Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আসা যাওয়ার মাঝে: সংলাপের যুগে এক সংলাপহীন সিনেমা

ইতিহাসে প্রথম বানানো ফিল্ম কোনটি, সেটি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও সময়কালটা ঊনিশ শতকের শেষের দিকেই ছিল। তখন সিনেমাতে কোনো সাউন্ড থাকত না, এরপর এল অর্কেস্ট্রার ব্যবহার, তারপর ধীরে ধীরে ১৯২৭-এ বের হলো প্রথম টকিজ ফিল্ম ‘দ্য জ্যাজ সিংগার’। কালের বিবর্তনে এলো ‘অল টকিজ ফিল্ম’, আর এখন তো সংলাপ আর শব্দের মিলনে একেকটা সিনেমা তৈরি করা হয়। জনরা বিবেচনায় কখনো পুরো সিনেমাটাই সংলাপ দিয়ে পরিপূর্ণ। কেবল সংলাপের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে কত শত সিনেমা। সেই সংলাপের যুগে দাঁড়িয়ে একেবারে সংলাপহীন একটি সিনেমা আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের ‘আসা যাওয়ার মাঝে: লেবার অভ লাভ’। কথার সীমানা ছাড়িয়ে সিনেমা যে দেখার আর উপলব্ধি করারও বটে, সেটি আমাদের পুনরায় মনে করিয়ে দিতে পেরেছেন এই পরিচালক।

আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত; image source: Times of India

ইতালো ক্যালভিনোর একটি দুই পৃষ্ঠার গল্প থেকে এই ছবির কাহিনী অনুপ্রাণিত। ইরানি শর্ট ফিল্ম ‘অ্যাডভেঞ্চার অভ ম্যারিড কাপল’ এর সাথে এর মূল ধারার মিল আছে বলে অনেকে দাবি করে থাকলেও আদতে সেরকম কিছু নয়, এই শর্ট ফিল্ম আর ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ দুটো গল্পই ক্যালভিনোর গল্প থেকে অনুপ্রাণিত; কিন্তু দুটোই ভিন্ন ধারার মেজাজে তৈরি।

সিনেমার গল্পটা একেবারে উত্তর কোলকাতার দু’জন মানুষের, তাদের যাপিত জীবনের। সিনেমা শুরু হয় এক সংবাদ পাঠিকার কণ্ঠ দিয়ে, প্রচুর মানুষ চাকরি হারিয়েছে একটা রিসেশোনে- সে সংবাদ জানা যায়, একটা বিক্ষুব্ধ কোলকাতার আভাস পাওয়া যায়; কিন্তু এরপরই ফ্রেমে চলে আসে পলেস্তারা খসে যাওয়া দেয়াল। সেইসাথে সানাইয়ের সুরের মধ্য দিয়ে যেন একটা আলাদা জগতে প্রবেশের আভাস দেওয়া হচ্ছে, এখানে এই দেয়ালেই যেন কত শত সুখ-দুঃখ,গল্প জমে আছে। এরপরই দেখা যায়, উত্তর কোলকাতার গলি-ঘুপচি পেরিয়ে স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে কাজে যাচ্ছেন এক কমবয়সী নারী (বাসবদত্তা চ্যাটার্জি), খুবই স্বাভাবিক আর নিস্তরঙ্গ সকালের দৃশ্যের মতো। সে দৃশ্য থেকে খুব সাবলীলভাবে চলে আসে জানালার ধারে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের কাছে।

এখানে পুরুষ চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। সিনেমাটিতে কোনো সংলাপ নেই, তাই এই দু’জন মানুষ শেষ অবধি আমাদের কাছে নাম-পরিচয়হীনই থেকে যায়। দু’জন আলাদা সময় কাজ করার ফলে সারাদিন কারো সাথে কারো দেখা হয় না; শুধু আসা যাওয়ার মাঝে একটুকু যে মিলন, তা নিয়েই পুরো গল্পটা। এর দৃশ্যায়ন আর অদ্ভুত সুন্দর শব্দায়নের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, কতটা যত্ন নিয়ে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিনকার পরিচিত মহলটাকেই যেন নতুনভাবে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক।

উত্তর কোলকাতার গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে যাবার দৃশ্য ;Image Source: F.O.R Films
জানালার ধারে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য; Image Source: F.O.R Films

দৃশ্যপটে দু’জনের প্রাত্যহিক জীবনের ছোট ছোট বিষয়গুলো ফুটে ওঠে। স্নানের সময় দুটো সাবান আলাদা করা, কাপড় মেলে দেওয়ার সময় চোখে পড়ে ভেজা কাপড়ের মাঝে জড়িয়ে থাকা ভাঁজ, একা খাওয়া-দাওয়া করা, ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হবে- সেটিও বুঝে নেওয়া টেবিলের উপর থাকা চেক দেখে, বাজারে যাওয়া, জীবন্ত কানকো দেখে মাছ কেনা, সেই মাছ ঘরে এনে ফ্রিজে রাখা, এরপর কিছুটা বিশ্রাম। তারপর সন্ধ্যা হতেই কাপড় তুলে ঘরে আনা, কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি, সন্ধ্যায় পূজোর আগরবাতি জ্বালানো, কাজে চলে যাওয়ার পর স্ত্রীর ঘরে ফেরা, আবার একা খাওয়া-দাওয়া করে সব গুছিয়ে শুয়ে পড়া, সকালে ফোন দিয়ে তুলে দেওয়া- কিন্তু কোনো সংলাপ নেই, কথা বলার ফুসরত নেই।

সকাল হতেই রান্নার দৃশ্যায়নে ফুটে উঠেছে চমৎকার কিছু মুহূর্ত। তেল গড়িয়ে পড়া, সবজি দেওয়া- সবকিছুতেই যেন পরম মমতা ফুটে উঠেছে। এরপর আগের আগরবাতি ফেলে নতুন বাতি জ্বালিয়ে পূজো শেষ করতেই দেখা যায় অপরজন ফিরে এসেছে কাজ থেকে, অবশেষে দেখা হয় দু’জনার, যার জন্য অপেক্ষায় থাকা হয় সারাটা সময়।

এই সময়টা তাদের একান্ত নিজের, সিনেমাটি দেখার সময় এই মুহূর্তটা এতটা সুন্দর করে ধরা দেয় যেন কত উৎকণ্ঠা, কত অপেক্ষার পর এই মিলন। কোনো ভাষা নেই, সংলাপ নেই, কেবল দু’জনের মুখের শান্তির ছায়াটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। অল্প কিছু সময়ের মাঝে চা করে এনে আবার কাজে যাবার প্রস্তুতি, এতটুকুই। এভাবেই পুরো সিনেমাটা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানেই যেন ফিরে যায়; প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামে।

বাজার করে ফেরার দৃশ্য; Image Source: F.O.R Films
পায়ের ছাপ পড়ার দৃশ্য; Image Source: F.O.R Films

আসা যাওয়ার মাঝের গল্পটি আমাদের রোজকার যাপিত জীবনের গল্প। এখানে কোনো তাড়া নেই, বড় কোনো সুখ নেই আবার বড় কোনো দুঃখও নেই কেবল শান্তি আছে। কিছু না হওয়াটাও যে একটা বড় শান্তি এটাই যেন বারবার বোধ করিয়ে দেয় আমাদের। মাঝে মাঝে শোনা যায় এ বাসা ও বাসা থেকে ভেসে আসা পুরোনো দিনের গান যেটা আরও বেশি মনরোম পরিবেশের সৃষ্টি করে এই জাফরিকাটা বারান্দা, ঘুলঘুলি আর পুরোনো সেই বাড়ির আবহাওয়াতে।

পরিচালক এই সিনেমায় কোনো ‘সিনেমার বিষয়’ আনতে চাননি। সিনেমাতে সুখ-দুঃখের বিষয়টা অনেকখানিক বাহ্যিকভাবে দেখানো হয় কিন্তু আমাদের স্বাভাবিক জীবনে বিষয়টা অনেকখানি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। কেউ খুব দুঃখ পেলে খুব কমে এর প্রকাশ থাকে মুখাবয়বে, সেটিই তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। সংলাপের ব্যবহার না করার পেছনে আরও একটা কারণ ছিল- তাতে দর্শকদের নিজের মতো ভেবে নেওয়ার জায়গাটা থাকে, কী চিন্তা করতে পারে, কী হতে পারে, অনেক ‘হয়তো’ আর সম্ভাবনার স্থান করে দেয়।

একই ফ্রেমিংয়ের মাধ্যমে দিনের বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছেন (১); Image Source: F.O.R Films
একই ফ্রেমিংয়ের মাধ্যমে দিনের বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছেন (২); Image Source: F.O.R Films

পুরো সিনেমা তৈরির সময় আদিত্য প্রচুর রিটেক নিয়েছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তার কাছে মনে হয়েছে অভিনয় বিষয়টা বাদ দিয়ে সাবলীল হচ্ছে, ততক্ষণ তিনি রিটেক নিয়েছেন। তার মতে, এতে সবাই ‘পারফেক্ট’ করার চিন্তাটা বাদ দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায় আর তখুনি তিনি যেটা চাইছেন সেটা বেরিয়ে আসে। ২০০৯ সালে প্রচুর মানুষ পশ্চিম বাংলায় চাকরি হারায়, এতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখায় যায়, সে সময়ের প্রেক্ষাপটে দু’জন মানুষের গল্প নিয়েই চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন আদিত্য সেনগুপ্ত। অভিনয়, শব্দ আর সিনেমাটোগ্রাফি এই তিনের সাবলীল মিলনে তৈরি এই সিনেমা।

মাঝরাতের কোলকাতা; Image Source: F.O.R Films

নিজেদের অর্থায়নেই এই সিনেমাটি বানানো, মাত্র নয়জন প্রোডাকশনে কাজ করেছেন। সিনেমাটোগ্রাফিতে ছিলেন মাহেন্দ্রা শেঠি আর বিক্রম আদিত্য সেনগুপ্ত নিজে। এই সিনেমাটি দেশ বিদেশ থেকে জিতে নিয়েছে নানা পুরস্কার। ৬২তম ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, বেস্ট ফিল্ম এবং বেস্ট অডিওগ্রাফি ক্যাটাগরিতে’ মারাকেচ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পেয়েছে সেরা পরিচালকের উপাধি; নিউইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পেয়েছে বেস্ট ফিল্ম, বেস্ট ডিরেক্টর, বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লের আখ্যা; আবুধাবি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও বিএফআই লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জুরিদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’।

অল্প একটু সময়ের দেখা তাতেই যেন কী অদ্ভুত মায়া আর মমতা জড়িয়ে আছে ;Image Source: F.O.R Films

পরিচালকের মতে, তিনি অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় করতে বারণ করেছিলেন এবং এই অভিনয় না করার অভিপ্রায় থেকেই যেন এতটা বাস্তবসম্মত এই অদ্ভুত সুন্দর সিনেমাটি দর্শকদের সামনে পৌছে দিতে পেরেছেন। প্রাজ্ঞ অভিনয়শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই সিনেমা সম্পর্কে বলেছেন

“সেই সময়, আমরা যখন কাজ শুরু করেছিলাম, তখন যেভাবে সিনেমা তৈরি হতো, সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণালরা একদম রাস্তায় নেমে বাঙালির নাড়ির স্পন্দনগুলো ধরতেন, এই ছবিটা সেইরকমভাবে তৈরি করেছেন বিক্রম আদিত্য সেনগুপ্ত। প্রত্যেকেটা দৃশ্য এত এত বেশি স্পর্শকাতর যে, দেখতে গেলে সত্যিই চোখে জল এসে যায়।”

এবং আসলেও যেন তা-ই।

Related Articles