Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এরিয়া সেভেন: এক অনন্যসাধারণ কল্পনাবিলাসী টেকনো–থ্রিলার

ধরুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সুপরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে এবং মার্কিন কমান্ডোরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে খুন করার জন্য তাড়া করে ফিরছে। শুধু তা-ই নয়, অভ্যুত্থানকারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরগুলো পারমাণবিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিতে চলেছে এবং এর মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে চাইছে সম্পূর্ণ নতুন ‘পরিশুদ্ধ’ এক যুক্তরাষ্ট্র! এরই ফাঁকে মার্কিনিদের মদদপুষ্ট এক দক্ষিণ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ বিজ্ঞানী সারা বিশ্বে এমন একটি ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে চাইছে, যেটি বিশ্বের সমস্ত অশ্বেতাঙ্গ (non-White) মানুষের মৃত্যু ঘটাবে!

এগুলো একজন পাঠকের কাছে পাগলের প্রলাপ বলে মনে হতেই পারে, কিন্তু অস্ট্রেলীয় ঔপন্যাসিক ম্যাথিউ রাইলি এই সমালোচনাকে ‘নেহায়েত কল্পনাশক্তির অভাব’ হিসেবেই আখ্যায়িত করবেন। কেননা তার রচিত ‘এরিয়া সেভেন’ (Area 7) উপন্যাসটির কাহিনী উপরে বর্ণিত ভাববস্তুর আলোকেই গড়ে উঠেছে। ২০০১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এই টেকনো–থ্রিলার উপন্যাসটি ম্যাথিউ রাইলির ‘শেন স্কোফিল্ড’ সিরিজের দ্বিতীয় বই। উপন্যাসটিতে খুবই বাস্তব ভঙ্গিতে এবং সিনেম্যাটিক স্টাইলে রাইলি ফুটিয়ে তুলেছেন এমন এক দৃশ্যকল্প, যা কার্যত উদ্ভটতম কল্পকাহিনীকেও হার মানাতে সক্ষম।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি দেশটির সবচেয়ে গোপনীয় সামরিক ঘাঁটি ‘এরিয়া সেভেনে’ গিয়েছেন একটি অনুরূপ গোপনীয় প্রকল্প পরিদর্শন করতে। তার নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে রয়েছে মার্কিন মেরিন কোরের ক্যাপ্টেন শেন স্কোফিল্ড এবং তার মেরিন ইউনিট, যার সদস্যদের মধ্যে রয়েছে স্কোফিল্ডের বড় বোনতুল্য দুর্ধর্ষ গানারি সার্জেন্ট জেনা নিউম্যান এবং স্কোফিল্ডের অনুরাগী তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী স্টাফ সার্জেন্ট এলিজাবেথ গান্ট। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতির জানা নেই, তিনি ঘাঁটিটিতে পৌঁছানোর আগেই মার্কিন বিমানবাহিনীর জেনারেল চার্লস রাসেল তার অনুগত ‘৭ম স্কোয়াড্রনে’র ৫০ জন ক্র‍্যাক কমান্ডোকে নিয়ে ঘাঁটিটি দখল করে রেখেছেন। রাসেলকে মার্কিন সরকার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, কিন্তু তিনি ‘মৃত্যু’র পরেও বেঁচে ফিরে এসেছেন তার ১৫ বছরের পুরনো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে।

জর্ডানে প্রশিক্ষণরত মার্কিন বিমানবাহিনীর দুজন কমান্ডো। উপন্যাসের মার্কিন বিমানবাহিনীর কমান্ডোদের ভিলেনের ভূমিকা চিত্রিত করা হয়েছে; Source: Wikimedia Commons

মার্কিন রাষ্ট্রপতি এরিয়া সেভেনে প্রবেশ করা মাত্রই সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতিকে একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে জানানো হয়, নির্বাচনের আগে একটি অপারেশনের সময় তার হৃৎপিণ্ডে একটি ট্রান্সমিটার যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। একটি কৃত্রিম উপগ্রহ এই ট্রান্সমিটার থেকে বার্তা গ্রহণ ও ট্রান্সমিটারটিতে বার্তা প্রেরণ করে, এবং ট্রান্সমিটারটি চালিত হয় রাষ্ট্রপতির হৃদযন্ত্রের স্পন্দন থেকে উদ্ভূত গতিশক্তির সাহায্যে। রাষ্ট্রপতিকে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ১৪টি বড় বড় শহরের বিমানবন্দরে টাইপ–২৪০ ব্লাস্ট প্লাজমাভিত্তিক পারমাণবিক বোমা রাখা হয়েছে এবং রাষ্ট্রপতির হৃৎপিণ্ডে থাকা ট্রান্সমিটারটি যদি কৃত্রিম উপগ্রহে বার্তা প্রেরণ বন্ধ করে দেয়, সেক্ষেত্রে এই বোমাগুলো বিস্ফোরিত হবে।

রাসেল রাষ্ট্রপতির ‘পারমাণবিক ফুটবলে’র (একটি বিশেষ ধরনের ব্রিফকেস যেটিতে মার্কিন পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের সংকেত থাকে) লঞ্চ কোডও পাল্টে দিয়েছেন, এবং এর ফলে প্রতি ৯০ মিনিটে ‘ফুটবলে’র ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সরের ওপর রাষ্ট্রপতি হাত না রাখলে বোমাগুলো বিস্ফোরিত হবে। এদিকে ‘ফুটবল’ রাসেলের অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত কমান্ডোদের নিয়ন্ত্রণে এবং এটির নাগাল পেতে হলে প্রায় নিরস্ত্র রাষ্ট্রপতি ও স্কোফিল্ডের মেরিনদেরকে তাদের সঙ্গে লড়ে সেটিকে ছিনিয়ে নিতে হবে। অন্যদিকে, এই কমান্ডোরা চেষ্টা করছে তাদেরকে মেরে ফেলার জন্য। ফলে শুরু হয় আত্মরক্ষার এক তীব্র লড়াই।

এরিয়া সেভেনের বিচিত্র ও বিপজ্জনক অভ্যন্তরভাগে লড়াই ও ছোটাছুটির একপর্যায়ে স্কোফিল্ড ও তার দলের লোকেরা কেভিন নামক সাত বছর বয়সী একটি বাচ্চার সন্ধান পায়। রাষ্ট্রপতি জানান, তিনি এরিয়া সেভেনে এসেছিলেন চীনা–নির্মিত জেনিটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড ‘সিনোভাইরাসে’র ভ্যাক্সিন তৈরির অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে। এই ভাইরাসটি মানুষের চামড়ার পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম এবং এটি ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বর্ণের জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করে দেয়া সম্ভব। এই ভাইরাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং–এর মাধ্যমে কেভিনকে তৈরি করা হয়েছে, যার অ্যান্টিবডি ঐ ভাইরাসের মোকাবিলা করতে সক্ষম।

‘এরিয়া সেভেন’ ম্যাথিউ রাইলির শেন স্কোফিল্ড সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস; Source: Goodreads

কিন্তু ভ্যাক্সিনের আবিষ্কারক দক্ষিণ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ডক্টর গুন্থার বোথা এরিয়া সেভেনে দক্ষিণ আফ্রিকান বর্ণবাদী ও দুর্ধর্ষ মার্সেনারি গ্রুপ ‘রেকন্ডো’র সদস্যদের প্রবেশের সুযোগ করে দেন এবং তাদের সহায়তায় কেভিনকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তার উদ্দেশ্য সিনোভাইরাসকে ‘এথনিক বুলেট’ হিসেবে ব্যবহার করে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে (এবং সম্ভব হলে পৃথিবী থেকে) কৃষ্ণাঙ্গদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। স্কোফিল্ডের মেরিন ও রাসেলের কমান্ডোরা উভয়েই তাদের পিছু ধাওয়া করে। অন্যদিকে, রাসেলের ৫টি কমান্ডো ইউনিটের মধ্যে ‘ইকো’ ইউনিট রাসেলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য, যেটি বাস্তবায়নের জন্য তারা কোনো পদক্ষেপ নিতেই দ্বিধা করবে না।

এভাবেই এগিয়ে চলেছে ‘এরিয়া সেভেনে’র কাহিনী। গল্পে এত বেশি পরিমাণ টুইস্ট রয়েছে যে প্রথম থেকে প্রায় শেষ পর্যন্তই পাঠককে বিভ্রান্ত থাকতে হয়। শেষ পর্যন্ত এটি নির্ধারণ করা কঠিন যে, ‘এরিয়া সেভেন’ আসলে কী? এটি কি একটি রাজনৈতিক বার্তা সংবলিত থ্রিলার? একটি অ্যাকশনে পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী? নাকি একটি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত প্রদানকারী রোমাঞ্চকর উপন্যাস?

কিন্তু উপন্যাসের ভাববস্তু হিসেবে যে বিষয়গুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো মোটেই অস্পষ্ট বা ধোঁয়াশাপূর্ণ নয়। অবশ্য এই বিষয়গুলো রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট স্পর্শকাতর এবং নৈতিকভাবে দ্বিধা সৃষ্টিকারী। রাইলির সাফল্য এখানেই যে, তিনি এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই তার উপন্যাসে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন এবং বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তার নিজস্ব অবস্থান কোথায়, সেটিও গোপন রাখেননি।

উপন্যাসটির মূল খলনায়ক চার্লস রাসেল মার্কিন বিমানবাহিনীর একজন অত্যন্ত মেধাবী কর্মকর্তা ছিলেন, যিনি ১৫ বছর ধরে তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তার বিশ্বাস, জাতিগত মিশ্রণ ও অশ্বেতাঙ্গদের আনুষ্ঠানিকভাবে সমঅধিকার প্রদানের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘অপবিত্র’ হয়ে পড়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে ‘পরিশুদ্ধ’ করার জন্য বিমানবাহিনীর সমমনা (অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ ও বর্ণবাদী) সদস্যদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি গুপ্ত সংগঠন। সংগঠনটির উদ্দেশ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলকে ধ্বংস করে দিয়ে দক্ষিণাংশে একটি বর্ণবাদী, ‘বিশুদ্ধ’, কনফেডারেট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় একজন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সৈন্য। মার্কিন সামরিক বাহিনীতে অতীতে ব্যাপক বর্ণবৈষম্য ছিল; Source: Wikimedia Commons

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদের ইতিহাস অতি পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর ‘ইউনিয়ন’ এবং দক্ষিণাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত কনফেডারেট স্টেটসের মধ্যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে ইউনিয়ন বিজয়ী হয় এবং দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক আচরণ অব্যাহত থাকে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণ সমস্যার বহুলাংশে সমাধান ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সহিংস ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ (বিএলএম) আন্দোলন এবং উগ্র শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী বিভিন্ন গ্রুপের উত্থান এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হতে এখনো অনেক দেরি। একইভাবে, মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর শ্বেতাঙ্গ সদস্যদের মধ্যে বর্ণবাদী মনোভাবও নতুন কিছু নয়।

উপন্যাসে যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার কথা বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বাস্তবে এই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সহিংসতাকে ব্যবহার করার প্রবণতা বর্তমানে দেশটিতে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিতর্কের পর ২০২১ সালে বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের মার্কিন ক্যাপিটল আক্রমণ, বর্তমান রাষ্ট্রপতি জোসেফ বাইডেনের প্রশাসন কর্তৃক ক্যাপিটল আক্রমণকারীদের ‘অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা প্রদান এবং এরপর হাজার হাজার ন্যাশনাল গার্ড পরিবেষ্টিত অবস্থায় বাইডেনের শপথ গ্রহণ কার্যত মার্কিন রাজনীতিতে একটি সম্পূর্ণ নতুন দিক উন্মোচন করেছে।

উপন্যাসটিতে দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী সরকারের পতনের পর কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য ডক্টর গুন্থার বোথা যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে এসেছেন এবং মার্কিন সরকার তাকে সমাদরে রেখেছে। এটি একটি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুদ্ধাপরাধে জড়িত জার্মান বিজ্ঞানীরা অনুরূপভাবে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং মার্কিন সরকার তাদের মেধাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তাদেরকে সাদরে আশ্রয় দিয়েছিল। মার্কিনিরা বিশ্বব্যাপী ‘মানবাধিকারের রক্ষক’ হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তাদের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোকে নিয়মিতভাবে ‘মানবাধিকার’ লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে থাকে।

কিন্তু যুদ্ধাপরাধে জড়িত জার্মান বিজ্ঞানীদের আশ্রয় প্রদানের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, নিজেদের স্বার্থের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে কাজ করতে তারা দ্বিধা বোধ করে না। রাইলি এই বিষয়বস্তুটিকেই ডক্টর বোথার আকারে উপন্যাসটিতে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসে বোথা মার্কিন সরকারের জন্য সিনোভাইরাসের ভ্যাক্সিন তৈরি করেছেন এবং এজন্য মার্কিন সরকার তার অতীতের রেকর্ড দেখেও না দেখার অভিনয় করতে প্রস্তুত।

মানচিত্রে বিশ্বব্যাপী কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগীর হার। আক্রান্তের হারের পরিমাণ লাল রঙের তীব্রতার সমানুপাতিক। ভাইরাসটি চীন থেকে ছড়ালেও সেখানে আক্রান্তের হার অনেক কম; Source: Wikimedia Commons

‘সিনোভাইরাস’ রাইলির উপন্যাসের আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়বস্তু। উপন্যাসে চীন সিনোভাইরাস নামক এমন একটি ভাইরাস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যেটি মানুষের বর্ণ চিহ্নিত করতে পারে এবং কেবল নির্দিষ্ট কোনো বর্ণের মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। রাইলি ২০০১ সালে এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। তার প্রায় ২০ বছর পরে চীন থেকেই করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং এমন এক মহামারীর সৃষ্টি করেছে, যেটি চীন নিয়ন্ত্রণ করতে সম্ভব হলেও চীনের বর্তমান বা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।

বহু ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক (conspiracy theorist) দাবি করেছেন, এই ভাইরাস চীনের তৈরি এবং চীন ইচ্ছাকৃতভাবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। চীনা সরকারের তথ্য গোপন করার প্রবণতা অনেকের এই সিদ্ধান্তকে আরো ঘনীভূত করেছে। বাস্তবে এই তত্ত্ব কতটুকু সত্যি বা কতটুকু মিথ্যা– উপযুক্ত পরীক্ষণ ও তদন্ত ছাড়া সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু কল্পকাহিনীতে এবং বাস্তবে ‘চীনা ভাইরাস’ নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা হয়েছে, সেটির পিছনে একধরনের প্রাচ্যবাদী (orientalist) মনোভাব কাজ করছে।

বস্তুত ১৯৯০–এর দশক থেকে চীনের অভাবনীয় অর্থনৈতিক উত্থান শুরু হয় এবং তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী চীনা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী চীনের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ এবং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ জাতীয় মেগাপ্রকল্প তাদের মধ্যেকার এই উদ্বেগকে আরো প্রবল করেছে। বর্তমানে চীন যেভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করছে এবং অবকাঠামো নির্মাণ করছে, পশ্চিমা বিশ্ব সেই হারে বিনিয়োগ বা অবকাঠামো নির্মাণ করতে আগ্রহী বা সক্ষম কোনোটাই নয়। এর ফলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব নিয়ে তাদের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, তারই একটি নিদর্শন হচ্ছে গল্পে এবং বাস্তবে ‘চীনা ভাইরাস’ তত্ত্বের বিস্তার।

মানচিত্রে চীন (লাল চিহ্নিত) এবং চীন-প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশীদারগণ (নীল চিহ্নিত); Source: Wikimedia Commons

পশ্চিমাদের ধারণা অনুযায়ী, চীনারা সামরিকভাবে পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্যকে মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়, সুতরাং বিশ্বব্যাপী চীনা আধিপত্য বিস্তার ও পশ্চিমা প্রভাব হ্রাস করার জন্য তারা বিভিন্ন বিকল্প পন্থা গ্রহণ করবে। এরকমই একটি পন্থা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী চীনা–নির্মিত একটি ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়া। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘জীবাণু যুদ্ধ’ পরিচালনার সামর্থ্য চীনের তুলনায় অনেক বেশি।

উপন্যাসের সর্বশেষ কৌতূহলোদ্দীপক দিক হচ্ছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। এখানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং–এর মাধ্যমে একটি শিশুকে সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং মার্কিন কমান্ডোদের সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তাদের মধ্যে জিনগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাস্তবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এতদূর অগ্রসর হয়নি ঠিক, কিন্তু একেবারে পিছিয়েও নেই এবং এই বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণা চলছে। সত্যিই কি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং–এর মাধ্যমে একজন মানুষের মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনে তার দক্ষতা ও সামর্থ্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে।

সামগ্রিকভাবে, ‘এরিয়া সেভেন’ উপন্যাসটি একদিকে যেমন পাঠকের সামনে বিচিত্র একটি রহস্যকাহিনী উপস্থাপন করে, অন্যদিকে তেমনি পাঠকের মনে নানান প্রশ্ন রেখে যায়। এজন্য থ্রিলার হিসেবে তো বটেই, কৌতূহল সৃষ্টিকারী একটি বই হিসেবেও ‘এরিয়া সেভেন’ অনন্যসাধারণ।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে

বইয়ের নাম: এরিয়া সেভেন
লেখক: ম্যাথিউ রাইলি
প্রকাশক: প্যান ম্যাকমিলান
প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০০১

This is a Bengali book review article on 'Area 7' by Matthew Reilly.

Related Articles