Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিশরের ইতিহাস: ভিন্ন আঙ্গিকে আসিমভ

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক হিসেবে গোটা পৃথিবীজুড়ে খ্যাত লেখক আইজ্যাক আসিমভ। কিন্তু বিজ্ঞানের খটমটে বিষয় ছাড়াও ভদ্রলোক মোট পাঁচশ’রও বেশি সংখ্যক বই লিখে গেছেন বিভিন্ন বিষয়ে‚ তার মাঝে প্রাচীন মিশরের ইতিহাস হলো একটি।

‘মিশরের ইতিহাস’ আসিমভের লেখা তেমনই একটা বই। মিশর দেশের যাবতীয় দেব-দেবী‚ জাদুটোনা‚ কুসংস্কার‚ মহাজাগতিক/পরজাগতিক/দৈবশক্তি‚ প্রেত‚ আত্মা- সবকিছুকে সযত্নে একপাশে ফেলে কেবল মূল ইতিহাসের প্রতিফলন দেখা যায় বইটিতে। পিরামিড আর স্ফিংক্সের দেশ হিসেবে নয়‚ আসিমভ বরং মিশরকে দেখেছেন গণিতশাস্ত্র‚ রসায়নবিদ্যা আর ভূতত্ত্ববিদ্যার দেশ হিসেবে। আর তাই এই বইতে আইসিস‚ হোরাস‚ আমুন রা আর তুতানখামেনদের নাম খুব কমই এসেছে। বারবার এসেছে মিশরের গণিতজ্ঞ আর রসায়নবিদদের কথা। পিরামিড‚ মমি আর স্ফিংসের বাইরেও মিশরের নিজের একটি ইতিহাস আছে‚ সেটিই আসিমভ তুলে এনেছেন প্রাণচঞ্চল বর্ণনার মধ্য দিয়ে।

মিশরের দেব-দেবী; source: KateMaxPaint-deviantart

বইটি শুরু হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক মিশরের নীল নদ আর নব্য-প্রস্তর যুগের বর্ণনার মধ্য দিয়ে। একে একে খাদ্যাভ্যাস‚ সেচ‚ বহিরাগতদের থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা‚ দুই মিশরের এক হওয়ার (তৎকালীন আপার ও লোয়ার ইজিপ্ট) মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মিশরের মূল ইতিহাসে প্রবেশ করেন আসিমভ‚ যেখান থেকে শুরু হয় ফারাওদের ইতিহাস। হলিউডের সাড়া জাগানো মুভি ‘দ্য মামি’ যারা দেখেছেন তারা কে না জানেন ‘ইমহোটেপ’ নামের কুচক্রী রাজপুরোহিতের কথা, যে প্রেমিকার সাথে পুনর্মিলনের আশায় পুনর্জন্ম নেয়? এই বইটিতে সেই ইমহোটেপের আদ্যোপান্ত পাওয়া যাবে‚ যে কিনা প্রথমে চিকিৎসক হিসেবে বিখ্যাত হলেও পরে যাদুবিদ্যায় হয়ে ওঠে অদ্বিতীয়।

মিশরের কথা আসলে পিরামিডকে কোনোভাবেই তা থেকে আলাদা করা যায় না। তবে এখানে পিরামিডে কোন ফারাওয়ের মমি কেমন করে রাখা আছে সেসব কথা নেই‚ বরং কোন রাজা কী প্রকৌশল খাটিয়ে পিরামিড তৈরি করেছিলেন তার কথা লেখা আছে। ২৬১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি পিরামিডগুলো তেমন মজবুত ছিল না। এরপর ফারাও স্নেফেরুর শাসনামলে তৈরি ৮০টি পিরামিড এখনও বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে মিশরের বুকে। তবে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবে খ্যাতি পাওয়া পিরামিড তৈরি হয়েছিল স্নেফেরুর উত্তরাধিকারী ফারাও খুফুর আমলে‚ যা নিয়ে মানুষের বিস্ময় কখনোই নিবৃত হবার নয়।

মিশরের পিরামিড; Source: earthworld.com

ক্লাস নাইন-টেনের গণিত বইতে টলেমির উপপাদ্য পড়ার সময় কম-বেশি সবার মাথাতেই ভাবনা আসে এই টলেমি ভদ্রলোকটি কে? টলেমি আসলে একজন লোকের নাম না‚ ৩ শতাব্দী ধরে টলেমিরা মিশর শাসন করে গেছে! ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যার সত্তর বছর পরে তার নাতির ছেলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে টলেমীয় বংশের অবসান ঘটে। তবে এর চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার হলো এরপরেও আরেকজন বিখ্যাত টলেমির আবির্ভাব হয়। তিনি একজন মহান জ্যোতির্বিদ ছিলেন‚ ‘ক্লদিয়াস টলেমিয়াস’ নাম ধারণ করে লিখতেন।

দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাস; Source: ancientrome.ru

মিশরের সামরিক বাহিনী ঘোড়া কিংবা ঘোড়ার চালিত রথ- এসব কিছুর সাথে পরিচিত ছিল না। তাই মিশরের ফারাওরা প্রায়শই বিভিন্ন যুদ্ধযাত্রায় নিজেদের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ভাড়াটে সৈন্যদেরও পাঠাতেন। টাকার বিনিময়ে এসব সৈন্যরা মোটামুটি যেকোনো অঞ্চলেই যুদ্ধে যেতে রাজি হত। বেশিরভাগ সময়েই এসব ভাড়াটে সৈন্যরা আসতো গ্রিস থেকে। নিজেদের অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা বলে পরিচয় দিলেও গ্রিক সৈন্যরা কাজেকর্মে ছিল তার বিপরীত। মিশরে ফারাওদের নির্মাণ করে যাওয়া কয়েক শতাব্দী পুরনো মূর্তি আর স্তম্ভের প্রতি কোনরকম শ্রদ্ধা না দেখিয়ে নির্বিকারভাবে সেগুলোর ওপর গ্রিক বর্ণমালা আর আঁকিবুকি খোদাই করে রেখে যেত। এমনকি মিশরে গ্রিকরা খুব সংক্ষিপ্তকালের জন্য রাজত্ব করেছিল। সেই সময় জুড়ে তারা মিশরের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেছিল। একটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে, গ্রিক সৈন্যরা স্ফিংক্স (অর্ধেক নারী-অর্ধেক সিংহের এক বিশাল মূর্তি) এর উপর কামান মেরে কামানের গোলার ধার পরীক্ষা করতো! আসিমভ গ্রিকদের এই অবস্থার কথা লিখতে গিয়ে একটা কথা বলেন‚ বাংলা করলে দাঁড়ায় এমন, “গ্রিকদের এরূপ আচরণ থেকে বোঝা যায় যে মানবজাতির এহেন বালখিল্যতা একেবারে নতুন নয়।” 

স্ফিংক্স এর মূর্তি; source: CNN.com

ধীরে ধীরে বইটি ধরে এগোলে ফারাওদের নানা কীর্তি‚ মহাশক্তিধর রাজপুরোহিত‚ চিকিৎসাবিদ‚ স্থপতি আর গণিতজ্ঞদের সাথে পরিচয় হবে। একটা সময়ে প্রবেশ করা যাবে মিশরে বহিরাগতদের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ে। সময়ের সাথে ফারাওদের ক্ষমতা কমতে থাকে‚ আর বাড়তে থাকে রাজপুরোহিতদের ক্ষমতা। ’পবিত্র ভূমি’ মিশরের সিংহাসনে সর্বপ্রথম বিদেশি হিসেবে চোখ দেন লিবীয় সেনাপতি শেশাঙ্ক। ফারাওর মেয়েকে বিয়ে করার মাধ্যমে তিনি সর্বপ্রথম বিদেশি শাসক হিসেবে নিজেকে ফারাও ঘোষণা দেন। একে একে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নুবিয়া ও অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য। এরপরেই গ্রিক‚ ক্যালদীয়‚ পারসিক আর এথেনীয়রা এসে মিশরের সিংহাসনের স্বাদ গ্রহণ করে যায়

এরকম সময়ে মিশরের শাসনভার নিতে আসে টলেমীয় বংশ। সময়কাল ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পরেই প্রথম টলেমি মিশরের সিংহাসনে বসেন। আসিমভ বলেন‚ এ সময়টা ছিল মিশরের জন্যে স্বর্ণযুগ। কেননা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্ববৃহৎ প্রসার শুরু হয়েছিল এই টলেমিদের শাসনকালেই। টলেমিরা মিশরকে শাসন করতো নতুন রাজধানী আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে। যদিও স্থানীয় মিশরীয়রা অজ্ঞাত এক কারণে আলেক্সান্দ্রিয়াকে খুব একটা পাত্তা দিত না‚ বরং বহিরাগতদের কাছে আলেক্সান্দ্রিয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।

টলেমিরা আলেক্সান্দ্রিয়াকে কেবল বৃহৎ‚ জনবহুল আর সম্পদশালী করাকেই যথেষ্ট মনে করতেন না। তারা চাইতেন এই শহরকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে এবং এতে তারা সফলও হয়েছিলেন। আলেক্সান্দ্রিয়াতে তারা নির্মাণ করেন সর্ববৃহৎ একটি পাঠাগার, যা তখনকার সর্বশ্রেষ্ঠ পাঠাগারে পরিণত হয়। বর্তমান কালের ছাপাখানা আবিষ্কারের আগপর্যন্ত পরবর্তী সতের শতাব্দী পর্যন্ত এর সমতুল্য কোনো লাইব্রেরি গড়ে ওঠেনি। শুধু তা-ই নয়‚ টলেমিদের শাসনামল ছিল শান্তিপূর্ণ‚ বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন তখন মিশরে যার যার মতো থাকত, এই আমলে বিদ্রোহও সবচেয়ে কম হয়েছিল। 

আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি

টলেমিদের শাসনামল শেষ হবার মধ্য দিয়ে আসিমভ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, মিশরের স্বর্ণযুগ এখানেই বুঝি শেষ! একে একে আরব আর রোমানদের পদচারণায় চঞ্চল হয়ে ওঠে মিশরের ভূমি। আসিমভ নিজের জবানিতে বলে যান ক্লিওপেট্রা‚ জুলিয়াস সিজার আর অ্যান্টোনিওর কাহিনী। একই সাথে দেখান মিশরের ধর্মবিশ্বাসে কীভাবে খুব ধীরগতিতে পরিবর্তন আসে। রোমান শাসনামলে আইসিস‚ আমুন রা আর হোরাসের মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয়। নীলনদের উপাসনা যায় বন্ধ হয়ে। পলিথিস্ট (বহুঈশ্বরবাদী)‚ মনোথিস্ট (একেশ্বরবাদী) থেকে শুরু করে একে একে খ্রিস্টান এবং সবার শেষে মুসলিম শাসনের যুগ শুরু হয়। বইটি না পড়লে সত্যিকার অর্থে বোঝা সম্ভব না কত মসৃণ করে একটা বৈচিত্র্যময় ইতিহাসকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব।

বইটির কিছু ছোট ছোট অংশ মনে দাগ কাটার মতো। যেমন- রোমান শাসনামলে ফাইমাস আর অরলিয়ন নামক দুই শাসকের হট্টগোলে আলেক্সান্দ্রিয়ার জাদুঘর কেমন করে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল‚ যা টিকে ছিল ছয় শতাব্দী ধরে‚ যা ছিল টলেমীয়দের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে লাইব্রেরির অসংখ্য প্যাপিরাসের বান্ডিল এখনও টিকে আছে।

আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্য করা। মিশরীয় রাজপুত্রদের তখন আপন বোনের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া লাগত। কেননা বাইরের কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে তারা সম্পূর্ণরূপে রাজ্যের অধিকার নিতে পারত না, বোনের সঙ্গে বিয়ের মধ্য দিয়ে রাজরক্ত পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হত। আসিমভ ব্যাপারটিকে ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যে চাচাত ভাই-বোনদের মধ্যে বিয়ের সম্পর্কের সাথে তুলনা দিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ব্যাপারটি এখন অস্বাভাবিক লাগলেও এটিই ছিল তখনকার সবচাইতে স্বাভাবিক রীতি।

আসিমভ এই বইটি লিখে গেছেন অত্যন্ত সাবলীল ভাষায়‚ মূল বইটির নাম The Egyptians, ’মিশরের ইতিহাস’ শিরোনামে বইটির চমৎকার অনুবাদ করেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মন। একই ধাঁচে আসিমভ গ্রিক আর রোমান ইতিহাস নিয়েও লিখেছেন‚ যা বরাবরের মতই সাহিত্যরসসম্পন্ন আর তথ্যবহুল।

দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মণের অনুবাদ করে বইটির প্রচ্ছদ; source: সন্দেশ প্রকাশনী

‘মিশরের ইতিহাস’ বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হলো আসিমভের লেখনি। রহস্যাবৃত মিশরের বিভিন্ন রহস্যকে তিনি উন্মোচন করেছেন খুব প্রাঞ্জল ভাষায়। সমস্ত বই জুড়ে তৎকালীন মিশর সম্পর্কে ছোট ছোট তথ্য রয়েছে, ইতিহাস বর্ণনার পাশাপাশি আসিমভ ভোলেননি গণিত, রসায়ন আর বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় মিশরের মাইলফলকের কথা তুলে ধরতে। কাজেই, যারা কুসংস্কার আর দেব-দেবীর ইতিহাস ছেঁকে ফেলে কেবলমাত্র শাসনকাল আর অন্যান্য বিষয় নিয়ে জানতে চান, তাদের জন্য এই বইটি না পড়লেই নয়।

ফিচার ইমেজ: ArtStation Magazine

Related Articles