বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ ছিল হুমায়ূন আহমেদের। গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্প লিখে যেমন পাঠকের হৃদয় জয় করেছেন, তেমনিভাবে সৃজনশীলতার সাক্ষর রেখে গেছেন নাটক ও চলচ্চিত্রে। বাঙালি মধ্যবিত্তের মনস্তত্ত্ব খুব ভালভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন তিনি। তাই সৃষ্টি করতে পেরেছেন হিমু, মিসির আলি, শুভ্র কিংবা বাকের ভাইয়ের মতো জীবন্ত সব চরিত্র। পুরো বাংলা ভাষায় সম্ভবত তিনিই একমাত্র লেখক যার উপন্যাস থেকে নির্মিত নাটকের চরিত্রের ফাঁসি প্রতিরোধে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। রাস্তার মাস্তান হিসেবে সৃষ্ট বাকের ভাই চরিত্রে কতটুকু প্রাণসঞ্চার করতে পারলে মানুষের হৃদয়ে এতটা আলোড়ন তোলা যায়, তা সহজেই অনুমেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশে পাঠক সৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদ যেমন ভূমিকা রেখেছেন, তেমনিভাবে প্রকাশনা শিল্পের বিকাশেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
মানুষের আনন্দ বেদনার রূপায়ণের পাশাপাশি কল্পনার রঙে অতীতকে ধরার আগ্রহও হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে দেখা যায়। বিংশ শতকের প্রথমার্ধকে চিত্রিত করতে তিনি রচনা করেছিলেন 'মধ্যাহ্ন'। ইতিহাসকে আশ্রয় করে হুমায়ূন আহমেদ যে কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন, তার মধ্যে 'বাদশাহ নামদার' অন্যতম। ২০১১ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের বৈচিত্র্যময় শাসনকাল, তার চরিত্রের খামখেয়ালিপনা এবং তার চারপাশের বহুবর্ণের বিচিত্র মানুষকে ইতিহাসের পাতা থেকে হুমায়ূন আহমেদ তার এই উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন। সুন্দর ও সাবলীলভঙ্গিতে মুঘল সম্রাজ্যের চমকপ্রদ উপস্থাপনে এ উপন্যাসে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
'বাদশাহ নামদার' লিখতে হুমায়ূন আহমেদ কেন আগ্রহী হলেন, তা সম্পর্কে উপন্যাসটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন,
"সব ঔপন্যাসিকই বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন। এই অর্থে হুমায়ূন অতি বিচিত্র এক চরিত্র। যেখানে তিনি সাঁতারই জানেন না সেখানে সারাটা জীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে। তাঁর সময়টাও ছিল অদ্ভূত। বিচিত্র চরিত্র এবং বিচিত্র সময় ধরার লোভ থেকে 'বাদশাহ নামদার' লেখা হতে পারে। আমি নিশ্চিত না।"
উপন্যাসের সূচনা পর্বে সম্রাট বাবর তার অতি প্রিয় সন্তান হুমায়ূন অসুস্থ হলে তার জীবন রক্ষা করতে পুত্রের কালান্তক ব্যধি নিজের শরীরে ধারণ করে মৃত্যুবরণ করেন এবং হুমায়ূনকে পরবর্তী মুঘল সম্রাট হিসেবে নির্বাচিত করেন। সম্রাট হুমায়ূন ছিলেন বহু বর্ণের মানুষ। খামখেয়ালীপনা ও বিচিত্র বিষয়ে (জাদুবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রন্ধনশিল্প, চিত্রকলা) আগ্রহ তার চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। গতানুগতিক সম্রাটদের ন্যায় লোভ ও হিংস্রতা তার মাঝে না থাকায় বিভিন্ন সময়ে তার জীবনে দুর্বিষহ বেদনা নেমে আসে। সম্রাট হুমায়ূনের জীবনের বৈচিত্র্যময় এবং কৌতূহল উদ্দীপক গল্প নিয়েই এ অসামান্য আখ্যানটি রচিত হয়েছে।
লেখক উপন্যাসের শুরুতে ভূমিকায় বলেছেন, হুমায়ূন এমন এক চরিত্র, যেখানে অতিমাত্রায় কোনো রং চড়ানোর প্রয়োজন নেই, কারণ তার জীবন এবং প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড এতটাই নাটকীয় যে অবলীলায় সেটি যেকোনো গল্পের চেয়ে অনেক বেশি চমকপ্রদ। সম্রাটরা সিংহাসনে বসেই তাদের ভাইদের হত্যা করেন যাতে তাদের রাজত্ব নিয়ে কোন সংশয়ের সৃষ্টি না হয়। কিন্তু শান্তিপ্রিয় হুমায়ূন তার ভাইদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। অথচ তার ভাইয়েরা বারবার তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। হুমায়ূন তাদেরকে বারবার ক্ষমা করেছেন। রাজত্বের শুরুতেই হুমায়ূন রানী কর্ণাবতীর চিঠি পেয়ে তাকে বাহাদুর শাহের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু এক মিথ্যা রটনায় বিভ্রান্ত হয়ে সবাই আত্মহত্যা করলে হুমায়ূন প্রচণ্ড ব্যথিত হন।
লেখক হুমায়ূন আহমেদের বর্ণনা মাধুর্যে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতি মুহূর্তে এ উপন্যাসে যথার্থ অনুভূত হয়,
"আগ্রার পথেঘাটে ময়ূরের ঝাঁক। তাদের দৃষ্টি আকাশের দিকে। তারা কুৎসিত শব্দে ডাকে, চক্রাকারে ঘোরে, একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গরমে এদেরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
...গরম অসহনীয় বোধ হওয়ায় সম্রাট গোসলখানায় 'দরবারে খাস' বসিয়েছেন। তাঁর প্রিয় অমাত্যরা গোসলখানায় জড়ো হয়েছেন। সম্রাট হাম্মামে বুক পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে আছেন। দুজন খোজা বালক মাঝে মাঝে তাঁর মাথায় পানি ঢালছে। পানিতে গোলাপগন্ধ। অসংখ্য গোলাপ পাপড়ি ছড়িয়ে পানিতে এই গন্ধ আনা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় পানি শীতল করা হয়েছে।"
লেখক এ উপন্যাসে হুমায়ূনকে একজন মানবিক সম্রাট রূপে উপস্থাপন করেছেন। সম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার পেছনে হুমায়ূন শৌর্য বা বীরত্বের পরিচয় নয়, বরং তার মানবিক বোধসম্পন্ন কোমল হৃদয় এবং শিল্পরসিক মন এখানে মহিমান্বিত হয়েছে। তাই শের খার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও তার ছবি আঁকার কথা মনে হচ্ছে,
"পশ্চিম আকাশের মেঘ পরিষ্কার হচ্ছে না, বরং গাঢ় হচ্ছে। ঘন কালো মেঘের যে বিচিত্র সৌন্দর্য আছে তা হুমায়ূন আগে লক্ষ করেননি। আকাশের এই ছবি এঁকে ফেলতে পারলে ভাল হতো। তার ছবি আঁকার হাত এখনো সেই পর্যায়ে আসেনি। আফসোস!"
হুমায়ূনের প্রধান শত্রু ছিল শের খাঁ। শের খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাঙাল মুলুকে রওনা দিলেও শের খাঁর ধূর্ততা এবং তার মিষ্টি কথায় বিভ্রান্ত হয়ে হুমায়ূনের পরাজয় ঘটে। শের খাঁর পক্ষ থেকে হুমায়ূনকে হত্যা করার নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি কোনোরকমে পালিয়ে দিল্লিতে ফেরেন। এই শের খাঁর হাতে হুমায়ূন বাহিনীর অজস্র সৈন্য ও আমীরের মৃত্যু ঘটে এবং হুমায়ুনের অতি প্রিয় কন্যা আকিকা বেগম ও তার সহচরী অম্বারও এ সময় করুণ মৃত্যুবরণ করে। হুমায়ূন দিল্লীতে ফিরে শের খাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করলেও ভাই কামরান মীর্জার বিশ্বাসঘাতকায় তার আবারও পরাজয় ঘটে। মুঘল ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বকে গল্পের ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তুলতে লেখক হুমায়ুন আহমেদ এ উপন্যাসে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
স্ত্রী হামিদা বানু ও অল্প কিছু অনুগতজন নিয়ে সম্রাট হুমায়ূনের পথেপ্রান্তরে পালিয়ে থাকার দিনগুলোতেই পরবর্তী মুঘল সম্রাট আকবরের জন্ম হয়। বহু কষ্টে হুমায়ূন অবশেষে পারস্য সম্রাট শাহ তামাস্পের কাছে গিয়ে পৌঁছান। পারস্য সম্রাট তামাস্পের সৈন্য সহায়তায় এবং বিশ্বস্ত সেনাপতি বৈরাম খাঁর যুদ্ধ নিপুণতায় হুমায়ূন আবার সবকিছু লাভ করেন এবং তার শেষ জীবনে আবারও শান্তি ফিরে আসে। শেষে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে হুমায়ূনের মৃত্যু এবং আকবরের রাজত্বের উত্থানের গল্পের মাধ্যমে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে।
অজস্র গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে লেখক ইতিহাসের কৌতুহল উদ্দীপক একটি অংশকে এতটা প্রাণবন্ত ও সরল ভাষায় লিখেছেন যে, এটি অপরূপ মাধুর্যপূর্ণ একটি উপন্যাসে পরিণত হয়েছে। এ উপন্যাসের পাতায় পাতায় পাঠকের মুগ্ধতা কাজ করে। মুঘল সম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সম্রাটদের ভোজনপ্রীতি, এছাড়া হুমায়ূন ও মীর্জা কামরানের লেখা শেরগুলো (কবিতা) পাঠকদেরকে নতুন এক আমেজ দেয়। যেমন, কাবুল দুর্গ দখলের পর মীর্জা কামরানের মাথায় এই শেরটি আসে,
"রাজ্য হলো এমন এক রূপসী তরুণী
যার ঠোঁটে চুমু খেতে হলে
সুতীক্ষ্ণ তরবারির প্রয়োজন হয়।"
তবে লেখক যদি আরেকটু বেশি সময় নিয়ে সম্রাটের হুমায়ূনের জীবনের বিভিন্ন পর্বগুলোকে বিস্তৃতভাবে চিত্রায়িত করতেন, তবে এ উপন্যাসটি আরও বেশি সার্থকতা লাভ করত। লেখকের অসাধারণ কোমল লেখনীতে মন্ত্রমুগ্ধ পাঠকের মনে হয়, যদি অনন্তকাল ধরে এ উপন্যাসটা পড়তে পারতাম। সব মিলিয়ে ইতিহাসের গল্প এ উপন্যাসে এতটা মাধুর্য পেয়েছে যে, পাঠক সম্রাট হুমায়ূনের রাজত্বকে অন্তরে অনুভব করতে পারবে।
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-
This is a review of the novel 'Badshah Namdar' by Humayun Ahmed. It is based on the life of the Mughal emperor Humayun. It was published in 'Amar Ekushey Book Fair 2011' by Anyaprakash.
Featured Image Credit: Nafis Sadik.