ভেবে দেখুন তো, কোনো নির্মাণাধীন ভবন; যেখানে সাধারণত কোনো অপরাধকর্ম বা শ্রমিকদের অসহায়ত্বের গল্পগুলো ছড়িয়ে থাকে, সেরকম একটি জায়গায় যদি কোনো প্রেম, ভালো লাগার বা ভালোবাসার সম্পর্ক বেড়ে ওঠার গল্প জন্ম নেয়, তবে তা কেমন হতে পারে? তা জানতে মাজিদ মাজিদীর ‘বারান’ সিনেমাটি দেখতে পারেন।
বারান (২০০১); ইরানি এই চলচ্চিত্রটি একটি রোমান্টিক ঘরানার চলচ্চিত্র। তবে যদি ভেবে থাকেন, সেই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রেম, আনন্দদায়ক কিংবা ট্র্যাজেডিক সমাপ্তি, মোটেই তা নয়। অন্য আর পাঁচটা বিখ্যাত রোমান্টিক সিনেমার সাথে মেলাতে গেলে পারবেন না। তাই যাদের অদেখা রয়েছে তাদের জন্য বলা যায়, সিনেমাটি নিয়ে আপনাদের অনুমান এবং প্রত্যাশা ভুল হবারই সম্ভাবনা বেশি। তবে যারা দেখেছেন, আশা করি তারা একমত হবেন এই যুক্তির সাথে। বারানকে অন্য ভালো বা নামকরা রোমান্টিক চলচ্চিত্রের সাথে তুলনা করা যায় না, কারণ ধরন রোমান্টিক হলেও বারানের ভেতর সেই উপাদানগুলো নেই, যা একটি তথাকথিত রোমান্টিক কাহিনীতে আমরা আশা করে থাকি।
এখানে তথাকথিত নায়ক-নায়িকার মাঝে নেই কোনো সংলাপ, না কোনো প্রেমের স্পর্শ, না রোমান্টিক কোনো দৃশ্য। এমনকি তাদের মধ্যে নেই কোনো ভাবের আদান-প্রদান অথবা সম্পর্কের বিনিময়। তবুও দর্শকের কাছে বারানকে ভালোবাসার গল্পই বলে মনে হবে। এখানেই মাজিদ মাজিদীর অসাধারণত্ব। ‘চিল্ড্রেন অভ হেভেন’ এবং ‘দ্য কালার অভ প্যারাডাইজ’-এর পর মাজিদী এখানেও তার সামান্য বিষয়কে অসামান্য করে তোলার ক্ষমতাকে সমুন্নত রেখেছেন।
যেভাবে একটি জুতোর গল্প নিয়ে ভাই-বোনের মাঝের মধ্যকার মধুর সম্পর্ক তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন চিল্ড্রেন্স অভ হেভেনে, তা দর্শককে শুধু কাঁদিয়েই ক্ষান্ত করেনি, ভাবিয়েও তুলেছে। আবার একটি বালকের অন্ধত্ব নিয়ে মাজিদীর নির্মিত 'দ্য কালার অভ প্যারাডাইজ’ সিনেমাতেও তিনি খুব বড়, জটিল বা কঠিন কিছু না দেখিয়ে খুব সাধারণ বিষয় দর্শকের সামনে এনেছেন। অন্ধত্ব কোনো অভিশাপ নয়, যে অন্ধ সে-ও আর দশটা মানুষের মতো, তার বড় পরিচয় সে মানুষ। এই বিষয়গুলো আমাদের সবার জানা, তা-ও কখনো কখনো আমরা তা ভুলে যাই। তিনি এই সাধারণ বা অতি সামান্য বিষয়গুলোকে অনেক অসাধারণভাবে প্রকাশ করেছেন যে যেকোনো ঘরানার দর্শকের তা মন কেড়ে নিতে বাধ্য।
'বারান' সিনেমাটিও রোমান্টিক সিনেমার জগতে ঠিক তেমনই এক মাস্টারপিস। নেই কোনো যৌনতা, নেই প্রেমের নিবেদন; অথচ এ নিস্তব্ধতাই দর্শক মনে এক অন্যরকম কৌতূহল, এক অন্যরকম অস্থিরতার জন্ম দেবে। সিনেমায় লতিফ মেয়েটাকে খুঁজে পেল কি না, তাদের পরিণতি কী হয়- এসব প্রশ্ন সিনেমার শেষ মিনিট পর্যন্ত দর্শক মস্তিষ্কে কাঠঠোকরার মতো ঠোকর দিতে থাকবে। ১৯৭৯ এ আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ হলে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ ইরানে আশ্রয় এবং কর্মের প্রত্যাশায় আসে। এই উদ্বাস্তুদের জীবনের অনিশ্চয়তা, হারানোর বেদনা ফুটে উঠেছে 'বারান'-এ।
সিনেমায় আছে একজন স্ত্রীর আহাজারি, একজন মায়ের অসহায়ত্ব, এক যুবকের না বলা ভালো লাগা, একজন ম্যানেজারের সর্বদা সরকারি লোকের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকা, এক মুচির অতি সাধারণ জীবনে অসাধারণ জীবনবোধ নিয়ে শান্তিতে বেঁচে থাকা- এই সবকিছুর একটি পরিমিত মিশ্রণ।
ইরানের মতো একটি দেশ, যেখানে নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করাই বেশ সাহসের বিষয়, সেখানে বারানের (ছদ্মনাম রাহমাত) মতো এক তরুণীর একটি নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করতে আসা দরিদ্রতার ভয়াবহতাই নির্দেশ করে। ছদ্মনামধারী রাহমাতের প্রতি ছিল লাতিফের যত হিংসা, ক্ষোভ। কিন্তু তা একেবারে ধুয়েমুছে সহমর্মিতায় ভরে ওঠে, যখন লতিফ জানতে পারে রাহমাত কোনো ছেলে নয়; একজন মেয়ে।
একটি নির্মাণাধীন ভবন। সেখানে রাত-দিন কাজ করছে অসংখ্য শ্রমিক। সেসকল শ্রমিকের সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে রাতের বেলায় সবার চায়ে চুমুক দিতে দিতে একসঙ্গে গান গাওয়ার দৃশ্য যেন দর্শককে নতুন একটি জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। আমাদের চারপাশে অজস্র বেড়ে ওঠা এই 'আন্ডার কন্সট্রাকশন' ভবনগুলো যে শুধু এই মানুষগুলোর ঘাম ঝরানোর জায়গাই নয়; বরং ইট-পাথরের ফাঁকে ফাঁকে তাদের খাওয়া-বসা, ঘুম, আড্ডা, আনন্দ-বেদনা সব কিছু মিশে আছে, সেই সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি দেয় 'বারান'।
যেভাবে এই ভবনটি একজন ঈর্ষাপরায়ণ, রাগী এবং খিটখিটে স্বভাবের মানুষ থেকে লতিফকে (হোসেইন আবেদিনি) একজন সমবেদনাপূর্ণ, মানবিক ব্যক্তিতে রূপ দেয় এবং একইসাথে তার প্রেমিকরূপে গড়ে ওঠার সাক্ষী হয়ে থাকে, তেমনই ভবনটি কোনো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে পঙ্গু করে দিয়ে সেই পরিবারকে জীবিকাশূন্য করে তোলার কারণও হয়ে থাকে। একদিকে জীবনের অনিশ্চয়তা আর দরিদ্রতা, অন্যদিকে এক যুবকের না বলা অনুভূতি। দুয়ে মিলে 'বারান' যেন জীবন সম্পর্কে এক বিপরীতমুখী অথচ বাস্তব উপলব্ধি দেয় আমাদের।
ইরানি ভাষায় 'বারান' অর্থ বৃষ্টি। চলচ্চিত্র বা চরিত্রটির এই নামকরণ কী অর্থে করা হয়েছে, তা অজানা থাকলেও এটুকু বলা যায়, বৃষ্টি যেমন আমাদের আবেগকে প্রভাবিত করতে পারে, সিনেমার 'বারান' (জাহরা বাহরামী) লতিফের জীবনে এবং আচরণে তেমনই প্রভাব ফেলে যায়। বৃষ্টি যেমন পারে অনেক আনন্দানুভূতি দিতে, আবার কখনও কখনও গভীর বেদনায় অজান্তেই ছেয়ে ফেলতে, বারান চরিত্রটিও ঠিক সেভাবেই ছাপ ফেলে যায় লতিফের মধ্যে।
বারানের প্রতি লতিফের এ অনুভূতি প্রেম, মোহ, ভালোবাসা না সমবেদনা, নাকি নিছক কৌতূহল- তা বের করার দায়িত্ব সত্যিই দর্শকের ওপর। কারো কাছে এটি হয়তো একতরফা 'লাভ স্টোরি', আবার কারো কাছে একে একটি মানবিক সম্পর্কের উদাহরণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ‘বারান'-এর মধ্য দিয়ে ভালোবাসার যে ভিন্ন মাত্রার সন্ধান মাজিদী দর্শককে দিতে চেয়েছেন, মনকে নাড়া দিতে বাধ্য, ঠিক এক পশলা বৃষ্টির মতোই।
This article is in Bengali language. It is a review of the film- Baran, directed by Majid Majidi.
Featured Image: Mubi