ছিল, তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর। চলচ্চিত্রে কাজ করাটা তখন খুব একটা ভাল চোখে দেখা হতো না। তবে সত্যজিতের বিষয়টা আলাদা ছিল। সবাই তার কাজকে সম্মানের চোখে দেখত। তিনি শর্মিলা ঠাকুরের বাবাকে ফোন দিয়ে বাড়িতে আসেন, কথা বলেন। এরপর স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে শাড়ি পরিয়ে সবদিক থেকে ছবি তুললেন। এভাবেই অপুর সংসারের অপর্ণার চরিত্রে নির্বাচন করা হলো শর্মিলা ঠাকুরকে। অপর্ণার বিয়ের পর প্রথম ঘরে প্রবেশের দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় তার অভিনয় জীবন।
১৯৫৮ সালের ৯ আগস্ট ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শুটিংয়ের প্রথম দিন। প্রথম দৃশ্য ছিল অপুর চাকরি খোঁজার জন্য একটা মেশিন ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার, প্রথম শটই ছিল 'ওকে'। সেই থেকে সৌমিত্র বুঝতে পারেন, তিনি এই কাজই বাকি জীবন করে যেতে চান। সত্যজিৎ রায় নিজে প্রতিটি দৃশ্য বুঝিয়ে দিতেন, কিন্তু তিনি কখনও অতিরিক্ত খবরদারি করতেন না। স্বাভাবিকভাবে একজন অভিনয়শিল্পীর কাছ থেকে যতটা বের করে আনা যায়, ঠিক ততটুকুই বুঝিয়ে দিতেন।
'অপুর সংসার' এর কাহিনী বিভূতিভূষণের লেখা ‘অপরাজিত’ থেকে একেবারে ভিন্ন প্রবাহে এগিয়েছে, এবং মূল গল্পের সাথে সিনেমার কাহিনীর সেরকম কোনো সংযোগ নেই বললেই চলে। সত্যজিৎ রায় নিজের মতো করে গল্প সাজিয়েছিলেন। সিনেমার শুরুতেই দেখা যায়, কলেজ পাশ করা অপুকে, যে কাজের সন্ধানে আছে, কিন্তু কাজ না পাওয়া নিয়েও খুব একটা মাথাব্যথা নেই। নিজের মতো ঘুরছে-ফিরছে, উপন্যাস লিখছে, বাঁশি বাজাচ্ছে। বহুদিন পর কলেজের বন্ধু পুলুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় পুলু তাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যায় খুলনায়, তার খালাতো বোন অপর্ণার বিয়েতে। বিয়ের দিন সকালে বাঁশি হাতে নদীর ধারে গাছের নিচে ঘুমিয়ে যায়, যে দৃশ্যটির সাথে হিন্দু পুরাণের অন্যতম চরিত্র কৃষ্ণের প্রতিরূপের ভীষণ মিল পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে দেখা যায়, অপর্ণাকে বিয়ে করতে আসা বর মানসিক ভারসাম্যহীন, তাই বিয়েটা ভেঙে যায়। কিন্তু বিয়ে করতে এসে কনের বাড়ি থেকে বর পক্ষ ফিরে গেলে সেটা ভালো চোখে দেখা হতো না, বরং সেই মেয়েকে একঘরে করে ফেলা হতো সমাজে। এমন পরিস্থিতিতে পুলুর অনুরোধে অপু বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। সেই থেকে শুরু হয় তাদের ছোট্ট সংসার। মাত্র ২০ মিনিটের স্ক্রিনটাইমে অপর্ণা আর অপুর যে অসাধারণ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, সেটি যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে রয়ে গেছে। এখনও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে তাদের কথা ঘুরে-ফিরে আসে বাংলা সিনেমাতে।
সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অপর্ণার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই সুমধুর সময়ের সমাপ্তি ঘটে এবং অপু সংসার-ছাড়া হয়ে যায়। সমুদ্র, বন দেখে শেষপর্যন্ত পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে অপুর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ছুঁড়ে দেবার দৃশ্যটি পুরো সিনেমার অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফির মাঝে উল্লেখযোগ্য।
এরপর পুনরায় পুলুর আগমনের মধ্য দিয়ে নিজের ছেলেকে কখনও দেখতে না যাওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। প্রথমে না চাইলেও শেষতক ছেলের কাছে ফিরে যায় অপু এবং নানা কাহিনীপ্রবাহে বাবা-ছেলের বন্ধুত্বের শুরু দিয়ে অপার সম্ভাবনার ডানা মেলে শেষ হয় সিনেমাটি।
শেষ দৃশ্যের পেছনে বাজতে থাকে তার সানাইয়ের সুর, যে সুরটি আরেকবার শোনা যায় 'পথের পাঁচালী' সিনেমাতে হরিহর ফেরার পর, যখন দুর্গার মৃত্যুর কথা জানতে পারে এবং তারপর সর্বজায়া ও হরিহরের কান্নার দৃশ্যে। সন্তান হারানোর বেদনা আর সন্তানের সাথে পুনর্মিলনের দুটি দৃশ্য বাঁধা হয়েছে একই সুরের সুতোয়।
অপুর ঘরটি রেলস্টেশনের উপর দেখানো হয়েছে। সেই ট্রেনের শব্দ আবার ফিরে এসেছে 'পথের পাঁচালী', 'অপরাজিত' হয়ে 'অপুর সংসার'-এ। তার বেড়ে ওঠার সাথে প্রথম ট্রেন দেখা থেকে তার থাকার ঘর থেকে ট্রেন দেখতে পারার মাঝে এক সুনিপুণ মেলবন্ধন দেখিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। সিঁড়ির ওপর থেকে অপুর ঘরের দৃশ্য পুরোটাই স্টুডিওতে ধারণ করা হয়েছে। বংশী সেনগুপ্ত আর সুব্রত মিত্রকে সাথে নিয়ে সুনিপুণ দক্ষতায় সত্যজিৎ গড়ে তুলেছেন একেকটি সেট। সেটের লাইটিংয়ে সুব্রত মিত্র ছিলেন অনন্য।
অপুর অপর্ণার শাড়ির আঁচল জামার সাথে বেঁধে রাখার দৃশ্যটি এরপর বহু পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সম্মানার্থে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন সিনেমায়। তাদের ছোট ছোট সংলাপে ফুটে উঠেছে দুজনের মধ্যকার সুমধুর সম্পর্ক। মান-অভিমান, খুনসুটি, সিগারেটের প্যাকেটের আবদার, কখনো বা খাওয়ার সময় ঘুরে-ফিরে দুজনের বাতাস করার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে কেবল বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য একসাথে থাকা নয়, বরং ফুটে উঠেছে দুজন মানুষের মধ্যকার শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব এবং প্রেমের চমৎকার এক নিদর্শন। সিনেমা দেখে ফেরার পথে গরুর গাড়িতে বসে থাকার সময় অপু অন্যমনস্ক হয়ে সিগারেট ধরাতে গেলে অপর্ণা নিজেই ম্যাচ জ্বালিয়ে ধরিয়ে দেয়। সে সময় অপু জিজ্ঞেস করে চোখে কী দিয়েছে, অপর্ণা উত্তর দেয়, "কাজল"। সেটিই ছিল তাদের একসাথে শেষ দৃশ্য। পরে দেখা যায় অপুর ছেলের নামও রাখা হয়েছে কাজল। এভাবেই দর্শকদের কাছে সেই কাজলই ফিরে আসে, নাম-পরিচয় হয়ে।
সত্যজিৎ রায়ের ছিল অসাধারণ শিল্প-দৃষ্টি, কিন্তু তার মাঝে কখনও নিজেকে জাহির করার স্বভাবটি ছিল না। তিনি নিজের মতো করে ছিলেন, ছিলেন সকলের প্রিয় মানিকদা। 'পথের পাঁচালী'র ছোট্ট অপুর জীবন থেকে 'অপুর সংসার'-এর বাবার চরিত্রে অপু এবং তার ছেলে কাজলের চরিত্রের মাঝে দিয়ে ছোট্ট অপু থেকে ছোট্ট কাজল, যেন একটি জীবনের চক্র পূরণ হয়েছে, প্রতিটি জীবনের মতোই।
[অপুর সংসার সমগ্র কিনতে ভিজিট করুন রকমারি ডট কমে।]
This is a Bengali article discussing about some of the back-stories of 'Apur Sangsar', a fabulous creation by the renowned film director, writer, and illustrator Satyajit Ray.
References:
1. 'Satyajit Ray: The Inner Eye' By Andrew Robinson
2. Sharmila Tagore and Soumitra Chatterjee on Apur Sansar(1959)
Featured Image: Satyajit Ray Productions